রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৪

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৪
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“এখন বলো,সেদিন আফিয়া কি বলেছিলো তোমাকে।একদম নাটক করবে না।সরাসরি জবাব দাও।”
উমাইরের কণ্ঠে বুঝা যায় সে আফিয়ার ঘটনা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত।তাহুরা মাথা নিচু করে বসে।জবাব দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।জবাব দিলে হাজারো সমস্যা দেখা দিবে।এরমাঝে এক,উমাইর নিশ্চয় মেহমানকে অপমান করার দরুণ বকবে আফিয়াকে।দুই,মেঘলা নিশ্চয় তাহুরাকে ভুল বুঝবে।মনে করবে তাহুরা ভালো মেয়ে না,বড়দের কথার মান রাখে না।

অস্থিরতায় ঘেমে যায় মেয়েটা।কি করবে সে?উমাইর নিঃসন্দেহে নাছোড়বান্দা। এক প্রশ্নে এখনো আড়ষ্ট।
তাহুরার বেজবান ভঙ্গি লক্ষ্য করে উমাইর।মেয়েটা আজও জবাব দিবে না! কাঁচের টেবিলে দুই আঙ্গুলের টোকা দিয়ে শব্দ করে উমাইর,
–“ভাষা খুঁজে পাচ্ছো না?বাংলা ভাষায় বলো।আমি বুঝবো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উমাইরের কণ্ঠে গা ছাড়া ভাব।
তাহুরা দৃষ্টি উপরে তুলে।উমাইর তার পানে চেয়ে।গম্ভীর,গভীর নজর।সমান্তরাল ভ্রু।মাদকতায় মত্ত চাহনি।তাহুরার উদরে চাপ অনুভব করে।সরাসরি এমন দৃষ্টি মিললে নিজের আঁখিদ্বয় কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে তাহুরার।পলক ঝাপটায় তাহুরা। হাতে হাত ঘষে।একটু ভেবে জবাবে বলে,
–“কি বলবো?আপনি বেশি ভাবছেন।”

ফের আরচোখে তাকায়।
উমাইর থুতনিতে হাত ঘষে হাঁটুতে হাত রাখে।গমগমে কণ্ঠে বলে,
–“ওকে ফাইন।বিশ্বাস করলাম।এই বিষয়ে পরে কিছু শুনলে তুমি সাফার করবে।”
ব্যস, হাওয়া বেরিয়ে যায় তাহুরার।লোকটা সরাসরি হুমকি দিলো তাকে। পরে জানলে জানুক।জানলেও অন্য থেকে জানবে।অন্তত তাকে মিথ্যে বলতে হবে না।মাথা দুলিয়ে তাহুরা বলে উঠে,

–“ঠিক আছে।”
–“ঠিক তুমি থাকবে নাকি জানিনা,যখন সত্যিটা আমার কানে আসবে।”
আবারো হুমকি!উমাইর তাকে এমন হুমকির সাগরে ভাসাচ্ছে কেনো?
তাহুরা কিছু বলতে চায়।তবে পারেনি।ইতোপূর্বে নিবরাসের কণ্ঠ ভেসে আসে। কিডজোনের মাঝপথে সে দাঁড়িয়ে।ভেতরে আসতে আসতে পুনরায় হাত নাড়ায়,
–“আমি চলে আসলাম।”
টেবিলের অপর প্রান্তে চেয়ার পেতে বসে।

–“কই ছিলে?”
উমাইর প্রশ্ন করে।
–“কাজে ছিলাম।”
অদ্ভুত হাসি নিবরাসের।
তাহুরার নজর বিস্ফোরিত।যা দেখার নয় সেটা দেখেছে মেয়েটা।নিবরাসের গালের কিনারায় লিপস্টিকের আবরণ।মেয়েলী লিপস্টিকের রং তাহুরা কিভাবে না চিনে থাকবে?উমাইর দেখেছে কি? হায় লজ্জা!তাহুরা হুট করে দাঁড়ায়,
–“আমি জাফরানকে ডেকে আনি। ওর খাওয়া দরকার এখন।”

তাহুরা থামে না।উমাইর তাকে কিছু বলবে সেই সময়টুকু দেয়নি।
উমাইর নিজেও উঠে। কিডজোনের খেলাঘরগুলোতে ভেতরে অনেক মানুষ।মূলত বাচ্চাদের সঙ্গী সকলে।
নিবরাস অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে।এরা সবাই পালাচ্ছে কেনো?
–“আমি আসলাম আর তোমরা যাচ্ছো কেনো?কি সমস্যা?”

