যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৮

যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৮
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

চারদিক থেকে ভেসে আসা করতালির শব্দে অর্ষার ঘোর ভাঙে। আবেগে, খুশিতে ও আনন্দে সে এতগুলো মানুষের সামনেই কী করে ফেলল ভাবতেই বারংবার লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে সে। আহনাফের বুক থেকে মাথাও তুলতে পারছে না। মনে হচ্ছে, মুখ লুকানোর চেয়ে এরচেয়ে ভালো কোনো স্থান এই মুহূর্তে আর কিছু হতেই পারে না। তবে সে বেশিক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে আহনাফের বুকে থাকতে পারল না। নতমুখে সরে এলো কিছুটা। আহনাফের চোখে-মুখে তখনও হাসি। তবে তারও এই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। শালিকারা তাকে জেঁকে ধরেছে। একেকজন কোমরে হাত রেখে এমনভাবে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে একেকজন থানার ওসি! আহনাফ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিলল। লামিয়া চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে বলল,

“ঢোক গিলে তো কোনো লাভ হবে না দুলাভাই। এইযে আপনি হুট করেই এসে অনুষ্ঠানে জুড়ে বসলেন। ফ্রি-তে হবু বউয়ের উষ্ণ স্পর্শ নিলেন। সব তো আর আমরা এমনি এমনিই বরদাশত করব না তাই না?”
রুহুল গলা খাঁকারি দিয়ে সেখান থেকে শটকে পড়ল। হাজার হোক, বড়ো ভাই বলে কথা! বাবা-মা’ও সেখানে না থেকে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়নে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওরা বাচ্চা মানুষ, এবার যা করে করুক গিয়ে।
লামিয়ার কথার মাঝে হাসিব ফোঁড়ন কেটে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এমনি এমনি বরদাশত করবেন না বলতে কী বোঝাতে চাইছেন? আহনাফ আপনাদের প্রত্যেককে জড়িয়ে ধরবে এটা? কিন্তু মিস ঝগড়াপার্টি, এটা তো সম্ভব নয়। আহনাফের মনে-প্রাণে, দেহে শুধু একজনেরই বসবাস। আর সে হলো আমাদের ভাবি অর্ষা। আহনাফ তো অর্ষা ব্যতীত কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, আমি সিঙ্গেল আছি। কোনো গার্লফ্রেন্ড, ফিয়ন্সে, বউ কিচ্ছু নাই। সূতরাং আপনারা চাইলেই আপনাদের জড়িয়ে ধরার মহৎ কাজটা করতে পারি। আসুন কে আগে আসবেন। তার আগে লাইনে দাঁড়ান আগে সবাই।”

রেশমি বিকট শব্দে একটা ধমক দিল হাসিবকে। হাসিব ততক্ষণে শাহরুখ খানের স্টাইলে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিল। যেই না ধমক খেল, ওমনি মনে হলো তার শিরদাঁড়া বেয়ে ভূ’মি’ক’ম্প হয়ে গেল। সে চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“বাচ্চা একটা ছেলেকে কেউ এভাবে ধমক দেয় নাকি?”
“ঠিক সময়ে বিয়ে হলে এখন তিন বাচ্চার বাপ থাকতেন আপনি ভাই!” বলল মুন।
আদিব তখন বলল,

“তুমি বাচ্চা মেয়ে এসবের মধ্যে কথা বলছ কেন?”
মুন এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আমি বাচ্চা? হ্যাঁ, আমি বাচ্চা? বাচ্চা মেয়েকে তাহলে বিয়ে করেছ কেন? তোমাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত। দেবো নাকি থানায় কল?
দুলাভাই, আপনার চেনাজানা ভালো কোনো পুলিশ আছে? যে এই লোকটাকে থানায় নিয়ে ডা-ন্ডা-পে-টা করে বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করার শখ মেটাতে পারবে?”

আদিব অসহায়ভাবে তাকাল আহনাফের দিকে। আহনাফও অসহায় ভঙ্গিতে আদিবের কাঁধে হাত রাখল; যার অর্থ,’ভয় পেও না। চেনাজানা থাকলেও তোমায় আমি পুলিশে দেবো না।”
আশিক দু’হাত বগলদাবা করে গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বলল,
“ওগো বান্ধবী মুনমুন,

কানের কাছে কোরো না গুণগুণ,
কথার বাণে হয়ে যাব;
আমরা সবাই গণ-খু-ন।”
জুঁই বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
“এত সুন্দর হলুদের রাতেও তোর আজাইরা কবিতা শুনতে হচ্ছে।”
“ঝগড়া পরে হবে। আগে আমাদের পাওনা চাই।” বলল লামিয়া।
আহিল প্রশ্ন করল,

