রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৩

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৩
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“চিঠি উমাইর ভাইয়া না তুমি ছিঁড়েছো,তাই না?”
রুদ্ধ কণ্ঠস্বর আফিয়ার।তাহুরা ভীত,চমকিত।কক্ষে ফিরে এলে আফিয়া নানান প্রশ্ন করে উমাইর সম্পর্কে।যখন জানে সে,উমাইর বকেনি তাহুরাকে।উল্টো চিঠি ছিঁড়েছে তার;তখন ক্রোধে মত্ত হয় আফিয়া।চেপে ধরে তাহুরার বাহু।
তার ঝলসানো আঁখিতে সরল তাহুরাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।জাফরান উঠে আসে বিছানা হতে।তাদের অবস্থা না বুঝে সে তাহুরার নিকট আসে।তার হাত টানে,

–“বাহিরে যায় আপু।চলো!”
তাহুরা স্থির।কান্না পাচ্ছে তার।বাহুতে পীড়া। আফিয়ার নখ দেবে যাচ্ছে সেথায়।তাহুরা নড়ে উঠে।ভেজা কণ্ঠে বলে,
–“আমি কেনো ছিঁড়বো আপু?আমি কিছু করিনি।”
–“এই,একদম নাটক করবা না। বড়বোন বড় ভাইকে হাত করেছে।ফকির কতোগুলো।এখন…”
বক্তব্য থামে আফিয়ার।দুয়ারে দাঁড়িয়ে মেঘলা বেগম।হুংকার ছাড়ে,
–“আফিয়া?নিজেদের বাড়ির সম্মানটা বজায় রাখো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দ্রুত হেঁটে এসে আফিয়ার খপ্পর হতে উদ্ধার করে তাহুরাকে।নিজ বুকে জড়িয়ে নেয়।
তাহুরা নিজ জগতে নেই।অন্য জগতে সে।আফিয়ার মন এমন নিচু!কই,তাকে দেখে তার মন মানসিকতা এমন,বুঝা দায়।তার বোন এই বাড়ির ছেলেকে হাত করেছে?তাদের বাড়ির ছেলে তার বোনের জন্যে কি মাতোয়ারা হয়নি?হয়েছে,বেশ হয়েছে।হয়েছে বলে তাদের বিয়ে ঠিক।আফিয়ার ভাবনা বিষাক্ত কেবল।তার বোন নিতান্ত ভালো একজন মেয়ে।মেঘলার বুকে লেপ্টে ছলছল নয়নে তাহুরা নিজ ভাবনায় মশগুল।

–“বড় মা,তুমি জানো না এই মেয়ে কি করেছে!উমাইর ভাইয়াকে আমি চিঠি দিয়েছিলাম আর মেয়েটা চিঠি ছিঁড়ে নাম দিচ্ছে উমাইর ভাইয়ার।”
গলার স্বর উচুঁ আফিয়ার।
হাত দেখিয়ে থামায় মেঘলা বেগম আফিয়াকে,
–“তুমি ভালো জানো,চিঠি কে ছিঁড়েছে।ভাগ্যিস উমাইর ঘরে নেই।বেরিয়েছে।যদি এমন তামাশা দেখতো,তাহলে কি হতো তুমি সেই বিষয়ে অবগত।তোমার রুমে যাও।”
–“সামান্য একটা মেয়ের কাছে এতো বছরের সম্পর্কের আমার, দাম নেই কোনো।তাই না?”
আফিয়ার নয়নে ক্রোধের অশ্রু।

–“ব্যাপারটা অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করো না আফি।তুমি রুমে যাও।ভুলে যেও না,সেদিনের বিচারকার্যে বলা হয়েছিল উমাইরের ব্যাপারে তুমি কোনোদিন কিছুতে কথা বলবে না।মর্যাদা রাখো পরিবারের।মেহমানদের সাথে ফের এমন ব্যবহার করলে তোমার বাবা মাকে বলতে আমি বাধ্য হবো আজকের ব্যাপারটা।”
মেঘলার কথা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগে আফিয়ার।সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহুরার পানে চেয়ে দৌড়ে পালায় নিজ কক্ষে।
মেঘলা বুক হতে তাহুরাকে উঠায়।মাথায় হাত রাখে,

