শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩০

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩০
তাসনিম জাহান রিয়া

নিতু আড় চোখে তাকিয়ে দেখে ইভা বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।
দাদু আমি তাহলে আসি।
এখনি চলে যাবে? একটু কিছু মুখে দিয়ে যাও।
দাদু ও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দেরি হলে যদি রাগ করে।
ওমা সে কী বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছো কেনো? যাও ভিতরে নিয়ে আসো।

দাদু ওর হাতে একদম সময় নেই। ও পেশায় একজন বিজনেসম্যান। কাজের কতো প্রেসার।
তুমি খুব লক্ষী মেয়ে। আমার নাতনিটা যদি একটু বুঝতো। সারাদিন শুধু ছেলেদের মতো ঘুরে বেড়ায়। ছেলেদের মতো জামাকাপড় পড়ে।
দাদু তাহলে আসি।
আচ্ছা সাবধানে যেও। একদিন তাকে নিয়ে বেড়াতে এসো।
আন্টি আসি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিতু দ্রুত বেড়িয়ে দেখে ইভা একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ানের জন্য দেয়াল টপকাতে পাড়ছে না। নিতু দৌড়ে দারোয়ানের কাছে চলে যায়।
চাচা আপনারা অনেক কষ্ট হয় না?
হুট করে নিতুর বলা কথা শুনে চমকে ওঠে দারোয়ান। অবাক হয়ে বলে,
কীসের কষ্ট?

এই যে সারাদিন আপনাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতো এতো মানুষ যাতায়াত করে আপনাকে একবার গেইট খুলতে হয় আরেক বার লাগাতে হয়। সারাদিন আপনাকে কতো কষ্ট করতে হয়। এদের এতো উপকার করেন তবুও এরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। আপনার সাথে কেউ ভালো ব্যবহার করে না।
তন্ময় সিটি বাজাতেই নিতু দৌড়ে বেরিয়ে যায়। নিতুর দৌড়ে যাওয়ার কিয়ৎক্ষণ পরেই দারোয়ান কিছু একটা আন্দাজ করে নিতুর পিছনে দৌড়ে যায়। নিতু ততক্ষণে গাড়িতে ওঠে গেছে। মিহান গাড়ি স্টার্ট করে ফেলছে। শ্রেয়সী জানালা দিয়ে মাথা বের করে দারোয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

আপনার বড় ম্যাডামকে বলে দিয়েন আমাদের আটকানোর সাধ্য উনার কেনো উনার মৃত পতীরও নাই।
মুহিব সিটি মেরে বলে,
ভাই সেই একটা অ্যাডবেঞ্চার হলো। মনে হচ্ছে বিয়ের আসর থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।
প্রিয়ন্তিও মুহিবের কথায় সায় জানায়। মিহান ড্রাইভ করতে করতে মুহিবের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,

মনে করতে হবে না তুই চাইলে আমি সত্যিই সত্যি বিয়ের আসর থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ফিল দিতে পারি। তুই বললে আমি এক পায়ে রাজি তোর বোনকে বিয়ের আসর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
তোমরা তো বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখছো কষ্ট তো করতে হয়েছে আমাকে আর নিতুকে।
তন্ময় হেসে বলে,

মামা তুমি এখন বুঝতে পারছো না। বিয়ের পর ঠিকই টের পাবা মাইয়া মানুষ কী জিনিস। আমার জীবনে আমার মা, অনন্যা আর এই চার বান্ধুনীরে দেখেই বিয়ের সখ মিটে গেছে। কী চিজ মাইরি। জীবনডা পুরা ভাঁজা ভাঁজা করে দেয়। আম্মু উঠতে বসতে আব্বুকে বলবে, আমি বলে তোমার সংসার করছি, অন্য কেউ হলে লাথি মেরে চলে যেতো। এটা মহিলাদের কমন ডায়লগ।

তন্ময়ের কথায় মেয়েরা ফুঁসে ওঠে। শ্রেয়সী তন্ময়ের চুল টেনে বলে,
মেয়েদের তোর জিনিস মনে হয়? মেয়েদের নামে এসব বলে আবার মেয়েদের পিছনেই ঘুরঘুর করিস। দুমুখো সাপ।
মিহান তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বলে,
বিয়ে হচ্ছে দিল্লিকা লাড্ডু। খাইলেও লস, না খাইলেও লস।
আমি, জেনে শুনে বিষ করেছি পান।
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।
যতই দেখি তারে ততই দহি,
আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,
তবু পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি,
লই গো বুক পেতে অনল-বাণ।
যতই হাসি দিয়ে দহন করে,
ততই বাড়ে তৃষা প্রেমের তরে,
প্রেম-অমৃত-ধারা ততই যাচি,
যতই করে প্রাণে অশনি দান।

মিহান গুনগুন করে গান শুরু করে। সাথে তাল মেলায় সবাই। হইহই করতে করতে সবাই মিহানদের ফার্ম হাউসে পৌছায়। খাবার দাবারের আয়োজন মিহান আগে থেকেই করে রেখেছিল। সব নিয়ে তারা ছাদে আড্ডা দিতে চলে যায়। নিতু কোকের গ্লাস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলে,
এটা হচ্ছে গরিবের মদ।
মুহিব নিতুর দিকে ঝুঁকে বলে,
দোস্ত আমার না একটা জিনিস দেখতে ইচ্ছে করছে?
নিতু চমকে বলে,
কী?