–“সমস্যা তোমার।গাল মুছো।স্টুপিড তুমি?আজ সবার এটা মুছো, ঐটা মুছো বলতে বলতে দিন যাচ্ছে আমার।”
বিরক্ত উমাইর।
নিবরাস কিয়ৎপল ভাবে।গাল মুছবে মানে!কিছু দৃশ্য মস্তিষ্কে হানা দেয়।লজ্জা না পেলেও ভাইয়ের সামনে দ্বিধায় ভুগে নিবরাস। বোকা হেসে গালে হাত রাখে,

–“ভুলে…”
–“মেয়েটা যদি ভালো পরিবারের এবং লয়াল হয়,তবে টাইম পাস না করে আগলে রেখো।”
উমাইর নিজ নির্দেশনা শুনিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়।
নিবরাস এইবার লজ্জা পায়।বড় ভাই ব্যাপারটা জেনেছে।কি ভাবছে তাকে নিয়ে উমাইর?মাথা চুলকে চোখে আঙুল ডলে নিবরাস।আগলে রাখবে মানে?সেই মেয়েটাই যে নিবরাসের সারাজীবন। ছেলেটা ফুড কাউন্টারে যায়।নিজের জন্যে ঠাণ্ডা জুস অর্ডার করে।

ভেতরে গিয়ে দেখে,তাহুরাকে জাফরান জোর করছে ভিডিও গেইমের দিকটায় নিয়ে যেতে।অথচ,তাহুরা আসার পূর্বে জাফরান একা একা আয়েশ করে ঘোড়ায় খেলছিলো।বাচ্চারা তাদের বায়না পূরণের মানুষ দেখলে যেনো আরো আহ্লাদী হয়।তাহুরা জাফরানকে বুঝাতে বেগ পাচ্ছে।কিভাবে যাবে সেখানে?আপাতত সেথায় বিরাট ভিড়।জাফরান তাহুরার হিজাব অব্দি টানাটানি করছে।বিপাকে পড়ে মেয়েটা।জাফরান হঠাৎ এমন বিগড়ে যাচ্ছে কেনো?কিছু চুল হিজাবের আড়ালে বেরিয়েছে তার।

উমাইরের মেজাজ চটে।এইখানে নানান বয়সের লোক উপস্থিত।একটা বাচ্চা বায়না করলে সেদিকে সবার আকর্ষণ থাকে।কিছু লোক জাফরান এবং তাহুরার দৃশ্যে মজেছে।হাঁটু গেড়ে বসে থাকা তাহুরা নিজেকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।উমাইর দ্রুত পা চালায়।কথা না বাড়িয়ে জাফরানের পেট চেপে তাকে তুলে নেয়,
–“সবসময় তাহুরার সাথে এমন লেগে থাকো কেনো?পঁচা ছেলে।”
জাফরানের চঞ্চলতা কমে উমাইরকে দেখে।সে তাকে পছন্দ করলেও ব্যাপক ভয় পায়।তাও ধীর সুরে বলে,
–“জাফরান খেলবে।”

–“ঐখানে ভিড় দেখছো না?তাহুরাকে টানাটানি একদম করবে না কখনো।”
জাফরান উমাইরের গলা জড়িয়ে তার বাক্য শুনছে।
–“বাচ্চাটা খেলতে চাইছে।”
তাহুরা হিজাব ঠিক করা অবস্থায় জবাব দেয়।
–“চলো এইখান থেকে।খেলতে চাইলে কি খেলা ফরজ?তুমি দাঁড়িয়ে কেনো?আসো।”
তাহুরাকে আদেশ দিয়ে তাকে আগে হাঁটার ব্যবস্থা করে উমাইর।
জাফরান ভীত গলায় উমাইরকে বলে,

