রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৪

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৪
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“উমাইর স্যার,তোর আত্মীয় এখন।এই তাহুরা উমাইর স্যার কি তোর সাথে সখ্যতা করে কথা বলে?”
চৈতালির বুলিতে তাহুরার ঘাম বাড়ে।একে তীব্র রোদে লাইন ধরেছে ফর্ম জমা দিবে বলে তার উপর সইয়ের এমন উদ্ভট কথায় গাল খানা জ্বলে উঠে।

উমাইর কেবল তার স্যার,তার আত্মীয় কি?না,একদম না।উমাইর তাহুরার প্রেমিক পুরুষ,তার মনের রাজা,তার ভালোবাসা।উমাইর তাকে হেনস্তা করে কথা বলে কুল পায় না। তার সাথে আবার সখ্যতা করে কথা বলবে?যদিও অনেক কিছু লক্ষ্য করে।তাহুরার প্রতি উমাইরের ধমকের মাত্রা উন্নতি হলেও,লোকটা তাকে সদা যত্ন করে।বাবাকে যেদিন ইন্ডিয়া নিয়ে যাচ্ছিলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাহুরা ভেঙে পড়েছিলো প্রচুর।তখন উমাইরের আদুরে শান্তনা,মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া মনে পড়ে সদা।
লোকটার শান্তনা দেওয়াটা বেশ মনে গেঁথে যায় তাহুরার।বড্ড নাজুক কিনা মেয়েটা।
তাহুরা মাথা উচুঁ করে,চৈতালির হাত ধরে জানায়,
–“কিসব বলছিস!উনি..”
–“হুম,হুম উনি উনি তোর খুব প্রিয় তাই না রে?”
স্বাগতা পেছন হতে বলে।
তাহুরা কুঁকড়ে উঠে।পেছন ফিরে।স্বাগতা হাসছে বেশ।তাহুরার ভ্রু কুঁচকে। দৃঢ় শ্বাস ছাড়ে,

–“উফ,কিসব বলছিস!”
তাহুরা মাথার ঘোমটা ঠিক করে।সামনে ফিরে। সইদের প্রশ্নের তোপে পড়ার পূর্বে তাহুরা মিনমিন সুরে তাদের জানায়,
–“উমাইর স্যারকে নিয়ে কোনো কথা না।”
বাকি দুজন কোনো প্রত্যুত্তর না করলেও মিটমিট হাসে।
তাহুরা বুঝে,কিন্তু প্রশ্ন করলো না।শেষে তাকে অপদস্ত করবে পাজির দল।উমাইর স্যার তার প্রণয়।যাকে সে লালন করে যাচ্ছে মন পিঞ্জিরায় সর্বক্ষণ।
উমাইরের মুখশ্রী আঁখিতে ভাসলে মেয়েটা লাজুক হাসে,যে হাসিটা দেখলে উমাইর নিজস্ব হুঁশ খুইয়ে অঘটন ঘটাতো নিশ্চয়।

বহু শিক্ষার্থীর ভিড়ে কার্যকলাপ শেষ করে তাহুরা। হাঁপিয়ে মেয়েটা অস্থির।শুভ্র চেহারায় তীব্র রক্তিম ছাপ।সকালবেলা গোসল না সেরে বিরাট অপরাধ করেছে যেনো।আফসোসের সাগরে ভেসে যাচ্ছে মেয়েটার তনু।এখনো বিরাট লাইন বাকি।তাহুরা সইদের নিয়ে আড়াল হয় কিছুটা।নিচ তলার বেশ কয়েকটা কক্ষ ফাঁকা। এমনই এক ফাঁকা কক্ষে বসে তিনজন।ফ্যানের স্পিড বাড়ায় চৈতালি।ওড়নার কিনারায় ঘামটুকু মুছে তাহুরা।জিহ্বা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ।তবে,শরীরে এইটুকু শক্তি নেই কিছুদূর হেঁটে গলা ভেজানোর!
মূলত তাহুরার কারণে তারা বসে আছে এইখানে।তাতে বিরক্ত স্বাগতা।সে তাহুরার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,

