রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৫

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৫
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“এই-যে দিয়ে পাঁচটা প্রশ্ন!তাও উনার চোখে তাকিয়ে!অসম্ভব।”
বিড়বিড় ভঙ্গিতে আওড়ায় তাহুরা।হাতের চুড়িতে মনোনিবেশ করে।সাদা পাথরের উপর মেজেন্ডা রঙের চুড়ি।অত্যধিক সৌন্দর্য বর্ধন করে তাহুরার শুভ্র হাতে।তার বাবার দেওয়া চুড়িগুলো।পরিহিত কামিজে হাত বুলিয়ে মাথায় ঘোমটা টানে।পিন দিয়ে আটকে দেয় নিখুঁতভাবে।তার মুখশ্রীর সম্মুখে কিছু চুল দোদুল্যমান।কানে ভারী দুল।নাকে আজ নতুন অলংকার পড়েছে।পাথরের নাকফুল।পরিপাটি হলো আজ সে একা।অধরে লেপন করা লিপস্টিক পুনরায় ঠিক করে নিজেকে শেষ বার আয়নায় পরখ করে।সব মন মতো।বোন ছাড়াও মেয়েটা নিজেকে তৈরি করেছে অপ্সরীর ন্যায়।বোন তার পার্শ্ববর্তী পার্লারে।

হাতের ছোট পার্স নিয়ে কামরা হতে বেরোয় তাহুরা। মা-বাবা কিছু একটা নিয়ে কথায় ব্যস্ত।তাহুরা সেথায় গেলে মুন্সী কথা থামায়।মেয়েকে ডাকে ইশারায়।আদুরে ভঙ্গিতে তাহুরা গেলে মেয়ের কাঁধে হাত রাখে মুন্সী,
–“সামনের মাসে সুনেরার বিয়ের পরপর রেজাল্ট দিবে।ভর্তি হবে কোথায়?”
–“আমাদের কলেজে।অনার্স কলেজ থেকে করতে চাই বাবা।”
তাহুরা জবাব দেয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–“উত্তম সিদ্ধান্ত।আর শুনো,আজ অনুষ্ঠানে একটু সাবধানে থাকবে।কোনো বাইরের পোলা এসে কিছু বলতে চাইলে,কথা শুনবে না।মহিলাদের কেউ বিয়া নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলবা,তুমি পড়বা।অনার্স শেষ করবা। বুঝলা?”
ক্ষেপে উঠে মুন্সী।বাঁধ সাধে শিউলি,
–“অনার্স একেবারে শেষ করতে হবে বলে কথা নেই।আমার মেয়েকে আমি আরো কয়েক বছর রাখবো বাসায় এটাই মূর্দা কথা।”
–“ঐ একই।”

মুন্সী ফের বলে।
তাহুরা মাথা নাড়ে।তার বিয়ে নিয়ে কাহিনী হলো নিশ্চয়।প্রস্তাব এসেছে নাকি?প্রশ্ন করার সাহস নেই তাহুরার।সে ভাবুক ভঙ্গিতে বাবার নিকট বসে।সুনেরা এলে রওনা দিবে সকলে।বাহিরে জুবায়েরের পাঠানো গাড়ি অপেক্ষারত।
তাহুরার যতো ভাবনা উমাইরের পাঁচটা প্রশ্ন নিয়ে।বাদবাকি বিয়ের ব্যাপারে সে সুনিশ্চিত।বাবা মা অতিদ্রুত তাকে আলাদা করবে না নিজ হতে।মিনিট দশেক পার হচ্ছে,তাহুরা একে একে প্রশ্ন সাজায় অন্তরে।প্রথমে ভেবেছে,কেমন আছেন?কি করছেন?এমন প্রশ্ন করে কেটে পড়বে।পক্ষান্তরে মনে জোর লাগায় মেয়েটা।প্রশ্নের স্তূপ গড়ে তোলে। উমাইরকে আজ কিছু প্রশ্ন করবে,যা তাহুরার অন্তরকে পীড়া দেয় ক্ষণে ক্ষণে।

–“সুনেরাকে ফোন দাও।আসবে নাকি জিজ্ঞাসা করো!আর কতক্ষণ বসে থাকবো?”
মুন্সীর গর্জনে নিজ দুনিয়ায় ফিরে তাহুরা।পার্স হতে মোবাইল বের করে।সুনেরাকে ফোন দিতে গিয়ে খেয়াল করে উমাইরের বিশাল মেসেজ,