–“আপুর কাছে যায়?”
–“নাহ।যাওয়া যাবে না।”
শক্ত উত্তর উমাইরের।
চারিদিকে নজর বুলিয়ে হাত মুঠ করে উমাইর।মনে মনে আওড়ায়,
–“সবখানে কাবিল হতে চলে আসে।তাকে এতো মানুষ দেখছিল সেই হুঁশ,আল্লাহ্ দেয়নি মহারাণীকে।মাথামোটা একটা।”
বাক্যগুলো উমাইরের বলা সবচেয়ে নির্মম সত্য।মেয়েটাকে এমন চোখে লাগে,একটু হলেও দেখতে মন চায়।মেজাজ উমাইরের ভীষণ চটে।তার শ্বাস প্রশ্বাস দৃঢ় হয়।
বেরিয়ে এলে তাহুরা উমাইরকে বলে,

–“জাফরানের জন্যে কিছু কিনে দিন।আমি খাইয়ে দিই?”
–“নিবরাস, স্ন্যাক্স টাইপ কিছু কিনে থার্ড ফ্লোরে আসো।আমি থাকবো সেখানে।”
পরপর উমাইর তাহুরার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আওড়ায়,
–“মামী খাইয়ে দিবে জাফরানকে।তুমি সোজা হাঁটতে থাকো।”

তাহুরা প্রতুত্তরে কি বলবে ভেবে পায়নি।তার পূর্বে উমাইর গটগট ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে।পেছন ফিরে আবার তাহুরাকেও অবলোকন করে।পায়ের গতি ধীর করে উমাইর।তাহুরা তার সন্নিকটে এলে দুজনে একসাথে এগোয়।
দোকানে বেশ ভালো কেনাকাটা হচ্ছে।মামীর কাছে জাফরানকে দিয়ে উমাইর বেরিয়ে যায়। নিবরাস আসবে যেকোনো সময়।
তাহুরা এলে তার ছেলের পছন্দমত রঙের তিনটা শাড়ি তাহুরার গায়ে মেলে ধরে মেঘলা।তিনটা থেকে যেকোনো একটা শাড়ি মেয়েটার জন্যে কিনবে।
তাহুরা বেশ অবাক হয়।মলিন হেসে বলে,

–“আন্টি,আমি কেনো?আপুর জন্যে দেখুন।”
–“তোমার আপুর কেনাকাটা প্রায় শেষ।এটা তোমার জন্যে।ধরো আন্টির পক্ষ থেকে গিফট।”
মেঘলার প্রশান্তির বাক্য।
–“নাহ আপা।তাহুরার জন্যে পরে কিনবো আমরা।”
শিউলি কথাখানা বললে মেঘলা বিরোধী দেখায়,
–“একদম না আপা।শাড়িটা আমি মেয়েটাকে গিফট করবো খুশিমনে।এটা নিতেই হবে।নাহলে আমি কষ্ট পাবো।”
অবশেষে জোরাজুরিতে রাজি হয় শিউলি।তাহুরার গায়ে মেলে থাকা জলপাই রঙের সাথে সোনালী রঙের মিশ্রণ।কেমন মনোরম লাগছে তাহুরাকে।শাড়িটা তার তনুটে ফুটেছে বেশ।

দোকানের বড় মিরোরে মেঘলার পাশাপাশি তাহুরা দাঁড়িয়ে।মিরোরে নিজেকে দেখা অবস্থায় আঁখিতে দৃশ্যমান হয় উমাইরের অবয়ব।তাহুরা স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ করে উমাইর জাফরানের দিকে যেতে চেয়েও তাহুরাকে দেখে স্তব্ধ হয়।নড়চড় করেনি।লম্বা মানবটার এমন অচেনা দৃষ্টিতে কুপোকাত তাহুরা।পা বেঁকে আসছে তার।লোকটা এইভাবে চেয়ে কেনো?অনুভূতিরা ডানা মেলে আকাশে উড়ে তাহুরার।নিজেকে হালকা অনুভব হয়।শূন্যে ভাসছে সে?

