রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৫

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৫
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“উমাইর…উমাইর ভাইয়া!”
আফিয়ার সুর আর বেরোয় না।কাছাকাছি উমাইর এবং তাহুরাকে অবলোকন করলে বুকের উত্তাল হাওয়ার জোর বাড়ে। উমাইরের বলা শেষ বাক্যটুকুও কর্ণগোচর হয় তার।উমাইর ফিরে তাকায় আফিয়ার পানে।তখনো আফিয়া স্পষ্ট দেখতে পায় উমাইর তার বলিষ্ঠ বাহু দ্বারা আগলে রাখলো তাহুরার কোমর।দৃষ্টি তাহুরাতে স্থগিত হলে গলা শুকিয়ে আসে আফিয়ার।ইচ্ছে করছে,তাহুরাকে ছুটিয়ে নিজে সেই জায়গা দখল করার।মেয়েটাকে বোকা ভেবে ভয় লাগাতে চেয়েছিল আফিয়া। ভেবেছিলো,সরল মেয়েটা উমাইরকে এতো প্যাঁচ পারবে না।কিন্তু হলো কি?উল্টো।একেবারে উল্টো।
উমাইর সেভাবে দাঁড়িয়ে রয়। স্বর ভারী করে কেবল,

–“কোন কোন মেয়ের সাথে আমার বেড শেয়ার করা হয়েছে,সব মেয়ের ডিটেইলস চাই। রাইট নাও।”
–“ভাইয়া….আমি!সরি ভাইয়া।আমি আসলে…”
–“আফিয়া,আমাকে ডিটেইলস দাও?মুখে যা বের করেছো সেটা সত্যি প্রমাণ করো।”
উমাইরের শান্ত এবং উন্মাদনার শব্দে আফিয়ার গায়ে কাঁটা দেয়।উমাইর ভয়ংকর রেগেছে।সে রাগলে এইভাবে কথা বলে।কি দরকার ছিলো ঐ মাথামোটাকে নিয়ে এমন মজা করার!এখন উমাইর তাকে ছেড়ে কথা বলবে না।
আফিয়া ভীত সন্ত্রস্ত।হাঁটু গেড়ে বসে।দুহাত এক করে বিনয়ী সুরে আওড়ায়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–“সব মিথ্যে বলেছি আমি তোমার নামে।এমন কোনো ঘটনা সত্যি নেই।আমি কেবল মজা করছিলাম তাহুরার সাথে। ও এমন কান্ড করবে আমি ভাবিনি।সরি,উমাইর ভাইয়া।”
–“তোমাকে আমার চেনা আছে,আফিয়া।বেহায়ার সব মান পার করেছো।আজকে যা করেছো এর শাস্তি তুমি পাবে।নিচে যাও।”

কেমন হিংস্রতার আভাস পাওয়া যায় উমাইরের সেই শব্দে।
আফিয়া উঠে দাঁড়ায়।দ্বিতীয়বার তাদের ঘনিষ্ঠতার সাথে দাঁড়ানোর দৃশ্য দেখার শক্তি নেই তার।আজ হয়তো তার হৃদয় পুরোপুরি ভঙ্গুর হয়।মনটা বুঝে নেয়,তার এই জীবনে উমাইর বলতে কোনো পুরুষ আপন হবে না।উমাইর কেবল তার জন্যে এক মরীচিকা।

আফিয়ার প্রস্থান ঘটলে উমাইর তাহুরার কোমর ছাড়ে।
তাহুরা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে।ইতোমধ্যে কোমরে জ্বালাপোড়ার অনুভূতি।পরক্ষণে উমাইরের বলা শর্তের কথা স্মরণ এলে দুনিয়া আঁধার হয় তাহুরার।অধরে হাত চলে যায় নির্বিঘ্নে।
তার কান্ডে উমাইরের মেজাজ পুনরায় চটে। মেয়েটা কিভাবে ভাবলো বিয়ে বিহীন এমন কোনো কাজ উমাইর করবে?তাহুরা ভাবলো কিভাবে?এই মেয়ে আজ উমাইরের সেই পূর্বের মেজাজ বিচরণ করতে বাধ্য করেছে।ভার্সিটি সময়কালে কেমন তেজী মেজাজি ছিলো উমাইর!

