শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩১

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩১
তাসনিম জাহান রিয়া

গেইট দিয়ে বের হতেই চাঁদের আলোয় অনুপমের মুখশ্রীর শ্রেয়সীর চোখে স্পষ্ট হয়ে যায়। শ্রেয়সী দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনুপমের বুকে। অনুপম শ্রেয়সীকে নিয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। শ্রেয়সী ডুকরে কেঁদে ওঠে।
অনুপম শ্রেয়সীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

হুস কাঁদে না। তুমি আমার বেলি। বলেছি না বেলিদের চোখের পানিতে না হাসিতেই মানায়।
নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সমস্যাটা তোমার। সমাধানটাও তোমাকেই করতে হবে। আমি তোমাকে যাস্ট পথ দেখিয়ে দিতে পারি। যেই কাজটা করতে মন সাই দিবে না। সেটা তুমি করবে না। মনের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করবে না। যাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারবে না তাকে মুখেও ক্ষমা করবে না। এই কারণে সম্পর্ক আরো খারাপ হয়। তুমি মুখে বললেও মন থেকে তো ক্ষমা করতে পারোনি। সেটা তোমার কাজে আর ব্যবহারে প্রকাশ পেয়ে যাবে। তবে ক্ষমা করা মহৎ গুণ। আমার বেলী তো কোমল হৃদয়ের নারী সে কারো ওপর রেগে থাকতে পারে না।
শ্রেয়সী অনুপমের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বলে,

আপনি বুঝলেন কী করে আমি কাঁদছি কেনো? আপনি সবটা জানেন? কিন্তু কীভাবে? আমি তো আপনাকে কিছু বলিনি।
যাকে ভালোবাসি তার মনের খবর রাখবো না। নাহিন ভাইয়া যখন কথাগুলো তোমাকে বলছিল তখন আমি তোমাদের দরজার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দরজার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কথাগুলো কর্ণগোচর হয়। এই ব্যাপারে আমি কোনো কমেন্ট করবো না। উনি তোমার বড় ভাই তোমাকে শাসন করতেই পারে। এটা তোমাদের দুজনের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এসব কথা বাদ দাও। বলোতো আজকে কী?
আজকে আবার কী?

আজকের দিনেই তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। প্রথম বারের মতো আমাদের সাক্ষাত হয়েছিল জ্ঞান হারানো মেয়ে।
শ্রেয়সী অনুপমের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙায়।
জ্ঞান হারানো মেয়েদের চোখ রাঙাতে নেই।
আরেকবার এই নামে ডাকলে আমি কিন্তু চলে যাব।
যেতে চাইলেই যেতে দিব? এতোই সহজ? আটকে রাখবো এই বুকের ভিতর। এখন চলো এই সময়টা একটু উপভোগ করি।

আগে সরি বলেন। তারপর যাব। নাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।
আচ্ছা সরি। এবার চলো। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল নিজের প্রিয়তমাকে নিয়ে মাঝরাতে চাঁদের আলোয় এই শহরে অলিতে গলিতে হাঁটার। ফাইনালি স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে।
সারা রাত কী হাঁটাবেন নাকি কোথাও নিয়ে যাবেন?
যাব তো নিয়ে আমাদের ঘরে।

মানে?
সারপ্রাইজ।
অনুপম শ্রেয়সীর হাতটা মুঠোবন্দি করে হাঁটা শুরু করে। চাঁদের আলোয় অনুপমের কাছে শ্রেয়সীকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। এলোমেলো হয়ে কিছু চুল কপালে পড়ে আছে। কানের পাশে কিছু চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। অনুপম শ্রেয়সীর মুখোমুখি দাঁড়ায়। দুজনের একসাথে ছায়ার ছবি তুলে। ছবি তুলে প্রোফাইল পিকচার দেয়। ক্যাপশন দেয়,
তোমার রাগের মাঝেও ভালোবাসা পাই,
তাই তো তোমায় এতো রাগাই।