–“দোস্ত, তোকে সেই লাগছে।নিয়ে নে শাড়িটা।”
নিবরাসের কণ্ঠে তাহুরা দৃষ্টি ঘুরায়।মেঘলা হেসে “মা শাহ্ আল্লাহ্ ” বলে।
পরক্ষণে উমাইরের গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,
–“মা,আমি বেরুচ্ছি।”
ছেলের বাক্যে উত্তর খুঁজে পায় মেঘলা।হাসির মাত্রা দ্বিগুণ করে শুধায়,
–“ফি আমানিল্লাহ্,আব্বা।”

তাহুরার নজর আয়নায় উঠে ফের।যাওয়ার পূর্বে উমাইরের তির্যক ভঙ্গিতে তাকানোটা উপভোগ করে মেয়েটা।অন্তর পিঞ্জিরায় প্রশান্তির নাচগান চলছে। উমাইরের সেই তির্যক দৃষ্টিতে ভস্ম হয় তাহুরার সত্তা।মেয়েটা বুঝে যায়,উমাইর তার জীবনের খুব কাছের একজনে পরিণত হয়েছে।লোকটার মতো স্থান তার হৃদয়ে কেউ জায়গা দখল করেনি ইহকালে।মন পিঞ্জিরার এহেন একান্ত দমবন্ধ পিরিতের অনুভূতি কেবল তাহুরার এই-যের জন্যে।

বিয়ের বাকি বারোদিন।জয় চায়,পরিবারের বড় ছেলের বিয়েতে সকল অনুষ্ঠান থাকুক।এনগেজমেন্টের আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আচমকা। দুই পরিবার বাইরে বৈঠক বসে।মুন্সী অনেক অনুরোধ করে অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে তাকে সুযোগ দেওয়ার।তবে,মানেনি জয়,জুবায়ের এবং উমাইর। এও বলা হয়,অনুষ্ঠান হবে উমাইরদের বাড়িতে।ছোট পরিসরে,পারিবারিকভাবে। মূলত বাড়ির বড় বউকে পূর্ব হতে সকলের নিকট পরিচয় করানোটা মূল উদ্দেশ্য।মুন্সী হার মানে সকলের চাপে।তার মন অস্থিতিশীল।মুন্সী চেয়েছিল অনুষ্ঠানের ভার নিজে বহন করতে।যেহুতু জুবায়েরদের বাড়িতে হচ্ছে অনুষ্ঠান তাই মুন্সী ব্যাপারটা হজম করে।

কাল শুক্রবার অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করা হয়।কেবল দুই পরিবারের লোকজন।উমাইরদের উঠানে নয় বরং ছাদে কিছু ডেকরেশনের কাজ হবে।যেহুতু,ঘরোয়া প্রোগ্রাম হলেও এনগেজমেন্ট হবে ভাইয়ের।উমাইর নিজে ব্যাপারটা সামলে নেয়।ভাইয়ের অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকদের সহিত যোগাযোগ করে।সাধারণের মাঝে ছাদকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার আহ্বান জানায়।

বাড়িতে মুটামুটি উৎসবমুখর পরিবেশ।উমাইর কলেজের কাজে ব্যস্ত ছিলো বেশ কিছুদিন।বৃহস্পতিবার আজ,তাই ক্লাসের চাপ কম।দুপুরের দিকে সে ঘরে ফিরে।কলেজে থাকাকালীন ডেকরেশনের জন্যে কন্টাক্ট শেষ করে সে।মামী,খালা উপস্থিত বাসায়।সবার সাথে দরকারি কুশল বিনিময় শেষে রান্নাঘরের বাহিরে দাঁড়ায় উমাইর।একগ্লাস ঠাণ্ডা শরবত দরকার তার।
তাকে অবলোকন করে আজিম।প্রবীণ লোক ভদ্রতার সহিত বলে,

–“কিছু লাগবে সাহেব?”
–“চাচা,মাকে বলবেন ঠাণ্ডা লেবুর শরবত দিতে।এখনই।আমি বসলাম ডাইনিংয়ে।”
জবাব দেয় উমাইর।
প্রবীণ মাথা নাড়ে,
–“বলছি।”
ডাইনিংয়ে চেয়ার টেনে বসে উমাইর।মেঘলা শরবত নিয়ে হাজির।ছেলের জন্যে আগে থেকে বানিয়ে রাখে।নিজেও বসে ছেলের পাশে।উমাইর গ্লাসে চুমুক দেয়।মেঘলা নিজের ভাব প্রকাশ করে,

–“জুবায়ের বললো, সুনেরা রেগে আছে।বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি আসবে,মেয়েটার কাছে তা ভালো লাগছে না।”
–“কিছুদিন পর এই বাড়িতে সারাজীবনের জন্য আসবে ভাবী।আগে আসলে সমস্যা কি?ভাবী আর উনার বাবা এক নৌকার মাঝি।শুধু ঐ ছোটটা একটু মাথামোটা।”
অধর বাঁকা করে উমাইর।

–“আব্বা!কেনো মেয়েটাকে এমন বলো তুমি?জানো জাফরানের মামাতো ভাইয়ের জন্যে তোমার মামী চাচ্ছে তাহুরাকে।ছেলেটা ছবি দেখেছে তাহুরার। কাল আসলে সরাসরি দেখবে বললো।আমি বলেছি,মেয়েটা এখনো ছোট।আর…”
–“আমি পছন্দ করি…তাহুরা আমার,মামীকে বলোনি? মেয়েটাকে আমার প্রতি ভাবাতে কি এফোর্ট দিয়েছি সেটা আমি জানি।তাহুরাকে দেখার সাহস যেনো না করে কেউ।”
উমাইর ক্রোধে মাতোয়ারা।মায়ের দেওয়া সংবাদ তার পছন্দ হয়নি।শরবতটুকু শেষ করে এক চুমুকে।ছেলের রেগে যাওয়া দেখে খেয় হারায় মেঘলা।মুখে আঁধার জমে তার,

–“তোমার মামীকে এগুলো এখন বলা যাবে না।বললে ঢোল পেটাবে সবার কাছে।তাহুরাকে নিয়েও ঠাট্টা করবে।এমতাবস্থায় তাহুরার উপর প্রভাব পড়বে।আগে তোমার ভাইয়ার বিয়েটা হউক।মেয়েটাও ছোট।মুন্সী কেমন লোক তুমি এতদিনে বুঝোনি?উল্টাপাল্টা কিছু উনার কানে গেলে তাহুরাকে ঘরবন্ধী করতে ভাববেন না একদণ্ড।ফুটফুটে মেয়েটার জীবন বিষিয়ে যাবে আব্বা!”
মায়ের প্রত্যেকটা অক্ষর মনোযোগ দিয়ে শুনে উমাইর।বাক্যগুলো নিতান্ত সঠিক।এলোমেলো পদক্ষেপ নিলে সবকিছু বিন্যস্ত হারাবে। সহস্র কথা মেনে নিলেও তাহুরাকে অন্যকেউ দেখবে,হজম হচ্ছে না উমাইরের।সে শক্ত মুখে মাকে জবাব দেয়,

–“মামীর ভাইয়ের ছেলের সাথে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা আছে,মা।আমার বোকার দিকে অন্য নজরে কেউ দেখবে,আমি সহ্য করবো না।”
–“এগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার।দেখলে কি বিয়ে হয়?মাথা ঠাণ্ডা করো।”
–” মাথা কালকে তোমার বড় ছেলের শালীকে দেখলে ঠাণ্ডা হবে।এর আগে না।তাহুরাকে আমি রক্ষা করবো।হোক সেটা অন্য কারো দৃষ্টি বা জীবন থেকে।”
উমাইরের কণ্ঠে তেজ।পারছে না সে আজ,তাহুরাকে ঘরে তুলতে।মেয়েটা ছোট মেয়ে কেনো হলো?সমাজে বা এতো নিয়ম কেনো?
ফিরতে গিয়েও অটুট থেকে সে পুনরায় মাকে বললো,