উমাইর তাহুরার অধর হতে হাত সরায় বেশ শক্ত আবেশে।তাহুরা অস্ফুট স্বর তুলে।আঁখিতে লজ্জার সাথে ভয়। উমাইরের উত্তপ্ত মেজাজে তা বিস্ফোরণে রূপ নেয়।
হঠাৎই উমাইর তার গাল চেপে ধরে।বল প্রয়োগ করে বেশ।আঁখিতে জমানো পানি গালে পদার্পন করে তাহুরার।
খুব কষ্টে বলে উঠে,

–“এই…যে। শুনুন!”
উমাইর তাহুরার নিচ অধরে দৃষ্টিপাত করে।আঙুল দ্বারা চাপ দেয় খানিকটা।চিনচিন পীড়ায় তাহুরা উমাইরের বুকের দিকটা খাঁমচে ধরে।মুচড়ে যায় ইস্ত্রি করা মসৃণ শার্ট।মুহূর্তে মেয়েটা শুনতে পায় গাম্ভীর্য ভরপুর তার প্রিয়তমের কণ্ঠ,
–“তোমার দৃষ্টিতে আমি খারাপ ছেলে ছিলাম, যখন শর্তের কথাটা বলেছি।এখন প্রমাণিত হয়েছে আমি কোনো বাজে কাজের সাথে জড়িত নই।তাই সকল শর্ত বৃথা।আমার এমন কোনো চাহিদা নেই।”

মিথ্যে কথা।তাহুরাকে বুঝ দেওয়ার জন্যে বললেও কথাগুলো,উমাইর জানে এখন তার ভেতরকার ছারখার অবস্থা। নিজ অধর না হোক,আঙুল দিয়ে চেপে হলেও মেয়েটার অধর রক্তিম করছে সে।মেয়েটা কি বুঝে,উমাইর তার বাগদত্তাকে সামান্য ছুঁয়ে দিলে কোনো মহা সমস্যা হবে না!কিন্তু,মানা সব মানা।এই ছিঁচকাদুনের জন্যে উমাইর ধৈর্যের সাথে সব সহ্য করবে।কিন্তু,যেদিন উমাইরের নামে বন্ধী হবে তার বোকা প্রেয়সী!একটা মানাও শুনবে না। মানা করার সুযোগ দিবে না পাষাণ প্রেমিক।

আঙ্গুল দ্বারা খানিক বল প্রয়োগ করলে,পীড়ায় তাহুরা অস্পষ্ট সুর তুলে।সেই মিহি সুরে উমাইরের উমাইরের পুরুষ-সত্তার আলোড়ন বৃদ্ধি পায়।হিম হয়ে আসে পুরো শরীর।জিহ্বা সহিত ঠোঁট ভেজায় উমাইর।নিয়ন্ত্রিত ঢেঁকুর গিলে শুধায়,
–“এমন শব্দ পরে করবে।এখন না।”
নজর মিলে দুজনার।তাহুরার দৃষ্টিতে বেদনা। দমলো না পাথর প্রিয়তম।একই অবস্থা জারি রেখে,অন্য হাতে তাহুরার মাথায় ঘোমটা তুলে বলে,

–“একটা কথা এই মাথামোটা মস্তিষ্কে সেট করো।আমি ব্যতীত কোনো ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।যদি দেখি এমন কিছু তখনই তোমার চোখ বের করে মার্বেল বানাবো।”
উমাইর তার অধর মুক্ত করে আঙ্গুলের অত্যাচার হতে।ফের,সেথায় টোকা দেয়,
–“আর হ্যাঁ,তুমি মাথামোটা আমার জন্যে যথেষ্ট।”
শেষ বাক্যে তুখোড় রাগ স্পষ্ট।

তাহুরার মগজের ভেতরকার অবস্থা এলোমেলো।এতটা অনুভূতি,পীড়া তার সহ্যের বাইরে। উমাইরের কথাগুলো মস্তিষ্কে সেট করার পূর্বে সে ভাবে,আজ পর্যন্ত উমাইর ছাড়া অন্য পুরুষের কথা সে ভাবেনি,না কখনো ভাববে।এতকিছু চিন্তার চেয়ে তাহুরা নিজ অধরের বিষে জর্জরিত।তবে, উমাইরের বলা সমাপ্তির বাক্যে তাহুরার সর্বসুখ নিহিত।
চক্ষু তুলে তাকায় তাহুরা।লম্বা অবয়বের লোকটা তার থেকে দূরে।হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছে উমাইর।প্রশস্থ কাঁধ নড়ে উঠে।পলক ঝাপটালে একেবারেই আড়াল হয় উমাইরের বিশাল দেহ।

আরো এক ফোঁটা জল আঁখি কোটর ভেদ করে বেরোয়।নিচ অধরে বিষাক্ত যন্ত্রণা।তাহুরা প্লে হাউজে ফিরে।জাফরান মনোযোগের সহিত খেলছে।মিউজিক সিস্টেমের টুংটাং শব্দে রুমটা সজাগ।তাহুরা ধীরে আঙুল ছোঁয়ায় অধরে।টনটন করে ব্যথায়। ফুঁপিয়ে কাঁদে। উমাইরের শেষ বাক্যে সুখী হবে নাকি পীড়ায় আফসোস করবে কিছু আয়ত্বে এলো না তাহুরার।এমন কষ্ট দিয়ে কেউ অনুভূতির জানান দেয়?তাহুরা কিভাবে গ্রহণ করবে বিষয়টা?
জাফরান এগিয়ে আসে তাহুরার নিকট।ছোট হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে,