–“আজ বেশি ঘুরঘুর করলে কান টানবো তোমার।অনুষ্ঠানে থাকবে ঠিক,কিন্তু চুপচাপ এক জায়গায় অটুট থাকো যেনো।অপরিচিত কেউ কথা বলতে আসলে কথা বলবে না।হেসে কথা বলার দুঃসাহস দেখালে,হাসি বন্ধ করেবো তোমার।আমার আত্মীয় হোক,বেশি আদিখেত্য দেখালে তোমার খবর আছে। ভালোমানুষি দেখানোর দরকার নেই কোনো।”
বিশাল হুমকি!হলো কি আজ?বাবাও হুশিয়ারি দিলো,আবার উমাইরও।জবাব পাঠানোর পূর্বে বাবা ফের তাড়া দেয়,

–“আম্মা,মোবাইল নিয়ে বসে থাকতে বলিনি।ফোন লাগাও বোনকে।”
–“দিচ্ছি বাবা।”
মেসেজ হতে বেরিয়ে দ্রুত বোনকে ফোন দেয় তাহুরা।কথা শেষে বাবাকে জানায়,গলির মোড় হতে সুনেরাকে তুলে নিতে।
নির্দেশনা অনুযায়ী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা।
এর ফাঁকে উমাইরকে মেসেজ দেয় তাহুরা,
–“কি হয়েছে?”

মোবাইল ব্যাগে পুরে তাহুরা।মোবাইল নিয়ে সময় কাটানো তার বাবার অপছন্দ কাজ। পাছে যদি বাবা বকুনি দেয়,এহেন খুশির দিনে হজম হবে না তাহুরার। কেঁদেকুটে খুশির দিন নষ্ট করবে।
সুনেরাসহ তারা ঐ বাড়িতে পৌঁছায়।জুবায়ের প্রধান ফটকের কিনারায় দাঁড়িয়ে।প্রেয়সী গাড়ি হতে নামলে দ্রুত এগিয়ে আসে।হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার জোগাড়।মুন্সীর পানে এক নজর দৃষ্টি দিয়ে তাড়াহুড়োয় চেপে ধরে সুনেরার হাত।সে ছুটাতে চাইলেও হাত ছাড়েনি জুবায়ের।কুশল বিনিময় সমাপ্ত করে ভেতরের দিকে অগ্রসর হয়।
বিষয়টা দারুণ লাগলো তাহুরার।বোন তার ব্যাপক ভাগ্যবতী।

বাহিরে তেমন মানুষ না থাকলেও,ভেতরে আত্মীয়দের ছড়াছড়ি।নিজের দুই চাচাকে দেখলো তাহুরা।নানু বাড়ির সকলে এখনো অব্দি আসলো না।চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে দেখছে সে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখার সখ জেগেছে মনে। প্রাণে হাহাকার তার।
সুনেরাকে ঘিরে আসর পেতেছে।তাহুরা বোনের কাছে নিজ অবস্থান জারি করে।কৌশলে মেসেজ দেখার জন্যে উদ্যত হয়।কিন্তু, লাভ হয়নি।মেসেজ আসেনি কোনো।
উমাইরের মামী দূরে অবস্থিত।তার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে ইশারায় দেখালো তাহুরাকে।পরক্ষণে মুখ খুলে,

–“দেখলে কেমন মেয়েটা?”
–“হুম।দেখলাম।তার বাবা কিছু জানিয়েছে?”
নম্রতার ভাইয়ের ছেলে প্রশ্ন করে।
–“নাহ, তুনাজ।জানায়নি।উনি ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করেছেন যেনো। আপাকেও বলে লাভ হয়নি।”
নম্রতা কেমন মিইয়ে জবাব দেয়।
–“মেয়েটার সাথে কথা বলে দেখি।ভাব হয় কিনা।”
হেসে উত্তর দেয় তুনাজ।

–“আব্বা,নিচে সবাই এসেছে।ছাদে উঠবে এখন।তুমি তৈরি?”
দরজায় টোকা দিয়ে প্রশ্ন করে মেঘলা।
উমাইর গায়ে পারফিউম স্প্রে করা অবস্থায় দরজা খুলে।মা ভেতরে প্রবেশ করে।ছেলের গম্ভীর মুখশ্রী অবলোকন করে ফের মেঘলা বলে,
–“আমার ছোট বউকে আজ পরীর মতো লাগছে।”
ঘাড় বাঁকিয়ে উমাইর মায়ের পানে তাকায়।পরিহিত কালো শার্টের হাতা কব্জি অব্দি টেনে বোতাম মারে,

–“সে এইভাবেও পরী।”
–“তুনাজ আশেপাশে ঘুরছে?”
জবাব দিয়ে প্রশ্ন করে মাকে।
–“নাহ।আপাতত দেখিনি।তোমার মনের রাণীকে তোমার দেখে রাখতে হবে।দ্রুত আসো।”
বলে উঠে মেঘলা।
–“আসছি।”

কথা খানা শেষে মায়ের পেছন পেছন বেরোয় উমাইর।নাকের আগায় আঙ্গুল ডলে।সর্দি ভাব তার। সিঁড়ি যোগে নামতে নিলে স্তব্ধ হয় দৃষ্টি।নজর আটকে যায় সুনেরার নিকট বসে থাকা ঘোমটা দেওয়া মানবীতে। মেয়েটা মিষ্টি হাসছে।কেনো হাসছে?ভরা মানুষকে তার দেওয়ানা করা রূপ দেখাতে?হিংসে হচ্ছে উমাইরের।অথচ,এইখানে কিছু নেই হিংসার।
সকলের কাছাকাছি গেলে উমাইর,নম্রতা হেসে বলে,
–“উমাইর এসেছে।এখন যাওয়া যাক।”

কলকল ছলছল ভঙ্গিতে উৎসবের সহিত সকলে ছাদের পানে যাচ্ছে।তাহুরা লুকায়িত দৃষ্টিতে উমাইরের অবয়বে মত্ত।মেঘলার ধারে হাঁটছে উমাইর।একটা বারের জন্যে তাহুরার পানে তাকিয়েছে কিনা জানা নেই মেয়েটার।তবে,তাহুরা সন্তুষ্ট।লোকটাকে সে দু চোখ ভরে যে দেখছে!

ছাদে সুন্দর সাজানো।সাদা,হলুদ রঙের আলোর আলোড়ন।কৃত্রিম কিছু গাছেও লাইট ঝুলছে।খাবারের জন্যে একপাশে কয়েকটা টেবিল বসানো।পারিবারিক অনুষ্ঠান হওয়ায় এইখানে কেবল দুই পরিবারের নিকট আত্মীয়ের আগমন।চোখ জোড়া কেবল উমাইরের খোঁজে।ঐযে দেখা যাচ্ছে তার মনের রাজাকে।উল্টো দিকে ফিরে কথা বলছে কার সাথে। হয়তো তার কোনো আত্মীয়!বুকটা নড়ে উঠে তার। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় অন্তর।
তাহুরা বসে ছিল আয়মা,শায়নের নিকট।এর মাঝে আসে নম্রতা।জাফরান তার কোলে।এক প্রকার জিদ করছে বাচ্চাটা।তাহুরাকে দেখে জাফরান নেমে দাঁড়ায়।তাহুরার হাঁটুতে হাত লাগিয়ে আহ্লাদ করে।
নম্রতা ঝেড়ে কাশে,

–“জাফরানকে আপার রুমে নিয়ে যাবে?তুমি ছাড়া কারো সাথে যাবে না জাফরান।আমার এইখানে অনেক কাজ।ছেলেটার ঘুম পেয়েছে নিশ্চয়।তোমাকে এমন কথা বলতেও সংকোচ লাগছে।নতুন আত্মীয় তুমি।কিন্তু,আমার ছেলেটা তুমি বলতেই অজ্ঞান।”
অগোছালো কথার খেয় খুঁজে পায়নি তাহুরা। তাও সাড়া দেয় নম্রতার কথায়।জাফরানের হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়,
–“সমস্যা নেই,মামী।আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

স্নেহপূর্ণ বাক্য বিনিময় শেষে মাকে জানায় ঘটনা।শিউলি সায় দেয়। তবে,মনে মনে আহত।নতুন আত্মীয় বলে মুখ ফুটে মানা করাটাও মান্য নয়।মুন্সীকে ব্যাপারটা জানানো হলে,সেও সায় দেয়।
তাহুরা,জাফরানকে সাথে নিয়ে নিচে নামতে উদ্যত হলে মেঘলা এসে পথ আটকায়,
–“কই যাচ্ছো মা?”
–“মামী বললো,জাফরানকে আপনার রুমে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।”
তাহুরা সহজ ভাষায় বলে।
–“নম্রতাও না!কোনো দরকার নেই।আমি নিয়ে…”

