রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১২

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১২
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“তাহু,প্লিজ উঠে পড়। সন্ধ্যা হতে চললো।কবে রেডি হবি,কবে যাবি ঐ বাসায়?”
ঘুমন্ত তাহুরা বেখবর।তার বোনের ডাক তার কর্ণগুহরে প্রবেশ করলো নাকি আয়ত্বে এলো না সুনেরার।সে বিছানায় শায়িত তাহুরাকে ধাক্কা দেয় আলতো হাতে,
–“এই মেয়ে!”
তাহুরা এইবার ধড়ফড়িয়ে উঠে।ঝাপসা চোখে বোনকে দেখে।সুনেরা রেগে আবার চিন্তিত।এক হাতে ডান চোখ কঁচলে তাহুরা বোনের কাঁধে মাথা রাখে। সুনেরা আলতো করে বোনকে জড়িয়ে নেয়,

–“ইমন আসলে কিন্তু একদম অপেক্ষা করবে না।অলরেডি দুইবার ফোন দিয়েছে।”
–“যেতে ইচ্ছে করছে না।”
তাহুরা কষ্টে মুখ খুলে।মেয়েটার মন অশান্ত।উমাইর দুদিন যাবত তার সাথে যোগাযোগ করেনি।তাহুরা কতো মেসেজ দিয়েছে তাও উত্তর দেয়নি লোকটা।অথচ কিছুক্ষণের জন্যে হলেও উমাইরকে অনলাইনে দেখেছে তাহুরা।
–“জলদি উঠে তৈরি হো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সুনেরা ধমক দিলে তাহুরা দ্রুত ছুটে।ইতোমধ্যে মেয়েটার আঁখিতে জল ছেপে।একে উমাইরের কারণে অন্তরে ঝড় তার,দ্বিতীয়ত আপু আচমকা ধমক দিলে মেয়েটা ভেঙে যায় যেনো।বালতির পানি দ্বারা অনবরত মুখ ধুতে থাকে সে।চোখে জ্বালা করছে মেয়েটার।
বারংবার মনে একটাই প্রশ্ন ভাসছে,উমাইর কেনো তার সাথে যোগাযোগ করছে না?

কান্নার কারণে হেঁচকি উঠে তাহুরার।তাও মুখে পানি দিতে থাকে।উমাইরের প্রতিচ্ছবি তার আঁখি জুড়ে ভাসমান।
কেনো এমন অবহেলা করছে উমাইর তাকে,জানেনা সে।অবহেলার সন্ধান কি কেবল তাহুরা অহেতুক ভাবছে?একমাত্র উমাইরের সাথে প্রায়শ কথা হতো তার।সর্বোচ্চ একদিন উমাইর তার সাথে গ্যাপ রেখে মেসেজ দিয়েছে।তবে,দুদিন হওয়াতে মেয়েটা কেমন মুচড়ে গেলো।বুকে তীব্র জ্বালাতন।বারংবার ভেসে উঠছে উমাইরের মুখশ্রী।সত্যি বলতে,তাহুরা ইদানিং উমাইরের সাথে স্যার হিসেবে নয় বরং মনের অন্য পিছুটানের কারণে যোগাযোগ করে।

উমাইরের আদেশ,উপদেশ,যত্ন,ধমকের সহিত শাসানো বাধ্য করেছে সৃষ্টি করতে উমাইরের জন্যে তাহুরার অন্তরে অন্যরকম প্রশান্তির টান। যার কারণে ভোর অব্দি তাহুরা অপেক্ষা করে উমাইরের পক্ষ থেকে একটা মেসেজের।
সুনেরা আবার ধমক দিলে তাহুরা দ্রুত বেরোয় ওয়াশরুম হতে।তাওয়াল দ্বারা মুখ চেপে ধরে।সুনেরা তাহুরার যাবতীয় সবকিছু বিছানায় সাজিয়ে রাখলো।অবশেষে বোন লক্ষ্য করে তাহুরার মলিন চেহারা, ফুলো মুখ,

–” চোখ,নাক ফোলা কমবে এখন?কেনো কেঁদেছিস?”
–“আর কাঁদবো না।”
তাহুরার চাপা সুর।
সুনেরা হাসে।বোনকে কাপড় দিয়ে পড়ার ইশারা করে।তাহুরা ধীরে সুস্থে কাপড় জড়ায় তনুতে।নতুন কাপড়।কারুকার্য বেশ মার্জিত।
জামাখানা তাহুরার শরীরে জ্বলজ্বল করছে।সুনেরা বোনকে উপর নিচ অবলোকন করে।সে ভাবে,বোনের আর কোনো সাজসজ্জার দরকার আছে কি?ফুলো আখিদ্বয়,রক্তিম নাক,ফুলো ঠোঁট মেয়েটার চেহারাকে প্রসাধনীবিহীন মনোরম লাগছে ঢের।তারপরও বোনকে ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে বসিয়ে সাজিয়ে দেয় একেবারে সাদাসিধে।ওড়না বুকে সেট করতে নিলে তাহুরা মুখ খুলে,

–“মাথায় ঘোমটা দিবো।”
–“আচ্ছা।”
সুনেরা জবাব দেয়।
তাহুরার ঘন কেশ যুগল আঁচড়িয়ে পিঠে বিলিয়ে দেয় সুনেরা।মাথায় ঘোমটা টানে বেগুনি দোপাট্টার।তাহুরার মুখে আঁধার।হাসি নেই।সুনেরা অনেক কথা বললেও কিচ্ছুটি বলেনি মেয়েটা।ইমন এলে বেরিয়ে যায় ঘর হতে।মোবাইল নেয়নি।চুপটি করে বসে গাড়িতে।
শায়ন,আয়মা হেসে কুশল বিনিময় করলে মিথ্যে হাসে তাহুরা।পরিশেষে সুনেরা ইমনকে বলে,

–“তাহুরাকে দেখে রেখো ভাইয়া।”
–“চিন্তা করিস না।তোর ঐ চাচাতো ভাইবোন যাবে না?”
ইমন প্রশ্ন করে।
–“নাহ যাবে না।আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে তারা গুহায় ঢুকেছে।”
ক্ষিপ্ত হয়ে বলে সুনেরা।
হালকা আলাপ শেষে বিদায় জানায় তাহুরাদের।শিউলিও দুয়ারে দাঁড়িয়ে মেয়েকে নানান নির্দেশনা দিয়েছিলো।

গাড়িতে থাকা অবস্থায় শায়ন এবং আয়মার সহিত কথা বলার দরুণ তাহুরার মন কিছুটা হালকা হয়।হাসি লেপ্টে থাকতে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে।জানালার বাহিরে নজর দেয় তাহুরা।গাড়ি সম্ভ্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করে।অনেকটা ইমনদের বাড়ির এলাকার মতো।চারিদিকে রঙিন আলোর ছড়াছড়ি।উচুঁ উচুঁ বিল্ডিং।কিছু বড় গেইট লক্ষণীয়।সেই গেইটের আড়ালে অবস্থিত এক তোলা,দোতলা একা বাড়ি। এমনই বিশাল ফটকের সম্মুখে গাড়ি থামিয়ে হর্ন দেয় ইমন।দারোয়ান ছোট দরজা হতে বেরিয়ে আসে।ইমনের পরিচয় নেয়।ভেতর হতে ফোন আসে দারোয়ানের নিকট।পরমাত্মিয় জেনে সম্মানের সহিত প্রধান ফটক খুলে দারোয়ান।

গাড়ি ভেতরে অগ্রসর হচ্ছে,তাহুরা নজর ঘুরিয়ে চারিদিক দেখছে।নিঃসন্দেহে তাদের তুলনায় উমাইরদের বাড়ি,বাড়ির পরিবেশ হাজার গুণে উত্তম।সোনালী আলোতে মুখর আশেপাশে।তাহুরা নজর ঝুঁকায়।তার দেখতে ইচ্ছে নেই কিছুর।উমাইরের কথা মনে আসছে কেবল।লোকটা কি বাড়িতে আছে?
ঘরের প্রথম দরজার পানে এগোলে তাহুরা জাফরানকে দেখতে পায়।তার পিছে পনেরো ষোলো বয়সী মেয়ে একজন।হয়তো দেখভাল করে জাফরানের।জাফরান দৌড়ে তাহুরার নিকট আসে।দু হাত উঁচু করে,

–“তাহু আপু।কোলে নাও।”
তাহুরা হাসে।কোলে উঠিয়ে নেয় জাফরানকে।একটু হাঁপিয়ে যায় তাহুরা।ভেতরে গেলে চাকচিক্যে নজর জোড়া বিস্ফোরিত হয় মেয়েটার। প্রচন্ড বিলাসিতায় ঘেরা ঘরের আনাচে কানাচে।মেঘলা এগিয়ে আসে প্রথমে।বাকিদের সাথে এইভাবে কথা বললেও বুকে জড়িয়ে নেয় তাহুরাকে।জাফরান তখনো তাহুরাকে আঁকড়ে রেখেছে।
–“অবশেষে এলে কেমন!আন্টি সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্যে। জাফরান নামো বাবা আপুর কোল হতে।”
মেঘলা ভাব বিনিময় করে।
তাহুরা ছোট গলায় সালাম দেয়।স্মিত হেসে বলে,

–“সমস্যা নেই আন্টি।”
এর মাঝে জাফরানের মা এসে জোর পূর্বক জাফরানকে ছুটিয়ে নেয়। এতে জাফরান গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদে।জাফরানের মা তাকে বকতে বকতে ভেতরে নিয়ে যায়।
–“আজ মুখটা এমন মলিন লাগছে কেনো?অসুস্থ তুমি?”
চিবুকে আঙ্গুল ঠেকিয়ে প্রশ্ন করে মেঘলা।
তাহুরার অধর প্রসারিত হয়,হেসে উঠে তার আঁখিজোড়া,

–“ঠিক আছি আমি।আপনি ভালো আছেন আন্টি?”
–“একদম ফার্স্ট ক্লাস আছি আমি।বসো মা।”
উপদেশ শুনে তাহুরা মাথা নাড়ে।সোফায় বসে।বিশাল তাদের বসার ঘর।সোফা সেটের সংখ্যা অনেক। ঝাড়বাতির শুভ্র আলোতে বসার ঘর ব্যাপক রমরমা।
সেখানে উপস্থিত হয় একে একে জুবায়ের,দিলরুবা,
আলেয়া।উমাইরের বাপ,চাচা অফিস সামলাতে মগ্ন।নিবরাস ঢাকায়,বন্ধুদের সাথে ঘুরছে।উমাইর অনুপস্থিত।তাহুরা হাসিমুখে সবার সহিত কথা বললেও দৃষ্টি তার অস্থির।কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে খুঁজে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

অপেক্ষার অবসান ঘটে তাহুরার।বসার ঘরে সেই লম্বা আকৃতির মানবের আগমন।তাহুরা দুর্ঘটনাবসত একবার দেখলো কেবল উমাইরকে।হঠাৎই উষ্ণতা অনুভব করে সে শরীরে।ঘেমে যায় হুট করে। অথচ সেন্ট্রাল এসির কারণে কক্ষ হিম।চক্ষুদ্বয় জ্বলে উঠে তাহুরার।জলে পরিপূর্ণ। ছাই রংয়ের শার্টে আবৃত লোকটা।চুলগুলো সর্বকালের মতো আঁচড়ানো পরিপাটি।গালের দাড়ি আবার ঘন হয়েছে। খরশান চোয়াল বা দাড়ির আবরণে লেপ্টানো চোয়াল,দুই রকমে বেশ দুর্দান্ত লাগে উমাইরকে।

বাকি সবার সাথে উমাইর কথা বলছে টুকটাক।তার স্বর তাহুরার কানে যেনো হুংকার ছড়াচ্ছে।
মাথা উঠিয়ে লোকটাকে দেখার লোভ গ্রাস করছে তাহুরার সত্তাকে।তাও মেয়েটা মাথা উঠিয়ে দেখলো না। পাছে যদি উমাইর কটু কথা শোনায়!