–“আফিয়া মেয়েটা ভালো।কেবল উমাইরের সাথে একটু ঝামেলা হওয়ায় মেয়েটা বিগড়েছে।কিছু মনে করো না ওর কথায়। উমাইর বা বাসায় কাউকে কিছু বলো না ঘটনাটা।ঝামেলা বাড়বে নাহয়।”
তাহুরা মাথা নাড়ে।অর্থাৎ সে বলবে না।এমনিও মেয়েটা জঘন্য ঘটনার কথা এড়িয়ে যেতো। উমাইরকে তো কস্মিককালে বলতো না।লোকটাকে তার ব্যাপক মনে ধরলেও,লোকটার প্রতি তার ভীতি কাজ করে।
–“আন্টি ভাইয়ারা কি এসেছে?আমি বাসায় যাবো।”

তাহুরার মলিন কন্ঠ।তার মলিন মুখখানা কেমন হাহাকার সৃষ্টি করে মেঘলার অন্তরে।ফের হাসিমুখ ফেরানোর জন্যে মেঘলা তাদের নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা জাফরানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“দেখলে জাফরান তোমার তাহুরা আপু নাকি না খেয়ে চলে যাবে।তুমি তাকে যেতে দিবে?”
জফরান আবারও ঝাপটে ধরে তাহুরাকে।ফোকলা দাঁত বের করে হাসে,
–“নাহ নাহ দিবো না।”
তাহুরা হাসে কিঞ্চিৎ।মন খারাপ এখনো বিদ্যমান।তাও ছোট মানুষটার জন্যে মন খারাপ করে থাকে কি করে?তাহুরা হাঁটু গেড়ে বসে।জাফরানের চুলে হাত বুলায়,
–“যেতে হবে ছোট ভাইয়া।”
জাফরান তার ছোট হাত দ্বারা আগলে নেয় তাহুরাকে।স্মিত হেসে বলে উঠে,

–“পরে যাবা।”
তাহুরা জাফরানের পিঠে হাত রাখে।মেঘলা আদুরে নজরে পর্যবেক্ষণ করে তাদের।তার ভাইয়ের ছেলেটা একটু বদমেজাজি।সহজে কারো সাথে বনে না তার।অথচ সে তাহুরার জন্যে কেমন ছন্নছাড়া।মেয়েটা এমন আদুরে,কেউ তার মায়ায় না পড়ে থাকতে পারবে কি!
দুজনে বিছানায় বসে।তাহুরার উরুতে শুয়ে মোবাইল উঁচিয়ে মুহূর্তে মগ্ন হয় জাফরান। তাহুরাও সেদিকে মন দিতে ব্যস্ত।মেঘলা বুঝে তাহুরার মন অশান্ত এখন।তাই সেও তাদের নিকট যায়।ইনিয়ে বিনিয়ে তাহুরাকে সহজ করতে মুখ খুলে,
–“উমাইর ফিরলে এরপর তোমাদের যেতে দিবো।”
আফিয়ার ব্যাপারে ভাবুক তাহুরা মেঘলার কথা ভালোভাবে বুঝেনি।সে প্রশ্ন করে,

–“জ্বী আন্টি?”
–“বলছি উমাইর এলে এরপর যাবে তোমরা।উমাইর বললো জলদি ফিরবে সে।”
মেঘলা জবাব দেয়।
–“নাহ আন্টি।ভাইয়ারা এলে চলে যাবো।আসলে দেরী হচ্ছে।”
–“ওরা ফিরবে দ্রুত।ভাত না খেয়ে যেতে দিবো ভেবেছো কিভাবে?আর মা তুমি আফিয়ার ব্যাপারে কিছু মনে করো না।”
–“করবো না আন্টি।কিন্তু উনার কথাগুলো আমার একটুও ভালো লাগেনি।জুবায়ের ভাইয়া আমার আপুকে পছন্দ করেছে প্রথমে।এরপরই ওদের সম্পর্ক হয়।শেষে আফিয়া আপু কি যেনো বলতে চেয়েছো আমার…”
তাহুরার কণ্ঠ ভেঙে আসছে। অশ্রুরা কেমন মিছিল করছে।

