রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ২

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ২
নবনী নীলা

” তোমাকে দেখছি।”, বলেই আদিল আরো গভীরভাবে তাকালো তারপর মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” হুম, তুমি দেখতে সুন্দর, তাই মিডিয়ার এতো বাড়াবাড়ি। এই জন্যেই তোমাকে মিসেস আবরার ফাইয়াজ ভেবে বসে আছে।” বলতে বলতে হাত দুটো নামিয়ে দুই পকেটে ভরে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো।

স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে বললো,” কে এই আবরার ফাইয়াজ?” স্নিগ্ধা এই নামটি বহুবার শুনেছে। কিন্তু কখনো জানা হয় নি কে সে। সামনে দাড়িয়ে থাকা এই ছেলেটি কি তাহলে আবরার ফাইয়াজ?
আদিল মেয়েটির এমন প্রশ্নে অবাক হলো। তার ধারণা ছিলো মেয়েটি তাকে চিনবে, কিন্তু না মেয়েটি তাকে চিনে পর্যন্ত না। ব্যাপারটা তার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো। আদিল একটু ভেবে বললো,” কে আবরার ফাইয়াজ?” বলেই জিমের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,” এইযে ও, না মানে উনি। উনিই তো আবরার ফাইয়াজ।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জিম হতবাক হয়ে গেলো। স্নিগ্ধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো তারপর বললো,” আপনি এতো কিছুর পরও রসিকতা করছেন আমার সাথে? মানছি, হতে পারে আপনি খুব বড় কেউ তাই বলে পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ আপনাকে চিনবে সেটা ভুল। আপনার কাছে বিষয়টা খুব স্বাভািকভাবে হতেই পারে। কিন্তু আমার কাছে সেটা নয়। আপনি ভাবতেও পারছেন না এই সামান্য একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমার পরিবার আর আমাকে কিসের মুখোমুখি হতে হবে।” বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্নিগ্ধা।

আদিল একটু ঝুকে এসে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,” জাস্ট কুল ডাউন। ব্যাপারটা এতটাও জটিল না যতটা তুমি মনে করছো। নিউজ তো বেরিয়েছে আমাকে নিয়ে। প্রকাশ্যে এলো আবরার ফাইয়াজের স্ত্রী আর সন্তান।”
এতটুকু শুনেই স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে বললো,” ওই বাচ্চাটা আপনার? আপনি এতো বডিগার্ড নিয়ে ঘুরেন অথচ নিজের ছেলের জন্যে কাউকে রাখতে পারেন না? আর স্ত্রী সন্তান প্রকাশ্যে এলো মানে কি? আপনার স্ত্রী কোথায়?”

আদিল অবাক হয়ে সামনের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো। এক নিঃশ্বাসে এতোগুলো প্রশ্ন করলো মেয়েটি তারপর মাথা নিচু করে মৃদু হেসে বললো,” আমার স্ত্রী নেই, আমি সিঙ্গেল ফাদার। তাই অভ্রকে সবার আড়ালে রেখেছি। তবে এখন আর কোনো সমস্যা নেই। মিসেস আবরার ফাইয়াজকে তো আমি পেয়েই গেছি।”

স্নিগ্ধা চোখ বড় বড় করে তাকালো। সিঙ্গেল মাদার শুনেছে সিঙ্গেল ফাদার আবার কি? ছেলেটির শেষের কথাটি সে যেনো শুনতেই পেলো না, সিঙ্গেল ফাদার কথাটিতে সে আটকে আছে। স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে বললো,” মানে? সিঙ্গেল ফাদার আবার কি জিনিস? আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার ডিভোর্স হয়ে গেছে? নাকি উনি মারা গেছেন?”

স্নিগ্ধা খেয়াল করলো হটাৎ ছেলেটি সিরিয়াস হয়ে তাকালো। স্নিগ্ধা ভয় পেলো না দ্বিতীয় বারের মতন বললো,” নাকি আপনারা মেরে ফেলেছেন? ছেলেকে আড়াল করে রেখেছেন কি এই কারণে? ছেলেটা সামনে এলে সেই কথাগুলোও সামনে আসবে সবার।” বলতে বলতে স্নিগ্ধা নিজেই বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো।

আদিল এগিয়ে এসে স্নিগ্ধার দুপাশে হাত রেখে শান্ত ভঙ্গিতে মেয়েটির চোখের দিকে তাকালো তারপর বললো,” অভ্র আমার ছেলে। ব্যাস এইটুকু জানলেই হবে। ভুলেও আর কিছু জানার চেষ্টাও করবে না। আর হ্যা, আজ থেকে তুমি মিসেস আবরার ফাইয়াজ। বুঝতে পেরেছো?”

” মানে কি? মনগড়া গল্প বানালেই হলো? কি ভেবেছেন কি এই অপবাদ আমি মেনে নিবো?”,রাগে কাপতে কাপতে বললো স্নিগ্ধা।
আদিল আরেকটু এগিয়ে এসে বললো,” তোমাকে কেউ অপবাদ দিচ্ছে না। এটা কোনো অপবাদ নয়। আর আমরা কোনো মনগড়া গল্প বানাচ্ছি না। হয়তো এইটাই হবার ছিলো। চাইলেও তুমি আমি কেউই সেটা বদলাতে পারবো না।”

স্নিগ্ধা আর চুপ করে থাকতে পারলো না। রেগে গিয়ে বললো,” অপবাদ নয় তো কি? নিজের পরিবারের সবাইকে ঠকানোর মতন অপবাদ মেনে নিবো এইটাই বলতে চাইছেন তো? দেখুন আপনি গিয়ে সবাইকে বলুন যে এইসব মিথ্যে নয়তো আমি গিয়ে বলছি।”

বলেই স্নিগ্ধা বেড থেকে নেমে যেতেই আদিল স্নিগ্ধার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললো,” নাহ্, তুমি যেতে পারবে না। এইসব করে কোনো লাভ হবে না। এতে বিষয় গুলো আরো বাজে হয়ে উঠবে। ভয় পেও না তোমার ফ্যামিলির সাথে আমি কথা বলবো।” আদিল চাইছে মেয়েটি যেনো তাকে ভরসা করতে পারে।

কিন্তু স্নিগ্ধা ছিটকে দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,” আপনি না আমার মাকে চিনেন না।”
আদিল মৃদু হেসে সোজা হয়ে দাড়ালো তারপর বুকের কাছে হাত গুজে বলল,” চিনে নিতে কতক্ষন? আফটার অল হবু শাশুড়ি বলে কথা।”

স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে তাকালো। লোকটা কি পাগল? এতো সহজে একটি মেয়েকে নিজের বউ মেনে নিচ্ছে। লোকটা এইসব রটিয়ে দেয় নি তো? স্নিগ্ধার মনের মধ্যে সন্দেহ জাগলো। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস জুগিয়ে না উঠতেই তার ফোনের রিং শুনতে পেলো সে। বেডের পাশের টেবিলে নিজের ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। মা ফোন দিয়েছে। নামটা দেখেই ঘাম ছুটছে তার। তাহলে কি সবটা জানাজানি হয়ে গেছে। তাকে এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হবে। স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যাগটা নিয়ে বেড ছেড়ে উঠে পড়লো।

আদিল একটা ভ্রু তুলে কঠিন গলায় বললো,” বয়ফ্রেন্ড ফোন করেছে নাকি?” ফোন পাওয়ার পর মেয়েটির এমন হন্তদন্ত দেখে সে প্রশ্ন করেই ফেললো।
স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো,”কেনো আপনার কোনো সমস্যা?”
” হ্যা, অবশ্যই সমস্যা আছে। কারণ যেটা আমার সেটা শুধু আমারই। কারোর ছায়াও আমি এলাও করি না।”, সিরিয়াস হয়ে বললো আদিল।

” দেখুন বাড়াবাড়ির একটা লিমিট থাকে।”, বলতে বলতে থেমে গেলো স্নিগ্ধা সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। যা বলার বলুক এই আবরার ফাইয়াজ। বললেই তো আর হয়ে যাচ্ছে না। এখন তার বাসায় ফিরতে হবে। লোকটার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার মানে নেই।

স্নিগ্ধা রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই আদিল বললো,” চলে যাচ্ছো যখন, শ্বশুর বাড়ির অ্যাড্রেস টা তো দিয়ে যাও।” স্নিগ্ধা সজোরে রূমের দরজা ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করলো। দরজাটা গিয়ে যদি লোকটার মুখের উপর পড়তো খুব ভালো হতো। তার মনটা খুশি হতো।

আদিল ভ্রু কুচকে জিমের দিকে তাকালো তারপর বললো,” সী জাস্ট ইগনোর মাই ওয়ার্ড। আবরার ফাইয়াজকে অ্যাটিটিউড দেখিয়ে চলে গেলো। আমার ওকেই চাই। এই নিউজটা কনফার্ম করার ব্যাবস্থা করতে বল।” বলেই সে মৃদু হাসলো।

এইমুহুর্তে সে স্নিগ্ধার বাড়িতে উপস্থিত। দোতলা একটা বাড়ি। বাড়িটা সাজানো বেশ সাদাসিধে ভাবে তবুও দেখতে ভারী সুন্দর লাগছে। বসতে না বসতেই স্নিগ্ধার মা মানে আয়েশা খাতুনের একের পর এক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো। আদিল যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে সে সবটা গুছিয়ে তারপরই এসেছে। জিম নিজেও অবাক কারণ আদিল খুব কৌশলে আয়েশা খাতুনের অনেকটা ভরসাই অর্জন করতে পেরেছে।

আয়েশা খাতুন সবটা শুনলেন। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান নি, চুপ করে শুনছেন। সবটা শুনে এবার তিনি গম্ভির গলায় প্রশ্ন করলেন,” তোমারা দুজনে সম্মতিতে বিয়ে করেছ, যদি তাই হবে? আমার মেয়ে কেঁদে কেটে বলছে কেনো সে বিয়ে করেনি।”

জিম ভেবেছিল আদিল এই প্রশ্নে আটকা পড়বে। কিন্তু না আদিল হেসে বললো,” আপনার মেয়ে রাগ করেছে, এইভাবে মিডিয়ার ইন্টারফেয়ার ওর পছন্দ হয় নি। তাই অভিমান করে বলেছে।”
আয়েশা খাতুন হাই স্কুলের প্রিন্সিপাল আবরার ফাইয়াজ নামের এই ছেলেটির এমন মার্জিত আর গুছানো কথা বার্তায় তিনি বেশ সন্তুষ্ট। ছেলেটাকে ওনার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তিনি সেটা প্রকাশ করলেন না। গম্ভীর মুখে বললেন,” বাচ্চাটাকে এইখানে আনার ব্যবস্থা করো।” বলেই তিনি উঠে গেলেন।

আদিল একটা নিশ্বাস ফেলে সোফায় গা এলিয়ে দিল। পুরো দুঘন্টার ইন্টারভিউ শেষ হয়েছে তার। বুয়েটের ভাইভা পরীক্ষায়ও সে এতো নার্ভাস হয় নি। জিম আদিলের এমন অবস্থা দেখে খানিকটা মজার ছলে বললো,” স্যার হবু শাশুড়িকে আপনার কেমন লাগলো।?”

আদিল ভ্রু কুঁচকে তাকালো তারপর ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো,” অনেক ভালো। দোয়া করি আল্লাহ যেনো সবাইকে এমন একটা শাশুড়ি দেয়। একা আমি কেনো ভুক্তভুগী হবো?” জিম ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললো,” স্যার, সবাই আপনার মতন এতো বুদ্ধির ভান্ডার নিয়ে ঘুরে না। এমন শাশুড়ি হ্যান্ডেল করা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার।”
আদিল উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো,” হুম, যাই হোক আপাদত অভ্রকে আনার ব্যবস্থা করো।” জিম আদিলের কথামত সে ব্যাবস্থা করতে গেলো।

আদিল সারা বাড়ি ঘুরে বেড়িয়ে দেখতে লাগলো। বাড়িতে এই মুহুর্তে কাজের মেয়েটি আর তার শাশুড়ি ছাড়া কেউ নেই। স্নিগ্ধা কোথায়? বাড়িতে নেই? দোতলার শেষের ঘরটা পেরিয়ে যেতেই দেখলো। সে ঘরে গুটিসুটি মেরে স্নিগ্ধা শুয়ে আছে। বাড়িটার আসে পাশে বিরাট কোনো বিল্ডিং নেই। গাছ পালাও আছে। তাই প্রচুর বাতাস। বাতাসে স্নিগ্ধার রূমের দরজা খুলে গেছে।

আদিল কৌতূহল বশত ঘরের ভিতরে এলো। এমন অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে আদিল বেশ চিন্তিত মুখে স্নিগ্ধার পাশে এসে দাড়ালো। ঘুমন্ত এই মেয়েটির চোখে মুখে ক্লান্তি স্পষ্ট। ধূসর রঙের বালিশটির এক পাশ ভিজে আছে কান্নায়। এমন ঠান্ডা বাতাসে ঘুমের মাঝেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সে। বাতাসে সামনের চুলগুলো উড়ে এসে মেয়েটির মুখ ঢেকে দিয়েছে। আদিল হাত বাড়িয়ে চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ অপলকে তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধার দিকে। তারপর মৃদু হেসে একপাশে রাখা চাদরটা টেনে গায়ে তুলে দিলো স্নিগ্ধার। প্রথম দেখায় মেয়েটি তাকে মুগ্ধ করেছে। এতটা মুগ্ধ হবার কারণ সে সত্যি জানে না।

আয়েশা খাতুন স্নিগ্ধার রুমে এসেছিল মেয়ের খোঁজ নিতে। বকাবকির পর কেঁদে কেটে কি করেছে কে জানে? ঘরে ঢুকে তিনি আদিলকে স্নিগ্ধার গায়ে চাদর টেনে দিতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। মনে সে কষ্ট পেয়েছেন ঠিকই তবে ছেলেটিকে তিনি যতই দেখছেন ততই মুগ্ধ হচ্ছেন।
তিনি ভেবেছিলেন তাকে দেখে ছেলেটি বেশ অপ্রস্তুত হবে কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে আদিল চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলো,” স্নিগ্ধা দুপুর থেকে কিছু খায় নি?”

আয়েশা খাতুন অবাক কারণ স্নিগ্ধা যে খায়নি মা হয়ে তিনি নিজেই সেটা খেয়াল করেন নি। তিনি উত্তরে কিছু বললেন না। এগিয়ে এসে স্নিগ্ধার গায়ে হাত রেখে দেখলেন জ্বর এসেছে কিনা? তারপর এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর ভারী মুখে জিজ্ঞেস করলেন,”তোমাদের এই বিয়ে আর বাচ্চটাকে সবার থেকে লুকিয়ে রাখার কারণ কিন্তু এখনো আমার কাছে স্পষ্ট হয় নি। যদি এতোই সমস্যা ছিলো, তাহলে বিয়েটা করলে কেনো?”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১

আয়েশা খাতুন উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেলেন। স্নিগ্ধা পড়ালেখার কারণে বেশ কয়েকবছর তাদের থেকে দূরে ছিলো। বছরে একবার আসা যাওয়া করতো। সে সময়টা নিয়েই তিনি মেয়েকে অবিশ্বাস করে বসলেন। একটা রুম ভাড়া করে স্নিগ্ধা আর তার এক বান্ধবী থাকতো। তাই সবটা এখনো তার কাছে ঘোলাসে।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