–“নাহ আন্টি।আপনি এইখানে থাকুন।আমার কোনো প্রবলেম নেই।জাফরানের সাথে থাকতে আমারও ভালো লাগে।”
মেঘলাকে থামিয়ে জবাব দেয় তাহুরা।
অতঃপর জাফরানকে সঙ্গী বানিয়ে কক্ষের পানে ছুটে তাহুরা।দুই তলা জনমানবহীন।আফিয়াকে দেখলো কামরা হতে মাত্র বেরুতে।তাহুরাকে কেমন উপেক্ষা করে চলে যায় সে।
হঠাৎ তাহুরা অনুভব করে জাফরানকে কেউ কোলে তুলে নেয়।
প্রথমে উমাইর ভাবলেও,অন্য ছেলেকে দেখে পিলে চমকে উঠে তাহুরার।জাফরান নিশ্চুপ হেসে যায় ছেলেটার সহিত।এর মানে ছেলেটাকে চিনে জাফরান।
তাহুরার মুখের ভাষা ফুরিয়েছে।ছেলেটা প্রথমে মুখ খুলে,

–“আমি তুনাজ।জাফরানের কাজিন।”
বিনিময়ে কি জবাব দিবে তাহুরা খুঁজে পায়নি।
তুনাজ আবারো বলে উঠে,
–“ইউ আর প্রিটি।”
ধপ করে উঠে তাহুরার ছোট্ট হৃদয়।আবার সেই জ্বলন্ত হৃদয়ে শান্তি মিলে তুনাজ নামক ছেলের পিছে উমাইরকে আসতে দেখে। চলমান অবস্থায় লোকটা তার মাথার চুল ঠিক করছে।
উমাইরের ভাবভঙ্গি কঠোর।
–“তুনাজ,তোমাকে মামী বললো জাফরানকে নিয়ে রুমে যেতে।অলরেডি ঘুমাচ্ছে ও তোমার কাঁধে।”
কণ্ঠস্বর ব্যাপক গম্ভীর উমাইরের।যেনো ক্ষিপ্ত কথাগুলো ভদ্র ভাষায় পেশ করছে সে।

–“কিন্তু,আন্টি আমাকে তাহুরার সাথে…”
–“যাও।”
কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে উমাইর।তার চেয়ে বয়সে ছোট তুনাজ বেয়াদবি না করে রুমের পানে এগিয়ে যায়।তুনাজ এও জানে,এখন তার বসে বসে পাহারা দেওয়া লাগবে জাফরানকে।মনের দুঃখে হাত মুঠ হয়ে আসে তার।আঁখিতে ভেসে উঠে তাহুরার আদুরে মুখখানা।
মেঘলা বেগম ছেলেকে সাথেসাথে ব্যাপারটা জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে।যাক কাহিনী বিগড়ে যায়নি।তার ছোট ছেলেকে ব্যবস্থা করে দিয়েছে মনের পরীর সাথে কথা বলার।উপরে সকলকে মেঘলা ভালোই সামলে নিবে। দূর হতে দৃশ্য অবলোকন করে ছাদে ফিরে মেঘলা।

উমাইর নিভু দৃষ্টিতে তাহুরাকে পর্যবেক্ষণ করে।হাত ধরে শক্ত ভঙ্গিতে।মুহূর্তে সারা সত্তায় উম্মাদনায় ছেয়ে যায় তাহুরার। উমাইরের লম্বা কদমের সহিত সে কেবল দৌড়ে যাচ্ছে।উমাইর তাকে গলির আড়ালে দাঁড় করায়।সাহস আছে উমাইরের।প্রেয়সীর নাক উঁচু বাবা উপস্থিত আছে জেনেও আগুনের সাথে খেলছে সে।
তাহুরা অবাক,বিমোহিত।উমাইরকে অশান্ত দেখাচ্ছে।উমাইর তার হাত ছাড়লে তাহুরা প্রশ্ন করতে চাইলে,উমাইর তার কপালে টোকা দেয়,