–“আরেকটু হেঁটে চল ক্যান্টিনে বসি?বা বাহিরে অসংখ্য রেস্তোরা আছে। পেটেও কিছু পড়বে মনটাও শান্তি হবে।”
–“রোদটা আমার মাথায় ঢুকেছে সরাসরি।তাই আমার শক্তি নেই।আমি একটুও হাঁটতে পারবো না।তোরা যা।আমি একটু বসবো ফ্যানের নিচে এরপর আপুর বাসায় যাবো।”
তাহুরা জবাব দেয়।মাথা ব্যথা বাড়ছে হুরহুর করে।এরই মাঝে কলেজের কয়েকজন প্রবেশ করে কক্ষে।তারা বসে দূরে।
উন্মুক্ত কক্ষে কে বা কাদের নির্দেশনা মানবে?
তাহুরা বেঞ্চে মাথা ঠেকায়।মিনিমিনিয়ে শুধায়,

–“আমি গার্লস কমন রুমে বসবো।মাথা ব্যথা কমলে বেরুবো।”
চৈতালি,স্বাগতা একে অপরকে দেখে।ইশারায় কথা বলে।তাহুরাকে একা ফেলে তারা কস্মিককালে যাবে না।অতঃপর স্বাগতা তার কাঁধে হাত রাখে,
–“উঠ,আমি নিয়ে যায় তোকে।চৈতালি সেখানে আমাদের জন্যে খাবার আনবে।”
তাহুরার ভেতরকার গুমোট ভাব কমতে থাকে।মেয়েটা খুশি হয়।ইতোমধ্যে মাথা ব্যাথার দরুণ তার আঁখি ফুলে কিঞ্চিৎ।সেই আঁখি জুড়ে কি নিষ্পাপ হাসির ঝিলিক দৃশ্যমান!
–“তোদেরকে অনেক শুকরিয়া।একা থাকা আমার জন্যে খুব আনইজি ব্যাপার।”

তাহুরা জানায়।ধীরে দাঁড়ায় সে।স্বাগতা এসে হাত ধরে।চৈতালি বেরোয় খাবারের সন্ধানে।তাহুরা ছোট কদমে এগিয়ে যায় স্বাগতার সহিত।আশেপাশে তাকানোর মুরোদ নেই মেয়েটার।মাথা ব্যথা একবার উঠলে একেবারে মরি মরি ভাব।
বাহিরে নজর পড়লে ভ্রু কুঁচকে আসে তাহুরার। গগণে মেঘ জমেছে।ধূসর রঙের সেই মেঘের আড়ালে সূর্য বদ।কই গেলো তীব্র রৌদ্র? যেই রোদের তেজে তাহুরার বেহাল দশা! মেজাজ চটে যায় মেয়েটার।হাঁফ ছাড়ে নিজের দুর্গতির কথা ভেবে।

নিজ ভাবনায় মশগুল তাহুরা খেয়াল করলো না,তার চার কদম সম্মুখে দাঁড়িয়ে উমাইর।পিলারের পাশে।কানে ফোন চেপে।ক্লাসের মাঝে হয়তো জরুরী ফোন এসেছে।
তাহুরার করুণ মুখশ্রী অবলোকন করে থমকায় উমাইর।হলো কি তার প্রেয়সীর?ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেনো এমন? ফোনে কথা বলা অবস্থায় উমাইরের আঁখি পরিদর্শন করে তাহুরার অবয়ব।ক্লাস শেষ হতে বাকি আর বিশ মিনিট।তাহুরা সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে।এর মানে সে এখন বাড়ি ফিরবে না।উমাইর পকেটে ফোন রাখে।ক্লাসে মনোযোগ দিলেও তার মন আটকে সরল মেয়েটাতে।খুব করে ইচ্ছে জাগলো বোকাটাকে তার বুকে মিশিয়ে সব ক্লান্তি দূর করতে।

স্বাগতা বেশ কিছুক্ষণ তাহুরার পাশে বসেছিলো।বারংবার ফোন আসায় সে আড়ালে যায়।গোপন ফোনকল।তাহুরার সম্মুখে কথা বলা যাবে না।ফোন নিয়ে সে আড়ালে যায়।তাহুরা কমন রুমের সোফায় হেলান দিয়ে বসে চুপচাপ।বাহিরে শীতল পবনের ছড়াছড়ি।হয়তো বৃষ্টি নামবে। বাসে করে যাওয়ার ঝামেলা বাড়লো দ্বিগুণ।না,আজকে আর বাসে ঠেলাঠেলি করে যাওয়ার শক্তি নেই।মনে মনে ভাবে রিক্সা নিয়ে ফিরবে বোনের বাড়ি।মা বাবা ইন্ডিয়া থেকে ফিরতে আরো সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগবে।