আফিয়া উমাইর এবং তাহুরার বিষয় উল্লেখ করতে চেয়েছে জানে মেঘলা।তাই যথা সময়ে থামিয়েছিলো মেয়েটাকে।উমাইর সব ভেবে রেখেছে।তাছাড়া,উমাইর যদি আফিয়ার কান্ড সম্পর্কে জানে ছেড়ে কথা বলবে না ছেলেটা আফিয়াকে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘলা বলে,
–“ওর কথা ভেবো না আর।সুনেরা মা এবং তোমার পরিবার কেমন আমি বেশ জানি।চিন্তা করো না।ছেলেমানুষী করছে কেবল আফিয়া।”
–“বুঝেছি আন্টি।”
জোর পূর্বক হেসে বললো তাহুরা।মেঘলা মেয়েটার মন অন্যদিকে ধাবিত করতে উমাইর সম্পর্কে আলোচনা শুরু করে। তাহুরাও অন্তর নরম করে শুনতে থাকে সেই আলোচনা।

উমাইর ফিরে আসে রাত দশটার দিকে।তখন সকলে খেতে বসেছে।তাহুরার হুঁশ অতীত নিয়ে মগ্ন খাওয়ার সময়ও।আফিয়ার করা অপমান ভুলতে পারছে না সে।তাহুরা নিশ্চিত তার বাহুতে দাগ হয়েছে আফিয়ার নখের খোঁচার।আফিয়া খেতে না আসায় মেয়েটা আরো চিন্তিত।সে সত্যিকারে রাগ করেছে তাহুরার সহিত।বিনা কারণে তার সাথে রাগ করলে সেটা সহ্য হয় না তাহুরার।ভাত নাড়াচাড়া করছে দেখে মেঘলা তার কাঁধ স্পর্শ করে বলেই ফেলে,
–“তাহুরা মা,আন্টির খাবার মজা হয়নি?”

আঁতকে উঠে তাহুরা।মাথা তুলে আন্টির দিকে দেখতে চাইলে উমাইরকে দেখতে পায় সে।লোকটা কোট কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে।দুহাত বুকে গুঁজে।দৃষ্টি সরায় সে মুহূর্তে।ম্লান হেসে বলে,
–“অনেক মজা হয়েছে।”
–“খাচ্ছো না কেনো তবে?আমি খাইয়ে দিবো?’
–“নাহ আন্টি।ঠিক আছি।”

নিজ জবাব শেষে মাথা নুইয়ে তাহুরা খাবারে মন দেয়।উমাইরের তির্যক দৃষ্টি দূর হতেও অনুভব করছে মেয়েটা।
মুন্সীর বারংবার ফোন কলে তাহুরা দিশেহারা।রাত এগারোটায় ঘড়ির কাঁটা।ইমন একা বড় ছেলে। মেয়েদের নিয়ে সে ফিরবে বলে মনে শান্তি নেই মুন্সীর।ইমনকে আবারও ফোন করেছে মুন্সী।সকলে বের হবে সেই মুহূর্তে ফোন ধরে সে,
–“আঙ্কেল,আমি সাবধানে নিয়ে আসবো তাহুরাকে।ওর সাথে আমার নিজের ভাই বোন আছে। অতিরিক্ত চিন্তা করলে কিভাবে হয়?”

ইমন শঙ্কিত।মুন্সীর প্রতি আলাদা এক ভয় আছে ইমনের ছোটকাল হতে।
–“ইমন,আমি আর ভাই যাচ্ছি তোমাদের সাথে। বাইক নিয়ে বের হবো।আঙ্কেলকে বলো তোমাদের গাড়ির পিছে আমরা থাকবো।টেনশন করতে মানা করো উনাকে।”
উমাইরের গম্ভীর সুর।সে এসেছে পর্যন্ত তাহুরার মলিন মুখশ্রী অবলোকন করে মেজাজ খোয়াচ্ছে বারংবার। তার উপর মুন্সী এমন ফোন করায় মেয়েটা আরো কুঁকড়ে যাচ্ছে।

–“আঙ্কেল,উমাইর ভাইয়া আর দুলাভাই আসছে বাইকে।আমাদের পিছু।এখন শান্তি লাগছে?”
ইমনের প্রশ্নে বিপরীতে কি বললো শোনেনি কেউ।কিন্তু,তার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝলো মুন্সী এখন শান্তিতে আছে।
বিদায় বেলা শেষে সকলে উঠে গাড়িতে।উমাইর এবং জুবায়ের মোটর বাইকে।ঘাড় বাঁকিয়ে পেছন ফিরে তাহুরা।সেকেন্ডের মাঝে উমাইরের মোটর বাইক শব্দ করে সম্মুখে এসে যায়।
বুক দুরুদুরু তাহুরার।বেশ দ্রুত চালাচ্ছে উমাইর।আবার কিছু পথ অতিক্রম করলে গাড়ির স্পিড কমিয়ে দেয়।তাদের তালে চলে।

আজকের সকল কর্মকাণ্ডে রীতিমত মাথা ধরেছে তাহুরার। গাড়ির কাঁচে হেলান দিয়ে সে ভেবে যাচ্ছে সব মুহূর্ত।অথচ আঁখিতে উমাইরের বাইকের অবয়ব। আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে চলছে মোটর বাইক তবে সাবধানের সহিত।উমাইর নিশ্চয় বেশ দক্ষ।
বাড়ির গেইটে সুনেরা একা।বাবাকে না দেখে তাহুরা দ্রুত গাড়ি থেকে নামে।ইমন বিদায় জানিয়ে চলে যায়।জুবায়ের নামলে উমাইর মোটর বাইক সাইডে রাখে।
শুনতে পায় তাহুরার চাপা আর্তনাদ,

–“বাবা কোথায়?”
–“বাসায়।আমাকে গেটে দাঁড়াতে বললো তোর জন্যে।বাবার হয়তো প্রেসার বেড়েছে।”
তাহুরা বাবার চিন্তায় মুষড়ে যায়।তারপরও পেছন ফেরে বলে,
–“আমি আসছি।বাসায় আসবেন আপনারা প্লিজ।”
তাড়াহুড়োয় ফিরতে নিলে গেইটে ওড়না আটকে যায় তার।উমাইর চেঁচিয়ে উঠলো সাথে সাথে,
–“তুমি তাড়াহুড়োয় গেলে আঙ্কেল ঠিক হয়ে যাবে?”
–“ভাইয়া ঠিক বলেছে।আস্তে যা তাহু।”
বোনের কথা শুনে ভেতরে ঢুকে তাহুরা।উমাইরের ধমকে এখনো তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে আতঙ্কে।উমাইর এমন বকছে কেনো?

সেদিন বাবাকে মাঝ রাত অব্দি পাহারা দিয়ে কক্ষে ফিরে তাহুরা। পড়নে তার ফতোয়া এবং ঢোলা প্যান্ট,গলায় ওড়না জড়ানো। বিছানায় এক পা তুলে বসে সে। অপর পা ঝুলিয়ে বালিশের নিচ হতে মোবাইল বের করে।
উমাইরের মেসেজ বেশ কয়েকটা।একটা প্রশ্ন দুবার করে করা। যেনো উত্তর চাইই চাই উমাইরের।তাহুরা মেসেজের উত্তর লিখতে গেলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে।উমাইর ফোন দিচ্ছে তাকে।
হাত পা কাঁপছে তার।আফিয়ার ব্যাপারে অনেকবার প্রশ্ন করেছে উমাইর। ফোনে সরাসরি কিভাবে কথা বলবে?উমাইর তার মিথ্যে সহজে ধরবে।তাই ফোন কেটে উত্তরে লিখে,

–“আপু ঘুমাচ্ছে।”
–“অন্যরুমে যাও।”
উমাইর লিখে।
–“সবাই ঘুমিয়ে।এখন যাওয়া সম্ভব না।এইখানে বলুন।”
তাহুরার বুক ঢিপঢিপ করছে।
মিনিট এক পর মেসেজ আসে উমাইরের পক্ষ হতে,