উমাইরের দৃষ্টি নিষ্পলক।তার পাখির দিকে স্থগিত উমাইরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।মেয়েটা কেঁদেছে নিশ্চয়!মেয়েটার আঁখি বড্ড চেনা উমাইরের।এই ফোলা নজর,রক্তিম নাক দেখায় জন্যে উমাইর দুদিন কথা বলেনি মেয়েটার সাথে।উমাইর ঠিক জানে,তার বোকা পাখি অস্থির হয়ে কেঁদেকুটে দিন পার করবে।ঠিকই হলো তা।মেয়েটা যে তাকে নিয়ে এখন স্যারের চেয়েও বেশি কিছু ভাবে উমাইর বুঝে।সোফায় হেলান দিয়ে বসে উমাইর।তার অপর পক্ষে বসে থাকা লাজুক,অভিমানী,সরল কন্যার প্রতি করুণা হচ্ছে।মনে উত্তোলন হচ্ছে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বুক পিঞ্জিরায় আটকে রাখার বিরল চিন্তা।মনটা উমাইরের বড্ড বেহায়া।

তাহুরার পানে উমাইরের এমন গভীর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি আফিয়ার।মেয়েটা অতো বোকা না।যেখানে উমাইর মেয়েদের পানে সাধারণ নজরে তাকাতে দেখেনি,সেখানে তাহুরাকে এক প্রকার নিজ দৃষ্টিতে আবদ্ধ করেছে উমাইর।এর মানে উমাইর তাহুরাতে মত্ত!
আফিয়া রুঢ় হাসে।ক্ষিপ্ত হয় মনে মনে,
–“আহ,শেষ পর্যন্ত এমন সরল পটল সুন্দরীকে দেখছে উমাইর? ভালোই তো।সমস্যা নেই পটল সুন্দরী।আজ উমাইরের থেকে বকা খেয়ে দূর দূর পালাবে তুমি।আমার উমাইর কেবল আমার!”
যে মেয়ের পানে তার কোনো ক্ষোভ ছিল না,আচমকা আফিয়ার মনে ক্ষোভের চেয়েও জমে বেশি ক্রোধ।তাহুরাকে ভস্ম করছে সে তার কটু দৃষ্টির মাধ্যমে।

–“জাফরান, কেঁদো না।আমার কাছে আসো।”
তাহুরা সন্তর্পনে হাসে।জাফরানকে তার মা কোলে নিয়ে নিচে নামলে,সে মায়ের কোল হতে নেমে দৌড়ে বসার ঘরে আসে।ততক্ষণে সকলে ডাইনিংয়ের দিকে যাচ্ছে।জাফরানকে আসতে দেখে থামে তাহুরা।সে এখনো বসার ঘরে।তার পিছে উমাইর।বাকিরা থামলে মেঘলা বলে,

–“তোমরা আসো।তাহুরা উমাইরের সাথে আসবে।জাফরানকে সামলিয়ে নিক তাহুরা।”
মেঘলা উমাইরকে ইশারা করে।উমাইর আসার পর থেকে তাহুরার একেবারে চুপচাপ হওয়াতে মেঘলা বুঝে মেয়েটা তার ছেলের কারণে নেতিয়ে আছে।মা কেবল ছেলেকে সুযোগ করে দেয় তার প্রেয়সীকে শান্ত করতে।
জাফরানের মাথায় হাত বুলিয়ে যায় মেঘলা।মনে মনে ভাবে,

–“ছেলেটাকে বারবার বারণ করা সত্বেও মেয়েটাকে কেমন কাঁদিয়ে নেয়।কি মজা পায় সরল মেয়েটাকে এমন হেনস্তা করে খোদা জানে।এইদিকে আবার আমার ছেলে এই মেয়ে বলতেই অজ্ঞান।”
মেঘলা হাসে উমাইরের কথা ভেবে।তার ছেলেটা উপদেশ দিয়েছে তার মনের রাণীকে সদা দেখে রাখতে!
জাফরান কেঁদে অস্থির।তাহুরা হাঁটু গেড়ে বসে জাফরানকে জড়িয়ে ধরে।জাফরান তার ছোট হাত রাখে তাহুরার পিঠে,
–“মাম্মা পঁচা।আমাকে কোলে নিবা?”
–“কাঁদে না জাফরান।আপু তোমাকে অবশ্যই কোলে নিবো।”

তাহুরা হাসে।উমাইর চেয়ে রয় দৃশ্য।মেয়েটা তাকে ব্যাকুল করছে প্রতিক্ষণে।আদুরে মেয়েটা জাফরানের চোখের পানি মুছে দিচ্ছে সযত্নে।
জাফরানকে কোলে নিতে গেলে উমাইর কোমর বাঁকিয়ে হাত ধরে জাফরানের,
–“আবার শুরু?তোমাকে না মানা করেছিলাম জাফরান?”
উমাইর আলাদা করে জাফরান আর তাহুরাকে।
তাহুরা বোকা বনে।কি বলছে এই লোক?তাহুরা উমাইরের পানে তাকায় না।অন্যদিকে চেয়ে বলে,

–“জাফরানকে দিন আমার কাছে।”
উমাইর তাহুরার কান্ড পর্যবেক্ষণ করে তাহুরার মাথার ঘোমটা টেনে ধরে,
–“তাকাও।”
তাহুরা না তাকালে উমাইর তাহুরার বাহুতে হালকা স্পর্শ করে তার পানে ফিরায়,
–“আমার দিকে তাকাও।”
শীতল,কঠোর কণ্ঠ।তাহুরা ভেবেছে উমাইর তাকে দেখতে চায় না।তাই ফিরছিল না লোকটার অবয়বে।উমাইর ততক্ষণে জাফরানকে নিজ কোলে তুলে নেয়।
তাহুরা ভীতু চোখে উমাইরকে দেখলে ভ্রু কুঁচকায় উমাইর,

–“অনেক শান্তি লাগছে তোমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে।”
তাহুরা কুঁকড়ে যায়।
–“তোমার এই কান্নারত রূপ উপভোগ করার জন্যে দুদিন যোগাযোগ করিনি। আমি জানতাম তুমি কাঁদবে। তা,কান্না করলে কেনো?”
জাফরান অসহায়।সে কিছু না বুঝলেও উমাইরের ভয়ে চুপটি করে বসে আছে কোলে।উল্টাপাল্টা করলে উমাইর নিশ্চিত বকবে তাকে!
–“আপনি ইচ্ছে করে…”
তাহুরাকে কথা শেষ করতে দেয়নি উমাইর।তাহুরার নাক টানে,
–“নাস্তা করবে চলো।আর কেঁদো না।”

শেষ বাক্যে উমাইর কেমন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।অথচ এই হাসিতে উন্মাদ হয় তাহুরা।ভেতরকার মনে তার ঢাকঢোল বাজে।ইচ্ছাকৃত তাহুরার কান্নারত রূপ দেখতেই উমাইর এমন অভিনয় করেছে!
তাহুরা আলগোছে উমাইরকে বলে,
–“আপনি আমার সাথে সত্যি রেগে নেই?”
–“আমি রাগলে আমার রাগ ভাঙানো তোমার জন্যে অনেক ভারী হবে,বোকা মেয়ে।আমার রাগ সহ্য হবে তোমার?”
তীক্ষ্ণ বাজের মতো কণ্ঠ।উমাইর জাফরানকে নামিয়ে দেয়।তার হাত ধরে হাঁটে।তাজ্জব তাহুরা তাদের পিছু।

উমাইর বন্ধুর রিসিপশনে যাবে।নিচে প্রেয়সীকে ঠিক স্থানে বসিয়ে নিজ রুমে ফিরে সে।তাহুরা উমাইরের মায়ের ঘরে।জাফরানের সাথে বসে।শায়ন,আয়মা,ইমন আবার জুবায়েরের সাথে হাঁটতে বেরিয়েছে।তাদের এগ্রো ফার্ম দেখার ছলে।বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিনিট পাঁচেক এর পথ।অত্র এরিয়ায় উমাইরদের সহ বেশ প্রভাবশালীদের ফার্মের অবস্থান।মূলত আলাদা ব্যবসায়িক কাজের জন্যে এই স্থানে ফার্মটি করা।

তাহুরাকে বেশ জোর করা হলো।সে যেতে না চেয়েও রাজি হচ্ছিলো ভাব।তবে ততক্ষণে উমাইরের কঠোর দৃষ্টির সম্মুখীন হয়।লোকটা তাকে যেতে নিষেধ করছে নির্দ্বিধায় বুঝেছে তাহুরা।একপর্যায়ে মেঘলা নিজে বলে উঠে,
–“তাহুরা থাকুক এইখানে।মেয়েটার সাথে কথা আছে আমার।বাসায় থাকুক।”

স্বস্তি পায় তাহুরা।তাকে যেতে হয়নি।মেঘলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাহুরাকে। মেয়েটা তার ভীষণ প্রিয়।উমাইর কেনো মেয়েটাকে এমন জ্বালাতন করে?যখন এই বাসায় এসেছিল তখন তাহুরা কেমন অমাবশ্যার চাঁদের মতো বেরঙ ছিলো।আর এখন?পূর্ণিমার চাঁদের লাহান ঝলমলে মেয়েটা।উমাইর নিশ্চয় সব ঠিক করেছে তাদের মধ্যকারে।তাহুরা জাফরানকে কোলে বসিয়ে মেঘলার মোবাইলে কার্টুন দেখছে,এটা সেটা বুঝাচ্ছে।মেঘলা রুমের কুশন বদলিয়ে তাহুরার সম্মুখে বসে ফের।তাহুরার উরুতে হাত দিয়ে বলে,

–“উমাইর বকে অনেক?”
তাহুরা অকপটে তাকায়।ম্লান হাসে,
–“নাহ আন্টি।”
সত্যি চাপা দিল মেয়েটা।উমাইর বকলেও সমস্যা নেই তাহুরার।তার বকুনি আজকাল সয়ে গেলো তার।কিন্তু,লোকটা খুবই নিষ্ঠুর। তাহুরার কান্নামুখ দেখার জন্যে কতো আয়োজন করেছে!বড্ড পাষাণ উমাইর।
–“আজ থেকে যেও,তাহুরা।”
মেঘলা কেমন অনুরোধ করে।
তাহুরা দুদিকে মাথা নাড়ে।হেসে শুধায়,

–“আপু এই বাড়িতে চলে এলে তখন থাকবো অবশ্যই।”
–“আজ থাকা যাবে না?”
–“বাবা খুব সেনসিটিভ আন্টি।খুব রাগ করবে।”
জাফরানকে সামলিয়ে বলে তাহুরা।এইভাবে তার পা অবশ হয়ে আসছে।জাফরান বেশ সময় ধরে একনাগাড়ে বসে।
–“আচ্ছা,মা।অপেক্ষায় থাকবো তুমি এসে এই বাড়িতে থাকার।”
মেঘলা উত্তর দেয়।
তাহুরা সৌজন্যমূলক হাসে কেবল,
–“আচ্ছা আন্টি।”
এর মাঝে কক্ষে উপস্থিত হয় আফিয়া।মেঘলাকে বলে,
–“মা তোমাকে ডাকছে,বড়মা।মেহমানদের খাবারের তালিকা দিতে বললো।”

সুযোগ বুঝে কোপ মারে আফিয়া।
মেঘলা তাহুরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,
–“বসো তবে।আমি আসছি একটু পর।”
–“জ্বী আন্টি।”
তাহুরার জবাব পেয়ে মেঘলা উঠে পড়ে। কামরা হতে বেরোয়।
আফিয়া বিছানায় বসে।ধীরে নিজের পকেট হতে চিরকুট বের করে।জাফরানকে তাহুরার কোল হতে সরিয়ে বিছানায় মোবাইল দেখতে বলে আফিয়া।মোবাইলে মগ্ন জাফরানের কোনো হেলদুল হলো না।
আফিয়া তার হাতের চিরকুট তাহুরার হাতে গুঁজে দেয়।তাহুরা প্রশ্নবোধক চেহারায় প্রশ্ন করে,

–“এটা কি আপু?”
মুহূর্তে মুখশ্রী পাল্টায় আফিয়া। ছলে বলে কয়,
–“এটা উমাইর ভাইয়াকে দিয়ে এসো প্লিজ।ভাইয়া আমার সাথে রাগ করেছে একটা কারণে।এইখানে আমার সরি লিখা আছে।একটু দিয়ে আসবে ভাইয়াকে?”
সাত পাঁচ বুঝলো না তাহুরা।সে কেনো দিবে?পরিবারে আর কেউ নেই?তাহুরা ইতস্তত ভঙ্গিতে ফের শুধায়,
–“আপু,আমি কিভাবে যায়!ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না।আপনি বরং বাড়ির কাউকে দিয়ে..”
–“তুমি বুঝছো না,তাহুরা।খুব জরুরী।উমাইর ভাইয়ার আমার সাথে কথা বলাটা খুব জরুরী বুঝলে।বাসায় অন্য কেউ দিলে ভাইয়া খুব বকাঝকা করবে।”

–“আমাকেও যদি ব…”
বলতে চেয়েও বললো না তাহুরা।আফিয়া যদি আবার কথা টানে! উমাইরকে নিয়ে তাহুরা বাজে কথা বলেছে,যদি এমন রটায়?বোনের বিয়েতে সমস্যা হবে তাহলে।বিরাট সমস্যা।
এইভাবে মেয়েটা বেশ সরল,সামান্য ভাবনায় মেয়েটার আকাশ কুসুম কল্পনায় লিপ্ত।
মিনিট এক ভাবে তাহুরা।কোনো কথা বলবে না সে,কেবল হাত টেনে চিরকুট দিবে উমাইরকে।রাজি হয় তাহুরা।জবাব দেয়,

–“দিন আপু। জাফরানের পাশে থাকুন আপনি।”
–“আছি আছি।যাও তুমি প্লিজ। এইযে বড়মার রুমের ডান দিকে দুই দরজা পরে উমাইর ভাইয়ার রুম।”
আফিয়ার ছলে হেরে যায় তাহুরা।সে বেরুলে বিছানায় শুয়ে পড়ে আফিয়া। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে,
–“যখন উমাইর জানবে এই চিরকুট আমি দিয়েছি।খুব বকা শুনবে তুমি বোকা তাহুরা!বকা শুনো তুমি,আমার শান্তি লাগবে।আহ।”
তাহুরা ভীত ভঙ্গিতে কালো রঙের কারুকাজ খচিত দরজার সম্মুখে আসে।আফিয়ার ভাষ্যমতে এটা হবে উমাইরের কক্ষ।দরজায় দুই টোকা দিলে ভেতর হতে পুরুষালি ভারী স্বরের প্রশ্ন আসে,

–“কে?”
–“আম…আমি তাহুরা।”
সময় নিলো দশ সেকেন্ড।ফট করে দরজা খুলে। উমাইরের অবয়ব দৃশ্যমান।ফরমাল ড্রেসাপ তার।দাড়ির কাট পরিবর্তিত।বেশ মানিয়েছে।উমাইর জিজ্ঞাসা করে,
–“ভেতরে আসো।আম্মু কই?”
–“নাহ আসবো না।আন্টি নিচে।”
তাহুরা কথাখানা বলতে বলতে উমাইর কক্ষের ভেতর যায়।আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে স্প্রে করে গায়ে,

–“শুনছি না।”
–“এই যে!শুনুন না।”
–“কিছু বলছো?”
উমাইর নিজ কার্য সম্পাদন করা অবস্থায় প্রশ্ন করে।
তাহুরা বুঝলো উমাইর তার কথা শুনবে না যতক্ষণ না সে ভেতরে আসে।তাহুরা ভেতরে যায়। উমাইরের পাশাপাশি দাঁড়ায়। হঠাৎ আয়নায় নজর গেলে অবাক বনে তাহুরা।উমাইর তার পানেই চেয়ে আয়নার অভ্যন্তরে।তাহুরাকে তার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় অবলোকন করে অন্তর কাঁপে তাহুরার।বেসামাল হচ্ছে মেয়েটা।
নিজেকে ধাতস্থ করে বহুকষ্টে।মিনমিনিয়ে আওড়ায়,

–” চিরকুট, আফিয়া আপু দিয়েছে।”
–“ছিঁড়ে ফেলো।”
তাহুরাকে নির্দেশনা দিয়ে উমাইর নিজের গাঢ় সবুজ রঙের কোট গায়ে চড়ায়।
বেক্কল বনে তাহুরা।ভ্রু কুঁচকে বলে,
–“কেনো?”
–“তুমি এনেছো তাই।”
–“আফিয়া আপু বললো দিতে।”
–“সে ছাদ থেকে লাফ দিতে বললে কি লাফ দিবে তুমি?”

হেসে উঠে উমাইর।তার সরল পরী আবারও দ্বিধায় পড়েছে।মেয়েটা চিরকুট দেখছে। দৃষ্টি জোড়া নিচু।মেয়েটা কেমন নাজুক।
উমাইর দ্রুত তার সামনে আসে।চিরকুট নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। তাজ্জব তাহুরা উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।উমাইর ভাবলেশহীন। তাহুরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
–“কি করলেন?আফিয়া আপু কষ্ট পাবে।”
–“পাক। এমন মেয়ে কষ্ট পাওয়া ভালো।”
উমাইর ঠাঁই দাঁড়িয়ে।নড়চড় নেই।
তাহুরার নজর ভিজে আসে।আফিয়া নিশ্চয় রাগ করবে তাহুরার উপর,

–“আমি কি জবাব দিবো আফিয়া আপুকে?ভুল বুঝবেন উনি আমাকে।”
–“খবরদার কান্না করবে না।”
উমাইর হুমকি দেয় তাহুরাকে।মেয়েটা পেরেশানি ভঙ্গিতে চলে যেতে নিলে পেছন হতে তাহুরার ঘোমটা টেনে ধরে উমাইর,
–“আজ থেকে মেসেজ দিবো।মোবাইল হাতে হাতে রাখবে।”
–“আপনি আবারও গায়েব হয়ে যাবেন?দুইদিন পরপর?”

সম্মুখে ফিরে তাহুরা।
–“গায়েব না হওয়ার জন্যে রোজ উত্তর দিবে মেসেজের।আর আমি ছাড়া অন্য কারো কথায় কান্না করবে না।তোমার ফোলা মুখটা আমি দেখবো।বুঝলে?”
তাহুরা উপরনিচ মাথা নাড়ায়।লোকটা ইঙ্গিত দিচ্ছে তাকে ফের কাঁদানোর।তাহুরা জেনেও সায় দিচ্ছে।উমাইর তাকে কাঁদাক তাও কথা বলুক তাহুরার সাথে।
–“জ্বী।”
পরপর সে আবারও বলে,
–“আফিয়া আপু যদি কষ্ট পায়?আপনি চিরকুট ছিঁড়লেন হঠাৎ!”

উমাইর তাহুরার আদুরে ভঙ্গিতে কথা বলার ধরন দেখে।বুক উথাল পাতাল।একা কক্ষে দুজন,ভাবনা মাথায় এলে ভেতরটা নড়ে উঠে তার।সামনের এই মেয়ের সম্মুখে এলে দুনিয়াটা এলোমেলো হয় উমাইরের। হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে যায়।শক্ত উমাইর দমায় নিজেকে।হালকা ঝুঁকে তাহুরার গাল চেপে ধরে,
–“আফিয়া কষ্ট পাক,কাঁদুক,অজ্ঞান হোক,এর জন্যে তোমার চোখ থেকে যেনো পানি না পড়ে।”
তাহুরা তার স্পর্শে ব্যাকুল হয়।দু’কদম পেছনে যায়।দ্রুত গতিতে কক্ষ হতে বেরুতে নিলে উমাইর গলার আওয়াজ উচুঁ করে বলে,

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১১

–“এই ছিঁচকাদুনে,তোমাকে কেবল আমি কাঁদাবো।তোমার রক্তিম কান্নামুখ কেবল আমার জন্যে।অন্যের কথায় তুমি কাঁদলে,তাকে আমি ছেড়ে কথা বলবো না কখনো।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৩