–“ভালোমানুষি দেখাতে মানা করেছি?”
উত্তর নেই তাহুরার।প্রসঙ্গ এড়াতে ভাবে কিছুক্ষণ তাহুরা।অতঃপর বলে,
–“পাঁচটা প্রশ্ন করি?”
–“নাহ।”
উমাইরের শক্ত জবাব।
–“তাহলে আমি যাই?”
–“নাহ।”
ঘাড়ত্যাড়া উত্তর উমাইরের।
–“কি করবো তাহলে?”
ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করে তাহুরা।দৃষ্টি তার উমাইরের বুকে।লোকটার আঁখিতে আঁখি আটকে কথা বলাটা এভারেস্ট জয়ের মতো।

–“চেস্ট থেকে দৃষ্টি তুলে আমার দিকে তাকাও।সবসময় খেয়াল করি সেখানে তাকিয়ে থাকতে।কি দেখো এতো?”
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে উমাইর।
লজ্জায় রক্তিম হয় তাহুরা।লাজে বেষ্টিত হয় তার সারা তনু।লোকটা কথাটা কিভাবে পেশ করলো!
–“জ্বী?”
অদ্ভুত প্রশ্নের সহিত তাহুরা দৃষ্টি তুলে তাকায়।
উমাইরের নজর পরখ করা কষ্টের।লোকটা কি ক্রোধে মত্ত?
–“পাঁচটা প্রশ্ন করো।রাইট নাও!নজর নিচে ফেললে খবর আছে তোমার। ”
সেকেন্ডে কথা শেষ করে উমাইর।
তাহুরাকে জাদু করে উমাইরের অন্যরকম দৃষ্টি জোড়া।হুরহুর করে তাহুরা বলে,

–“এই-যে আপনি কি অন্য কাউকে শাসন করেন? যেমনটা আমাকে করেন?”
–“এই-যে আপনি আমাকে এমন অবহেলা কেনো করেন মাঝে মাঝে?”
–“এই-যে আপনি কি আমি ছাড়া অন্য কাউকে যত্ন করেন?”
বাকি প্রশ্ন শোনার ক্ষমতা নেই উমাইরের।গাঢ় লিপস্টিকে আবৃত অধর তাকে আকৃষ্ট করছে চুম্বকের লাহান।বেসামাল হচ্ছে উমাইর।তাহুরার দুই অধর তার দুই আঙ্গুলের সাহায্যে চেপে ধরে।মেয়েটা তার নিকট মাদক।বেশিক্ষণ কাছে থাকলে নেশাক্ত হয়ে পড়ে উমাইর।
কিঞ্চিৎ কাছে গেলে তাহুরা তার দুই হাত উমাইরের বক্ষে রাখে।মেয়েটা ভীত।পা জোড়ার জোর হারাচ্ছে।
উমাইরের এই দৃষ্টিটা তাহুরার সহ্য হয় না।

–“আর একটা কথাও বলবে না।”
উমাইর সোজা হয়ে দাঁড়ায়।তাহুরা প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়।ডান দিকে মাথা নাড়ে।কথা না বলার হলেও উত্তর জানতে আগ্রহী তাহুরা।
উমাইর উপরে মুখ করে কপালে আঙ্গুল ঠেকানো।লোকটার উত্তর জানতে তাহুরার ভেতরে উত্তাল।মনে সহস্র উত্তেজনা।অতঃপর ধীর স্বরে মেয়েটা প্রশ্ন করে বসে,
–“এই যে,উত্তর দিবেন না?”
–“উত্তর দিবো বলেছি আমি?প্রশ্ন করতে বলেছি,প্রশ্নের উত্তর দিবো এমনটা বলিনি!”
উমাইরের জবাবে মনঃক্ষুণ্ণ হয়।
কতো আশা নিয়ে প্রশ্নগুলো তৈরি করেছিলো মেয়েটা।আঁখি ভরে আসে।মনে মনে আওড়ায়,
–“আপু তোমার দেবর একটা জলদস্যু!”

