শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৩

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৩
তাসনিম জাহান রিয়া

মিহান অপলক তাকিয়ে আছে অদূরে রাখার মেঘলার লাশটার দিকে। ‘লাশ’ শব্দটা উচ্চারণ করতে তার বুক কেঁপে ওঠছে। মিহান ভাবছে, খুব বেশি কী ক্ষতি হয়ে যেতো সাদা কাফনে মুড়ানো মেঘলা না থেকে লাল বেনারসিতে আবৃত মেঘলা বসে থাকলে?

যার ঠোঁট জুড়ে থাকতো লজ্জা মিশ্রিত হাসি। তার ঠোঁটের কোণে থাকতো প্রাপ্তির হাসি। সবকিছু হারিয়ে ফেলার পরও তার আল্লাহর প্রতি বিন্দুমাত্র অভিযোগ ছিল না। তবুও আল্লাহ্ কেনো তার থেকে তার শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিল? সে তো সব হারিয়ে মেঘলাকে নিয়ে একটা ছোট সংসার সাজাতে চেয়েছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেঘলাকে এখন জানাযার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। হাজেরা খাতুন, মুহিবের বড় বোন আর মেজো বোন কিছুতেই মেঘলাকে নিয়ে যেতে দিবে না। শক্ত করে মেঘলার খাঁটিয়া ধরে রেখেছে। নিতু, ইভা, শ্রেয়সী আর প্রিয়ন্তি তিনজনকে দূরে সরিয়ে নেয়। মিহান শান্ত ভাবেই খাঁটিয়া কাঁধে তুলে নেয়। অনুপম শুধু মিহানকে দেখছে।

বাইরে থেকে নিজেকে যতটা শান্ত নিজেকে দেখাচ্ছে ভিতরে ততটাই অশান্ত। বুকের ভিতরটা যে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। অনুপমের তো মেঘলার জায়গায় শ্রেয়সীকে কল্পনা করতেও বুক কেঁপে ওঠছে।
মুহিবের হাত-পা কাঁপছে। খাঁটিয়া তুলতে গিয়ে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে ভারী বস্তু এটা। মুহিব পড়ে যেতে নিলে পিছন থেকে কেউ একজন ধরে ফেলে। মিহান, মুহিব, তন্ময় আর অনুপম খাঁটিয়া কাঁধে তুলে নেয়। অতঃপর কালেমা শাহাদত বলতে বলতে সামনে এগোয়।

জানযা খুব সুষ্ঠভাবে সম্পর্ণ হয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে লাশ দাফনের সময়। মিহান কিছুতেই মেঘলাকে ছাড়বে না।
এই মেঘলা একটু কথা বলুন না। সবাই বলছে আপনি নাকি মারা গেছেন। কিন্তু আমি জানি আপনার কিছু হয়নি। আপনার কিছু হতে পারে না। আপনি তো আমাকে এভাবে একা করে দিতে পারেন না। আমাদের এখনো বিয়ে করা বাকি। একটা ছোট সংসার সাজানো বাকি। এই মেঘলা আপনি কবুল বলবেন না? এই দেখুন আমি কবুল বলছি, কবুল কবুল কবুল। এবার আপনি বলুন। কথা বলছেন না কেনো?

মিহানের ডাকে তো মেঘলা সাড়া দেয় না। আর কোনোদিন সাঁড়া দিবেও না। সে এখন মৃত লাশ মাত্র। কিছুক্ষণ পরই যার ঠাঁই হবেন অন্ধকার কবরের ভিতরে। মিহানকে কেউ টেনে সরাতে পারছে না। মিহানের শরীরে যেনো একশ জনের শক্তি ভর করেছে।
এই আপনারা কেনো আমাকে আমার মেঘলার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন? আমার মেঘলা এই অন্ধকার কবরে থাকতে পারবে না। ভয় পাবে। আপনারা আমাকেও মেরে ফেলুন। আমাকে আমার মেঘলার সাথে কবর দিয়ে দেন।

সবাই দেখছে প্রেমিকার জন্য এক প্রেমিকের উন্মাদ আচারণ। সবার বাধা অতিক্রম করে মিহান কবরে শুয়ে পড়ে। মিহান চিৎকার করে বলে,
এবার আমাকে কবর দিয়ে দেন।

অনুপম, তন্ময় আর কয়েক জন মিলে মিহানকে টেনে তুলে। মিহান এখন অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত মানসিক প্রেসারের কারণে এক সময় জ্ঞান হারায়। অনুপম মিহানের হাত দিয়ে মেঘলার কবরে প্রথম মাটি দেওয়ায়। এরপর মুহিব এক মুঠো মাটি হাতে তুলে নেয়।
ভালো থেকো আপা। দুনিয়াতে সুখ নামক বস্তুর দেখা পেলে না। পরকালে আল্লাহ্ যেনো তোমায় সব সুখ দেয়।