–“প্রেমে পড়েছিলাম আমি,দেখে রেখেছি আমি, এতো বছর পর একটা সম্পর্কের টান সৃষ্টি করলাম আমি।আর সেই আমার থেকে আমার পাখিকে আরেকজন নেওয়ার চিন্তাটা আমার কাছে বিষাক্ত।আমি উমাইর,বিষাক্ত হলে সেই বিষে নীল হবে তাহুরা আর আমার মধ্যে আসা লোকজন।আমি কাউকে ছাড়ার পাত্র না।”
উমাইর থামেনি এক সেকেন্ড।উল্টো ফিরে হাঁটে।মাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলো,উমাইরের কলেজ-ভার্সিটি লেভেলে মাইরপিট,ঝামেলা করার ঘটনাগুলো।
মেঘলার প্রেসার বাড়ে যেমন। কাল সব ঠিক হওয়ার দোয়া করে মনে মনে।

উমাইর মোবাইল হাতে ব্যলকনিতে বসে।রাত বারোটা প্রায়।ফুলের টবগুলোর উপর টিমটিম করছে সাদা,গোলাপী রঙের লাইট।নতুন লাগিয়েছে উমাইর।তাহুরার দেওয়া গোলাপ গাছের ফুটন্ত গোলাপে নজর তার।পরক্ষণে নজর সরিয়ে মোবাইলে দৃষ্টি রাখে।তাহুরার কন্ট্যাক্টে ঢুকে।তিনদিন মেয়েটার খবর নেওয়া হয়নি উমাইরের।নেয়নি বলতে টুকটাক কথা হয়েছে এমন।কলেজের কাজের পর বন্ধুদের সাথে দেখা,এরপর বাসায় ফিরে খাওয়ার পর বিছানায় শুলে ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে যায় তার।তাও ফাঁক দিয়ে একটু করে খবর নেয় মেয়েটার।

আজ দুপুরে ফিরলেও,মায়ের কথাগুলো শোনার পর লাঞ্চ শেষে বন্ধুদের সহিত বেরিয়ে যায় পতেঙ্গা।সেথায় আড্ডার সমাপ্তিতে ফিরে মিনিট বিশ আগে।
তাহুরাকে অনলাইন দেখাচ্ছে।পাঁচ মিনিট পূর্বেও মেয়েটা তাকে মেসেজ পাঠায়,
–“আপনি কোথায়?খেয়েছেন রাতে?”
উমাইর বুঝে,সহস্র পুরুষের ভেতর তাহুরার জীবনে উমাইর তার সুপুরুষ।তাহুরা উমাইরে মত্ত সেটা উমাইর অনেক আগে জেনেছে।তাদের কথার শুরুটা ভয় পেয়ে হোক, শেষটা হবে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।কেবল উমাইর নামক লোকটার সাথে তাহুরা যোগাযোগ করে।
উমাইর প্রথমে টাইপ করে কিছুক্ষণ। পরে সেটা মুছে ফেলে।মেয়েটার কণ্ঠ শোনা দরকার তার।ফোন দেয় সে।রিং বাজছে।রিসিভ হচ্ছে না।ফোন কাটে অপর পাশ হতে।মেসেজ পাঠায় তাহুরা,

–“আপু,ভাইয়ার সাথে কথা বলছে।”
উমাইর জবাব দেয়নি।মেয়েটা নিজে আজ ফোন করবে উমাইরকে।বাধ্য করবে উমাইর।
ফের মেসেজ দেয় তাহুরা,
–“এই-যে আপনি আছেন?ঘুমিয়ে?”
মেসেজ দেখেও চুপ থাকলো উমাইর।
মিনিট তিনেক পার হয়।ইনকামিং কল আসে “স্টুপিড রূপসী” নাম্বার হতে।অধর প্রসারিত হয় উমাইরের।রুমে ফিরে উবুত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ফোন রিসিভ করলে তাহুরা সালাম দিয়ে কথা শুরু করে,