অথচ এই বাক্য যদি উমাইরের সম্মুখে আসে,উমাইর নিশ্চিত হাড় ভাঙবে তাহুরার।
প্রেয়সীর ছলছল নয়নে দাগ কাটে উমাইরের পাষাণ হৃদয়ে।দৃষ্টি পৌঁছায় মেয়েটার হাতে।ওড়নার কোণায় আঁখি পুচছে সে।তাহুরার বাম হাতের আঙ্গুল টেনে নিজের দিকে টানে উমাইর,
–“দুহাত থেকে দুটো চুড়ি নিচ্ছি।”
নিজ দায়িত্বে উমাইর চুড়ি খুলে তার।ডান হাতের মুঠোয় রাখে।পরক্ষণে নাক টানে সে তাহুরার,
–“না কেঁদে উপরে যাও।আপুদের পাশে বসো।”
উত্তর বিহীন তাহুরা চলে যেতে নিলে উমাইর গলার স্বর বাড়ায়,

–“চিন্তা করো না,ভয় পায় না।তুনাজ বা অন্য ছেলে আর কাছে আসবে না তোমার।আসলে তোমার বাবার সামনে তাদের ধোলাই দিবো আমি।”
তাহুরা পেছন ফিরে।উমাইর তার চুড়ি জোড়া শার্ট উঁচিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখছে।খানিক্ষণ আগের ক্রোধে মত্ত উমাইর এখন কেমন শান্ত।মুখশ্রী জ্বলজ্বল তার।উমাইর মাথা সোজা করলে দুজনের ফের দৃষ্টি মিলে।ভ্রু কুঁচকে যায় উমাইরের।
সম্মুখে অগ্রসর হয়ে আসা অবস্থায় বলে,
–“আমি ছাড়া কি হাঁটতেও পারো না?দ্রুত আসো।”

তাহুরা হাসে উমাইরের আড়ালে।অশ্রুর পানি শুকনো।লোকটার দুই রূপ ভারী ঝামেলা।বোঝা মুশকিল।উমাইরের সুঠাম দেহের পশ্চাতে তাহুরা আয়েশী ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে।মন মাতোয়ারা ঘ্রাণ ধাক্কা খেলো তাহুরার নাকে।লোকটা আশেপাশে থাকলে তার বড্ড সুখ সুখ লাগে সর্ব দুনিয়া।তাহুরা বুঝতে পারে,এই রাগী কলেজের স্যারটা এখন তার সারা মনে বসবাস করে।সেথায় একমাত্র রাজা তার এই যে,তার উমাইর।

ছাদে পৌঁছে উমাইর ফোন কানে চেপে অন্যদিকে যায় তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে।তাহুরা এগোয় বোনের পানে।সুনেরা বোনকে কাছে পেয়ে ছবি তুলে বেশখানেক।টিস্যু দিয়ে বোনের নাকে সরে যাওয়া মেকাপ মুছে বলে,
–“তোর নাকের মেকাপ নষ্ট করেছে কে?মা বললো জাফরানের সাথে রুমে তুই।জাফরান করেছে?”
তাহুরার হাত হাত পৌঁছে নাকে।কি সাংঘাতিক লোকটা! ছলেবলে মেকাপ নষ্ট করেছে তার।অথচ বুঝতে দেয়নি।
–“নাহ আপু।জাফরান করেনি।”
জবাব দেয় তাহুরা।

–“সে যায় হোক,জাফরানের মামাতো ভাই থেকে দূরে থাকবি। ঐ ছেলের জন্যে বাবার কাছে তোর প্রস্তাব দিয়েছে মামী।বাবা রেগে আছে।ছেলেটাকে তোর আশপাশ দেখলে আবার সমস্যা করবে বাবা।”
বোনের আড়ালের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তাহুরা।ধীর কণ্ঠে বলে,
–“আচ্ছা।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৪

কাহিনী এতদূর এগিয়েছে!অথচ কেউ বলেনি তাকে কিছু।উমাইর জানে বুঝি কথাগুলো?তাই তুনাজ নামের ছেলেটা হতে তাকে বাঁচিয়েছে!আবারো তাহুরার উৎসুক নজর খুঁজতে থাকে উমাইরকে।পেয়েও যায় দ্রুত।ইমনের সাথে দাঁড়িয়ে উমাইর।তাহুরার পানেই চেয়ে সে।দৃষ্টি মিললে,হতভম্ভ তাহুরা অন্যদিকে ফিরে।পলক ফেললে ভেসে উঠে উমাইরের অবয়ব,অনুভব করে তার সুঘ্রাণ। বুকে হাত চাপে তাহুরা।আপন সুরে আওড়ায়,
–“তোমার দেবর একটা রাগী,পাষাণ আবার ভালো জলদস্যু,আপু!”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৬