“কীসের পাওনা তোদের?”
“বুঝিস না? টাকা, টাকা! টাকা বখশিশ চাই আমরা।”
“মামার বাড়ির আবদার?”
সকাল ভেংচি কেটে বলল,
“জি না! দুলাভাইয়ের বাড়ির আবদার।”
দিদার আহনাফের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,

“কেন যে ভাই শুধু শুধু যেচে এখানে আসতে গেলেন! এখন গেলেন তো ফেঁসে। ভালো হয়েছে না?”
আহনাফ প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,
“তোমাদেরই তো বান্ধবী!”
সূক্ষ্ম খোঁচাটা স্পষ্ট টের পেয়েও চুপ করে গেল দিদার। অর্ষা ওদের পক্ষ নিয়ে রিনরিনে স্বরে বলল,
“বাদ দে না!”

“বাদ দেবো? কী বাদ দেবো? তুমি হলো গিয়ে বিয়ের কনে। তোমার মাতব্বরি চলবে বিয়ের পর স্বামীর ওপর। এই সকাল, যাও তো সোনা ওদেরকে স্টেজে বসিয়ে আসো।”
লামিয়ার কথামতো সকাল আহনাফ এবং অর্ষাকে স্টেজে নিয়ে গেল। বেচারা হাসিব সেই যে ধমক খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে; আর একটা টু’শব্দ-ও করেনি। লামিয়া কোমরে হাত গুঁজে বলল,

“এইযে বিড়াল কমিটির চেয়ারম্যান, এখন কেন চুপ করে আছেন? ওয়ালেট বের করুন। আর আমাদের পাওনাটা ভালোই ভালো মিটিয়ে দিন।”
আহিল বলল,
“অসম্ভব! কাল তো ঠিকই গেইট ধরে পকেট ফাঁকা করবি। আবার আজও টাকা নিবি? মগের মুল্লুক পেয়েছিস নাকি?”
আহিলের সঙ্গে বাকি ছেলেরাও তাল মেলাল।

“নে’ম’ক’হা’রা’মে’র দল! বরপক্ষ হয়েছিস বলে কি মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি? জলদি, জলদি টাকা বের কর বলছি।”
উপায়ন্তরহীন হয়ে ওদের ওয়ালেট হালকা করতেই হলো। টাকা হাতে পেয়ে জুঁই হেসে বলল,
“তো, তোরা এখন কী খাবি বল? শরবত নাকি মিষ্টি?”
আশিক বলে,

“কীসের শরবত, মিষ্টি? বি-ষ দে। খেয়ে ম-রে যাই। টাকা নিয়ে তো দিলি ফুতুর করে।”
“সরি রে! বি-ষ কোথায় পাওয়া যায় আমি জানিনা। তবে তুই চাইলে, তোর জন্য আমি খুঁজে অর্ডার করতে পারি।”
“মাফ চাই বইন! মিষ্টি, শরবত যা ইচ্ছে খাওয়া। আমার পেটে ইঁদুর হা-ডু-ডু খেলছে। কাবাডি কাবাডি বলার বদলে বলছে,’খাবার দে, খাবার দে।’ বুঝতেই পারছিস অবস্থা কী রকম সাংঘাতিক?” বলল দিদার।
লামিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“শা-লা পেটুক!”
হালকা খাওয়া-দাওয়া করেই ওরা সবাই চৌধুরী বাড়ির দিকে রওনা হলো। জহির চৌধুরী ফোন দিয়ে এরকম খামখেয়ালির জন্য সবার ওপর ভীষণ ক্ষেপে আছেন। হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত প্রায় একটা বেজে গেছে। সেলিনা বেগম মেয়েদেরকে আগে আগে খাইয়ে দিয়ে কড়াস্বরে বললেন,
“সব্বাই কিন্তু এখন চুপটি করে ঘুমাবে। রাত জেগে হাহা, হিহি করা যাবে না একদম। সকালে কিন্তু তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। মনে থাকবে?”

মুন হাই তুলে বলল,
“মনে থাকবে আন্টি। আমরা লক্ষী মেয়ের মতো এখনই ঘুমিয়ে পড়ব।”
সেলিনা বেগম মুচকি হেসে ঘরের দরজা চাপিয়ে দিলেন। বান্ধবীরা সবাই ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমিয়েছে। খাটে ঘুমিয়েছে অর্ষার দুঃসম্পর্কের দুই নানি। বান্ধবীরা একেকজন জড়াজড়ি করে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাত দুটো নাগাদ আহনাফ বেশ কয়েকবার অর্ষাকে ফোন দেয়। তবে দুঃখের বিষয়, অর্ষার ফোন ছিল সাইলেন্ট মুডে।

সকালে প্রত্যেকের ঘুমও ভাঙল সেলিনা বেগমের ডাকে। সবাইকে টেনে ঘুম থেকে তুলতে হয়েছে তার। সকাল বাচ্চাদের মতো করে অর্ষার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। একপাশে মুন। সে ওর এক পা দিয়ে রেখেছে অর্ষার পায়ের ওপর। লামিয়াকে দু’পাশ থেকে জড়িয়ে ধরেছে জুঁই এবং রেশমি। আদার মতো একজন আরেকজনের সাথে জোড়া লেগে আছে। মহারানিদের ঘুম ভাঙাতেও তাকে বেশ কসরত করতে হলো। কাঁথা টেনে নিয়ে ভাঁজ করতে করতে বললেন,
“দশ মিনিটের মধ্যে সবাই ফ্রেশ হয়ে নেবে। আমি নাস্তা এনে যেন দেখি তোমাদের ফ্রেশ হওয়া শেষ।”
এরপর তিনি নানিদের উদ্দেশ্য করে বললেন,

“খালা, যাও তোমরাও মুখ ধোও। আমি খাবার আনছি। একটুপর কাজের চাপে সরতেও পারব না। তোমাদেরকে আগে খাইয়ে আমি কাজে হাত দেবো। নইলে এগুলো তো একেকটায় আনন্দে খাওয়া-দাওয়াই বাদ দিয়ে বসে থাকবে।”
শেষের কথাটি অর্ষাদের উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি। ব্যস্তভাবে যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। সকালের নাস্তা একসাথে খেয়ে অর্ষা ফোন হাতে নিয়ে দেখল ১৯+ মিসডকল। সবগুলোই আহনাফের কল ছিল। সে পার্লারে যাওয়ার সময় কলব্যাক করল আহনাফকে। আহনাফ রেসপন্স করেনি। রুহুল ওদেরকে পার্লারে পৌঁছে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। সাজতে বসার ঠিক আগ মুহূর্তে আহনাফ অর্ষাকে কলব্যাক করে।

“হ্যালো।”
“জি, বলেন।”
“কোথায় তুমি?”
“পার্লারে এসেছি।”
“পরে ফোন করব?”
“সমস্যা নেই। আপনি বলেন। আর হ্যাঁ, সরি। কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ফোনও সাইলেন্ট ছিল তাই রিসিভ করতে পারিনি।”
আহনাফ হেসে বলল,

“বুঝতে পেরেছিলাম প্রজাপতি। এমনিতে আমিও গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলার জন্য অবশ্য কল করিনি রাতে।”
“তাহলে?”
“এমনিই খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।”
“ওহ।”
“তবে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ফোন করেছি।”
“বলেন।”
“ভালোবাসি প্রজাপতি।”

অর্ষা আয়নায় তাকিয়ে ছিল। সলজ্জিতভাবে হাসল সে। পার্লারে কর্মরত মেয়েটি বলল,
“কথা শেষ হয়েছে ম্যাম? ব্রাইডাল সাজ তো। একটু বেশি সময়ই লাগবে কিন্তু।”
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আহনাফ কথাগুলো শুনেছে। সে বলল,
“এখন তাহলে রাখছি বাটারফ্লাই। তুমি সুন্দর করে সাজো। আমার পরীটাকে আজ সবচেয়ে সুন্দর দেখতে চাই।”
“শুনুন না!”

“বলো না!”
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে অর্ষা বলল,
“আপনার প্রজাপতিও আপনাকে ভালোবাসে।”
অপরপ্রান্ত থেকে আহনাফের হাসির শব্দ শুনতে পেল অর্ষা। লজ্জা পেয়ে তৎক্ষণাৎ ফোনের লাইন কেটে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ফা-জি-ল বান্ধবীগুলো সমস্বরে বলে উঠল,
“বাহ্, বাহ্,! বাহ্, বাহ্! কী প্রেম!”

অর্ষার লজ্জার পরিমাণ গেল আরও বেড়ে। পার্লারের মেয়েগুলোও এখন মুচকি মুচকি হাসছে। অর্ষার মনে হচ্ছে, এই বুঝি লজ্জায় সে শেষ হয়ে যাবে।

যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৭

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
উফ! আজও ওদের বিয়েটা দিতে পারলাম না! এজন্য কাহিনি যে স্লো এগোচ্ছে এটা ভাবার কিন্তু কোনো কারণ নেই। সমস্যা হচ্ছে, আমি আগের মতো বড়ো বড়ো পর্ব লেখার সময় পাচ্ছি না। যাই হোক, বেশি অপেক্ষাও করাব না ইন-শা-আল্লাহ্।]

যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৯