রঙিন রোদ পর্ব ৪

রঙিন রোদ পর্ব ৪
নাজমুন বৃষ্টি

সেদিনের পর কেটে গেল আরো কয়েকদিন। সেদিন মৃত্তিকা ক্লাস করে এসে শুতেই ঘুমিয়ে পড়লো। সন্ধ্যার দিকে কারো ধাক্কায় আধো আধো চোখ খুলে দেখলো তার রুমমেট সিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্তিকা চোখ-মুখ কুঁচকে কিছু গালি দিয়ে আবারো শুতে গিয়ে সিয়া বাধা দিতেই মৃত্তিকা উঠে বসলো।

-‘কী? এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আমার ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছিস ক্যান?’
-‘সেটা তোর মোবাইল দেখলেই বুঝতে পারবি। বাইরে ঈশান স্যার অপেক্ষা করছে,গিয়ে দেখ।’
মৃত্তিকা চমকে তাকালো শিয়ার দিকে। ঈশান ভাই এখানে কেন আসবে! বিছানার এক কোন থেকে মোবাইলটা হাতড়িয়ে দেখল গুটি গুটি অক্ষরে একটা মেসেজে লেখা,’ নিচে আয় দ্রুত।’ ব্যাস, মৃত্তিকার জন্য এই একটা মেসেজই যথেষ্ট। ঈশান ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে সবাই অবগত।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তাই মৃত্তিকা আর কোনো বাক্য বিনিময় না করে ওয়াশরুম থেকে মুখে পানির ঝাপ্টা মেরে আলসেমি ভাবটা দূরে রেখে কোনোমতেই উড়না পেঁচিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো গেটের বাইরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে ফোনের দিকে দৃষ্টি ঈশান ভাইয়ের। কালো শার্ট পরিহিত ঈশান ভাইকে আজ যেন অন্যদিনের তুলনায় সৌন্দর্য আরো বেশি ফুটে উঠেছে। মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে ঈশানের সামনে এগিয়ে মাথা নিচু করে বলে উঠল,’ ঈশান ভাই?’
ঈশান ফোন থেকে মাথা তুলে মৃত্তিকার দিকে এক পলক তাকিয়ে মোবাইলটা পকেটে পুরে নিল।

-‘ গাড়িতে উঠ।’
ঈশানের কণ্ঠস্বরটা কানে আসতেই মৃত্তিকা বলে উঠল,
-‘আমাকে বলছেন?’
ঈশান গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে পেছন ফিরে মৃত্তিকার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘তোর আশেপাশে আর কাউকে দেখতে পারছিস?’
মৃত্তিকা ‘না’ বোধক মাথা নাড়তেই ঈশান ইশারা করলো গাড়িতে উঠতে।
মৃত্তিকা বুঝতে পারলো না। এই ভর সন্ধ্যায় কই যাবে। ঈশান মৃত্তিকাকে আর কিছু ভাবতে না দিয়ে হাত ধরে ঠেনে গাড়ির ভেতর সিটে বসিয়ে সিট্বেল্ট বেঁধে দিল।

গাড়ি চলছে আপনগতিতে। ধরণীর বুকে সূর্য ডুবে গিয়েছে পুরোপুরি। আস্তে আস্তে রাতের নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরছে চারদিক থেকে। গাড়ি চলছে এক নীরব- শান্ত রাস্তা দিয়ে। ঈশান আপন মনেই সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। মৃত্তিকা হঠাৎ করে সাহস জুগিয়ে বলে উঠল,
-‘আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত ঈশান ভাই। এই বিয়েটা তো ভিত্তিহীন।’
জানালা দিয়ে ক্ষনে ক্ষনে বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মৃত্তিকাকে। ঈশান মৃত্তিকার কথাটির কোনো জবাব না দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসার ব্যাপারটা খেয়াল করে গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উঠল,
-‘জানালাটা বন্ধ করে দেয়।’

মৃত্তিকা জানালাটি বন্ধ করে দিল। সে হতাশ হলো ঈশানের পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে। এরপর আর কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি। ঈশান গাড়ি থামিয়েছিল এক নিস্তব্ধ শান্ত নদীর তীরে। এরপর মৃত্তিকাকে বের হতে বলল। মৃত্তিকা বের হতেই অনেকক্ষন সেই নদীর তীরে নীরবভাবেই কাটিয়ে দিল দুইজনে।
-‘আমি কাল চলে যাবো।’ সামনের শান্ত নদীর পানির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শান্তকণ্ঠে বলে উঠল ঈশান।
মৃত্তিকা কিছু না বলে নীরব ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তার কীই বা বলার আছে!

-‘তুই সামনে থেকে যা দেখছিস তা হয়ত নাও হতে পারে। আমাকে একা রেখে কোনোদিন চলে যাস না মৃত্তি। আমার জীবনের বড়ো প্রাপ্তি হলো ‘তুই’। তুই ছাড়া এই ঈশানের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। কোনোদিন যদি কোনো সত্যি জানতে পারিস তাহলে ছেড়ে যাবি না তো! আর সবকিছু মিথ্যে হলেও অন্তত তোকে মনেপ্রাণে চাওয়াটা সত্যি থাকবে চিরদিন।’
মৃত্তিকা অবাক দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশানের এই কথাগুলো থেকে একটি কথাও তার মাথায় ঢুকছে না। কেমন জানি রহস্যময় মনে হচ্ছে ঈশান ভাইকে। কী বলতে চাচ্ছে উনি!

-‘ঈশান ভাই, এসব কী বলছেন আপনি?’
-‘সময় হোক, বুঝবি।’ বলেই ঈশান মৃত্তিকার দিকে ফিরে তার হাতটা মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
-‘কথা দেয়। এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বড়ো নিকৃষ্ট সত্যি তোর সামনে আসলেও আমায় ছেড়ে যাবি না মৃত্তিপাখি!’
মৃত্তিকা পলকহীন চোখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশান এখনো তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। মৃত্তিকার কাছ থেকে কোনো প্রতিত্তর না পেয়ে ঈশান তার হাত ফিরিয়ে নিলো। এরপর কী বুঝে গাড়িতে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে মৃত্তিকার উদ্দেশ্যে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
-‘গাড়িতে উঠ।’

মৃত্তিকা এখনো ঘোরের মাঝে আছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। ঈশানের গম্ভীর স্বরে গাড়িতে উঠতে বলাটা কানে আসতেই সে গাড়ির সিটে বসে পড়তেই ঈশান আর কিছু না বলে ড্রাইভ করা শুরু করলো। একটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে মৃত্তিকাকে হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘আমি কাল সকাল সকাল দেশের বাইরে চলে যাবো। ছয়মাস সেখানেই কাটাবো। এর ভেতর কোনো দেখা বা কথা তোর সাথে হবে না। তাই ভাবলাম, যাওয়ার আগের সময়টা তোকে দিয়ে যায়। আলাদা হওয়ার কথা ভুলেও মাথায় আনবি না। ওই বাসায় যাস না আমি বলার আগে। আমার একটামাত্র অনুরোধ – হোস্টেল থেকে ক্লাস বাদে বের হবি না। ভালো থাকিস, নিজের খেয়াল রাখিস আর পড়াশোনা মন দিয়ে করিস।’ বলেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মৃত্তিকার চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল।

মৃত্তিকা কিছুই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারলো না। সন্ধ্যা থেকে রাতের সময়টা ঈশান তার সাথে কাটিয়েছিল ঠিক কিন্তু অপ্রয়োজনীয় একটা কথাও বলেনি তাহলে শুধু শুধু ঈশানের এতো ব্যস্ত সময় থেকে এই সময়গুলো মৃত্তিকাকে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। কালকে চলে যাবে, নিশ্চই আজকের এই রাতটা তার অনেক কাজের রাত ছিল। ঈশান চলে যাবে ভাবতেই বুঁকের কোথাও জানি খুব চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো মৃত্তিকা। হয়ত এতদিনের মায়া।

মৃত্তিকা আর কিছু না ভেবে হোস্টেলে এসে ফ্রেস হয়ে নিলো। আজকে ঈশান মৃত্তিকাকে নদীর তীরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে নিশ্চই কোনো কারণ ছিল। সে হয়ত মৃত্তিকাকে আরো অনেক কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু বলতে পারেনি। ঈশান অনেকবার হয়ত কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতে চেয়েছিল কিন্তু জড়তায় বলতে পারেনি। মৃত্তিকা বিষয়টি খেয়াল করেছিল, সে মনে করেছিল ঈশান হয়ত গাড়িতে হলেও বলবে। কিন্তু বলেনি। মৃত্তিকা ভাবতে পারছে না, কী এমন সত্যি যেটা সামনে আসলে মৃত্তিকা ঈশানকে ছেড়ে চলে যাবে এমন ভয় পাচ্ছে ঈশান!

মৃত্তিকার সেদিন রাত আর ঘুম এলো না। ঈশান ভাইয়ের জন্য কোথাও একটা সূক্ষ্ম ব্যথার অনুভূতির অনুভব হচ্ছিলো। তাই সে সেদিন সকাল সকাল নিজের বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে হাজির। ঈশান ভাইদের গাড়ি এয়ারপোর্ট যাওয়ার উদ্দেশ্যে গেট দিয়ে বের হতেই মৃত্তিকা অনুসরণ করে পেছন পেছন গেল। এয়ারপোর্ট যেতেই ঈশান ভাই যখন সবার সাথে কথা-বাত্রার প্রাথমিক পর্যায় শেষ করে এয়ারপোর্টে ঢুকে যাচ্ছিল তখন দূর থেকেই মৃত্তিকা তাকিয়ে রইল।

ঈশান ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৃত্তিকার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তার চোখ থেকে টুপ্ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে জানে না, ঈশান ভাই আর তার বন্ধনটা আর এগোবে কিনা কিন্তু তবুও কেন জানি কবুল বলার পর থেকেই মানুষটাকে অনেক আপন মনে হয়। দেখতে দেখতেই ঈশান মৃত্তিকার চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। মৃত্তিকা চোখ মুছে লুকিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো হোস্টেলের উদ্দেশ্যে।

কেটে গেল কয়েকদিন। এর ভেতর মৃত্তিকা আর বাইরের কোনো কিছুতে খেয়াল না দিয়ে পড়াশোনায় মন দিল। রিনি জানিয়েছে, ঈশান ভাই সহি-সালামতেই দেশের বাইরে পৌঁছে গিয়েছে। তবে মাঝখানে ভীষণ খারাপ লাগে আদিবের জন্য। আদিব সেদিনের পর থেকে আর আসেনি। মৃত্তিকা শুনেছে, আদিব এখান থেকে চলে গিয়েছে অন্য কোথাও। এই মেডিকেলেও সে আর পড়বে না। এতদিন একসাথে পথ চলা যার ফলে মৃত্তিকার হুট্ করে ভীষণ খারাপ লাগে আদিবের জন্য।

রঙিন রোদ পর্ব ৩

সে তো এটা চায়নি। ঈশান ভাইয়ের সাথে হুট্ করে এভাবে বিয়ে হয়ে যাবে সেটা মৃত্তিকা কল্পনায়ও আনেনি। মৃত্তিকা মনে করেছিল, ঈশান ভাইকে সুযোগ বুঝে ডিভোর্সের কথা জানাবে কিন্তু সেদিনের পর থেকে মনে হচ্ছে না এমন কিছু হবে। তবুও সে চেষ্টা করবে।আদিবের সাথে যদি আরেকবার দেখা হতো তাহলে মৃত্তিকা বুঝিয়ে বলতো। কিন্তু আদিব যে এভাবে চোখের পলকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে তা ভাবেনি মৃত্তিকা। কোথায় খুজবে সে আদিবকে! হয়ত আছে কোথাও লুকিয়ে, মৃত্তিকাকে ধরা দিতে চাচ্ছে না। কালই মৃত্তিকা ঢাকার বাইরে আদিবের গ্রামের বাড়ির খোঁজ নিবে। যেমন করেই হোক, আদিবের সাথে দেখা করবেই মৃত্তিকা।

রঙিন রোদ পর্ব ৫