–“আজ আমি যাওয়ার পর কি হয়েছিল?আফিয়া বকেছে?”
–“সব ঠিক আছে।আপনি চিন্তা করবেন না।আমি একটু ঘুমায়।খুব মাথা ব্যথা।আল্লাহ্ হাফেজ।”
তাহুরা মোবাইল রাখে। মিথ্যে বলতে নারাজ সে।এইদিকে সত্যটা বলা যাবে না।শুয়েও শান্তি মিলছে না তার।
উমাইর নিশ্চয় মেসেজে বকা দিচ্ছে এতক্ষণে।তাকে বকুনি দিক,তাও শান্তি।অন্তত আফিয়ার সহিত কোনো ঝামেলা তো হবে না। শত চিন্তায় বোনকে জড়িয়ে ধরে তাহুরা।মাথা ব্যথায় আঁখি খিঁচে বন্ধ করে।

আজসহ একদিন উমাইর মেসেজ দেয়নি।অথচ লোকটা প্রায় অনলাইনে থাকে।দুবার নিজ থেকে মেসেজ দিয়েছে তাহুরা।তাও উত্তর দেয়নি উমাইর।
বসার ঘরের সোফায় বসে ভাবুক হয় তাহুরা।সেদিনের জবাবে লোকটা নিশ্চয় ক্ষেপেছে।এখনো উমাইরকে অনলাইনে দেখাচ্ছে একটিভ।তাহুরা কোনো ভনিতা ছাড়া লিখে,
–“আজ মার্কেটে আসছেন?”

হঠাৎ করে সকালে ফোন করে মেঘলা।বিয়ের কেনাকাটার জন্যে আজকের দিনটা নির্ধারণ করে।তাদের পরিবার হতে উমাইর ব্যতীত সকলে এবং জাফরানের বাবা-মা আসবে।তবে,তাহুরার পরিবার হতে কেবল শিউলি,তাহুরা এবং সুনেরা যাবে।তাহুরা কামিজের সাথে হিজাব বেঁধেছে আজ, বোনের দেখাদেখি।
উমাইর মেসেজ সিন করে আবারও।কিন্তু,জবাব দিচ্ছে না।
তাহুরার ভেতরে শঙ্কা।লোকটা কি তার সহিত আর কথা বলবে না?সিএনজি এলে মা,বোনের সাথে বেরিয়ে যায় তাহুরা।তবে, মনে মনে দোয়া করে আজ যেনো লোকটা আসে মার্কেটে।

শহরের বিখ্যাত মার্কেটে তারা।বেশ এক্সপেনসিভ।মার্কেটের নিচে বোনের শ্বশুরবাড়ির অপেক্ষাকৃত লোকদের দেখতে পায় তাহুরা।কেবল তার মেসেজের উত্তর না দেওয়া লোকটা,তার ভাই, তার চাচা ও নিবরাস অনুপস্থিত।
আফিয়ার সাথে দৃষ্টি মিললে তাহুরা হাসতে চায়।কিন্তু,আফিয়া দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরায়।সকলের সাথে তারা ভেতরে যায়।পরিচিত দোকান মেঘলার।দেখতে পেয়ে সখ্যতা করে মেঘলা সহ সকলকে।

বেশ ডিজাইনিং লেহেঙ্গা পছন্দ করে মেঘলা তার ছেলের বউয়ের জন্যে।জুবায়ের বারংবার বলেছে তার বউয়ের জন্যে কলিজা রঙের লেহেঙ্গা পছন্দ করতে।ছেলেটা কাজের চাপে আসতে পারেনি আজ।
হাসিমুখে সব পছন্দ করা কাপড় সুনেরার গায়ে জড়িয়ে দেখছে,মনকে শান্তি দিচ্ছে মেঘলা।পরপর মোবাইল বেজে উঠে।তার আদরের ছোট ছেলে ফোন দিয়েছে।
সুনেরাকে আরো কয়েকটা লেহেঙ্গা দেখতে বলে ফোন ধরে একটু চেপে যায় সে,
–“বাবা,আসবে?কই তুমি?”
–“বোকাটা এসেছে?”
উমাইর প্রশ্ন করে।

–“বাবা!ওর নাম তাহুরা।এসেছে সে।ওর জন্যে কি রঙের জামা কিনবো বলো?”
–“আসছি আমি।ওকে কিডজোনে বসিয়ে আসো জাফরানের সাথে।”
উমাইর মায়ের কথায় জবাব দেয়।
–“মেয়েটাকে সব রঙে মানায়।জলপাই রঙের শাড়ি হলে বেটার।”
সঙ্গে সঙ্গে ফোন কাটে উমাইর।
মেঘলা হাসে।পেছন ফিরে তাহুরাকে অবলোকন করে। প্রেয়সী মেয়েটাতে তার ছেলে একেবারে বুদ হয়েছে।জাফরানকে কি সুন্দর সামলিয়ে রেখেছে মেয়েটা।অথচ অন্যবার জাফরান মার্কেটে এলে কি কান্নাটাই না করে!

মেঘলা সকলকে মানিয়ে তাহুরা এবং জাফরানকে কিডজোনে নিয়ে যায়।সুনেরা বা শিউলি আপত্তি জানায়নি।এইভাবে তাদের মেয়ের কোল ছাড়া ছেলেটা বসছে না।নিশ্চয় তাহুরার পায়ে ব্যথা হচ্ছে।মুখ বুঁজে ব্যাথা সহ্যের চেয়ে কিডজোনে জাফরান খেললে এবং তাহুরা বসে থাকলেই ভালো।নিঃসন্দেহে এই মার্কেট বেশ নিরাপদ।
সুরক্ষিত জায়গায় বসিয়েছে মেঘলা তাহুরাকে।

তার সম্মুখে জাফরান বাউন্ডারির অপর পাশে খেলনার ঘোড়ায় বসে।খিলখিলিয়ে হাসছে।মেঘলা কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করতে গেলে মেসেজ আসে ফোনে।তার ছেলে পার্কিংয়ে।
তাহুরাও স্বস্থির শ্বাস ফেলে।বিয়ের বাজারে তার বসে কাপড় দেখা ছাড়া কাজ ছিল না।এখন জাফরানসহ বাকি বাচ্চার খেলা দেখা যাক।

উমাইর কিডজোনের সম্মুখে এলে মাকে দেখে।নিজের গম্ভীরতা বজায় রাখে উমাইর।মেঘলা তাহুরার আড়ালে দাঁড়িয়েছে।মাকে উমাইর প্রশ্ন করে,
–“কেনাকাটা শেষ?”
–“দেরী হবে।লাঞ্চ করেছো?”
মায়ের প্রশ্নে উমাইর মাথা নাড়ে,
–“এখন খাবো।”
–“আচ্ছা এইখানের ক্যাফে থেকে কিছু খেয়ে নিও তুমি। তাহুদের জন্য‌ও নিও।ভেতরে আছে তাহুরা।বকবে না ওকে কিছু নিয়ে।”
মেঘলা বলে।

–“দেখা যাক।থ্যাংকস মা।”
উমাইর গটগট পায়ে এগিয়ে যায় সম্মুখে।
হাঁটতে হাঁটতে শার্টের হাতা কুনই পর্যন্ত উঠায় উমাইর। কিডজোনের ভেতরে অবস্থিত ক্যাফে থেকে কিছু নাস্তার আইটেম নিয়ে সামনে অগ্রসর হয় সে।তাহুরার পেছন দিক দৃশ্যমান।পেছন হতেই উমাইর থমথমে কণ্ঠে বলে উঠে,
–“মার্কেটে এসছি।আমাকে কি করবে এখন?”

বিস্ফোরিত হয় তাহুরার নজর।পেছনে বাঁক ফেরার পূর্বে উমাইর তার পাশে চেয়ার টেনে বসে।চেয়ারে হেলান দেয়।তার বিশালাকৃতির দেহে নিমিষে চোখ বুলিয়ে ফেলে তাহুরা।অন্তরে স্রোতের আগমন।রিরি করে উঠে সারা সত্তা। দৃষ্টি ঝুঁকে যায় মুহূর্তে।ধীর শব্দে জবাব দেয়,
–“কিছু না।”
–“তাহলে জিজ্ঞেস করেছো কেনো?”
উমাইর প্রশ্ন করে।মেয়েটাকে দ্বিধায় ফেলতে তার সুখ অনুভব হয়।দূর হতে হাত নাড়িয়ে জাফরানকে ইশারা করে উমাইর। বিনিময়ে জাফরান হাত নাড়িয়ে নিজের খেলায় মত্ত হয়।

–“এমনি।আপনি মেসেজ দিবেন বলে আর মেসেজ দেননি।”
তাহুরার নজর মেঝেতে। উমাইরের চকচকে কালো রঙের সুয়ের উপর।
–“আমার কথার জবাব উল্টাভাবে দিলে আমি একদম বেঁকে যায়।
বার্গারে কামড় দেয় উমাইর। অপর বার্গার তাহুরার দিকে এগিয়ে দেয়,
–“খাও।জাফরান এলে ওর জন্যে আলাদা নিবো।”
তাহুরা হাত টেনে নেয়। খেতে না চেয়েও কামড় বসায়।চিজ এবং সসে বার্গার মাখামাখি।তাহুরা খাওয়া অবস্থায় বলে,
–“আমি কি করলাম?”

মাথা উঠায় মেয়েটা।উমাইরের দৃষ্টি তাহুরা অধরে আটকে।সস্ লেগেছে কিছুটা। হিজাবেও পড়েছে।ভ্রু কুঁচকে যায় উমাইরের।একটা নির্দিষ্ট সময় পর এই দৃশ্যটা যদি তার বাসায়,তার রুমে একান্ত তার সম্মুখে হতো তাহলে তাহুরার এমন অগোছালো সবকিছুর দখল উমাইরের নিকট থাকতো।
মনের নিষিদ্ধ ইচ্ছাটাকে দমিয়ে নিলো উমাইর।টিস্যু এগিয়ে দেয়,
–“কিছু না করেও সবটা এলোমেলো করো তুমি,
মাথামোটা।”
–“জ্বী?”

তাহুরা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে।
–“জ্বী না বলে লিপ্স মুছো।মানুষকে দেখাও তোমার অগোছালো রূপ?”
উমাইর ফের কামড় দেয় বার্গারে।
তাহুরা টিস্যু নেয়।দ্রুত ঠোঁটে চাপে,
–“বাহিরে আমি বার্গার খুব কম খাই।আপনার ভয়ে কিছু বলিনি।”
–“কিছু না বলে আমার মনকে অনেক কিছু ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছো।”
কথাটা বলে উমাইর বার্গার রাখে।কপালে আঙ্গুল চাপে।
তাহুরা অবাক হয়।সে কি করলো?উমাইর কি বলতে চায়?
চারিদিকে নজর বুলায় তাহুরা।মানুষের সংখ্যা একদম কম।যারা আছে উনারা নিজের কাজে ব্যস্ত।তাহুরা একটু থামে।মলিন সুরে বলে,

–“কি হয়েছে?আমি কি করেছি?”
ঝলমলে সোনালী আলোতে উমাইরের অবয়ব মনোরম।
উমাইর কিছু বলছে না।এখনো সেভাবে বসে।যেনো ভেতরকার কিছু ভাবনা নিজ মনে আড়াল করছে সে।
তাহুরা চেয়ার সমেত একটু এগিয়ে যায়। উমাইরের গায়ে প্লেট দ্বারা ধাক্কা দেয়,
–“এই-যে আপনার কি মাথা ব্যথা করছে?একটা পেইনকিলার খাবেন?”
উমাইর ফট করে দৃষ্টি মেলে।তাহুরার মুখোমুখি হয়।নিজ চুল ঠেলে পিছনে।তাহুরার ললাটে আঙ্গুল স্পর্শ করে।ধীর তবে মোলায়েম সুরে বলে,

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১২

–“যেখানে ব্যথা হচ্ছে,সেই ব্যথার ঔষধ নেই।এই ব্যথা নাশের জন্যে যেটা দরকার সেটা এখনো আমি পায়নি।পেলে ব্যথার “ব” আমার জীবনে আসতে দিবো না।বুঝেছো মাথামোটা?”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৪