বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১৭

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১৭
শারমিন আক্তার বর্ষা

শীতের সকালে ঘাসের গায়ে যেমন জমে শিশিরের বিন্দু ফোঁটা ঠিক তেমনি নিহান কর্ণর কপালে জমেছে ঘামের কণা। সকাল সকাল থানায় স্বয়ং ডিআইজি দিদার ম্মেদ উপস্থিত হয়েছেন। উনার রাগান্বিত চেহারা দেখে অনুমান করা যাচ্ছে তিনি মারাত্মক রেগে আছেন।

উনার মুখশ্রী দেখে বুঝার উপায় নেই, উনি ঠিক কোন বিষয়টি নিয়ে ক্রোধিত আছেন। ডিআইজি দিদার ম্মেদ’র সামনে হাত দু’টি গুটিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নিহান কর্ণ ও আদ্রিক আহির মির্জা। আঁড়চোখে দুজন ইন্সপেক্টর দুজনার দিকে তাকাল। হঠাৎ জরুরি তলব, বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা বলতে ডিআইজি স্যার নিজে আসছেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তিন জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ডিআইজি স্যার এতক্ষণ ধরে নিজের মুখে কুলু পেতে রাখছেন। টেবিলের ওপরের কেসের ফাইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখছেন। ডিআইজি দিদার ম্মেদ স্বগতোক্তি করলেন আপন মনে। ডিআইজি স্যারের মুখে গাম্ভীর্যের আভা ছড়ানো, ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ত্যাগ করল নিহান ও আদ্রিক। কেসের ফাইলগুলো টেবিলের ওপরে ছুঁড়ে ফেললেন, মাত্রাতিরিক্ত রাগে চেঁচিয়ে বলে,

“পরপর এতগুলো খু’ন হয়ে গেছে। অথচ তোমরা এখনও কোনো ক্লু খুঁজে বের করতে পারছো না। তোমরা কেসটা নিয়ে তদন্ত করছো নাকি হেলাফেলা করে ফেলে রাখছো? আসল ক্রিমিনাল কে খুঁজে বের করার জন্য যখন যা পদক্ষেপ নিতে হয়, তোমরা নাও। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যদি তোমরা এই কেস সল্ভ করতে না পারো, তাহলে আমি এই কেসের ফাইল অন্য ইনস্পেক্টরের হাতে হস্তান্তর করবো।”

রাগে ও ক্ষোভে ডিআইজি দিদারের চোখ দু’টি আগুনের লাভার ন্যায়, রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
টেলিভিশনে সাংবাদিকরা যা-চ্ছে তাই বলছে,’ এতগুলো খু/ন হচ্ছে অথচ দেশের আইন কিছুই করতে পারছে না।
পুলিশরা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে?’
এখনও কিছু করতে না পারলে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করা যাবে না।
অন্যদিকে উপর থেকে ডিআইজি দিদার এর ওপর পেসার আসছে। কেসটা নিয়ে কতদূর তদন্ত হয়েছে কেস নিয়ে আঁধোও কি ইনভেস্টিগেট হচ্ছে না-কি না?

শান্ত হয়ে বসে টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে অর্ধেক পানি পান করে, সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলল ডিআইজি দিদার। নিজের রাগের ওপর যথার্থ নিয়ন্ত্রণ এনে ডিআইজি দিদার স্বাভাবিক হয়ে কিয়ৎক্ষণ বাদে থানা থেকে বেরিয়ে যান।
ডিআইজি দিদার ওঠে চলে যেতেই নিহান রাগে টেবিলের ওপর থেকে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারল অপজিটে গ্লাস ভাঙার শব্দ শুনে হকচকিয়ে ওঠে আদ্রিক।

চেয়ারে বসে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে কর্কশকণ্ঠে বলল, “একটা কেস সল্ভ করতে গেলে আরেকটা উল্টিয়ে যাচ্ছে। শুরুটা মিললে শেষটা গোলমাল পাকিয়ে যায়। আবার শেষটা মিললে শুরুটা। সব জেনো এক গোলকধাঁধা। রাগে নিজের চুল নিজে টেনে ধরল নিহান। আজ পর্যন্ত অনেক কেস সল্ভ করেছে নিহান, কিন্তু কোনো টাই এইটার মতো জটিল অথবা গোলমেলে ছিল না। যখনই কেসটা সল্ভ করার চেষ্টা করছে,আসল ক্রিমিনালের ধরা পাবে তখনই সব ধোঁয়াশা হয়ে যায়। সব শেষে হাত শূন্য।