শ্রেয়সী অনুপমের এক হাত জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। কিয়ৎক্ষণ হাঁটার পর শ্রেয়সীর চোখ বেঁধে দেয়।
কী করছেন আপনি?
হুসস কোনো কথা না। এখন শুধু অপেক্ষা কর আমাদের ঘর দেখার জন্য।

অনুপমের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শ্রেয়সী। কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর অনুপম দাঁড়িয়ে যায়। শ্রেয়সীর পিছনে দাঁড়িয়ে বাঁধন খুলে দেয়। শ্রেয়সী সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। লাইটিং করা একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
এটাই ‘আমাদের ঘর’। এখানে তোমার আর আমার ছোট সংসার হবে।
শ্রেয়সী ‘আমাদের ঘর’ লেখাটার ওপর হাত ভুলাচ্ছে বারংবার। তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।
তার আর অনুপমের ছোট্ট একটা সংসার হবে এখানে।

ভিতরে যাবে না?
হু।
অনুপম শ্রেয়সীর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যায়।
শ্রেয়সী ঘুরে ঘুরে ড্রয়িংরুম আর কিচেন দেখে।
চলো তোমার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।
কী?

আগে চলো। গেলে নিজেই দেখতে পাবে কী সারপ্রাইজ।
ছাদের দরজার কাছে এসে অনুপম শ্রেয়সীর চোখ চেপে ধরে। ছাদের মাঝখানটাই গিয়ে শ্রেয়সীর চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়। শ্রেয়সী পিট পিট করে চোখ খুলে। রেলিংয়ের পাশে দুই সারি করে ফুলের গাছ লাগানো। ছাদটা সুন্দর করে ফেরি লাইট দিয়ে ডেকোরেশন করা। খুশিতে শ্রেয়সী অনুপমের হাত খামছে ধরে। অনুপম শ্রেয়সীর
দিকে ঝুঁকে মোহনীয় গলায় বলে,

পছন্দ হয়েছে?
ভীষণ।
আমাদের বেডরুম দেখবে না?
‘আমাদের বেডরুম’ শব্দটা এতো শ্রুতিমধুর কেনো শোনাচ্ছে? ‘আমাদের বেডরুম’ শব্দ তো আগেও শুনেছি। কই এমন অনুভূতি তো আগে হয়নি। তার আর অনুপমের একটা রুম হবে এটা ভাবতেই শ্রেয়সীর মুখশ্রী লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
শ্রেয়সী যখন বাসায় আসে তখন সকাল ছয়টা। শ্রেয়সী মিহানের ফার্ম হাউসে আর ফিরে যায় না। একদম বাসায় চলে আসে। অনুপম দিয়ে গেছে। দুই ঘন্টার মতো ঘুমিয়েছিল আর গতকাল বিকালে অনেকক্ষণ ঘুমনোর জন্য তেমন একটা অসুবিধা হচ্ছে না।

তবে অনুপমের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত তার জন্য বিশেষ ছিল। অনুপম প্রতিটা মুহূর্ত তার জন্য বিশেষ করে তুলেছিল। নিজের হাতে ফুচকা বানিয়ে দিয়েছে। কলিংবেল বাজাতেই নাহিন দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে দিয়ে দরজার পাশে সটান দাঁড়িয়ে আছে নাহিন। শ্রেয়সী কোনো কথা না বলে জুতা খুলে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে।
শ্রেয়সী?

শ্রেয়সী দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু কোনো কথা বলে না। নাহিন মৃদু পায়ে হেঁটে শ্রেয়সীর সামনে এসে দাঁড়ায়। নাহিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করেই শ্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়সী চমকায় না অবাকও হয় না। নাহিন হুট করে যেমন শ্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরেছিল তেমনি হুট করেই শ্রেয়সীকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। রুমে ঢুকেই ঠাস করে দরজা আটকে দেয়। শ্রেয়সী নিজের কাধে হাত রাখে। হাতের আঙ্গুলে পানির স্পর্শ পেতেই চমকে ওঠে শ্রেয়সী।

নাহিন যে ভীষণভাবে অনুতপ্ত সেটা শ্রেয়সী বুঝতে পারে। শ্রেয়সীর সাথে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। রাতের অন্ধকারে শ্রেয়সীর রুমে গিয়ে শ্রেয়সীর মাথার পাশে বসে কাঁদে। কিন্তু সেই কষ্টটা মুখে প্রকাশ করতে পারে না। শ্রেয়সী আর দাঁড়ায় না ড্রয়িংরুমে। স্লান পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে যায়। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। ঠিক সেই মুহূর্তেই শ্রেয়সীর ফোনটা বেজে ওঠে। মিহান কল করছে। শ্রেয়সী একটু অবাক হয়। মিহানের সাথে তার ঘন্টা খানিক আগেই কথা হয়েছে।

হ্যালো।
হ্যালো শ্রেয়সী। প্রিয়ন্তি সুইসাইড করেছে।
শ্রেয়সী চমকে ওঠে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
কী? প্রিয়ন্তি সুইসাইড করেছে? কীভাবে? মিহান তুই আমার সাথে ফাজলামো করছিস না তো?
শ্রেয়সী তোর মনে হয় আমি এমন সিরিয়াস ব্যাপারে ফাজলামো করবো? আমরা প্রিয়ন্তিকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি।
আমি আসছি। তোরা প্রিয়ন্তিকে নিয়ে হসপিটালে যা।

শ্রেয়সী ফোনটা কেটে পার্সটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। নাহিনের রুমের সামনে গিয়ে দরজায় কড়াঘাত করে। নাহিনের কোনো সাড়াশব্দ নেই।
ভাইয়া, ভাইয়া প্রিয়ন্তি সুইসাইড করেছে। ওকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে।
নাহিনের কোনো সাড়াশব্দ নেই। শ্রেয়সী আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায়। আধ ঘন্টার মাঝে শ্রেয়সী হসপিটালে পৌছে যায়। শ্রেয়সী গিয়ে দেখে সবাই হসপিটালের করিডোর ধরে পায়চারি করছে।

প্রিয়ন্তির এখন কী অবস্থা?
মোটামুটি ভালো।
কীভাবে কী হলো? তোরা তো প্রিয়ন্তির সাথে ছিলি। তাহলে প্রিয়ন্তি এমন একটা ঘটনা ঘটালো?
তন্ময় নিজের চুল টেনে বলে,
এটাই তো আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল। আমি, মিহান আর মুহিব এক রুমে ছিলাম। নিতু আর ইভা এক রুমে আর প্রিয়ন্তি একা একটা রুমে ছিল। সকালে প্রিয়ন্তির রুমে গিয়ে দেখি প্রিয়ন্তি হাত কেটে একাকার করে ফেলছে। আমরা দ্রুত হসপিটালে নিয়ে আসছি।

আংকেলকে খবর দিয়েছিস?
হ্যাঁ। নিতু কল করেছিল।
শ্রেয়সী চেয়ারে বসে পড়ে। অনেকটা সময় পার হয়ে যায় কিন্তু নাহিন আসে না। শ্রেয়সীর কাছে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগে। শ্রেয়সীর ফোনে ব্যালেন্স নেই। শ্রেয়সী ফেসবুকে ঢুকে নাহিনকে মেসেজ করার জন্য। নিউজফিডে আসা একটা পোস্ট দেখে শ্রেয়সী চমকে উঠে।

পোস্টটা করা হয়েছে মেঘলা রহমানের আইডি থেকে। পোস্টটা করা হয়েছে চারটার দিকে।
আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই সমাজ আমাকে বাঁচতে দিল না। এই অসুস্থ সমাজ আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলেছে। এই আত্নাবীহিন শরীরটাকে আর আমি বয়ে চলতে পারছি না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩০

মিহান আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমার এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসার মূল্য আমি দিতে পারিনি। তোমার ঘরের বধূ হয়ে আমার আর যাওয়া হলো না। তোমার নামে বউ সাজার স্বপ্ন আমার আর পূরণ হলো না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩২