শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩২

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩২
তাসনিম জাহান রিয়া

যখন গ্রামে পৌছায় তখন মেঘলার লাস পানি থেকে তুলে উঠোনে রাখা হয়েছে। সকালে পুকুর থেকে পানি নিয়ে আসতে গিয়ে মেঘলার জলে ডুবা লাশ দেখতে পান হাজেরা খাতুন। হাজেরা খাতুন মেঘলাকে এই অবস্থায় দেখেই চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। উনার চিৎকার শুনেই আশেপাশের মানুষ ছুটে আসে।

মুহিব মেঘলার এমন অবস্থা দেখে আর এগোতে পারে না। ধপ করে বসে পড়ে উঠোনের এক প্রান্তে। মিহান স্লান পায়ে হেঁটে মেঘলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মেঘলাকে একটা খাঁটিয়ার ওপর রাখা হয়েছে। মেঘলার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মিহানের মনে হচ্ছে এটা সেই মেঘলা না যে মেঘলাকে সে চিনে। এই মেঘলা তার অচেনা। মিহানের বুকের ভিতর হাঁসফাঁস করছে। ধপ করে বসে পড়ে মেঘলার খাটিয়ার পাশে। মিহান হাত বাড়িয়ে মেঘলাকে ছুঁতে গেলে গ্রামের কিছু লোক বাঁধা দিতে আসে কিন্তু শ্রেয়সীদের জন্য পারে না। মিহান আলতো করে মেঘলার মুখে হাত বুলিয়ে দেয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি তো আপনাকে সাদা কাফনে মুড়ানো অবস্থায় দেখতে চায়নি মেঘলা। আমি তো আপনাকে লাল বেনারসি গায়ে আমার বউ রূপে দেখতে চেয়েছিলাম।
মিহান পড়ে যেতে নিলে তন্ময় পিছন থেকে ধরে ফেলে। মিহান তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বলে,
আল্লাহ্ বোধহয় আমার কপালে সুখ জিনিসটা রাখেননি। আমি যাকে আকঁড়ে ধরে বাঁচতে চাই তাকেই আল্লাহ্ আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেন।

তন্ময় মিহানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
আরে বোকা কাঁদছিস কেনো? মেঘলা তো মুক্তি পেয়ে গেলো। আমার সাথে সম্পর্কে জড়ালে তো ও ভালো থাকতো না। একটা কথা জানিস না খারাপ মানুষের কপালে ভালো মানুষ থাকে না। আমি তো খারাপ।তাই তো আল্লাহ্ সবাইকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেন। ভালো থাকবেন মেঘলা।

মিহানের লাস্ট কথাগুলো অস্পষ্ট শোনায় পরমুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে যায় মিহান। তন্ময় শক্ত হাতে মিহানকে আগলে নেয়। দুইটা ছেলেকে নিয়ে তন্ময় মিহানকে ধরে ভিতরে নিয়ে যায়। হাজেরা খাতুন চিৎকার করে কাঁদছে। হাজেরা খাতুনকে সামলানোর চেষ্টা করছে শ্রেয়সী। ইভা আর নিতু মুহিবকে ধরে মেঘলার কাছে নিয়ে আসে। মুহিব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘলার মুখশ্রীর দিকে। এক দিনের ব্যবধানে কতো কিছু ঘটে গেলো। গতকালের সকালেও বসে সে মেঘলার সাথে ভাত খেয়েছে। আজকে তার ছোট আপা তার সামনে একজন মৃত ব্যক্তি।

এই আপা এমনটা করার কী খুব দরকার ছিল?এটা করার আগে একবারও আমাদের কথা ভাবলে না? তুমি এতোটা স্বার্থপর কী করে হলে? তুমি জানো না তোমার মুহিব তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না? আম্মার কথা ভাবলে না? আম্মা এই বয়সে এতো বড় ধাক্কা সামলাতে পারবে? আমাদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। তুমি একবার মিহানের কথা ভাবলে না? তুমি জানতে না মিহান তোমাকে কতোটা ভালোবাসে? ঐ ছেলেটা তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। জানো ওর আপন বলতে কেউ নেই। ও তোমাকে আকঁড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল। নিজের ছন্নছাড়া জীবনের পরিবর্তন এনেছিল তোমার জন্য। তুমি নিজেকে শেষ করে দাওনি ঐ ছেলেটাকে মেরে ফেলেছো তুমি। ওকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলে। ওকে এভাবে জীবন্ত লাশ না বানিয়ে একবারে মেরে দিলেই পারতে।

মুহিব নিজের চুল টেনে ধরে। দুই হাত দিয়ে মুখ ঘষে।
তুমি এখন কেনো চুপ করে আছো? কথা বল? ছেড়েই যখন যাবে তাহলে ওর জীবনে গিয়েছিলে কেনো? ওকে মিথ্যা স্বপ্ন কেনো দেখিয়েছিল? ও তো ছিল নিজের মতো বেশ।
মুহিব মেঘলার মুখের দিকে ঝুঁকতেই চমকে ওঠে। মেঘলার পাশে একদম স্থির হয়ে বসে যায়। কিছু একটা তাকে ভাবাচ্ছে। এর মাঝে পুলিশ এসে হাজির হয়। মেঘলার লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাবে। এই নিয়ে ইভার সাথে ঝামেলা হচ্ছে।
ইভা উনাদের আসতে দে। আমার আপা সুইসাইড করেনি। উনাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আমি চাই তদন্ত হোক।

মুহিবের কথায় সবাই চমকে ওঠে। নিতু অবাক হয়ে বলে,
এসব কী বলছিস মুহিব?
একদম ঠিক বলছি। আমি আপা এমন স্বার্থপরের মতো কাজ করতে পারে না। এই দেখ ছোট আপার গলায় হাতের ছাপ। আমার আপাকে কেউ গলা টিপে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেছে। আমার ছোট আপাকে গোসল কে কে করিয়েছিলেন? উনারা দেখেননি এই দাগগুলো? নাকি সবাই এই খুনের সাথে জড়িত? আমি কাউকে ছাড়বো না। অফিসার, অফিসার এই হত্যার সুষ্ঠ তদন্ত চাই। আমার ছোট আপার একটা খুনিও যেনো রেহাই না পায়। সবাই যেনো কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি পায়।

আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ব্যাপারটা দেখছি। উনার আগের কেইসটা নিয়ে আমাদের ওপর চাপ আছে। এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত নাহলে আমাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে। মিস্টার অনুপম আপনার কী হয়?
ভাই।

ভাই বলে মুহিব নিজেই চমকে যায়। অনুপম তার মনের এতোটাই জায়গা দখল করে নিয়েছে যে তার অজান্তেই সে অনুপমকে ভাই বলে ফেলছে। অনুপম তার জন্য যতটুকু করছে ততটুকু হয়তো নিজের ভাই থাকলেও করতো না। অনুপমের সাথে তার সম্পর্ক বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড। তার বোনদেরও তো হাজবেন্ড আছে। কই তাদের তো সে এভাবে নির্দ্বিধায় ভাই বলতে পারে না। বরং দুলাভাই বলতেও তার সংকোচ হয়।

রক্তের সম্পর্কই বড় সম্পর্ক না। রক্তের থেকে বড় সম্পর্ক হচ্ছে আত্নার সম্পর্ক। এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও তার বোনেরা এখনো উপস্থিত হতে পারেনি। কিন্তু তার বন্ধুরা ঠিকই চলে আসছে। একজন অসুস্থ শরীর নিয়েই চলে আসছে। একেই হয়তো বলে আত্নার সম্পর্ক। মেঘলার লাশ নিয়ে যাওয়ার পর পরিবেশ কেমন শান্ত হয়ে যায়। হুট করেই যেনো সবাই চুপ হয়ে গেছে। কিয়ৎক্ষণ পরেই মুহিবের বড় বোন আর ছোট বোন আসে। হাজেরা খাতুন নিজের আর দুই মেয়েকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

মুহিব আলী সাহেবকে লক্ষ্য করছে। মুহিব ভাবছে আজকেও কী উনি বিরক্ত হচ্ছেন? কিন্তু আলী সাহেবের মুখ দেখে মনে হচ্ছে না উনি বিরক্ত হচ্ছেন। মুহিবের খুব জানতে ইচ্ছে করছে আলী সাহেব কী তার ছোট আপার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছে?
সকাল গড়িয়ে এখন দুপুর। দুঃখের সময়গুলো যেনো ফুরাতে চায় না। আজকে যেনো কারো সময়ই কাটছে না। কান্না-কাটির কোনো রেশ নেই। সবাই কেমন শান্ত বসে আছে। বারান্দায় বসে আছে মিহান। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। শ্রেয়সী মিহানের পাশে বসে। মিহানকে মৃদু স্বরে ডাকে। কিন্তু মিহান জবাব দেয় না। সবার ভয় এখন মিহানকে নিয়ে। মিহান যদি নিজেকে সামলাতে না পেরে ভুল কিছু করে ফেলে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। পাশের বাসা থেকে ভাত আর আলু ভর্তা দিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। এমন পরিস্থিতিতে কারো খাওয়ার অবস্থায় নেই। কারো গলা দিয়েই খাবার নামবে না। সন্ধ্যা হতেই মিহান গিয়ে পুকুরে গোসল করে ফেলে। মিহানকে পুকুরে নামতে দেখে সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মিহান সবাইকে অবাক করে দিয়ে গোসল করে মেঘলার বাবার একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পড়ে।

মিহানের কাজে সবাই শুধু অবাক হচ্ছে। এমন অদ্ভুত আচারণ আগে কখনো করেনি। মিহানকে কেউ কিছু বলতে পারছে না। কারণ সে কারো সাথে কথা বলছে না। নিজের মর্জি মতো সবকিছু করছে। মিহান গোসল শেষে একটা চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে। প্রিয়ন্তি ভয়ে ভয়ে জিঙ্গেস করে,

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩১

মিহান তুই এখানেন বসছিস কেনো আর সাদা পাঞ্জাবীই বা কেনো পড়েছিস?
প্রিয়তমাকে বিদায় দিতে হবে না। উনার একটা স্বপ্ন ছিল আমাকে উনার আব্বার পাঞ্জাবিতে দেখবেন। উনার ইচ্ছে তো অপূর্ণ রাখতে পারি না। উনার বাবার পাঞ্জাবি পড়েই উনাকে বিদায়।
সন্ধ্যার পর অনুপম, নাহিন আর তন্ময় মেঘলার লাশ নিয়ে আসে। অনুপম আর নাহিনের পড়নে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি গেম ভিজে জবজব করছ।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৩