রঙিন রোদ পর্ব ১১

রঙিন রোদ পর্ব ১১
নাজমুন বৃষ্টি

সিয়া চলে যাওয়ার অনেকদিন পেরিয়ে গিয়েছে। এখনো মৃত্তিকা সিয়াকে প্রচুর মিস করে। কী থেকে কী হয়ে গেল সে এখনো ভেবে উঠতে পারে না।
-‘তোকে বড্ড মিস করি সিয়ু। কেন এভাবে আমাকে একা করে চলে গেলি! যেখানেই থাকিস,ভালো থাকিস সিয়ু।’ বলতে বলতেই মৃত্তিকার দু’চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হলো। এখন কান্না করা সেটা প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

মৃত্তিকা চোখ মুছে ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকলো। পাশেই গুনগুন করে এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে একটা মেয়ে পড়ছে। সিয়া চলে যাওয়ার পর হোস্টেলের কর্মরত ম্যামটা অন্য আরেকটা মেয়েকে মৃত্তিকার সাথে শেয়ার দিয়েছে। মেয়েটা মৃত্তিকা থেকে জুনিয়র। সবসময় পড়ার উপর থাকবে। মেয়েটাকে যতবার সিয়ার জায়গায় শুতে দেখবে ততবার তার বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয়। ইচ্ছে করে, সিয়া আসুক- আগের মতো গল্প করুক। মৃত্তিকা যদি একবার সিয়াকে কাছে পেত! জড়িয়ে ধরতে পারতো মেয়েটাকে! তাহলে সব মন খারাপ নিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে যেত।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘আপু? তোমার শরীর ঠিক আছে? চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছে যে!’
মৃত্তিকা একটা মলিন শ্বাস ফেলল।
-‘হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি।’ বলেই মৃত্তিকা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল ফ্রেস হতে। সিয়া চলে যাওয়ার পর সম্পূর্ণ দিনটার রুটিন’ই বদলে গিয়েছে। আগে মৃত্তিকা ক্লাস শেষ করে এসে ফ্রেস হতে না গেলে সিয়া রেগে গিয়ে বকা দিতে দিতে মৃত্তিকাকে ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে লক করে দিতো। যাতে মৃত্তিকা ফ্রেস হওয়া ছাড়া বের হতে না পারে। এরপর মৃত্তিকা ফ্রেস হয়ে আসতে আসতে সিয়া রান্নার কাজ শেষ করে খাবার নিয়ে মৃত্তিকার জন্য অপেক্ষা করতো। মৃত্তিকা বের হওয়ার পর একসাথে খেত।

মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই দিনগুলো এখন বড্ড মিস করে। এখন আর কেউ মৃত্তিকাকে নিয়ম-মাফিক চলার জন্য উপদেশ দেয় না। এখন আর কেউ মৃত্তিকা খাবে না বললেও জোর করে টেনে-হিচড়ে তুলে খাইয়ে দেয় না। এখন আর কেউ, মৃত্তিকা ঘুমিয়ে পড়লে পানি ঢেলে দিয়ে ঘুম থেকে তুলে না। মৃত্তিকা ক্লাসে না গেলেও এখন আর কেউ রেগে যায় না। তাকে এখন আর কেউ আগলে রাখে না। কতদিন হয়ে গেল, আজ কারো সাথে মন-খুলে হেসে হেসে আড্ডা দিচ্ছে না মৃত্তিকা। সবকিছুর পেছনে একমাত্র ‘সিয়া’। সিয়া এখন আর তার কাছে আসে না। মৃত্তিকাকে এসে ছুঁয়ে দেয় না। মৃত্তিকা রেগে থাকলেও কেউ এসে হাসাতে চেষ্টা করে না। তার এখনো বিশ্বাস হয় না, মেয়েটা না-কি আর নেই। মৃত্তিকার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গিয়েছে – যেখান থেকে চাইলেও আর ফিরে আসা যায় না। এসব ভাবতেই মৃত্তিকার চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হলো। সে পাশ ফিরে তাকাতেই খেয়াল হলো,ওয়াশরুমে না ঢুকেই মৃত্তিকা ভাবনায় ডুব দিয়েছে। পাশে নিধি মেয়েটা তার পড়া রেখে মৃত্তিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

-‘আপু, তোমার ব্যাচমেট সিয়া আপুকে মিস করছো?’
মৃত্তিকা কন্দন-রত চোখে মলিন হাসলো।
-‘সিয়ুকে কী ভোলা যায়?’ এরপর পরই মৃত্তিকা দ্রুত পদে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ওয়াশরুমে ঢুকতেই কল ছেড়ে দিয়ে সে মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। প্রতি পদে পদে সিয়াকে মনে পড়ছে। সে সিয়াকে ছাড়া কীভাবে বাঁচবে। বাইর থেকে মৃত্তিকা নিজেকে শক্ত রেখে সবার সাথে হেসে হেসে কথা বললেও ভেতরে ভেতরে তার হৃদয় যে পুড়ে যায়। ক্লাসে, হোস্টেলে সব জায়গায় সে সিয়াকেই কল্পনা করে। মৃত্তিকা কাঁদতে কাঁদতে মাথা চেপে ধরলো। সে যে তার সিয়ুকে ছাড়া নিজের জীবনটা কল্পনা করতে পারছে না। তার কলিজাকে কেউ যেন টেনে-হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে মৃত্তিকার। সিয়ার কথা মনে পড়লেই মৃত্তিকার মাথা ঠিক থাকে না। হঠাৎ মাথা তুলে পানির দিকে তাকিয়ে সে একটা শপথ নিলো।

-‘সিয়া পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার পিছনে যে মানুষটার হাত আছে। তাকে মৃত্তিকা একদিন না একদিন খুঁজে বের করবেই। মৃত্তিকা নিজ হাতে সেই আগন্তুককে খুন করবে। মৃত্তিকার অস্তিত্বের এক অংশকে যে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করেছে। তাকে মৃত্তিকা নিজ হাতে যতদিন পর্যন্ত তাকে খুন করতে না পারবে ততদিন মৃত্তিকার তৃষ্ণা মিটবে না।’

লুৎফর আহমেদ হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় ব্যাডে শুয়ে আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় আছেন তিনি। পাশেই বাসার সবাই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। লুৎফর আহমেদের পাশে ঈশানের মা আমেনা রহমান শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরে কিছুক্ষন পর পর কান্নার সুর তুলতেছে। রুমি আহমেদ ভাইয়ের পাশে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের দরজার একপাশে রিনি আর আরেক পাশে মৃত্তিকা দাঁড়িয়ে আছে।

কাল রাতের দিকে লুৎফর আহমেদ বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পথে তার গাড়িতে কেউ একজন গুলি করে। প্রথম গুলিটা গাড়ির কাঁচ ভেদ করে লুৎফর আহমেদের হাত বরাবর পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আবারও গুলি ছুড়া হলো, সেই গুলিটা একদম টার্গেট করে মারার ফলে লুৎফর আহমেদের মাথায় এসে পড়ে। এরপর একে একে গুলি ছুড়তে লাগলো। ভাগ্য ভালো, ড্রাইভার অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন হওয়ায় পরবর্তী গুলি করার আগেই কোনোমতে গাড়িটা জোরে টান মারে যার ফলে পরপর আর বাকি গুলিগুলো কারো কোনো ক্ষতি করতে পারে নাই। লুৎফর আহমেদ প্রথম গুলিটার আওয়াজ শুনে সরে যেতে চেয়ে গাড়ির সাথে মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এরপর অজ্ঞান অবস্থায় সোজা গুলি এসে মাথায় পড়ে। ড্রাইভার ঐদিকে খেয়াল না দিয়ে গাড়িটা এক টানে বাসায় নিয়ে আসে।

লুৎফর আহমেদকে হাজার চেষ্টা করেও কেউ হাসপাতালে নিতে পারেনি। তার এক কথা, তিনি এই বাসা থেকে নড়বেন না। তবুও বেশি আঘাত পাওয়ায় হাসপাতালের কয়েকজন চেনা-পরিচিত ডাক্তার বাসায় এসে সময়-মতো দেখে যায়। আর দুইজন নার্স লুৎফর আহমেদের দেখা-শোনার জন্য সবসময় বাসায় থাকে। আজ দুইদিন যাবৎ তার অবস্থা এমন। কোনো উন্নতি হচ্ছে না। যতই দিন যাচ্ছে উনার ততই অবনতি হচ্ছে।

উনাকে দুর্বলতা আস্তে আস্তে আরো অসুস্থ বানিয়ে ফেলছে। এখন কথা বলে ধীরে ধীরে। বাসার সবাই চিন্তিত। তারা ঈশানকে খবর দিতে চাইলে লুৎফর আহমেদ কড়াভাবে নিষেধ করেন। ঈশান ভুলেও যেন তার এই অবস্থা সম্পর্কে অবগত না হয়। লুৎফর আহমেদের কড়া নিষেধাজ্ঞা শুনে বাসার কেউ আর ঈশানকে খবর দেওয়ার সাহস পায় নাই।
বাসার কেউ ভাবতে পারছে না। হঠাৎ লুৎফর আহমেদের শত্রু কই থেকে আসবে! এতো বছর কঠোর পরিশ্রম করে তিনি আজ বিশাল বড়োলোক। কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি কোনোদিন। সবসময় গরিব-অসহায় মানুষদের দান করতো। হঠাৎ কোথ থেকে আড়ালে এতো শত্রু হয়েছে!

রঙিন রোদ পর্ব ১০

সেদিনের পর আরো বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো কিন্তু লুৎফর আহমেদের সুস্থ হওয়ার নাম-গন্ধ নেই। তিনি আস্তে আস্তে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন আর শোয়া থেকে উঠতে পারে না। উনার দিন কাটে সারাদিন এক রুমে শুয়েই। এতদিন বুঝা না গেলেও এই কয়েকদিনের উনার চেহারায় বার্ধক্যের চাপ পড়ে গিয়েছে। মৃত্তিকার উনাকে দেখে ভীষণ মায়া হয়। কী মানুষ কেমন হয়ে গেল!

রঙিন রোদ পর্ব ১২