রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১০

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১০
লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)

অয়নের এঙ্গেজমেন্টে যাওয়ার জন্য একটা লাল রঙের শাড়ি পড়ে নিলাম আমি। সাদিও লাল সুট পড়ে রেডি হচ্ছেন। আপাতত উনি জুতা পড়ছেন সোফায় বসে আর আমি ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল পাফ করছি। ওনাকে দেখে আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

___” আমি তো বান্ধবী বলে যাচ্ছি। আপনি কেন যাচ্ছেন?”
উনি মুচকি হেসে চোখ টিপে বললেন,
___” কেন ভুলে গেলি? এখন তো আমি তোর বর।”
আমি ওনার থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। এই লোকের চোখ টিপ দেয়াটা মারাত্মক।উনি আবারো বললেন,
___” আরেকটা কাহিনীও আছে।গেলেই বুঝবি।”
আমি সম্মতি দিলাম।সাদির সাথে পৌঁছে গেলাম কমিউনিটি সেন্টার।আমাদের আসতে দেখে এগিয়ে এল রুশ। অবাক হয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

___” ইউ আর লুকিং অস্থির ইয়ার।”
আমি চোখ বড় করে তাকালাম। এই পোলা কি পাশে থাকা সাদিকে দেখতে পারছে না? সাদি ভ্রু কুঁচকে রুশের দিকে তাকিয়ে আছে।রুশ আমার হাত ধরে বললো,
___” চল তোকে অয়নের এঙ্গেজমেন্টের জায়গায় নিয়ে যাই। ভালোই ডেকোরেশন করেছে ইয়ার।”
রুশ টানলো। কিন্তু আমি আটকে গেলাম। সাদি আমার হাত ধরে ফেলেছে। রুশ অবাক হয়ে পিছনে ফিরে বললো,
___” কিরে চল!”

আমি পড়েছি গেরাকলে।কি করবো বুঝতেই পারছি না। আমাদের কথা বলতে দেখে সবাই চলে এলো। প্রান্তি,আয়ান,শুভ,সানিয়া সবাই।আমি কি বলবো বুঝতেই পারছি না। সব হয়েছে এই সাদির জন্য। উনি জোর করে বিয়ে না করলে আজ এমন পরিস্থিতি হত না। সাদি আমার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো। আমি ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি বাকি সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

___” ডিয়ার শ্যালক/শালিকারা! মিট মাই ওয়াইফ অনন্যা। ”
আমি চোখ বড় করে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। ওনার হাত আমার কোমড়ে। আর বাকি সবগুলা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মুহুর্তের মধ্যে সবগুলা আমার উপর হামলা দিয়ে বললো,
___” শয়তান! বললি না কেন যে তুই বিয়ে করেছিস!অনেক শয়তান তুই।”
প্রান্তির কথায় আমি অসহায় গলায় বললাম,
___” অনেক বড় কাহিনী। অন্য কোনোদিন বলবো।”
আমার কথার বিপরীতে কেউ কিছু বলতে যাবে তার আগেই অয়ন এসে উপস্থিত হলো। আমাকে বাদে সবার উদ্দেশ্যে বললো,

___” তোরা এসেছিস আমি তো ভীষণ খুশি হয়েছি।”
কেউ কিছু বললো না। ভদ্রতার খাতিরে একটু হাসলো। অয়ন এবার আমার দিকে তাকালো। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
___” অনেকে তো ইনভিটেশন ছাড়াই চলে আসে।”
আমার হাসিটা মিলিয়ে গেলো। প্রান্তি রেগে কিছু বলবে তার আগেই সাদি মুচকি হেসে বললেন,
___” হ্যালো মিস্টার আহমেদ। আমাদের ইনভাইট করার জন্য ধন্যবাদ। ”
অয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমিও অবাক হয়েছি বেশ। অয়ন কখন ইভাইট করলো? অয়ন ভ্রু কুঁচকেই বললো,
___” হোয়াট?”

সাদি কিছু না বলে অয়নের দিকে এগিয়ে গেলো আমার হাত ধরে।তারপর অয়নকে পাস করে ওর পিছনে ওর বড় ভাইয়ের সাথে হাত মিলালো। অ্যনের বড় ভাই অর্ণবও আমাদের মেডিকেলের ডক্টর। অর্ণব হেসে বললো,
___” আরে হাই! অনেকদিন পর দেখা। নেমন্তন্ন রক্ষা করলেন তবে। ”
সাদি হাসলেন।আমাকে দেখিয়ে বললেন,

___” মিট মাই ওয়াইফ অন্যা।”
অর্ণব আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন। হেসে বললেন,
___” ওহহ ইনি তো আমাদের মেডিকেলেরই ছাত্রী। আর এখন আমাদের ভাবীও।”
আমি লাজুক হাসলাম। আর বললাম,
___” ভালো আছেন ভাইয়া?”

অর্ণব হাসলেন। ওনার স্ত্রীর সাথে আমাদের পরিচয় করাতে লাগলেন। সাদিও মিষ্টি হেসে কথা বলছেন। আর আমি ওনার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি। উনি আবারো আমার পাশে দাঁড়ালেন। এভাবেই আমার পাশে থাকবেন তো? খুব ইচ্ছে করছে জিজ্ঞাসা করতে। কি ভেবে যেন আমি পিছনে তাকালাম। অয়ন ভ্রু কুঁচকে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আর মিশমিও ওর পাশে দাঁড়িয়ে রাগে গজগজ করছে। আমার কেন যেন পৈশাচিক আনন্দ হতে লাগলো। আহা!মানুষকে জ্বলতে দেখতে এত সুখ?অয়ন রেগে সেখান থেকে চলে গেলো।আমি মিশমির দিকে চোখ রেখে লো ভয়েজে ঠোঁট নাড়ালাম,

___”জিয়া জ্বালে, জান জ্বালে…”
ও মনে হয় বুঝলো। রাগে আমাকে কিছু বলতে আসতে চাইলো এর মাঝেই আমার বান্ধবী আর বন্ধুরা এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। ইশারা করলো ওদের সাথে যেতে। আমি সাদির দিকে তাকালাম। উনি সম্মতি দিলেন। সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

___” নিয়ে যাও।দেখে রেখো।”
সানিয়া দুষ্টু হেসে বললো,
___” জিজু,দেখে তো রাখবোই।কিন্তু আমাদের ঘুষ আর ট্রিটও দিতে হবে।”
সাদি হেসে বললো,
___” আগে কাজ। পরে ফি।যাও যাও।ইনজয়।”
আমি হেসে ওদের সাথে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। ওরা আমাকে টেনে অয়নদের ওদিকে নিয়ে এলো। মিশমি মনে হয় কারোর সাথে কথা বলছিল। আমাকে দেখে হাসিটা মিলিয়ে গেলো। রাগে লাল হয়ে বললো,

___” তুমি এখানে?”
আমি শয়তানি হেসে কিছু কড়া কথা বলতে যাচ্ছিলাম এর আগেই মিশমির বাবা জয় খান আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
___” আরে আপনি মিসেস সাদি?রুদ্র সাইমানের পুত্রবধু?”
আমি হাসলাম। উনি আমার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন,
___” নাইস টু মিট ইউ ইয়াং লেডি।”
আমিও হাত এগিয়ে দিয়ে বললাম,
___” ভালো আছেন আঙ্কেল?”

___” আমার মেয়ের বিয়েতে এসেছো মামনি,আমি তো খুব হ্যাপি হয়েছি।তোমার শ্বশুড়কেও দাওয়াত করেছিলাম উনি বললেন ওনার ছেলেকে পাঠাবেন।”
___” মাই প্লেজার আঙ্কেল। এন্ড বাবা একটু অসুস্থ তো।আপনার যা ফাইল সাইন করানোর তা নিয়ে সাদির সাথে আলাপ করতে পারেন। ”
___” থ্যাংক ইউ মামনি। ”
আমি মাথা নাড়ালাম। উনি চলে গেলেন। ওনাকে আমি আগে থেকে চিনলেও উনি হয়ত কিছুক্ষণ আগেই চিনেছেন। মিশমি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

___” বেশি ভাব বেড়ে যাচ্ছে তাই না?”
আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
___” কিছু মানুষের টাকার এত গরম ছিলো, কিন্তু এখন সেই টাকার উৎসও আমার বরের হাতে।তাই সবাই যেন সাবধান থাকে।”
___” মানে?”(ভ্রু কুঁচকে)
আমি ওর দিকে একটু ঝুঁকে বললাম,

___” তোমার বাবার একটা ডিল ফাইনাল করতে হবে। যার ফাইলটা আজ সকালে বাবাকে চা দিতে গিয়ে দেখেছি আমি। এখন আমিও চাইলে বাবাকে না বলে দিতে পারি।সো ডিসিশন ইজ ইউরস।”
মিশমি চুপ হয়ে গেলো। আমি হেসে ওর চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে নিজের চোখে দিয়ে বললাম,
___” এটাকে বলে সাপ মরা আর লাঠিও না ভাঙা। সি ইউ লেটার।”
বলেই সেখান থেকে সাদির কাছে চলে এলাম আমি।মনে মনে আজ এতটা খুশি হয়েছি। ইশ!মিশমির চেহারাটা!

ছাদে দাঁড়িয়ে কাদছি আমি। রাত ঠিক ১০ টা। ফুপি শুয়ে পড়েছেন।এঙ্গেজমেন্টে সবটা ঠিক ছিলো।কিন্তু আংটি পড়ানোর সময় দূর্বল হয়ে গেছিলাম আমি। কেমন নোনাজলে চোখ ভরে উঠছিলো। অয়ন চাইলে আজ সবটা অন্যরকম হত।প্রথম ভালোবাসা কি ভোলা যায়? কিন্তু ওর ব্যবহারগুলো ভাবতেই ওর প্রতি ঘৃণা চলে আসে আমার। এখনো ওকে ঘ্ণাই করি আমি। কোনোমতে নিজেকে সামলে বাসায় এসেই সোজা ছাদে চলে এসেছি। চোখের সামনে ভালোবাসাকে অন্যের হতে দেখার চেয়ে কষ্টের আর কিছু আছে কি?কাঁধে কারোর হাত পড়ায় তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছে নিলাম আমি। পিছনে ফিরে সাদিকে দেখে হালকা হেসে বললাম,

___” আপনি এখানে? আমি তো আসছিলামই।”
সাদি আমার চোখের কোণায় থাকা পানিটা মুছে বললো,
___” আমার থেকে চোখের পানি লুকাস?”
আমি মাথাটা নিচু করে নিলাম। উনি আমার মাথটা উঁচু করে বললেন,

___” কখনো মাথা নিচু করবি না। সবসময় মাথা উঁচুতে রাখবি। তুই কষ্ট পেয়েছিস অয়নের জন্য।তাই না?”
আমি কিছু বলছি না। উনি নিজেই আমার হাত ধরে ছাদের দোলনাটায় বসিয়ে দিলেন। আমার পাশে বসে বললেন,
___” এই কয়েকদিনের ভালোবাসায় কেঁদে ভাসাচ্ছিস? নিজের ভালোবাসাকে অন্যের পাশে সহ্য হচ্ছে না?আর আমি যে তোকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি?তোকে নিজের বউ হিসেবে কল্পনা করেছি!আজ তোর মনে অন্য কাউকে দেখে আমার কেমন ফিল হচ্ছে?”

আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। ওনার দৃষ্টি আকাশের চাঁদটার দিকে। ছাদে থাকা ছোট্ট নিভু নিভু দুটি লাইট দিয়েও দেখা যাচ্ছে সাদির চোখে থাকা পানির উপস্থিতি। উনি কাঁদছেন? উনি তবুও ঠোঁটে হাসি রেখে নিজেই বলছেন,
___” তুই হয়তো ভাবছিস যে এটাও আমার একটা চাল তোকে অপদস্থ করার জন্য।”
আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম। উনি হাসলেন। হেসে বললেন,

___” কিন্তু এটাই সত্যি যে আমি তোকে ভালোবাসি। সেটা ছোট থেকেই।তোর মধ্যে আমি আমার আনন্দ খুঁজে পাই। তোকে কাঁদিয়েও আমি আমার খুশি পাই। তোর কান্নার মাঝেও যে মায়া!সেই মায়া আমাকে বারবার বাধ্য করে তোকে কাঁদাতে। আবার সেই কান্নার কষ্ট সহ্যও হয় না। তোর থেকে দূরে থাকতে পারি না আমি।তাই তো লন্ডন চলে গেছিলাম। কিন্তু ফিরে এসে তোকে সামনা-সামনি আবারো দেখে তোকে পাওয়ার লোভটা আমার মাঝে আবার জেগে উঠেছিল। কিন্তু তুই তো অন্যকাউকে..”

বলতে বলতে ওনার চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। ওনার এই কান্না আমার সহ্য হলো না। যে মানুষটা আমাকে নিঃশব্দে ভালোবাসে তাকে আমি কষ্ট দিলাম না তো? আমি ওনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলাম। কান্নায় ভেঙে পড়ে বললাম,

___” আ..আমি স..সরি।”
সাদি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলছেন,
___” কাঁদছিস কেন?কার জন্য অয়নের জন্য?”
আমি ওনাকে ঝাপটে ধরে বললাম,
___” না আপনার জন্য। অয়ন কে আমি চিনি না। ওর মনে আমার জায়গা নাই। তাই আমার মনেও ওর জায়গা নাই।”
___” সত্যিই কি তাই? ওকে ভুলতে পারবি তুই?”(হেসে)
আমি কান্না থামিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

___” আপনি পারবেন? ওকে ভুলিয়ে দিতে? আমার মন থেকে?”
সাদি আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
___” আগে কথা দে,আমার হয়ে থাকবি?”
আমি ওনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
___” হ্যা হ্যা থাকবো।আপনার হয়েই থাকবো। আপনি যা বলবেন তাই শুনবো আমি। কখনো অবাধ্য হব না। এক মিথ্যা ভালোবাসাকে হারিয়েছি। এখন এই সত্যিকারের ভালোবাসাটা হারাতে পারবো না আমি।”

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ৯

___” শশশ! শশশ! হইছে আর না। আর কাঁদবি না তুই। এরপর থেকে তোকে আর কাঁদতে দিবো না আমি।”
উনি আমাকে বুকের সাথে শক্ত করে ধরে আছেন৷ আর আমিও পরম নিশ্চিন্তে ওনার বুকে মাথা রেখে আছি।আজ অনেক শান্তি পাচ্ছি আমি। মুহুর্তের মধ্যে আগের কষ্টগুলো ভুলে যাচ্ছি।ওনার কথায় ভরসা পাচ্ছি। এক নতুন সাদিকে আবিষ্কার করেছি।হ্যা আমি পেয়েছি! আমার ভালো থাকার মেডিসিন পেয়েছি আমি।

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১১