তীব্র সুরে মোবাইলের রিংটোন বাজলে তাহুরার টনক নড়ে।দৃষ্টি সরে লম্বা নারকেল গাছের নৃত্য হতে। উমাইরের নাম্বার স্ক্রিনে স্পষ্ট।তাহুরা খানিক অবাক হয়।তারপরও ফোন রিসিভ করে,
–“আসসালামুয়ালাইকুম।”
উমাইর মনে মনে সালাম গ্রহণ করে।তবে মুখে অন্য কথা আওড়ায়,
–“বাসায় যাবে কবে?”
–“একটু বসবো।মাথা ব্যথা খুব।”
তাহুরা কপালের ধারে আঙুল চাপে।
–“কেনো?সকালে ঠিক ছিলে তুমি।”

উমাইর পকেটে হাত গুঁজে।দৃষ্টি তার দরজায়।অনুমান করছে মেয়েটার বেদনাদায়ক চেহারা।
উমাইর যদি এখন তার গালে আঙুল ছুঁয়ে সেথায় ভালোবাসাময় অধর ছুঁয়ে দেয়, তাহলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে?
আঁখি বুঁজে নেয় উমাইর।বেসামাল মনের অবাধ্য চাহিদা পূরণ হবে আর কিছু মাস পরে।
–“রোদে ছিলাম অনেক্ষণ।তাই খারাপ লাগছে।”
তাহুরা ধীরে জবাব দেয়।

–“তাপ দেখে বাসা থেকে বের হওনি? রোদ সহ্য হয়না,তাহলে ছাতা নাও নি কেনো?অন্ধ তুমি?”
অনেকটা মেজাজ দেখায় উমাইর।তাহুরার অন্তর নড়ে। বুকে ধুকধুক শব্দ হয়।লোকটা বকছে তাকে।কেনো?মাথা ব্যথা তাহুরার করছে,উনার এতো দরদ কেনো!প্রশ্নটা মনে রইলো। আওড়ালো না একটি বাক্য।ফের উমাইর চেঁচায়,
–“অন্ধের সাথে কি এখন কানেও শুনতে পাও না?খেয়েছো কিছু?”
–“সরি, স্যার।”

তাহুরার বেদনাদায়ক কণ্ঠ।এই কণ্ঠে উমাইরের দুনিয়ায় ঝড় নামে।চারিদিকে মেয়েটাকে পাওয়ার তৃষ্ণা জেঁকে ধরে।
উমাইর ঘাড়ে হাত ঘষে।কণ্ঠ নরম হয়ে এলেও রুক্ষতা বজায় রাখে উমাইর।মেপে মেপে বলে,
–“বাড়ি আমার সাথে ফিরবে। দশ মিনিট পর পার্কিংয়ে আসবে।”
তাহুরা কিছু বলতে চেয়েও শুনলো না উমাইর।ফোন কাটে সে দ্রুত।চিন্তার মাত্রা বাড়ে সরল রমণীর।তার মহৎ চিন্তা,কেউ তাকে উমাইরের গাড়িতে যেতে দেখলে কি না কি রটাবে! অবাঞ্চিত চিন্তার ফোয়ারায় ভিজে যাচ্ছে মেয়েটার ভেতরকার সত্তা।

চৈতালি আসে সঙ্গে সঙ্গে।বাহিরের আবহাওয়ার বর্ণনা দিয়ে খাবার খেতে ব্যস্ত হয় তিন সই।তাহুরা স্যান্ডউইচ সম্পূর্ণ শেষ করে।এরমাঝে মোবাইলে বিপ শব্দ হয়।মেসেজ এসেছে উমাইরের পক্ষ হতে,
–“পার্কিংয়ে আসো।”
তাহুরা টিস্যুতে হাত মুছে।বিনিময়ে লিখে,
–“আসছি।পাঁচ মিনিট।”

পরপর তিনজন বেরিয়ে আসে।বারান্দায় প্রচুর বাতাস।সূর্য মামার দেখা নেই। বৃষ্টি নামলো ধরণীতে। এতো বাতাসেও তাহুরার অন্তরে শান্তি নেই।মাথা ব্যথা এখনো আগের লাহান স্থির।হয়তো পেইন কিলার খাওয়া দরকার তার।
কলেজের প্রধান ফটকে এলে তাহুরা সইদের বিদায় জানায়। উমাইরের সাথে বাসায় ফিরবে এও বলে।চৈতালি মিটমিট হাসে কিন্তু স্বাগতা যেনো সবটা জানে।সে পুরোপুরি স্বাভাবিক।
তারা বিদায় জানালে তাহুরা পার্কিংয়ের দিকে এগোয়।

সেথায় গিয়ে পা থমকে।উমাইর দুজন স্যারের সহিত দাঁড়িয়ে।কথা বলছে।তাহুরা যাবে কি যাবে না ভাবলো মিনিট খানেক।পা ঘুরিয়ে ফিরতে নিলে উমাইরের গম্ভীর সুর শুনতে পায়,
–“কাম হেয়ার,তাহুরা।দেরী হচ্ছে।”
বাঁক ঘুরায় তাহুরা।চিন্তিত পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করে।
স্যারদের সম্মুখে এলেও মাথা তুলে না।আবারও শুনে উমাইরের গাম্ভীর্যে ভরপুর স্বর,
–“তাহুরা,আমার রিলেটিভ।ভাইয়ের শালী।”
উমাইর জবাব দেয়।

স্যারদের কিছু বলতে না দিয়ে গাড়ির পানে এগোলে,তাহুরা পিছু নেয় উমাইরের।
দুজনে গাড়িতে উঠে।তাহুরা ব্যাগ বুকে চেপে বসে।আঁখি নিভু নিভু। বাহিরে বর্ষণের ছাপ।জানালার কাঁচে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা।গাড়ি কলেজ হতে বেরুনোর পূর্বেই বর্ষণ ভারী হয়।গাড়িতে বসা তাহুরা অবলোকন করে মানুষের ছুটাছুটি। সিটে মাথায় হেলিয়ে দেয় মেয়েটা।চক্ষু জোড়া বন্ধ হয়।
পাশে বসা উমাইর লক্ষ্য করে ঠিক।সামনেই ফার্মেসি,পেইন কিলার কেনা অত্যাবশ্যক।
উমাইর গাড়ি থামায় রাস্তার এই পাড়ে।বৃষ্টির দরুণ যানজট লেগে অস্থির অবস্থা।গাড়ি থামলে তাহুরার চক্ষু সজাগ হয়।সে জিজ্ঞাসা করে,

–“কোথায় যাচ্ছেন?”
–“ঘুমিয়ে যেও না।আসছি।”
উমাইর এতটুকুন জবাব দেয়।গাড়ির দরজা বন্ধ করে।আবারও খুলে প্রশ্ন করে,
–“কিছু খেয়েছিলে?”
তাহুরা মাথা নাড়ায়।উমাইর চলে যাচ্ছে বৃষ্টির মাঝে,অসংখ্য গাড়ির আড়ালে।লোকটার ধূসর রঙের শার্টে বৃষ্টির ফোঁটা হামলে পড়ছে।তাহুরা ভাবুক হয়।আপন মনে শুধায়,

–“আমি ছাতা ছাড়া রোদে দাঁড়িয়েছি বলে কতো না কথা শুনলো।নিজে এখন বৃষ্টিতে ভিজছে।কই আমি কিছু বলছি?কিছু বলার শক্তি বা সাহস আমার আছে?নেই।উনি কেবল আমাকে বকে।”
দীর্ঘ শ্বাস বেরোয়। আঙুলের আংটিতে নজর দেয় সে।সুন্দর এক পাথরের সাধারণ আংটি। আঙুলে বেশ মানিয়েছে।তাহুরা মেঘলার কথা মতো এখনো আংটি খুলেনি।আর না কখনই খুলবে।মহিলা বেশ স্নেহ করে তাহুরাকে।সেই মান রাখতে হবে অবশ্যই।
উমাইর ফিরে আসে দ্রুত।ভেজা তার অবয়ব।তাহুরা মিহি সুরে বলে উঠে,

–“আপনি ভিজে গেছেন একেবারে।”
উমাইর টিস্যু নেয় বক্স হতে।হাতের পানির বোতল এবং পেইন কিলারের পাতা এগিয়ে দেয় তাহুরার পানে,
–“এটা খাও।নাইলে গাড়ি থেকে নামো।”
–“কিসের ঔষুধ?”
তাহুরা ভীত।

–“অজ্ঞান হওয়ার।অজ্ঞান করে তোমাকে বিক্রি করবো নাহলে সাগরে ভাসিয়ে দিবো।মাথামোটা একটা।”
উমাইর তার আঙ্গুল ঠেকায় তাহুরার কপালের কিনারায়।
ডাহা মিথ্যা কথা জানে তাহুরা।তার মনের রাজা এমনটা করবে না ইহকালে।মুচকি হাসির বলি রেখা দৃশ্যমান হয়।ঔষধ হাতে নিয়ে বুঝতে পারে পেইন কিলার।চুপচাপ গলধঃকরণ করে সে।
খেয়াল করে টিস্যু দিয়ে উমাইর তার মাথায় পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম।ভেজা চুল,ভেজা শার্ট আঁটসাঁট তার শরীরে।শুভ্র গলায়,কানের পাশে পানির ধারা।চুল ভিজে থাকায় পানি থামার নাম নেই। ঘোর লেগে যায় তাহুরার।নিচ অধর অনায়াসে গালের ভেতর।হঠাৎ উমাইর তার পানে ফিরলে তাহুরার টনক নড়ে।সে দৃষ্টি সরাতে চেয়ে পারেনি।ততক্ষণে উমাইরের নেশাক্ত নজরে আবদ্ধ হয় সে।

উমাইর টিস্যু রাখে।কিঞ্চিৎ ঝুঁকে তাহুরার পানে।কোলে পড়ে থাকা তাহুরার ওড়না তুলে নেয়।মাথায় চেপে মুহূর্তে তার ভেজা চুলের পানি মেয়েটার ওড়নায় শোষণ করায়।সুতির ওড়না হওয়ায় পানিতে ওড়না ভারী হয়।উমাইর তাহুরার গাল ধরে। বৃদ্ধাঙ্গুলের সহিত সেথায় বুলিয়ে দেয় কিছু মুহূর্ত,
–“আমার দিকে লুকিয়ে তাকানোর শাস্তি।”
তাহুরার দম বন্ধকর পরিস্থিতি।সে উমাইর হতে ছুটি পেয়ে একেবারে জানালার কিনারায় লেপ্টে বসে।মনের অস্থিরতা আকাশে পেখম মেনে নাচে।এই অনুভূতি তাহুরার সর্বপ্রিয়।লোকটা কাছে এলে নবীন সকল অনুভূতির সঞ্চার হয়।বাহিরের ভারী বর্ষণ এবং শরীরে ক্লান্তিভাব থাকায় তাহুরা আচানক ঘুমিয়ে পড়ে। বোকা মেয়েটা খেয়াল করলো না গাড়ি অন্য রাস্তায় যাচ্ছে।

তাহুরা চুপচাপ হওয়ায় উমাইর বুঝে মেয়েটা তন্দ্রাসক্ত।একহাতে সিটবেল্ট ধরে শক্তভাবে। জানালায় মাথা টুকে যায় হালকা।উমাইর হাসে।তাহুরার মাথায় হাত বুলায়,
–“অল্পতে এমন ক্লান্ত হলে চলে,জান?কয়েকমাস পর উমাইর তোমাকে ক্লান্ত হওয়ারও সুযোগ দিবে না।”
আলতো হাত সরিয়ে নেয় উমাইর। কাঁচা ঘুম ভাঙ্গার সম্ভাবনা অনেক।উমাইর বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটায় গাড়িতে তার প্রেয়সীর সহিত।মেয়েটার ঘুমন্ত মুখশ্রী অন্যতম সুখের অনুভূতি। নুয়ে থাকা ঘাড় সোজা করে নরম স্পর্শে।অধরে আঙুল স্পর্শ করে অতি সাবধানে,
–“দিন রাত এইখানে মাতোয়ারা থাকবে,উমাইর।”

চার’দিন পর……
সন্ধ্যা বেলায় ঝড়ো পরিবেশ।থেমে থেমে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে।আজ নতুন বউ সুনেরাকে দাওয়াত দিয়েছে জাফরানদের বাড়িতে।সেই সুবাদে সকলে তৈরি হতে ব্যস্ত।রাতের দাওয়াত তাই সন্ধ্যার পর বেরুনোর সিদ্ধান্ত নেয় সকলে।তবে,বৃষ্টির দরুণ তাহুরার যাওয়ার মন নেই।সে তৈরি হয়নি।মেঘলার কক্ষে পাইচারি করছে।তার উপর শরীর সুবিধার না।এমন অবস্থায় সে ঘরে থাকতে চায়।কিন্তু,এটা তার বাড়ি না।না এইখানে মায়ের মতো কেউ আপন।মেঘলা বেশ ভালো হলেও,মা তো মা”ই হয়।

মেঘলা তৈরি হয়ে অনেক আগে কক্ষ হতে বেরোয়।বিছানায় রেখে যায় তাহুরার জন্যে সেলোয়ার সুট।দরজা খোলার শব্দ হলে তাহুরা সেদিক ফিরে। সুনেরা এসেছে।হাসিমুখ।শাড়িতে বোনকে কি দারুণ মানিয়েছে।কাজল টানা আঁখি,ভারী সাজ,বোনকে দেখতে অপ্সরী হতে কম লাগছে না।
তাহুরাকে তৈরি না দেখে সুনেরা চেঁচায় খানিক,
–“রেডি না হয়ে কি করিস?উমাইর ভাইয়া এলে সবাই বেরুবে।”
–“বাসায় কেউ থাকবে না?”
তাহুরা পাল্টা প্রশ্ন করে বোনকে।

–“উফফ,কথা কম।সবখানে যাওয়ার আগে তোর পেট ব্যথা শুরু হয়।বিয়ের পর কি করবি?তখন শুধু দাওয়াত আর দাওয়াত।আয়,আপু রেডি করিয়ে দিচ্ছি।”
সুনেরা শাসায় বোনকে।
তাহুরা মিনমিন করে ঠিক।কিন্তু,বোনের কথা ফেলে না।বোনের সাহায্যে তৈরি হয় ঝটপট।সুন্দর বেগুনী রঙের থ্রিপিস।ওড়নার রঙ সাদা।মাথায় ঘোমটা দিয়ে সুনেরা পিন দ্বারা আটকে দেয় তা,
–“হিজাব লাগবে না।ওড়না দে মাথায়।”
–“আচ্ছা।”
তাহুরা সায় দেয়।

দুইবোন নিচে নামে একসাথে।মেঘলা এবং বাকি সবাই উমাইরের অপেক্ষায়।সে বাসায় ফিরেছে কিছু সময় পূর্বে।
তাহুরা আফিয়ার অবয়বে তাকায়।অন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আফিয়া।নজর মিললে কেমন জানি মুখ বানায়।
তাহুরা নজর ঝুঁকায়।আফিয়া তার সাথে কথা অব্দি বলে না এখন।কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়নি এখনো।মেঘলা সুনেরা এবং দিলরুবাকে ডেকে নেয় নাস্তার সকল জিনিসপত্র আবারও চেক করে নিতে।রয়ে যায় আফিয়া এবং তাহুরা।
আফিয়া নিজ থেকে এগিয়ে না এলেও তাহুরা শুনতে পায় আফিয়ার ফোনালাপ।সে কাউকে বলছে,

–“উমাইর ভাইয়া?আরে উমাইর ভাইয়া কতো মেয়ের সাথে প্রেম করে জানিস?তুইও লাইন ধর।একবার না একবার সুযোগ পাবি।প্রেম না হোক, অন্তত বেড পার্টনার হতে পারবি।”
ক্রোধে উন্মত্ত আফিয়া ভুলভাল যা পেরেছে বললো।সে চেয়েও ভুলতে পারছে না,তার সম্মুখে দাঁড়ানো মেয়েটা উমাইরের বাগদত্তা।

তাহুরার পায়ের তলে মাটি নেই। যা শুনেছে সেটা কি সত্যি?না সত্যি না।কখনোই সত্যি হতে পারে না এটা।উমাইর এমন ছেলে না।উমাইরের চরিত্রে দাগ থাকলে তাহুরা নিশ্চয় সেটা বুঝতো।উমাইর পবিত্র।নিজেকে বুঝ দেয় তাহুরা।তারপরও তার আঁখি ভিজে আসে।মনের মানুষের নামে উল্টোপাল্টা শুনলে কে বা ঠিক থাকে?
–“কান্নার কারণ কি?”
উমাইরের কণ্ঠে বিচলিত তাহুরা।পেছন ফিরে আঁখি মুছতে চায়।আফিয়া নেই এখন।
তাহুরা উত্তর দেওয়ার পূর্বে মেঘলা সাথে বাকিরা সবাই ফিরে। তাড়া দেয়।উমাইর জিজ্ঞাসা করেনি কিছু আর।কিন্তু,ব্যাপারখানা ভুলেনি।

যাওয়ার সময় গাড়িতেও তাহুরার চিকচিক দৃষ্টি, লুকিয়ে তাকে অবলোকন করা সব লক্ষ্য করে উমাইর।কিছু একটা নিশ্চিত হয়েছে।আপাতত উমাইর সেই বিষয় উদঘাটনের চেষ্টায় মগ্ন।
তাহুরা নিজের অনুভূতি লুকাতে হিমশিম।কোনো ভাবে নাস্তা সেরে বোনকে জানায় একা রুমের ব্যবস্থা করে দিতে। সুনেরা শাশুড়িকে জানালে মেঘলা আগলে নেয় তাহুরাকে,

–“কি হয়েছে আমার মায়ের?”
–“আন্টি একটু শুতে ইচ্ছা করছে।”
তাহুরা জবাব দেয়।
–“জাফরানের রুম খালি।আসো নিয়ে যাই।”
যেই না সামনে যাবে তারা জাফরান এসে হাজির।সে তাহুরার হাত ধরে।অনুনয় করে বলে,
–“আমার টয় হাউজ দেখবে আপু?”
–“না আব্বা, ও এখন শুবে।”

এতটুকু কথায় কান্নার রোল পড়ে জাফরানের।মায়া হয় তাহুরার।জাফরানের হাত ধরে মেঘলাকে জানায়,
–“আন্টি আমি ওর সাথে যাই।সমস্যা নেই।”
–“ওখানে একটা ছোট্ট বেড আছে।বেশি সমস্যা হলে শুতে পারবে।”
মেঘলা নির্দেশ দিলে তাহুরা জাফরানের হাত ধরে এগোয়।
নিচ তলা হতে উমাইর জাফরান এবং তাহুরাকে খেয়াল করে।তার সম্মুখে বসে থাকা আফিয়ার চোরা দৃষ্টিটাও বাদ যায়নি তার শকুন দৃষ্টি হতে।আফিয়া কি কোনো অঘটন করেছে?
উমাইর উঠে অন্য পাশে যায়।ফোন করে তাহুরাকে।
কয়েকবার ফোন বাজলে তাহুরা রিসিভ করে।মুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠে উমাইর,

–“কোথায় তুমি?”
তাহুরা জবাব দিতে পারেনা। ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। পাশ থেকে জাফরানের কণ্ঠ শুনে পায়,
–“তাহু আপি,কেঁদো না।চোখ মুছো।”
–“কাদঁছো কেনো?”
আবারো প্রশ্ন করে উমাইর।উত্তর আসেনি সেদিক হতে।মেজাজ চটে উমাইরের।মেয়েটা তাকে উপেক্ষা করছে?
–“উত্তর রেডি রাখো।আমি আসলে কিন্তু ভেঙে ফেলবো তোমাকে।”
উমাইর ফোন কাটে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে।যে যার অবস্থায়।এছাড়া উমাইরকে প্রশ্ন করার ব্যাপারে সকলে দুইবার ভাবে।অগত্যা, নিবরাস এবং জুবায়ের চেয়ে রয় রেগে যাওয়া উমাইরকে।

মৃদু মিউজিকের শব্দ আসছে প্লে হাউজ থেকে। ছাদের সিঁড়ি ঘরের নিচে ছোট্ট এক রুমে প্লে হাউজ।হলুদ রঙের আলোয় খাটো একটা বেডে তাহুরা মুখ ঢেকে বসে।জাফরান তার পাশে প্লেন উড়াচ্ছে।
উমাইর তাহুরার হাত ধরে সহজে।জাফরানের উদ্দেশ্যে বলে,
–“তুমি খেলো।আমি তাহুরার কান্না থামিয়ে আনি।”
জাফরান মাথা দুলিয়ে নিজ কাজে ব্যস্ত থাকে।

তাহুরার হাত টেনে উমাইর প্লে হাউজের বাহিরে আনে। ছাদের লাইটের আলোয় আলোকিত জায়গা।এছাড়াও প্লে হাউজের বাহিরে সফেদ আলো বিদ্যমান।
উমাইর তার ধৈর্য ভাঙে।তাহুরার চিবুকে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
–“বলো।”
–“কি..কিছু না।”
তাহুরা কান্না নিবারণ করার চেষ্টায়।
উমাইর চোখ বুঁজে।দেওয়ালে সজোরে আঘাত করে,
–“আমি চিল্লালে তোমার পছন্দ হবে না।”
মৃদু গম্ভীর ভয়ংকর সুর।

তাহুরা দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলায়।মনে জমানো কথাগুলো কম্পিত অধরে বলে আরম্ভ করে,
–“আপ..আপনি…আপনি কি অন্য মেয়েকে নিয়ে গভীর কিছু করেছেন?”
গভীর কিছু!উমাইর মেয়েটার ভদ্র ভাষায় বাজে ইঙ্গিত খানা বুঝেছে।কপালের রগ ভেসে উঠে। চক্ষুদয় রক্তিম হয়।
সুদর্শন উমাইরের এমন রাগী অবয়ব তাহুরা কখনো দেখেনি।ভ্রু উঁচিয়ে মেয়েটা মিইয়ে যায় আরো।
–“আমি চরিত্রহীন না,মাথামোটা।তবে,অহেতুক কথায় কান্না কারার শাস্তি পাবে তুমি।
উমাইর গাল চেপে ধরে তাহুরার।

পরক্ষণে তাহুরাকে বুকে আগলে নেয় উমাইর।ফোন লাগায় আফিয়াকে।স্বাভাবিক সুরে বলে,
–“কোনোরকম শব্দ ছাড়া ছাদে আসো।নাটক করবে তো সবার সামনে চড় দিয়ে অপমানিত হবে।”
তাহুরা অবাক হয়। উমাইরকে সে আফিয়ার নাম বলেনি।তারপরও সে কেমনে জেনে গেলো?তাহুরা আফিয়ার কথা বিশ্বাস করেনি।তাও মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। যার কারণে কিছু সময় একা কাটাতে উপরে আসে।কিন্তু,উমাইর ব্যাপারটা খুব দূরে নিয়ে যাচ্ছে।

–“আমি আপনাকে বিশ্বাস করি,এই যে।”
তাহুরা নাক টেনে বলে।
উমাইরের মন গললেও,প্রকাশ করেনি সে।বরংচ দ্বিগুণ ক্রোধ দেখায় সে তাহুরাকে।কিভাবে পারলো মেয়েটা তাকে এমন প্রশ্ন করতে?
নিজের সুবুদ্ধি হারিয়ে উমাইর তার কোমর জড়িয়ে কাছে টানে।

নিজ বিশাল দেহের আড়াল করে তাহুরাকে।মাদকতা ছড়ানো মেয়েটাতে বুদ হয় উমাইর।এই একটা মেয়েকেই তো সারাজীবন চেয়ে এসেছে সে।আর চেয়েই যাবে।নিজের করে নিবে দুনিয়ার সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে।তবে,ভেতরকার প্রেমিক সত্তা হার মেনে যাচ্ছে আজ।তাহুরার ভীত মুখ,কম্পিত অধর এইসবে মাথার খেয়াল সব উলোট পালোট হচ্ছে তার।অবশেষে কাঙ্ক্ষিত কিছু চাওয়া প্রকাশ করে উমাইর।তাহুরার ঘাড়ে হাত রেখে,

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৩

–“যে তোমাকে কথাটা বলেছে,সে যদি এটা প্রমাণ করতে পারে তাহলে আমি উমাইর তোমাকে নিয়ে সবার আড়ালে এই দেশ ছাড়বো।আর যদি না পারে,তাহলে…”
শ্বাস ছাড়ে উমাইর।মনের সকল চাহিদাতে হাজারো ক্রোধ মিশিয়ে অনেকটা হিংস্র সুরে আওড়ায়,
–“আ’ইল কিস ইউ হার্ডলি।যতক্ষণ না তোমার ঠোঁট ব্লাডি হয়।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৫