কী না বল কাকে? আমার তোর বিজনেসম্যান জামাইকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আমাদের এতো বড়লোক দুলাভাই থাকতে আমরা কোকাকোলা দিয়ে পার্টি করছি।
নিতু মুহিবকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
একদম মজা নিবি। আজকে মজা নিলে আমার কাছ থেকে অর কোনো হেল্প পাবি না।
আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট দুলাভাইকে বলি তার তোর জন্য গাঞ্জা নিয়ে আসতে?
ইভার কথার মাঝেই তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্কিনে বাবা নামটা দেখেই চমকে ওঠে ইভা। সবাই ইভার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভার পাশেই মুহিব বসে ছিল। ইভা ফোনটা রিসিভ করেই মুহিবের হাতে ধরিয়ে দেয়। মুহিব ভয়ে ঢুক গিলে। মিন মিন করে বলে,

হ্যালো।
কী ব্যাপার তোমাদের?
মুহিব হকচকিয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
আংকেল আপনি যেমনটা ভাবছেন ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। আবার আপনি যেমনটা ভাবছেন না ব্যাপারটা ঠিক সেরকমও না।
তুমি আমার সাথে ফাজলামো করছো?

ইভার বাবার গম্ভীর গলা শুনে ঠাস করে ফোন কেটে দেয় মুহিব। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলে,
তোর বাপ এমন করে কথা বললো কেনো? একদম আমার ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছে।
মুহিবের কথা শেষ হতেই সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। নিতু ব্যঙ্গ করে বলে,
আংকেল আপনি যেমনটা ভাবছেন ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। আবার আপনি যেমনটা ভাবছেন না ব্যাপারটা ঠিক সেরকমও না।

রাত একটা অব্দি চলে তাদের আড্ডা। এরপর সবাই ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে নিচে নেমে যায়। অনুপমের কল আসায় শ্রেয়সী ছাদেই থেকে যায়। অনুপমের সাথে কথা শেষ করে পিছনে ঘুরতেই শ্রেয়সী চমকে যায়। শ্রেয়সীর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ন্তি।
শ্রেয়সী?
শ্রেয়সী চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে যায়।
আমার ওপর রাগ করে আছিস তাই না?
আমার কারো প্রতি রাগ নেই।

আমি কিছুদিন ধরে তোর সাথে বহুবার কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। আমার ভিতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। তোর সাথে ওরকম ব্যবহার করা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস কর নাহিন তোর সাথে এমন ব্যবহার করেছে সেটা আমি জানতাম না। তুই বলেছিলি না তোর জেঠু অন্য একটা ছেলের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছেন। তুইও অনুপম ভাইয়ার সাথে রাগ করে হ্যাঁ বলে দিয়েছিস। এই নিয়ে তুই সবসময় টেনশনে থাকতি।

তোকে টেনশন করতে দেখে আমার একদম ভালো লাগতো না। তাই আমি নাহিনকে তোর আর অনুপম ভাইয়ার রিলেশনের কথা বলেছিলাম। নাহিন যদি কিছু করতে পারে। কিন্তু নাহিন যে এই ব্যাপারটা নিয়ে এরকম করবে আমি ভাবতে পারিনি। দোষটা আমারই। আমার বলা উচিত হয়নি নাহিনকে। আমার জন্যই সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। আমাকে তুই ক্ষমা করে দে প্লিজ। আমি আর পারছি না। আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে আমার জন্য সুন্দর একটা সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলো। আমার জন্য তোদের ভাই-বোনের সুন্দর একটা বন্ডিং নষ্ট হয়ে গেলো। আমার জন্য যখন সবকিছু হয়েছে।

আমিই সবকিছু ঠিক করে দিব। তোদের মাঝখান থেকে অনেক দূরে চলে যাব। আমাকে তুই প্লিজ ক্ষমা করে দিস।
বলতে বলতে প্রিয়ন্তি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। পরমুহূর্তেই দৌড়ে চলে যায়। শ্রেয়সী আকাশের দিকে তাকায়। সে দ্বিধান্বিত। সে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। শ্রেয়সী চায় না তার ভাইয়ের আর প্রিয়ন্তির সম্পর্ক নষ্ট হোক। প্রিয়ন্তি দূরে চলে গেলেও তার আর নাহিনের সম্পর্ক কোনোদিন ঠিক হবে না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৯

তাদের মাঝে অনেকটা দূরত্ব চলে এসেছে। সম্পর্কে একবার ফাটল ধরলে সেই ফাটল সহজে জোড়া লাগে না। শ্রেয়সী ভীষণ অসহায়বোধ করছে। শ্রেয়সী চোখ বন্ধ করে ফেলে। বন্ধ চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। শ্রেয়সীর মুঠোবন্দি ফোনটা বেজে ওঠে।
শ্রেয়সী একবার বাইরে আসবে? আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩১