রাজনীতির রংমহল পর্ব ৭

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৭
সিমরান মিমি

তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে ভাইয়া?আমাকে এর আগে কখনো দেখো নি?এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল রাহুল। স্পর্শী যে বাবার সামনেই এমন ভাবে নাকানিচুবানি খাওয়াবে তা ক্ষুনাক্ষরেও বুজতে পারেনি।আবদূর রহমান খাওয়া রেখে স্পর্শীর দিকে তাকালো।তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো-

আমিও তোমার সমস্যাটা’র কথা জানতে চাইছি রাহুল।বেশ অনেকদিন ধরে জিজ্ঞেস করতে চাইলেও সময় বা সুযোগ কোনোটাই হয়ে ওঠে নি।তাছাড়া স্পর্শী মাও তো আর আগের মতো বাড়িতে আসে না যে দুটো কথা বলবো।
বলেই স্পর্শীর দিকে পুনরায় তাকালেন। স্পর্শী নিরব ভাবেই নিচের দিকে তাকিয়ে খেয়ে যাচ্ছে।ভীষণ খারাপ লাগলো আব্দুর রহমানের। সেই জন্মের তিনদিন পর থেকে যে বিপাশা ওকে নিয়ে এলো সেই থেকে বাবার মতো যত্নে-স্নেহে বড় করে তুলেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

স্পর্শীও বাবার মতো সারাক্ষণ আবদারের মেলা নিয়ে বসতো।খাবার টেবিলে কখনো নিরব হয়ে খেতে পারতো না।দুই ভাই-বোন মিলে কারাকারি -ভাগাভাগি-রাগারাগিতে মেতে থাকতো। কিন্তু হঠাৎ করে মেয়েটা একদম নির্জীব হয়ে গেল৷ বাড়ি তো ছাড়লোই সেই সাথে আগের সেই চঞ্চলতাও ছেড়ে দিলো।হোস্টেলে কত কষ্ট করে থাকছে।আব্দুর রহমান চাইলেই জোর করে স্পর্শীকে বাড়িতে রাখতে পারতেন।কিন্ত তা করেন নি। ভয়ে,পাছে যদি অধিকারের প্রশ্ন ওঠে।বাবার চেয়ে খালুর দরদ বেশি।নিরবে দীর্ঘ শাস ছাড়লেন।মুখের খাবার শেষ করে রাহুলকে বললেন-

বেশ অনেকদিন ধরে তোমার বেহায়াপনা সহ্য করছি।আর নয়,এবার যেকোনো একটা সিদ্ধান্তে যেতে হবে তোমায়।এই মাসের মধ্যে হয় তুমি মেয়ে পছন্দ করবে না হয় আমরা তোমার জন্য মেয়ে দেখবো।অনেক হয়েছে,বয়স তো আর থেমে থাকছে না।দুদিন পরে মেয়ে পাওয়াই মুশকিল হয়ে যাবে।দ্রুত চাকরী নেও আমি বিয়ের ব্যাবস্থা করছি।
রাহুল অসহায় হয়ে স্পর্শীর পানে চাইল।ওর কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না।তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো-

আব্বু তুমি জানো আমি….
ধমকে উঠলেন রহমান সাহেব।চেচিয়ে বললেন-
খবরদার!আমি তোমাকে শেষ বারের মতো সাবধান করছি স্পর্শী’মাকে ডিস্টার্ব করবে না।তোমার পছন্দ কে গুরুত্ব দিয়েই এতোদিন অপেক্ষা করেছি।আর নয়,স্পর্শী তোমাকে পছন্দ করে না।তাই ওর জন্য আর বসে থাকবে না।তুমি আমার ছেলে,এতটুকু সেল্ফ রেস্পেক্ট নেই তোমার মধ্যে।মেয়েটা তোমার জন্য বাড়ি পর্যন্ত ছেড়েছে।এবারে কি চাও?
থেমে,

ঠিকাছে,তুমি যদি বিয়ে না করে চিরকুমার থাকতেও চাও তাহলেও আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি আগে তাহলে স্পর্শী’মার বিয়ে দেব।
খুক করে কেশে উঠলো স্পর্শী।এতোক্ষণ তো সব ভালোয় ভালোয়’ই যাচ্ছিলো। হঠাৎ আবার তার বিয়ে কেন?
রেগে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল রাহুল।স্পর্শীও গেল নিজের রুমে।আর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই হোস্টেলে চলে যাবে।
খালামনির কাছে বিদায় নিয়ে গেটের কাছে এলো স্পর্শী।স্কুটিতে বসতেই ওপাশ থেকে রাহুল হাত ধরে টেনে হিচড়ে নামালো।তেড়ে এসে স্পর্শীর দু-গাল চেপে ধরে বললো-

খুব তেজ না তোর।তোর তেজ কিভাবে কমাতে হয় তা রাহুলের ভালো করে জানা আছে।ওই তুই কোন রাজার ছেলেকে বিয়ে করবি হ্যা?দেখতে তো আহামরি কতটা সুন্দর ও না।এতো দেমাগ কেন?তোর থেকে হাজারগুন সুন্দরী মেয়েরা রাহুলের পায়ের কাছে বসে থাকে এটেনশন পাওয়ার জন্য।
দুহাত দিয়ে রাহুলের হাতের থাবা খুলতে চাইছে স্পর্শী।শেষে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো-

আমি জানি আমি দেখতে কেমন?সেটা তোমার থেকে জানতে হবে না।এতো সুন্দরী মেয়েরা পেছনে পড়ে থাকলে বেহায়ার মতো এখনো আমার পেছনে ছ্যাচড়ামি করো কেন?খবরদার আমার গায়ে ভুলেও হাত দিবে না।তুমি ছুলেও আমার বমি আসে।

হতভম্ব হয়ে গেল রাহুল।বুকের ভেতরটা কেমন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে।স্পর্শী কি তাহলে প্রেম করে অন্যকারো সাথে?চোয়াল শক্ত করে স্পর্শীর হাতে থাকা ফোন’টা ছিনিয়ে নিলো।
স্ক্রিন অন করতেই দেখলো “নেতামশাই” লিখে সেভ করা নাম্বার থেকে দুটো মিসডকল।কললিস্টে ঢোকার আগেই ছিনিয়ে নিজের ফোন নিয়ে গেল স্পর্শী।রাহুল দাতে দাত চিবিয়ে বললো-

ওই এই নেতামশাই কে?তুই প্রেম করিস?স্পর্শী, আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
–তোমার সাহস হলো কি ভাবে আমার ফোন চেক করার?তুমি কোন আক্কেলে আমার ফোন ধরছো?
–ওই নাম্বার টা কার?
–আমার জামাইয়ের।আর কিছু?বিয়ে করছি আমি।প্রেম করে বিয়ে করছি।এই জন্য তোমাকে ইগনোর করি।বুঝতে পারো না তুমি।আর দ্বিতীয়বার আমার চোখের সামনে পড়বে না।
বলেই স্কুটি নিয়ে চলে আসলো রহমান ভিলা থেকে।

প্রায় অনেকটা দূরে নির্জন জায়গায় আসতেই স্কুটি থামায়।ডুকরে স্কুটির পাশে বসে পড়ে।কাদতে থাকে অনবরত।ডান হাতটা ব্যাথায় নীল হয়ে আছে।দুগাল যন্ত্রনায় যেন ছিড়ে যাচ্ছে।তার জীবনটা এমন কেন?বাইরের মানুষ সবসময় অধিকার দেখায়।একটা নিজের মানুষ নেই,যাদের সাথে মনখুলে জেদ ধরে বসে থাকতে পারে।কেউ নেই স্পর্শীর।সবাই শুধু দায়িত্ব টা পালন করে।বাবা তো থেকেও নেই।মাসে মাসে হাজার হাজার টাকা পাঠিয়ে শুধুমাত্র দায়িত্ব টুকু এড়িয়ে যায়।মাঝেমধ্যে মনে হয় ওই টাকা ছুড়ে মারতে।কিন্তু তাহলে চলবে কিভাবে?এতটাও সহজ নয় জীবন।

ফোন অনবরত বাজছে।সেদিকে হুশ নেই স্পর্শীর।সে তো হুহু করে ব্যাথায় জর্জরিত হাতের উপর হাত বুলিয়ে কেদে যাচ্ছে।কতক্ষণ পর পর চারদিকে তাকিয়ে দেখছে কেউ আছে কিনা।সে তো কাউকে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না।
স্পর্শীয়া,এই মেয়ে?স্পর্শীয়া।তুমি কি কাদছো?
এই কি হয়েছে?এইইই?স্পর্শীয়া?

কোলের মধ্যে থেকে ছোট্ট আওয়াজে এমন উত্তেজিত কন্ঠের আওয়াজ শুনতেই চমকে উঠলো স্পর্শী।শব্দ টা ফোন থেকেই আসছে।হাতে নিতেই দেখলো নেতামশাই নাম্বার টি।হয়তো হাতে টাচ লেগেই রিসিভড হয়ে গেছে। ফোন কেটে দিল স্পর্শী।ভাল লাগছে না তার কথা বলতে। কল কাটার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে আবারো কল আসলো।টানা তিনবার কাটার পরেও যখন ফোনের পর ফোন আসলো তখন রেগে ফোনটা’ই বন্ধ করে রাখলো স্পর্শী।

হতাশ হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো পরশ।মেয়েটা কাদছিলো,হ্যা।হুহু করে কাদছিলো,পরশ স্পষ্ট শুনেছে সেই কান্নার আওয়াজ। কি এমন হয়েছে যে স্পর্শী কান্না করছিলো। বুকের বাম পাশটা কেমন চিনচিন করে উঠলো। ইচ্ছে করছে ছুটে যেতে ঢাকায়।গিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে।কিন্তু কোন অধিকারে যাবে সে?এখনো যে কোনো সম্পর্কের সুত্রপাত’ই ঘটেনি।আর তাছাড়াও সে যে ভীষণ ব্যাস্ত।পিরোজপুর থেকে ঢাকায় যেতে আসতে কমপক্ষে পাচ-ছয় ঘন্টা লাগবে।একজন রাজনৈতিক নেতার কাছে কি এই সময় হবে তাও কোনো মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য।মাথার উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে নিল পরশ।ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে।

সারাদিন শেষ। নিজের অতি ব্যাস্ততা থাকা সত্ত্বেও প্রতি দশ মিনিট পর পর স্পর্শীর নাম্বারে ফোন দিয়েছে পরশ।ফোন আগের মতোই বন্ধ।উফফস, এতোটা অস্থির কেন লাগছে?আচ্ছা,সে ও তো স্পর্শীর সাথে কথা বলার মাঝখানেই ফোন বন্ধ করে দেয়।তখন কি তার ও এমন অস্থির অস্থির লাগে।
রাত নয়টা,পুনরায় ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই চমকে উঠে পরশ।রিং পড়ছে।একবার,দুইবার, তিনবার…….কেটে গেল ফোন।রিসিভড হলো না।পুনরায় দশ বারের মতো ফোন দেওয়ার পরেও যখন ধরলো না।তখন পরশ গুটিগুটি অক্ষরে মেসেজ পাঠালো।

স্পর্শীয়া,ফোন ধরছো না কেন?আর সারাদিনে ফোন বন্ধ করে রেখেছিলে কেন?
সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ফিরতি বার্তা এলো।
–কেন?এখন খারাপ লাগছে।যখন আপনি কথার মাঝখানে বন্ধ করে রাখেন,তখন?আমি ফোন ধরবো না।
মেজাজ বিগড়ে গেল পরশের৷ ইচ্ছে করছে কানের উপর দু-তিনটা মারতে।সে কতটা ভয় পেয়ে গেছিলো আর এই মেয়ে ঢং করছে তার সাথে।দাতে দাত চেপে আবারো ফোন দিলো।কিন্তু ধরলো না।শেষে আবারো মেসেজ দিলো-
ফোন ধর,কথা আছে আমার।

–আমার তো কোনো কথা নেই। শুনুন নেতামশাই,নিজের নেতাগিরি অন্যদের উপর ফলান।আমাকে একদম বিরক্ত করবেন না।ফোন ও দিবেন না।আমি অলরেডি সিম চেঞ্জ করে ফেলেছি।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৬

ব্যাস,মেসেজ আসার সাথে সাথেই ওপাশের ফোন বন্ধ।দাতে দাত চেপে ফোন’টা ছুড়ে ফেলে দিল পরশ।এই মেয়ের কত্তবড় সাহস?তাকে ইগ্নোর করে।এমনকি সে ফোন দিলে বিরক্তও হয়।নাহ,আর ফোন দিবে না পরশ।একটা মেয়ের কাছে এতটা ছোট হওয়াও উচিত হবে না।ভীষণ ভাবে স্পর্শীর কথাগুলো আত্নসম্মানে লাগলো পরশের।

রাজনীতির রংমহল বোনাস পর্ব