রঙিন রোদ পর্ব ৩

রঙিন রোদ পর্ব ৩
নাজমুন বৃষ্টি

ক্লাসে যেতেই মৃত্তিকাকে দেখে অনেকের মধ্যে কানাকানি শুরু হয়ে গিয়েছে। মৃত্তিকা ঢুকতে ঢুকতেই এসব বুঝে গিয়েছে। আর সবাই কানাকানি করবেও বা না কেন! ঈশান স্যারের সাথে মৃত্তিকার বিয়ে বলে কথা। মৃত্তিকা এসবের দিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো।

-‘কিরে মৃত্তিকা! এসব কী শুনছি?’ মৃত্তিকার পাশের জন বলে উঠল।
-‘ তোর না কি ঈশান স্যারের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে? কীভাবে? আর তুই তো কাল ঈশান স্যারের বিয়ে খেতে গেছিলি!’
মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেই বিষয়টা আড়ালে রাখতে চেয়েছিল সেটাই হলো। দেয়ালেরও কান আছে কথাটি আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মৃত্তিকা। মৃত্তিকা কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই ঈশান ক্লাসরুমে ঢুকতেই মুহূর্তের মধ্যে সবাই চুপ হয়ে গেল। মৃত্তিকা একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাসে মনোযোগ দিল। ঈশান ভাই সবসময় গম্ভীরভাবেই থাকে যার ফলে সবাই উনাকে ভয় পায়, এই সবার মধ্যে মৃত্তিকাও আছে। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ঈশান ভাই প্রতিদিনের ন্যায় ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে যেতে নিতেই আবারো সবার কানাকানি শুরু হয়ে গেল। সবার এই কানাঘুষার ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পেরে পেছন ফিরে আবারো ক্লাসে ঢুকে মৃত্তিকাকে দাঁড় করিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘অনাকাঙ্খিতভাবে মৃত্তিকা আমার ওয়াইফ। আশা রাখি, কেউ ওকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করে বিভ্রান্ত করবে না। পড়াশোনা করতে এসেছো সবাই, পড়াশোনার দিকেই ফোকাস দাও। গুড লাক।’ বলেই বেরিয়ে গেল ক্লাসরুম ছেড়ে। এরপর পরই শোনা গেল ঈশান ভাই আর ক্লাস করাতে আসবেনা। উনি দেশের বাইরে চলে যাবেন। মৃত্তিকার একটু খারাপ লাগলেও পাত্তা দিলো না। হয়ত এতদিন দেখতে দেখতে মায়া জন্মে গিয়েছে। মৃত্তিকার হঠাৎ আদিবের কথা মনে পড়লো। সে আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও আদিবের চিন্হও দেখতে পেল না। ছেলেটা কী আজকে ক্লাস করতে আসেনি!

কিন্তু সে তো ক্লাস মিস দেওয়ার মতো ছেলে নয়। মৃত্তিকা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে আদিবের নাম্বারে কল লাগাতেই ওইপাশ থেকে বিরক্তিকর আওয়াজটা কানে বাজলো। মোবাইল বন্ধ। মৃত্তিকার চিন্তা হতে লাগলো। সে আদিবের ভালো বন্ধু কয়েকজন থেকে জানতে পারলো সে অসুস্থ। ‘আদিব অসুস্থ’ কথাটি শুনতেই মৃত্তিকার বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হলো। মৃত্তিকার একটু মাথা ব্যথা হলেই ছেলেটা প্রাণ দিয়ে দেয় অথচ আদিব আজ দুইদিন ধরে অসুস্থ কিন্তু মৃত্তিকা কোনো খোঁজই নিতে পারলো না। মৃত্তিকা ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে আদিবের নাম্বারে আবারো কল দিল কিন্তু এবারও আগের মতোই বন্ধ শুনালো। মৃত্তিকা আদিবের কয়েকজন বন্ধুকে ওর খোঁজ নিয়ে জানাতে বলল। তারা এসে জানালো আদিব আগে থেকে একটু সুস্থ আর কাল ক্লাসে আসবে। এটা শুনেই মৃত্তিকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, একটা চিন্তা কমলো মাথা থেকে।

পরদিন আদিব গেট দিয়ে ঢুকতেই মৃত্তিকা দৌড়ে এগিয়ে গেল। ছেলেটাকে কেমন জানি অগোছালো লাগছে। হয়ত অসুস্থতার জন্য দুর্বলতা গ্রাসঃ করেছে। আদিব মৃত্তিকার সাথে তেমন কোনো কথা বলেনি। এমন কোনো দিন নেই যে আদিব মৃত্তিকার সাথে কথা বলেনি অথচ আজ কী এমন হলো মৃত্তিকার সাথে কথা বলছে না! আদিব মৃত্তিকাকে একদিন না দেখলেই পাগলের মতো আচরণ করে অথচ আজ! কেমন চুপ হয়ে গিয়েছে ছেলেটা! মৃত্তিকা মনে করলো হয়ত অসুস্থ তাই। কিছুসময় পর আদিব নিজে থেকেই শান্ত কণ্ঠেই সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে উঠল,

-‘তোমার না কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে মৃত্তি? বলো না, এটা মিথ্যে। তুমি আমার আগের মৃত্তিই আছো। বলো না, এসবকিছু মিথ্যে।’ বলতেই বলতেই আদিব মৃত্তিকার দিকে ফিরে উত্তেজিত হয়ে উঠল।
মৃত্তিকা হঠাৎ থমকে গেল আদিবের এমন আচরণে। তার নিজেরও এতক্ষন খেয়াল ছিল না সে যে বিবাহিত সেটা।
-‘আদিব, এটা একটা দুর্ঘটনা। কীভাবে যে হয়ে গেল আমি নিজেও ভাবতে পারিনি।’

-‘আচ্ছা, কিছু হবে না। তুমি ঈশান স্যারকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমাদের মাঝে কেউ আসবে না। আমরা এরপর পরই বিয়ে করে অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো মৃত্তি।’বলতে বলতেই মৃত্তিকার দু’হাত আদিব নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করে নিলো।
-‘তুমি যেটা ভাবছো সেটা কোনোদিনও সম্ভব নয় আদিব। আর আমি আগেও বারবার করে বলেছিলাম, এই সম্পর্কের পরিণতি ভালো হবে না। আর এখন এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল আদিব,এখন আমি বিবাহিত।’ বলেই হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আদিব আরো জোরে হাত ধরে রইল মৃত্তিকার। তার একটায় কথা, সে মৃত্তিকার হাত ছাড়বে না।
মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে নিম্ন কণ্ঠে আদিবকে বলে উঠল,

-‘আদিব, হাত ছাড়ো। আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে আছে।’
-‘আমি ছাড়বো না। সবাই তাকিয়ে থাকুক মৃত্তি। তুমি আমার ছিলে আর থাকবে। তোমাকে আমি ছাড়তে পারবো না মৃত্তি। তুমি তো বলছো এই বিয়েটা নিছক দুর্ঘটনা তাহলে চলো না, আমরা বিয়ে করে নিই।’ আদিব আরো জোরে মৃত্তিকার হাত চেপে ধরলো। ব্যথায় মৃত্তিকার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো কিন্তু সেদিকে আদিবের হুশ নেই। আদিব যেন আজ উঠেপরে লেগেছে -মৃত্তিকাকে নিজের মতো করে পাওয়ার।

মৃত্তিকা ব্যথাকাতর চোখে আদিবের দিকে তাকিয়ে রইল। এই ছেলেটাই এতদিন তার চোখের পানি সহ্য করতে পারতো না অথচ আজ কেমন সাইকো রূপ ভর করছে! মৃত্তিকা আজ আদিবের এমন পাগলাটে আচরণ মেনে নিতে পারছে না। আদিবের এমন আচরণের সাথে মৃত্তিকা পরিচিত নয় সে আর কোনোদিন আদিবের এমন রূপ দেখেনি। সে বুঝতে পারছে না, আদিব হঠাৎ করেই এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছে! এদিকে হাতের তীব্ৰ চাপের ফলে হাত ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলল মৃত্তিকা। হঠাৎ তীব্ৰ শব্দে চোখ খুলতেই দেখলো আদিব মৃত্তিকার হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর সামনে ঈশান ভাই রক্তচক্ষু দৃষ্টি দিয়ে আদিবের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিবকে পরপর দুইটা থাপ্পড় মেরে চিৎকার করে বলে উঠল,

-‘তোর সাহস হয় কী করে! মৃত্তিকাকে স্পর্শ করার! তোর এই হাত আজ আমি ভেঙে ফেলবো।’ বলেই আবারো এগিয়ে গিয়ে পরপর দুইটা লাথি দিল আদিবকে। আদিব সহ্য করতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেল।
মৃত্তিকা এখনো স্তব্ধ। কী থেকে কী হয়ে গেল সে ভাবতে পারছে না। হুশ ফিরতেই সে ঈশানের পথ আগলে ধরলো ততক্ষনে আরো কয়েকজন সিনিয়র এসে ঈশানকে থামিয়ে ফেলল। ঈশান এখনো রেগে আদিবের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকজন এসে আদিবকে তুলে নিয়ে গেল।

আদিব চলে যাওয়ার পরেও ঈশান কিছু সময় রেগে দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশের সব মানুষ জড়ো হয়ে তাকিয়ে থাকতেই মৃত্তিকার অস্বস্তি হলো। ঈশান আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে ধমক দিতেই মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ মাঠ খালি হয়ে গেল। এরপর মৃত্তিকার দিকে ফিরতেই মৃত্তিকা গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল।
-‘ওই ছেলের আশেপাশেও যেন আর না দেখি তোকে। ক্লাসে যা।’ বলেই ঈশান গাড়িতে উঠে পড়লো।
মৃত্তিকা ঈশানের গাড়িটি যাওয়ার দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে রইল। তার আদিবের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। ছেলেটা হঠাৎ এমন আচরণ কেন করলো মৃত্তিকা ভাবতে পারছে না। সেদিন আর ক্লাস করার মুড ছিল না বলে মৃত্তিকা হোস্টেলে ফিরে এলো। দিনটা বিতৃষ্ণাই কাটলো।

সারারাত আর ঘুম এলো না। মোবাইল হাতে নিয়েই বুঝতে পারলো আদিবের সাথে যোগাযোগ করার সব পথ ও বন্ধ করে দিয়েছে। ওর মোবাইলটাই বন্ধ। হয়ত রেগে আছে ভীষণ। মৃত্তিকা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
পরদিন যথারীতি ক্লাস করে আসতেই খেয়াল হলো আদিবের ব্যাপারটা। আদিব আজ আর আসেনি ক্লাসে। মৃত্তিকা মোবাইল নিয়ে দেখলো আদিবের নাম্বার তখনো বন্ধ। হয়ত রাগ পড়ে গেলে খুলবে ভেবে মৃত্তিকা আর মাথা দিলো না। কিন্তু দিন যতই যায় তার চিন্তা ততই বাড়ে। আদিব এরপর আরেকদিনও ক্লাসে আসেনি। ঈশান ভাইয়ের সাথেও এরপর আর দেখা হয়নি মৃত্তিকার। তার মাথায় আদিবের চিন্তা বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই একদিন সিদ্ধান্ত নিলো মৃত্তিকা আদিবের বাসায় গিয়ে দেখে আসবে।

রঙিন রোদ পর্ব ২

আদিবের বাসার সামনে গিয়ে তালা দেখে সে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। এই বাড়িতে আদিবের সাথে আরেকবার আসা হয়েছিল যার ফলে বাসা চিনতে কষ্ট হয়নি। মৃত্তিকা আদিবের বাসায় আসাতে কী খুশিই না হয়েছিল ছেলেটা, সম্পূর্ণ বাড়ি মাথায় তুলেছিল এটা-ওটা দেখাতে মৃত্তিকাকে। আদিবের মাও ছেলের খুশিতে এটা-ওটা রান্না করে খাইয়েছিল মৃত্তিকাকে। আদিব আর ওর মা মিলে তাদের ছোট্ট সংসার। আদিব টিউশন করে কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। মাঝে মাঝে মৃত্তিকাও আদিবকে এটা-ওটা দিয়ে সাহায্য করত। ছেলেটা নিতে চায়তো না কিন্তু মৃত্তিকা জোর করে দিতো। মৃত্তিকা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিবের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরে আসলো হোস্টেলে। বাড়ি ছেড়ে যাবেই বা কোথায় ছেলেটা! ছেলেটার কী হয়েছে হঠাৎ করে তা মৃত্তিকা বুঝে উঠতে পারলো না।

রঙিন রোদ পর্ব ৪