তারপর একে একে সবাই মাটি দেয়। এতো এতো মানুষের কান্না-কাটি আহাজারি কোনো কিছুই মেঘলার মৃত্যুকে ঠেকাতে পারলো না। সবাইকে একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। মানুষ নশ্বর। মৃত্যুকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। সে তুমি যতো বড় বড়লোকই হও না কেনো। একদিন তোমার ঠিকানা ঐ অন্ধকার কবরস্থানই হবে।
মিহানের জ্ঞান এখনো ফিরেনি। নাহিন আর অনুপম মিহানকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মুহিবকে তন্ময় আর একটা ছেলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মুহিবের প্রতিটা কদম ফেলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতর তোলপাড় করছে।

সবাই বসে আছে মুহিবদের বারান্দায়। শ্রেয়সী অদূর থেকে লক্ষ্য করছে মিহানকে। শ্রেয়সী মনে ঘুরে ফিরে একটাই ভাবনা আসছে। তার অবস্থা যদি মেঘলার মতো হয় তাহলে কী অনুপমও মিহানের মতো পাগলামি করবে? শ্রেয়সী মন থেকে একটাই উত্তর আসছে ‘না’।

এতোটা পাগলামি করার জন্য অনুপম থাকবেই না। অনুপম মিহানের মতো এতো শক্ত মনের অধিকারী না। অনুপমের হার্ট একদম দূর্বল। কোনো বিষয়ে তার উত্তেজিত হওয়া বারণ। মিহান কষ্ট সহ্য করতে করতে পাথরে পরিণত হয়ে গেছে। মিহানের সম্পূর্ণ জীবনটাই কেটেছে কষ্টে। একটুখানি সুখের ছোঁয়াও পায়নি। সুখের হদিস মিলতেই তা কর্পূরের মতো উদাও হয়ে যায়।

নাহিন বাড়ি ফিরেই বাবা-মার সাথে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে যায়। কেউ আর মিহানের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে না। বরং অজ্ঞান অবস্থায় মিহানকে নিয়ে রওনা দেয় অনুপম, শ্রেয়সী আর নিতু। জ্ঞান ফিরলে যদি আবার পাগলামি করে। এখানে যত থাকবে মিহানের কষ্ট তত বাড়বে। মুহিবদের বাড়িতে থেকে যায় ইভা, প্রিয়ন্তি আর তন্ময়।

মিহানকে নিয়ে অনুপমের ফ্ল্যাটে ওঠে। এতো রাতে ডক্টর পাওয়া অসম্ভব। অনুপমের হুট করেই তার বন্ধুর কথা মনে পড়ে যায়। অনুপম তার বন্ধুকে ফোন করে আসতে বলে। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই ডক্টর চলে আসে। উনি মাত্রই হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। তাই অনুপমের ফোন পেয়ে আসতে বেশি একটা সময় লাগলো না। মিহানকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে কিছু ঔষধ দিয়ে যায়।

নিতু, শ্রেয়সী আর অনুপম তিনজনেই এর মাঝে ফ্রেশ হয়ে নেমে। অনুপম নিতুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
তুমি পাশের রুমে গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নাও। আমি মিহানের পাশে আছি। শ্রেয়সী তুমিও যাও। তোমাদের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে।

আমাদের থেকেও আপনার ওপর দিয়ে বেশি ধকল গেছে। আমি রুমে গেলে এমনিতেও ঘুম আসবে না। মিহানকে একা রেখে যেতে পারবো না। ভয়ে আমার ঘুম আসবে না। প্রতিক্ষণ মনে হবে এই বুঝি মিহান কিছু করে বসলো।
তোমাদের মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

আপনার মতো শুভাকাঙ্ক্ষী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন। আমাদের সবার বিপদে আপনি সব সময় পাশে থেকেছেন। আপনি বরং এখন একটু রেস্ট নিন ভাইয়া। আজকে রাতটা আমি মিহানের এখানেই থাকবো।
অনুপম আর কথা বাড়ায় না। রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

অনুপমের পিছু পিছু শ্রেয়সীও বেরিয়ে যায়। কিচেনে গিয়ে দুই কাপ চা করে। শ্রেয়সী জানে নিতুর এখন ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। মুখে না বললেও শ্রেয়সী বুঝতে পারছে। নিতু মৃত ব্যক্তি বা মৃত ব্যক্তির বাড়ি কোনোটাই সহ্য করতে পারে না। বেশিক্ষণ থাকলে অজ্ঞান হয়ে যায়। আজকে মনে হয় বন্ধুর জন্যই অলৌকিক শক্তি এসে ভর করছে।