দু’টি আঙুল দিয়ে কপাল চেপে ধরে চোখজোড়া বন্ধ করে ঠাই বসে রইল নিহান। আদ্রিক টুকটাক কথা বলে চলে যায়। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে শুরু থেকে এই পর্যন্ত সব কিছু ঘটনা মিলানোর চেষ্টা করছে নিহান। এমতাবস্থায় হঠাৎ প্যান্টের পকেটের ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল।

রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাঙলো নিহানের চট করে চোখজোড়া মেলে তাকাল। ফোন হাতে ভ্রু কুঁচকানো করে স্কিনে তাকাই অচেনা নাম্বার। কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে ফোন রিসিভ করতে অপরপাশ থেকে পুরুষালী গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কেউ বলল,
” ইন্সপেক্টর নিহান কর্ণ আপনার যদি মার্ডার মিস্ট্রি কেসের আসল ক্রিমিনাল দের ধরবার জন্য কোনো হেল্প প্রয়োজন পরে তাহলে আজ সন্ধ্যায় জুরাইন গোরস্তানের দক্ষিণে একটা পুরালো ভাংলো আছে ওখানে চলে আসবেন। আসল ক্রিমিনাল সহ তাদের সকল কুকিত্তির প্রমাণ আমি আপনাকে দিবো। মনে রাখবেন, আপনি একা আসবেন।”

দুইদিন পর, বন্ধু বান্ধব সকলে মিলে ঘুরতে বের হয়েছে সাথে করে নতুন বর ও বউ রয়েছে। সবাই বেশ হাসিখুশি ও মিশুক। আজ পুরো দিন বাহিরে ঘুরবে ও বাহিরে খাওয়া দাওয়া করবে। আগামীকাল রুহানি ও বাকিদের ফিরে যাওয়ার কথা। রুহানি ও বাকি বন্ধুরা চলে যাবে বৈকি বেচারি শ্যামার ভীষণ মন খারাপ। কিন্তু কিছু করার নেই যেতে তো হবে। কানাডা পড়তে যাওয়ার পর ওরা সবাই যে শ্যামার অনেক আপন হয়েগেছে।

দু’দিন পর চলে যাবে ভাবতে ঢুকুরে কেঁদে ফেলছে। ওর মন ভালো করার জন্যই সবাই একসাথে বেরিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরির পর, লেকের পাশে এসে বসল রুহানি ও বাকিরা। শ্যামা বাঙালি মেয়ে ওর ফুচকা অনেক পছন্দ। ফুচকা ওয়ালা দেখে গাড়ি থামিয়ে নেমে পরে। ওর জন্য সবার নামতে হয়। রুহানির ফুচকা পছন্দ নয়, তাই ‘ও’ হাঁটতে হাঁটতে সকলের থেকে একটু দূরে চলে আসে। আজও অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে লেকে ইয়াসিরের সাথে রুহানির দেখা হল। ইয়াসির সাধারণ মানুষের মত লেকের পাশে বসে আছে, রুহানি আগ বাড়িয়ে ইয়াসিরের সাথে কথা বলতে আসে।

আগের বারের মতো এবার ইয়াসির রুহানির সাথে ভালো আচরণ করল না। রুহানিকে দেখে তিনি নাক কুঁচকালেন। এক সপ্তাহ আগে রুহানির সাথে দেখা হয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ বসে গল্পগুজব করে ছিল সেগুলো হয়তো ইয়াসিরের মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। ইয়াসির আজ চিনতে পারল না রুহানিকে। পাশে বসায় রেগে গিয়ে রুহানিকে বেশ কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে ওঠে চলে যায় ইয়াসির। ইয়াসিরের হঠাৎ এমন আচরণে মনে কষ্ট পায় রুহানি। ঠোঁট মুখ কালো করে বসে রয়। অচেনা লোক, তাছাড়া তার মতো ক’জনই বা প্রথম দেখায় সব মানুষকে মনে রাখে? ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তাহলে কেনো রুহানি এই স্বাভাবিক বিষয় টাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারছে না? কেনো রুহানির কষ্ট হচ্ছে? কেনো ই বা চোখের কার্নিশে জমলো অশ্রুকণা।

হাতের তর্জনী দিয়ে চোখ মুছে ওঠে দাঁড়াল রুহানি। অন্য মন্যস্ক হাঁটতে শুরু করল। অন্য দিকে, সকলে ফুচকা খেলো। গাড়িতে ওঠে দেখে ওদের মাঝে রুহানি নেই। গাড়ি নিয়ে অন্য দিকে রুহানিকে খুঁজতে লাগে, কিন্তু রুহানি ওইদিকে নেই। রাস্তায় কয়েকজনকে রুহানির ছবি দেখালে তারা জানায় উনারা কেউ রুহানিকে এ পথে যেতে দেখেনি। নিরাশ হয়ে আগের ন্যায় গাড়িতে ওঠে রাস্তার আশপাশে খুঁজতে লাগল।

রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূরে চলে আসছে রুহানি। রাস্তার মোড়ে কুকুরের ঘেউঘেউ ডাকে হুঁশশ ফিরে পেলো সে। সরু দৃষ্টিতে আশপাশ লক্ষ্য করে দেখল। সে পথভ্রষ্ট ভুল পথে প্রচলিত হয়েছে। পিছনে ঘুরে লেকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হল। কিন্তু কিছুদূর আসতে রাস্তা গুলিয়ে ফেলল রুহানি। চৌরাস্তা মানে চারটা রাস্তা,এখন কোন রাস্তা দিয়ে এসেছিল জানা নাই। হতাশাজনক শ্বাস ফেলল অভিমানে ঠোঁট কামড়ে আশপাশটা আবারও লক্ষ্য করল। সকাল বেলা, এই আটটা ন’টা বাজে বোধহয়।

তেমন কোনো গাড়িঘোড়া নেই, শুধু কয়েকটা রিক্সা চলাচল করছে এই পথে। সাথে ব্যাগ নেই। রিক্সা ভাড়া করবে তারও উপায় নেই। হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে বুদ্ধি আসল, শ্যামা বা অন্যদের কল দেওয়ার। কিন্তু হল না কিছুই। সিম কোম্পানি জানাল, পর্যাপ্ত ব্যালেন্স নেই। ফোনে নেট ও নাই। কোনো ভাবে কল দেওয়ার কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের সিম অফারের সম্মন্ধে রুহানির কোনো ধারণা নেই, কেননা সে এদেশে নতুন।

আর রিচার্জ করবে সাথে টাকা নেই। ফোনে ব্যালেন্স না থাকলে যে নেটে কল দিবে তারও উপায় নেই। আশপাশের কয়েক জনের থেকে রুহানি সাহায্য চাইল। রুহানির ইংলিশ কেউ বুঝতে পারছে না। হেলাফেলা করে রুহানিকে এড়িয়ে চলে যাচ্ছে। চারটা রাস্তার দিকে তাকিয়ে কান্না পেলো রুহানির। কান্না কান্না ভাব, এমতাবস্থায় চোখ গিয়ে পরল, রোডের ওইপাশে একটা গাড়ির ওপরে মাত্রই এসে গাড়িটা থামছে। গাড়ির পিছনে ডিক্রি তে একটা বোর্ড ঝুলানো। তাতে ইংলিশে লিখা-

‘এই গাড়িতে ওয়াইফাই ফ্রী। গাড়িতে ওঠেন ফ্রী তে ওয়াইফাই ব্যবহার করেন।’
ওয়াই-ফাই আছে শুনে, রুহানি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। মনে মনে বলল, আমাকে এই গাড়িতে ওঠতেই হবে। সামনে ড্রাইভার স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে বসে আছে। লো ভলিউমে গান বাজছে, চোখ জোড়া বন্ধ করে সে গান উপভোগ করছে ড্রাইভার নাজিম। রুহানির বেশ কয়েকবার ডাকার পর, নাজিম চোখ মেলল। গ্লাস নামাতে রুহানি ইনোসেন্ট লুকে রিকুয়েষ্ট করল, তার ফোনে জেনো ওয়াইফাই কানেক্ট করে দেয়। এটাও বলে, তার জরুরি কল দিতে হবে। আর সাথে করে ব্যাগ নিয়ে আসতে ভুলে গেছে।

নাজিম পিছনের ডোরের লক আনলক করল। রুহানির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে তাকে বলল,
“আপনি গাড়িতে ওঠে বসুন। আমি কানেক্ট করে দিচ্ছি। প্রয়োজন মিটে গেলে নেমে যাবেন।”
বিপদের সময় আশার আলো হয়ে আসল এই গাড়িটা। খুশিতে আপ্লূত রুহানি সাত পাঁচ না ভেবে গাড়িতে ওঠে বসে পরল। একহাত দিয়ে তার ব্লেজার টা কাঁধের ওপর ফেলে আছে ও অন্য হাত তার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে কালো শার্ট-প্যান্ট পরণে একটা ছেলে, রাস্তা দিয়ে স্টাইল করতে করতে হেঁটে এদিকেই আসছে।

আচমকা গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে ঢুকে বসলো। সামনে ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে রুহানি শাসিত কণ্ঠে বলল,
“আপনি গাড়িতে উঠছেন কেন যান নামুন?”
রুহানির কথা শুনে ঘাড় কাত করে লোকটা রুহানির দিকে বাজপাখির নজরে তাকাল। ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে হেসে সুক্ষ্ম কণ্ঠে বলল,

” আমার গাড়ি থেকে আমিই নেমে যাবো মিস রুহানি?”
কণ্ঠে গম্ভীরতা শুনে থমকে গেলো রুহানি। মূহুর্তে পরিবেশ টা কেমন থমথমে হয়ে গেলো। শুঁকনো ঢোক গিলল সে। এই কণ্ঠস্বর যে তার পূর্ব পরিচিত হাজারও মানুষের ভীড়ে ও শত বছর পরেও তার এই কণ্ঠস্বর চিনতে ভুল হবে না। নিষ্পলক চোখে তাকাই পাশে বসা লোকটার দিকে,লোকটার মুখশ্রী দর্শন হতে ছিটকে উঠলাম। নিজ জায়গা থেকে কিছুটা নড়েচড়ে গেলাম। ড্রাইভার সুযোগে গাড়ির ডোর গুলো লক করে ফেলল। আমি চেয়েও দরজা খুলতে পারছি না। ভয়ে আমার হাত পা নিষ্ক্রিয় হয়ে আসছে। লোকটা তাত্ক্ষণিক আমার হাত ধরে টেনে তার মুখোমুখি ঘোরালো। কাঁপা কাঁপা গলায় তার নাম উচ্চারণ করলাম, ” এ.স?”

এ.স তথা আরিশ আমার দুইহাত তার শক্তপোক্ত দুইহাত দিয়ে চেপে ধরে। গাড়ির ডোরের সাথে আমাকে চেপে ধরল। উনি আস্তেধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে আমি ভয়তে চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নেই। আমার হার্ট বিট করছে। আমি চাইনা আরিশ আমার সামনেও আসুক। এখন কেনো জানি না, উনার আমাকে স্পর্শ করা, আমার কাছাকাছি আসা, উনার গরম নিঃশ্বাস আমার গায়ে উপচে পড়া সব কিছুর মধ্যে আমার ভালো লাগা ও অদ্ভুত অনূভুতির সঞ্চরণ ঘটছে। আমার কানের লতির সাথে আরিশ তার নাক ঘষল। আমি কিছুটা নড়েচড়ে উঠলাম। আরিশ আমার হাতজোড়া আরও শক্ত করে চেপে ধরল। আরিশ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুহানি কে পরখ করে নিলো।

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১৬

একটু ঝুঁকে আমার কানের কাছে তার ঠোঁট জোড়া নিয়ে ফিসফিস আওয়াজে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
” তুমি স্নিগ্ধ একদম ওই দিঘির পুষ্প ফুলের মতো। আর আমার এই প্রস্ফুটিত পুষ্প ফুল টার উপর যত নজর!”

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ১৮