রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১৩

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১৩
নবনী নীলা

অভ্র ঘুমিয়ে পড়তেই আদিল অভ্রকে কোলে করে বেরিয়ে এলো। রুমটায় ঘণ্টা খানেক ছিলো তারা। আদিল অভ্রর রুমে এসে অভ্রকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই খেয়াল করলো স্নিগ্ধা একপাশে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধার চোখে মুখে বিষণ্ণতা স্পষ্ট। তবুও স্নিগ্ধা বিছানায় অভ্রর একপাশে বসলো। তারপর স্বাভাবিক ভাবেই বললো,” ঘুমিয়ে পড়েছে?”

আদিল পকেটে এক হাত ভরে বললো,” হুম্।” আদিলের মনে হচ্ছে স্নিগ্ধা তাকে হয়তো আজ সত্যিটা বলার জন্যে জোর করবে। জোর করলে সে বলবে স্নিগ্ধাকে। সেই মানসিকতা নিজেই ওই রুম থেকে বেরিয়েছে আদিল। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে স্নিগ্ধা কোনো প্রশ্ন করলো না। অভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,” আপনি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি আছি অভ্রর কাছে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদিল থমকালে স্নিগ্ধার এমন স্বাভাবিক আচরণে। আদিল নির্বিকার দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধা অদ্ভূত এক আচরণ করছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না। আদিল তপ্ত এক নিশ্বাস ফেলে রূম থেকে বেরিয়ে এলো।
স্নিগ্ধা নিশ্চুপে কিছুক্ষণ আনমনে বসে রইলো। কত প্রশ্ন আছে তার মনে। কিন্তু প্রশ্নগুলো সে করতে পারলো না কেনো? আচ্ছা প্রশ্ন করতে হবে কেনো তাকে?

প্রশ্ন না করলে আদিল কি কখনই তাকে কিছু জানবে না? তাহলে কি তার জানবার কোনো অধিকার নেই। স্নিগ্ধা নিরবে নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর অভ্রর পাশে ঘুমিয়ে পড়লো।
আদিল ফ্রেশ হয়ে স্নিগ্ধাকে নিজের রুমে না দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে আদিল বের হয়ে এলো। অভ্রর রুমে এসে সে থমকে দাড়ালো। স্নিগ্ধা অভ্রকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আদিল মৃদু হাসলো তারপর তোয়ালে কাধের দুপাশে রেখে এগিয়ে এলো। চাদরটা দুজনের গায়ে তুলে দিয়ে সে ড্রীম লাইট অন করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

স্নিগ্ধার ঘুম ভাঙলো দেরিতে। সে ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো। অভ্র এখনো ঘুমিয়ে আছে। অভ্র বেলা করেই ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু স্নিগ্ধার সকাল বেলায় উঠার অভ্যাস। আজ এতো বেলা হলো কেনো সে জানে না। জানালা দিয়ে সকালের রোদের আলো অভ্রর মুখে এসে পড়ছে। স্নিগ্ধা উঠে গিয়ে জানালায় পর্দা টেনে দিলো। তারপর নিজের রুমে চলে গেলো।
আজ উঠতে দেরী হওয়ায় সে সকাল সকাল গোসল সেরে নিলো।

স্নিগ্ধা ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। চুলের পানি মুছে তোয়ালে একপাশে রাখতে গিয়ে স্নিগ্ধার চোখ পড়ল একটি সাদা খাম যার ঠিক উপরে একটি লাল গোলাপ। স্নিগ্ধা আশেপাশে তাকালো এই ঘরে আদিল আছে কিনা? আদিলের থাকবার কথা নয় কারণ বেশ বেলা গড়িয়েছে। স্নিগ্ধা নিশ্চিত হয়ে গোলাপসহ খামটি হাতে নিলো। আগে সাদা খামটি খুললো। খামের ভিতরে লাল কাগজে সাদা রঙের বলপেন দিয়ে লেখা,

তোমার বইয়ের পাতার ভাজে,
আমার দেওয়া গোলাপটির জন্যে
একটু জায়গা হবে কি?

স্নিগ্ধা চোখ পিট পিট করে তাকালো। এইটা কে রেখেছে? তার জন্যেই কি রেখেছে? এই বাড়িতে তো সে বাদে কোনো মেয়ে নেই। তাহলে এইটা আদিল লিখেছে তার জন্যে? আদিল তাকে এতো ভালো করে জানে কিভাবে? সে যে বইয়ের পাতায় ফুল রাখতে পছন্দ করে সেটা তো আদিলের জানার কথা না।

হটাৎ লোকটা তাকে ফুল দিতে গেলো কেনো? এমন লাল গোলাপ তাও আবার। ভালোই নাটকীয়তা করতে পারে এই ছেলে। কাল রাতে একবারো ভালো করে কথা বলেনি। আর এখন সকাল সকাল ফুল দিয়ে মন গলানোর চেষ্টা। চেষ্টায় যে ব্যার্থ হয়েছে এমনটাও নয়।

স্নিগ্ধা লাল গোলাপটা হুমায়ূন আহমেদের লেখা তার প্রিয় বই ” অপেক্ষা “। সেই বইয়ের পাতার ভাজে গোলাপটি রেখে দিলো। সাদা খামটি তার ফেলতে ইচ্ছে করলো না। সেটাও সে সযত্নে বইয়ের একটা পাতার ভাঁজে রেখে দিলো।
কিন্তু স্নিগ্ধা এতো বোকা নয়। সে ঠিক সেই রকম আরেকটা খাম বানালো। বানিয়ে সেটা হাতে মুড়িয়ে পাশের ঝুড়িতে ফেলে দিলো। আর বাগান থেকে একটা গোলাপ এনে তার পাঁপড়ি ছিঁড়ে সেই ঝুড়িতে ফেলে দিলো। স্নিগ্ধাকে হাতে পাওয়া এতো সহজ না আবরার ফাইয়াজ।

স্নিগ্ধার মনটা এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে। এই ফুলগুলো দেখে আদিলের কি চেহারা হয় সেটাই দেখবার পালা।
বেলা বারোটার দিকে স্নিগ্ধার ফোন বেজে উঠলো। স্নিগ্ধা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো অচেনা নাম্বার। স্নিগ্ধা কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরতেই এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো। ওপাশ থেকে বললো,” কেমন আছো, স্নিগ্ধতা?”

স্নিগ্ধা একটু অবাক হলো। নাম্বারটা তার চেনা নয় আর এই কণ্ঠ সে এর আগে কখনো শুনেনি। পরিচিত কারোর সাথে এই কণ্ঠের মিলও নেই। অথচ লোকটা তার নাম জানে আর এমনভাবে কথা বলছে যেনো তাকে চিনে। স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে বললো,” কে আপনি?”

ওপাশ থেকে ভারী গলায় বললো,” তুমি আমাকে চিনবে না।”
স্নিগ্ধা বেশ বিরক্ত হলো তারপর বললো,” কি জন্যে ফোন করেছেন আপনি ?”
ওপাশ থেকে হালকা হাসির শব্দ পেলো স্নিগ্ধা। হাসি থামিয়ে ওপাশ থেকে বললো,” নতুন জীবন শুরু করেছে তাই শুভেচ্ছা জানতে ফোন করেছি। যদিও বেশি দেরি করে ফেলেছি। আফটার অল তুমি আবরার ফাইয়াজের ওয়াইফ শুভেচ্ছা তো তোমাকে দিতেই হতো।”

স্নিগ্ধা লোকটার কথা বুঝতে না পেরে বললো,” মানে?”
ওপাশ থেকে বললো,” মানে বুঝতে পারা কি আর এতো সহজ? তোমাদের ছেলেটা কেমন আছে? আমার জানা মতে বাচ্চাটা তো তোমার না। ঠিক বলেছি না?”
স্নিগ্ধা বেশ রেগে গিয়ে বললো,” আপনার মনে হচ্ছে না, আপনি বেশি বলছেন?”

” নাহ্, একদমই না। আমি মোটেও বেশি বলছি না।ঠিক কোন সত্য চাপা দেওয়ার জন্যে আবরার ফাইয়াজ তোমাকে ব্যাবহার করছে সেটা জানার আগ্রহে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি নিজেই দিশেহারা।”
স্নিগ্ধার বেশ রাগ হলো ফোনটা কেটে দিতে নিলো তখনই ওপাশ থেকে লোকটা হেসে বলল,” আরে আরে, রেগে গিয়ে ফোন কাটার আগে আমার নামটা তো জেনে নিবে। আমার নাম ফাহাদ রেজওয়ান আর আমি কে সেটা না হও তুমি নিজেই খুঁজে বের করো।” বলেই ওপাশ থেকে কল কেটে দিলো।

স্নিগ্ধার প্রাথমিক অবস্থায় ভীষন রাগ হলো। কিন্তু এই লোকটার কথা গুলো তার মাথায় বাসা করে নিয়েছে। সত্য চাপা দিতে তাকে ব্যাবহার করছে মানে? আদিল তাকে ব্যাবহার করছে এই কথাটাই যেনো তার মাথায় গেঁথে গেলো। কি আড়াল করতে চাইছে আদিল?

জিম বিরক্তি মুখে স্পৃহার কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনেও সে এমন কাজ করে নি। কিন্তু এই মেয়ের জন্যে তাকে এই কাজ করতে হচ্ছে। একে একে সব মেয়ে বের হয়েছে স্পৃহার কোনো হদিস নেই।
কলেজ ছুটির প্রায় বিশ মিনিট পর স্পৃহা ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বের হলো। তার প্ল্যান সফল, এই রবোমানবকে উচিৎ শিক্ষা আজ দেওয়াবে সে। স্পৃহা এসে দাড়াতেই জিম তাড়া দিয়ে বললো,” এতো লেট কেনো? তোমার ক্লাস কি বিশ মিনিট দেরিতে শেষ হয়?”

স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে বললো,” হয়, আমার ক্লাস হয়। আপনার কোনো সমস্যা?”
জিম কথা বাড়াতে চায় না চটজলদি গাড়ীর দড়জা খুলে বললো,” উঠো।”
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,” আজব গাড়ি সঙ্গে এনেছেন কেনো? আপনার কি পা নেই? হাঁটতে পারেন না। নাকি ব্যাটারি শেষ হয়ে যায় হাঁটলে।”

জিম তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। স্পৃহা দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি এমন ঢং করে বাড়ি ফিরতে পারবো না। আমি রোজ যেমন হেঁটে বাড়ি ফিরি আজও সেভাবে ফিরবো।”
জিম ভ্রূ কুচকে বললো,” তুমি হেঁটে বাড়ি ফিরবে? তাহলে আমাকে শুধু শুধু ডেকে আনার মানে কি?”
স্পৃহা রেগে গিয়ে বললো,” আপনাকে ডেকেছি। কিন্তু আপনাকে কোলে করে গাড়ী নিয়ে আসতে বলেছি? আশ্চর্য। আর আপনি না দেখবেন? আমাকে কারা ডিস্টার্ব করে? গাড়িতে করে গেলে আমাকে তারা ডিস্টার্ব করবে কি করে।”

জিম গাড়ীর দরজা সজোরে ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করে বললো,” চলো।” অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলে স্পৃহার সঙ্গে হাঁটা দিলো। এই মেয়ে এতো অদ্ভূত কেনো? জিম স্পৃহার পিছে পিছে হাঁটছে। আর আশেপাশে তাকাচ্ছে। কোথায় কেউ তো নেই। শুধু শুধু এই মেয়ে তাকে ঘুরাচ্ছে।

হটাৎ স্পৃহা গোলাপের দোকান দেখে হুট করে এক দৌড় দিলো। জিম তীব্র বিরক্তি নিয়ে পিছু পিছু এলো।এই মেয়ে নিশ্চই এখন বলবে না, যে এই দোকানদার তাকে ডিস্টার্ব করে।
স্পৃহা দোকানদারের সাথে প্রায় দশমিনিট দাম নিয়ে বার্গেনিং করলো তারপর। তিনটা গোলাপ কিনলো। মাঝে জিম বলেছিলো কথা না বাড়াতে, স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে বললো,” এই থামুন তো আপনি। আমি টাকার গাছ লাগিয়েছি তো, যে টানবো আর টপ টপ করে পড়বে।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১২

জিম এই মুহুর্তে তীব্র বিরক্তি নিয়ে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে আছে। স্পৃহা ফুলগুলো থেকে একটা ফুল জিমের দিকে এগিয়ে দিতেই জিম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো,” আমার লাগবে না।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১৪