শ্রেয়সী নিতুকে এক কাপ চা দেয়। নিতু প্রথমে না করলেও শ্রেয়সীর জেদের সামনে হার মানে। এমনিতেও তার মাথা ভীষণ ব্যথা করছে। শ্রেয়সী আরেক কাপ চা নিয়ে অনুপমের রুমে প্রবেশ করে। অনুপমকে রুমে পায়ে বারান্দায় যায়। শ্রেয়সীর সন্দেহই ঠিক। অনুপম বারান্দায় আছে। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। শ্রেয়সী কিছু বলার আগেই অনুপমও ডেকে ওঠে,

শ্রেয়সী?
এই নিন চা খান। ভালো লাগবে।
তুমি খাবে না?
আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না।

আমারও এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। বার বার মেঘলা আর মিহানের কথা মনে পড়ছে। বারবার মনে হচ্ছে ওদের পরিণতিটা এমন নাহলেও পারতো। মেঘলা আর মিহানের বিয়েটা ছিল একদম অসম্ভব। সেখানে আল্লাহ্ মিহানকে আশার আলো দেখিয়ে কেড়ে নিলেন মেঘলাকে।
অনুপম চায়ের কাপটা নিয়ে রেলিংয়ের ওপর রাখে। শ্রেয়সী অনুপমের পাশে এসে দাঁড়ায়।

হাত দিয়ে গ্রিল আঁকড়ে ধরে। মৃদু স্বরে বলে,
ধন্যবাদ।
কেনো?
সবকিছুর জন্যই। আপনি যেমন আমার সব বন্ধুদের বিপদে পাশে থাকেন সেটা সত্যিই ধন্যবাদযোগ্য। আপনাকে নিজের জীবনে পেয়ে আমি সত্যিই ভাগ্যবতী। সবসময় দেখে এসেছি প্রেমিকরা কখনো প্রেমিকার বন্ধুদের সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আপনি ব্যতিক্রম।

জীবনে ভালো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সেই ভাগ্য সবার কপালে জুটে না। তোমার একটা ভীষণ সুন্দর বন্ধুমহল আছে সেটা শক্তভাবে আগলে রাখবে। আমারও একটা বন্ধু ছিল যে মিহানের মতো ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল।
শ্রেয়সী এক পলক তাকায় অনুপমের দিকে।

রূপম ভাইয়া আর আমি একসাথে পড়লেও আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিল পিয়েল। আমাদের ফ্রেন্ডশিপের এমন বন্ডিংয়ের স্কুল কলেজে বিখ্যাত ছিলাম। একজন না গেলে স্যার আরেকজনকে জিঙ্গেস করতো তোর লগেরটা কই। স্কুলের সামনে ঝালমুড়িওয়ালাটাও জানতো আমাদের বন্ধুত্বের কথা। কলেজ থেকে ওর একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক শুরু হয়। মেয়েটা পিয়েলের ব্যাপারে ছিল উদাসীন।

আমার মনে হতো মেয়েটা পিয়েলকে ব্যবহার করছে। আমি পিয়েলকে অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। ওর একটাই যুক্তি ছিল। মেয়েটা তাকে অনেক ভালোবাসে, অনেক কেয়ার করে। কিন্তু মেয়েটা নাকি নিজের ভালোবাসা সবার সামন প্রকাশ করে না। মেয়েটা যতক্ষণ পিয়েলের পাশে থাকতো পিয়েল ততক্ষণ ভীষণ হাসিখুশি থাকতো। মেয়েটা ফোন রিসিভ না করলে পিয়েল পাগলামো শুরু করতো। ওর এমন পাগলাটে রূপ দেখে আমার আর কিছু বলার সাহস হতো না। কলেজ জীবনের সমাপ্তি ঘটলো। আমরা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং শুরু করলাম। বিভিন্ন ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিলাম।

হুট করে পিয়েল জানতে পারে মেয়েটা নাকি কোনো এক প্রবাসীকে বিয়ে করে নিয়েছে। পিয়েল অনেক কাকুতি মিনতি করে ফিরে আসার জন্য। মেয়েটা পিয়েলকে অপমান করে। পিয়েল ভীষণ ভেঙে পড়ে। আমরা সবাই পিয়েলকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করে বাসায় ফেরার জন্য রওনা দেই।

কিন্তু আমাদের আর বাসায় ফেরা হয় না। বাসায় ফেরার পথেই জানতে পারি পিয়েল সুইসাইড করেছে। আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভীষণ দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে পিয়েল আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। আমি রোজ পুড়ি অনুতাপের আগুনে। বার বার মনে হয় সেদিন যদি বাসায় না ফিরে পিয়েলের পাশে থাকতাম তাহলে হয়তো পিয়েল আজকে আমাদের মাঝে থাকতো।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩২

শ্রেয়সী আনুপমের দিকে তাকায়। অনুপমের চোখের কোণে অভি চিক চিক করছে। বন্ধুত্বগুলো এমনই হয়। একজন না থাকলেও আরেকজনের মনের ভিতর সে ঠিকই বেঁচে থাকে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩৪