রঙিন রোদ পর্ব ১০

রঙিন রোদ পর্ব ১০
নাজমুন বৃষ্টি

‘মৃত্তি,সিয়াকে হয়ত কেউ পরিকল্পিত’ভাবে খুন করার চেষ্টা করেছে। ওই গাড়িটার ড্রাইভার পুরোপুরি সুস্থ, শুধু একটু হাতে ব্যথা পেয়েছে।’
-‘ম… মানে?’

-‘ড্রাইভারটার ভাষ্যমতে, সিয়া দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে গাড়িতে উঠে বসছিল। ড্রাইভারটা যাবে না বলা সত্ত্বেও সিয়া জোর করে তাড়াতাড়ি গাড়িটা চালু দিতে বলেছিল। যার ফলে ড্রাইভার অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাড়ি ছেড়েছিল। সিয়া ড্রাইভারকে জোর করে বলার সময় ভীষণ হাঁফাচ্ছিল আর বারেবারে পেছনের দিকে কী জানি দেখছিল। সিয়া তখন অনেক ভয়ে ছিল। গাড়ি ছাড়ার পর সিয়া কাকে জানি কল করে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু হাঁফানোর কারণে কথা স্পষ্ট ছিল না। ঠিক সেসময় কোথ থেকে হঠাৎ করে বিপরীত দিক থেকে একটা বড়ো মালবাহী ট্রাক এসে সিয়াদের গাড়িটাকে ধাক্কা মারে যার ফলে ড্রাইভার সামনের কাঁচে মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারায়। ড্রাইভারের চোখ বুজার আগে দেখেছিল, সেই ট্রাকটা থেকে কেউ একজন তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল। যার ফলে ড্রাইভার সম্পূর্ণ নিশ্চিত, কেউ পরিকল্পিত-ভাবে সিয়াকে খুন করার চেষ্টা করেছে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ এ… এস… এসব কী বলছিস তুই রিনি? আ… আমার সিয়া’র সাথে কার এতো শত্রুতা যে তাকে প্রাণে মেরে দিতে চাইছে!’
-‘আজকে কিছুক্ষন আগে সিয়া’র সেইদিনের গাড়ির ড্রাইভারটা খোঁজ নিয়ে হাসপাতালে এসে সিয়ার মা-বাবাকে সব বলে গেল। নাহলে ভাব?ড্রাইভারটা নিজে সামনে থেকে তেমন একটা আঘাত পায়নি অথচ সিয়া! সে পেছনে থাকার পরেও ড্রাইভারের চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে। আর ডাক্তাররা কাল ঠিকই বলেছিল, সিয়ার পেটে ছুরির আঘাত।’

মৃত্তিকা স্তব্ধ হয়ে হাসপাতালের করিডরে ধপ করে বসে পড়ল। তার আপাতত কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সে শুধু মনে-প্রাণে প্রার্থনা করছে, সিয়া যেন খুব তাড়াতাড়ি আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠে।
মৃত্তিকা এখনো হাসপাতালেই আছে। কাল রাতে রিনি হাজার জোর করেও মৃত্তিকাকে বাসায় নিতে পারেনি। তার এক কথা, সে সিয়াকে একা রেখে যাবে না নাহলে সিয়া সুস্থ হয়ে মৃত্তিকার উপর অভিমান করে থাকবে। মৃত্তিকার কারণে রিনিও আর যায়নি। বাসায় ফোন করে বলে দিয়েছে।

-‘হ্যালো স্যার?’
-‘কী অবস্থা ওইদিকে?’
-‘স্যার, আসলে… আমি মেরেছি কিন্তু বেঁচে গিয়েছে ওই মেয়েটা।’
-‘শেষ করে দাও।’ আগন্তুকটি নিজের খারাপ লাগাকে আড়ালে ঢেকে শক্ত কণ্ঠে আদেশ দিল অপর পাশের লোকটাকে।
-‘ওকে স্যার।’
ফোন রেখে আগন্তুকটি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা মলিন শ্বাস ফেলল। এই জীবনে সে অনেক হত্যার আদেশ দিয়েছে কিন্তু আজকের মতো এতটা খারাপ লাগা কাজ করেনি। তার আজ এই কথাটা বলতে গলা কেঁপেছিল। তার বড্ড খারাপ লাগছে আজ কিন্তু সে যে নিরুপায়!

সন্ধ্যা কেটে গিয়ে চারদিকে ধীরে ধীরে রাতের নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরছে। আস্তে আস্তে দিনের আলো ঢেকে গিয়ে গুটগুটে আঁধারে পরিণত হচ্ছে চারপাশ। মৃত্তিকা হাসপাতালের একটা ক্যাবিনের সামনে দরজাতে হেলান দিয়ে মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে চোখ বুজে আছে।
আজ দুইদিন কেটে গিয়েছে অথচ সিয়ার জ্ঞান ফেরার নাম-গন্ধ নেই। রিনিকে মৃত্তিকা জোর করে সকালের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটা যেতে চায়নি কিন্তু মৃত্তিকার জোরাজোরির ফলে বাধ্য হয়ে গিয়েছিল।

আর কয়দিনই বা এখানে থাকবে! মৃত্তিকা কোথাও গিয়ে মন বসাতে পারবে না বিধায় এখানে রয়ে গিয়েছে। সে জানে, বাসায় অথবা হোস্টেলে গেলে প্রতি পদে পদে সিয়ার কথা মনে পড়বে। তার চেয়ে এখানে সিয়ার পাশে থেকে মনকে শান্ত রাখতে পারলেই হলো। মৃত্তিকা নিজেকে সামলে নিবে। পাশের ক্যাবিনে সিয়ার মা দুর্বল অবস্থায় শুয়ে আছে আর সিয়ার বাবা ভারাক্রান্ত মনে বসে আছে। তাদের একটা মাত্র মেয়ের আজ এই অবস্থা মানতে পারছে না। মৃত্তিকার আজ কেন জানি মন ভীষণ খারাপ। কেন- সেটার উত্তর মৃত্তিকার কাছে নেই। সিয়ার সাথে কাটানো সবদিন’গুলো তার ভীষণ করে মনে পড়ছে।

মৃত্তিকার পাশের দরজা খোলার আওয়াজ হতেই দেখলো, সিয়ার ক্যাবিন থেকে নার্স বের হচ্ছে। এই নার্সগুলোর কারণে মৃত্তিকা তার সিয়ার কাছে যেতে পারে না। আজকের সম্পূর্ণ দিন মিলে একবারও সিয়াকে কাছ থেকে দেখতে পারেনি মৃত্তিকা। আজ সে সুযোগ হাত-ছাড়া করবে না।
নার্স বেরিয়ে যেতেই মৃত্তিকা আস্তে আস্তে মেঝে থেকে উঠে দরজার কাঁচ দিয়ে সিয়ার দিকে তাকালো। সে আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ক্যাবিনে ঢুকে সিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। শোয়া অবস্থায় সিয়াকে দেখতে একদম নিষ্পাপ লাগছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে! একদম পুতুলের মতো।

-‘স… সিয়া… এই সিয়া?’
-‘জানিস? আজ কী হয়েছে? তুই তো সারাদিন শুয়ে থাকিস তাই বাইরের কোনো কথা’ই শুনতে পাচ্ছিস না। আর কয়দিন এভাবে আমার সাথে কথা না বলে থাকবি বল? নার্সগুলো সারাদিন তোর পাশে থাকে। আমাদের একটু ঢুকে দেখতেও দেয় না তোকে। তাই আজ নার্স একটু করে বের হতেই চুরি করে ঢুকে গিয়েছি। ভালো করেছি না বল?’ বলতে বলতেই মৃত্তিকা হেসে উঠল। সে জানে, আজও সিয়া থেকে সে কোনো প্রতিউত্তর পাবে না কিন্তু তবুও সে একের পর এক আজকের ঘটা সব কথা সিয়াকে শোনাতে লাগলো।
তার আশা, যদি প্রতিদিনের ন্যায় সিয়াকে মৃত্তিকার সম্পূর্ণ দিনের রুটিন না পড়ে শোনায় তাহলে একদিন সিয়া সুস্থ হয়ে উঠে মৃত্তিকার উপর রাগ করে গাল ফুলিয়ে বলবে,’আমি সুস্থ থাকলে তুই তোর সম্পূর্ণ দিনের কথা আমাকে না বলে থাকতে পারতিস না অথচ আমি অসুস্থ হয়ে শুয়ে যাওয়ার পর তুই আমাকে তোর দিনের রুটিন শোনাসনি। কেন রে? আমি শুয়ে গিয়েছি বলে! অথবা আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর পাবি না বলে? আমি ভীষণ রাগ করেছি তোর উপর।’ তখন মৃত্তিকা হেসে সিয়াকে জড়িয়ে ধরলেই সিয়া হেসে দিবে। মুহূর্তের মধ্যে সিয়ার সব রাগ ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।

মৃত্তিকা এসব ভাবতে ভাবতেই হাসতে লাগলো। এরপর আরো কিছু মনে পড়তেই সিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলো। হঠাৎ মৃত্তিকা খেয়াল করলো, সিয়া হাত নাড়াচ্ছে। মৃত্তিকা প্রথমে চোখের ভ্রম মনে করে পাত্তা না দিলেও পরে যখন সিয়া ধীরে ধীরে চোখ খুলে তার দিকে তাকালো তখন মৃত্তিকা খুশিতে হেসে সিয়ার কপালে এলোপাতারি চুমু দিতে দিতে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘স… এই সিয়া। ত..তুই উঠছিস? আমি জানতাম তুই উঠবি। তুই আমাকে ফেলে কোথাও যাবি না। দাঁড়া আন্টিকে ডেকে নিয়ে আসি। একটু অপেক্ষা কর।’ বলেই মৃত্তিকা হেসে পেছন ফিরে সিয়ার মা-বাবাকে ডাকার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিতেই পেছন থেকে সিয়া তার হাত ধরে ফেলাতে মৃত্তিকা থেমে গেল।

মৃত্তিকা ফিরে সিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো সিয়া মৃত্তিকা’কে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে আর তাকে ইশারা করে তার কাছে ডাকছে।
মৃত্তিকা হাসি-মুখে সিয়ার একদম কাছে এগিয়ে যেতেই সিয়া তার ক্যানেলা লাগানো কাঁপা কাঁপা হয়ে মুখের অক্সিজেন মাস্কটা খোলার চেষ্টা করছে। হাতে ক্যানেলা লাগানোর ফলে তার হাতে রক্ত উঠে গিয়েছে সেদিকে সিয়ার খেয়াল নেই। সে মৃত্তিকাকে ইশারা করে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।
মৃত্তিকা তাড়াহুড়ো করে সিয়াকে থামিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘ক…কী করছিস সিয়া? হাতে ব্যথা পাবি তো। মুখের অক্সিজেন মাস্ক কেন খুলছিস!’
সিয়া মৃত্তিকার উত্তেজিত রাগী রাগী কণ্ঠ দেখে দুর্বল অবস্থায় কন্দনরত চোখে ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা আনতে চেষ্টা করলো।
সিয়ার চোখ গড়িয়ে অঝোরে ধারায় অশ্রু নির্গত হচ্ছে। মৃত্তিকা তার একদম কাছে এগিয়ে যেতেই সিয়া কাঁপা কাঁপা হাতে তার অক্সিজেন মাস্কটা টেনে খুলে হাঁফাতে লাগলো। তা দেখে মৃত্তিকা রেগে সিয়ার মুখে জোর করে মাস্কটা পড়িয়ে দিতে গিয়ে সিয়ার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কিছু শুনে থমকে গেল।

-‘আ… আ…মার স.. ময় খ.. খু… ব কম। ত… তুই সাবধানে থাক… থাকিস মৃত্তি।’
মৃত্তিকা হুশে নেই। কী বলছে এসব সিয়া!
সিয়ার শ্বাস ক্রমশ ভারী হচ্ছে। সে কোনোমতে শ্বাস টেনে হাঁফাতে হাঁফাতে শোয়া থেকে উঠার চেষ্টা করলো।
-‘ত… তু… র স.. সামনে অনে… ক ব… বিপদ। সা…সাব… ধা… নে থা… কিস।’ বলতে বলতেই শুয়ে পড়লো সিয়া। সিয়া শুয়েই কাঁপা কাঁপা হাতটা মৃত্তিকার দিকে বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। মৃত্তিকাকে ছোয়ার আগেই সিয়া শুয়ে আস্তে আস্তে চোখ বুজে ফেলল।

রঙিন রোদ পর্ব ৯

মৃত্তিকা সিয়াকে চোখ বন্ধ করে ফেলতে দেখে উত্তেজিত কণ্ঠে সিয়াকে ছুঁয়ে ডাকতে লাগলো। সিয়াকে চোখ না খুলতে দেখে মৃত্তিকা দ্রুত ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে পাগলের ন্যায় ডাক্তারকে ডাকতে লাগলো। ডাক্তার তাড়াহুড়ো করে এসেই সব পরীক্ষা করে দেখে একটা মলিন শ্বাস ফেলল। তাদের সব চেষ্টা বিপলে গেল।

রঙিন রোদ পর্ব ১১