–“আসসালামুয়ালাইকুম,ঘুমিয়ে আপনি?”
মনে মনে সালাম নিলেও মুখে কর্কশ শব্দ শোনায় সে তাহুরাকে,
–“কেনো?না ঘুমালে তুমি ঘুম পাড়িয়ে দিবে?”
তাহুরার সত্তা কাঁপে।অধর চাপে দাঁত দ্বারা।লোকটা আবারও বেসামাল কথা বলছে!
–“আপনি কি ব্যস্ত?”
তাহুরা অকপটে বলে,কথা ঘুরাতে।
–“আমি কি বিবাহিত?”
উমাইর হুট করে এমন কথা বলবে বিশ্বাস করলো না তাহুরা।তার কানে ভনভন সুর।সে অভাবনীয় ভঙ্গিতে বলে উঠে,

–“জ্বী?”
–“কি জ্বী?আজ কিভাবে ফোন দিয়েছো?”
প্রসঙ্গ পাল্টায় উমাইর।মানবের মুখে রাজকীয় শয়তানি হাসি।
–“আপু জেগে আছে।তাই আমি অন্যরুমে এসেছি।একা একা আসাটা একটু ভয় ভয় করে।”
তাহুরা জবাব দেয়।
–“তুমিও যাও আপুর কাছে।আমাকে ফোন দিয়েছো কেনো?”
–“সরি।রাখছি তবে।”

মন খারাপ করে জবাব দেয় তাহুরা।সে তো এই লোকের অপেক্ষায় থাকে রোজ।উমাইর তাকে বাধ্য করেছে তার ব্যাপারে চিন্তা করার,যত্ন করার।লোকটার একদিন খবর না পেলে তাহুরা ব্যাপক অস্থির হয়।রাতে ঘুম আসে না।মুহূর্তে মেয়েটার আঁখিতে জল জমে।নাকে সর্দি এলে নাক টানে।
–“ফোন দিয়েছো তোমার ইচ্ছায়, কাটবো আমার ইচ্ছায়।”
উমাইর জবাব দেয়।
–“জ্বী।”
তাহুরা নাক মুছে জবাব দেয়।
–“কান্নার কি হলো?”

উত্তর আসেনি তাহুরার পক্ষ হতে।মেয়েটা মোবাইল রেখে বোনকে দেখতে গেলে হাত লেগে ভিডিও কলের অপশন চালু হয়।
বিপ করতে থাকায় উমাইর ফোন কান হতে সরায়।হঠাৎ ভিডিও কল দেখে অবাক হলেও কল রিসিভ করে।সিলিং দেখা যাচ্ছে।উমাইর উঠে বসে।তার উদাম কাঁধ,বুকের উপরিভাগ দৃশ্যমান।ভ্রু জোড়া কুঁচকে।আচমকা হলো কি?তাহুরা কোনো সমস্যায় পড়েছে?
সে কিছু বলার পূর্বে তাহুরা ফোন তুললেও উমাইর স্পষ্ট দেখতে পায় সুতির ফতোয়ায় আবৃত তাহুরাকে।মেয়েটা এখনো অন্যদিক চেয়ে।যেনো খুব সাবধানে কিছু চেক করে ফের এই কামরায় এসেছে।তাহুরা ফোন কানে ধরবে,এমন সময় উমাইর কথা বলে,

–“এনি প্রবলেম?”
স্পিকারে কথা শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠে তাহুরা।বুকের সাথে মোবাইল চেপে ধরে।ঘটনা কি সেও বুঝলো না।পরক্ষণে সাবধানে মোবাইল মুখের সামনে ধরলে,তাহুরার মুখ হতে বুক পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়।
অপর দিকে উমাইরকে দেখে পা হতে জমিন সরে তাহুরার। উমাইরের উদোম শরীর দেখা কি খুব দরকার ছিল তার?হাত হতে মোবাইল পড়তে নিয়েও সামলে নেয়।
অপরন্ত উমাইর ওড়না বিহীন তাহুরার রূপে দিগ্বিদিক শূন্য।সুতির ফতোয়ার উপরের বোতাম খোলা।নিজের হুঁশ বুদ্ধি লোপ পাওয়ার পূর্বে ফোন কাটে উমাইর।

রীতিমত এসির উপস্থিতিও তার শরীরকে ঘর্মাক্ত করে।খোলা চুল,কিঞ্চিৎ লাল নাক,সাদাসিদে ফতোয়ায় আবৃত তাহুরা মাতোয়ারা করে উমাইরকে। বদ্ধ অনুভব হয় বুকের ভেতরটা।দুই আঙ্গুলের সাহায্যে চক্ষুদ্বয় আড়াল করে সে।মেয়েটাকে একান্ত নিজের করে নেওয়ার ভাবনাটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে আসক্তির ন্যায়।
মোবাইলের নোটিফিকেশন অনবরত আসতে থাকে।বিছানা হাতড়ে মোবাইল নেয় উমাইর।মেয়েটা একে একে মেসেজ দিচ্ছে,

–“আমি জানিনা কিভাবে কি হলো।আমি খুব সরি।আমি এমন মেয়ে না।”
–“সত্যি আমি ভিডিও কল দিইনি আপনাকে।”
–“আমার কোনো খারাপ ইচ্ছে নেই।স্যার আমি সত্যি দুঃখিত অনেক।”
–“আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ।আমার সহ্য হবে না।”
উমাইর হেসে উঠে।সে জানে ভুলে চাপ পড়ে ভিডিও কল চালু হয়েছে।ভুলটা উমাইরের পছন্দ হলো বেশ।তার প্রেয়সীকে যে নতুন রূপে দেখেছে।উমাইর ফোন দেয় তাহুরাকে।দুই রিং বাজলে ফোন ধরে তাহুরা।মুখ চেপে কান্না আড়াল করলেও উমাইর জানে তাহুরা কাঁদছে।
ভরাট গলায় উমাইর বলে উঠে,

–“বাসায় তোমার ভাইয়ারা আসলেও নিজেকে গুছিয়ে ওদের সামনে যাবা।ড্রেসের দিকে,ঘোমটার দিকে নজর দিবে।আর কি যেনো লিখেছো!স্যার কে?”
হেঁচকি উঠে তাহুরার।কথা বলার শক্তি নেই। তাও মুখ খুলে,
–“যাই।আমি এখন ঘুমিয়ে যাবো তাই..আমি সত্যি জানতাম না ভিডিও কল…আমি এমন মেয়ে না….”
–“জানি তো।কি হলো? কাঁদছো কেনো?”
উমাইর গলার আওয়াজ নরম করে।তার বোকা পরীকে শান্তনা দেওয়া মূল কাজ।
–“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন?”
নাক টেনে প্রশ্ন করে তাহুরা।
–“ভুল বুঝিনি এতক্ষণ।কিন্তু এখন বুঝবো।কলেজের বাহিরে আমি তোমার স্যার?”
উমাইর বিছানায় শোয়।গায়ে পাতলা কম্বল টানে।অধরে লেপ্টে প্রাণনাশক হাসি।
তাহুরা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,

–“নাহ।”
–“আমি তোমার কি?
মাথার নিচে এক হাত রাখে উমাইর।উত্তরটা তার প্রাণপ্রিয়।
–“এই-যে।”
–“কলেজের বাহিরে আর যদি স্যার ডাকো,তাহলে তোমাকে ভুল বুঝবো আমি।”
–“আর ডাকবো না।”
পরপর তাহুরা আবারও উমাইরকে বলে,
–“আপনি সত্যি আমাকে ভুল বুঝছেন না তো?”
তাহুরা অনেকটা শান্ত হয়।উমাইর তার অশ্রুকে কাবু করতে জানে ভালো।

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৩

–“ভুল না বুঝাতে চাইলে একটা কাজ করতে হবে তোমার।”
–“কি?”
তাহুরা ভাবনায় মশগুল।
উমাইর তার মনের ভাবনার প্রকাশ ঘটায়।সরাসরি মেয়েটার মুখ হতে প্রিয় ডাকটা শোনার বন্দোবস্ত করে।পুরুষালি ভারী,মাতোয়ারা কণ্ঠে উমাইর জবাব দেয়,
–“কালকে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে,
এই-যে দিয়ে আমাকে পাঁচটা প্রশ্ন করবে তুমি।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৫