–“কাদঁছো কেনো আপু?”
–“এমনি।”
তাহুরা থামানোর চেষ্টায় নিজেকে।
এরমাঝে খেয়াল করে সুনেরার উপস্থিতি।সুনেরা তাহুরার মাথায় হাত রাখে।গমগমে সুরে বলে,
–“ঐ বাজে মেয়েটার কথায় কাঁদবি না।উমাইর ভাইয়া সত্যি ভালো মানুষ।”
কথাটা জানে তাহুরা।সে বিশ্বাস করে উমাইরকে।আজকের ঘটনায় বিষয়টা কাঁচের মতো পরিষ্কার।একা পেয়ে,কাছাকাছি থেকেও উমাইর বাজে কিছু করেনি। উল্টো ঠোঁট চেপে শাস্তি দিয়েছে।

–“আমি জানি আপু।”
তাহুরা জবাব দেয়।
বোন খেয়াল করে তাহুরার রক্তিম অধর খানা।সেথায় ইশারা করে জিজ্ঞাসা করে,
–“ঠোঁটে কি হয়েছে?এমন রক্তিম কেনো?”
–“পো…পোকা কামড়িয়েছে হয়তো।”
আমতা আমতা উত্তর তাহুরার।
–“নিচে চল।আর একা থাকতে হবে না।পেস্ট লাগাবি ঠোঁটে।”
তাহুরা মাথা নাড়ায়।

জাফরানকে কোলে তুলে সুনেরা।ফের বোনের হাত ধরে নিচে নামতে উদ্যত হয়।হাঁটতে হাঁটতে আওড়ায়,
–“চাচী আফিয়াকে চড় দিয়েছে।উমাইর ভাইয়া কি চিৎকার না করলো।ভাগ্যিস মা আলাদা রুমে নিয়ে আলোচনা করেছে ব্যাপারটা।নাহলে আফিয়ার মান সম্মান কই যে যেতো।”
–“আফিয়া আপু কাঁদছিলো?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।
–“হ্যাঁ।কেমন জঘন্য মেয়ে।”
তাহুরা চুপটি করে শুনলো।উত্তর দিলো না আর।
নিচ তলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো। আড় দৃষ্টিতে লিভিংরুমে পা টেনে বসে থাকা উমাইরকেও অবলোকন করে।পাশে আছে জুবায়ের।

তাহুরাকে সুনেরা পূর্বের খালি কক্ষে নিয়ে আসে।মেঘলা বেগম বসে।সুনেরা বর্ণনা দিলে তাহুরার ঠোঁটের,মেঘলা দ্রুত পেস্ট আনে।আলতো হাতে লেপ্টে দিয়ে বলে,
–“আমার মেয়েটাকে সবাই শুধু কাঁদায়।উমাইর খুব বকেছে আফিয়াকে।পুনরায় কখনোই সাহস করবে না সে এমন কাজ করতে।”

তাহুরা পীড়া সহ্যের চেষ্টায়।আফিয়াকে যে বকেছে,সে’ই আফিয়া থেকে বেশি কষ্ট দিয়েছে তার ঠোঁটে।
এরমাঝে দরজায় টোকা পড়ে।মেঘলা আসার নির্দেশনা দিলে দরজা খুলে অপর পক্ষ।উমাইরের অবয়ব স্পষ্ট।
উমাইর তাহুরার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালে তাহুরা নজর ঝুঁকায়।ভেসে আসে উমাইরের কণ্ঠ,
–“মা,আমি বেরুচ্ছি।রনি আসবে এখন।”
–“ডিনার এইখানে করবে না,আব্বা?”
–“না।”
শক্ত জবাব উমাইরের।
মেঘলা দাঁড়ায়।ছেলের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

–“তাহুরার সাথে একা কথা বলবে?”
উমাইর ফের তাকায় তাহুরার অবয়বে।তাহুরা দৃষ্টি তুলে।ভাবভঙ্গি কঠোর উমাইরের।তাহুরার গলা শুকিয়ে আসে।আঁখিতে ভাসে ঠোঁট চেপে দেওয়ার দৃশ্য।কামিজের উপরিভাগ মুঠোতে নেয় সে।পরক্ষণে উমাইরের শব্দতে মনটা ভারী হয়।
–“না।আমি যাচ্ছি।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৪

মুখের উপর প্রত্যাখ্যান করে দরকার ওপারে আসে উমাইর।
দরজা বন্ধ হলে,ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে সে। ঘাড়ে হাত বুলায়। অনুভূতিরা হরতাল করছে তাল দিয়ে।কি কথা বলবে সে মেয়েটার সাথে?তখনকার মুহূর্তে তাহুরার মিহি মোলায়েম সুরে অন্তঃস্থল এখনো উলোটপালোট মানবের।
সম্মুখে অগ্রসর হওয়া অবস্থায় আপন মনে সে শুধায়,
–“তোমার ছোট ছেলের বউকে শুধু আদর করতে মন চায়,মা।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৬