রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৮

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৮
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“তুই আমার শালীকে কাঁদিয়েছিস,উমাইর?”
তাহুরার ফুলে থাকা মুখশ্রী অবলোকন করে প্রশ্ন করে জুবায়ের।
তাহুরা ইতস্তত ভঙ্গিতে হাসে।সুনেরা বোনের কাঁধ চেপে দাঁড়িয়ে।উমাইর গাড়ির সম্মুখে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাহুরার পানে তাকিয়ে আছে।সে ভেবেছে তাহুরা নালিশ করবে বোনকে।কিন্তু,মেয়েটা হাসছে।উমাইর গাড়ির দরজার সম্মুখে যায়।ভ্রু কুঁচকে ভাইকে জবাব দেয়,

–“তোমার শালী মিটমিট হাসছে।দেখছো না?”
–“ভাইয়া, ও কাঁদলে আলাদা বুঝা যায়।”
সুনেরা বোনকে নিয়ে চিন্তিত।তার বোন সহজ সরল বেশ।মুখ ফুটে তার কম।অন্যের দোষ ঢাকতে উস্তাদ মেয়েটা।
–“আপু,আমি ঠিক আছি।আসলে রেস্টুরেন্টে একটু অকোয়ার্ড লাগায় ভুলে কান্না এসেছিলো।উনার দোষ নেই।”
দৃষ্টি মিলে তাহুরা,উমাইরের।তাহুরার উত্তরে মনটা কেমন নড়ে উঠে মানবের।মুর্দা কথা,উমাইর কাঁদিয়েছিলো তাহুরাকে।তাও বিনা কারণে,ইচ্ছাকৃত।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জুবায়ের শব্দ করে হাসছে।সুনেরার চেহারার চিন্তিত ভঙ্গি কেটেছে।বোনের উত্তরই তার জন্যে যথেষ্ট।
–“তুইও না।জুবায়ের সিএনজি ঠিক করে দাও আমাদের।তোমাদের ঝামেলায় আর না ফেলি।”
সুনেরার কথায় রেগে যায় জুবায়ের।সে তার হবু বউয়ের বাহুতে হাত রাখে,
–“নতুন গাড়ি করে ড্রপ করছি। আমার গাড়ি ছেড়ে সিএনজিতে যাবে কেনো?”
–“শুনো জুবায়ের তুমি বেশি কথা বাড়াচ্ছো।”
সুনেরা বলে উঠে।

–“তুমি বেশি করছো,জান।আমার মেজাজ ঠাণ্ডা ছিলো।এখন গরম।যাবে কিনা বলো?”
কেমন তেঁতিয়ে উঠছে জুবায়ের।
তাহুরা ভীত হয়। পাছে বোন রাগ করে যদি ভাইয়ার সাথে মনোমালিন্য করে! তার বোন রেগে গেলে আবার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সে তার বোনকে বলে,
–“ভাইয়ার সাথে যায়,চলো।”
–“ওকে,তোমরা যাও তবে।আমি বাসায় যাচ্ছি।”

উমাইর ফোড়ন কেটে বলে। সেও চায় না ঐ দুজনের মাঝে কোনো ঝামেলা হোক।উমাইর গাড়ির দরজা খুললে এমতাবস্থায় কেশে উঠে জুবায়ের।সে অনুরোধের সুরে তাহুরাকে শুধায়,
–“প্রিয় শালী,তুমি উমাইরের সাথে আসো।আমি তোমার আপুকে নিয়ে যায়?সমস্যা হবে তোমার?”
ফের উমাইর!এই লোকটা কি বলে কাঁদাবে আবার তাকে?উমাইর মানুষটা তার পিছু ছাড়ছে না কোনোভাবে।বাস্তবিক বা জল্পিত কোনো না কোনো ভাবে উমাইরের সাথে তার সঙ্গ দিতে হচ্ছে।সুদর্শন লোকটা তাহুরার মনের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি করলেও,

ভয় ছড়িয়ে রাখে সর্বক্ষণ।
তাহুরা উমাইরের অবয়বে দৃষ্টি রাখে।লোকটা তার সাথে যেতে চায়?উমাইর বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাহুরা জবাব দেওয়ার পূর্বে বলে,
–“হারি আপ,তাহুরা।”
তাহুরার উত্তর শোনার অপেক্ষা করেনি উমাইর।গাড়িতে বসে।সুনেরা প্রশ্নবোধক চেহারায় বোনকে দেখলে,তাহুরা উত্তর দেয়,

–“সমস্যা নেই ভাইয়া।”
তাহুরার মিষ্টি হাসিতে মন গলে সুনেরার,
–“আচ্ছা আয় তবে।জুবায়ের তুমিও না,বেশি করছো ইদানিং।”
–“বেশি করার সময় এখন ডার্লিং।”

এক চোখ টিপে জুবায়ের।অভিমান অল্প কমে সুনেরার।মুচকি হেসে তাহুরাকে গাড়িতে উঠতে বলে।সে উঠলে নিজেও বসে জুবায়েরের নতুন গাড়িতে।গাড়ির সকল ফর্মালিটি,টেস্টিং, সার্ভিসিং সবকিছু কমপ্লিট করানো।
ঘড়ির কাঁটা রাত আটটায়।আবহাওয়া শীতল।উমাইরের গাড়ির স্পিড ভালো।রাস্তাঘাটে আজ কম ট্র্যাফিক। জানালা বন্ধ।সেথায় মাথা ঠুকে বাহিরে দৃষ্টি দেয় তাহুরা।মনে কেমন ঝড় তার।

পাঞ্জাবি পরিহিত উনাইরকে নিয়ে তার অন্তর ভাবুক হতে চায়। তাহুরা কুঁকড়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে।উমাইর এই ব্যাপারে জানলে তাকে কেটে হয়তো নদীতে ভাসাবে।কিন্তু,তাও।আজ মনটা কেমন ছন্নছাড়া।রাগী উমাইর,হাস্যোজ্বল উমাইর,আবার অন্য এক রূপ দেখেছে উমাইরের সে।কেমন জড়তায় ঘেরা।দৃষ্টিতে ছিল উমাইরের আলাদা আকাঙ্খা।সকল রূপে লোকটা অন্তরে জ্বলনের সৃষ্টি করছে তার। কলেজের স্যার উমাইর,তাহুরা সে কথা ভুলতে বসেছে। উমাইর নিজে বললো,কলেজের বাহিরে সে তার স্যার না।

–“ভাইকে মিথ্যে বলেছিলে কেনো?”
গাড়ির তুখোড় শব্দে উমাইরের গম্ভীর স্বরে ধ্যান ছুটে তাহুরার,
–“জ্বী?”
সোজা হয়ে বসে তাহুরা।আড় চোখে উমাইরকে দেখে।
–“আমি তোমাকে কাঁদিয়েছি ইজিলি বলতে পারতে। মিথ্যে বলার কি দরকার ছিলো?”
উমাইরের দৃষ্টি সোজা।

–“মিথ্যে বললাম কই?আমি এইভাবেই কান্না করেছি।যদিও কান্না করার কোনো কথা আপনি বলেননি।একটু সহজে কাঁদি আমি। তাই এখানে আপনার দোষ দেখছি না।”
অধর প্রসারিত করে তাহুরা।
–“ওহ আচ্ছা।সমস্যা নেই,এখন থেকে ভালো করে কান্না করাবো।এমনি এমনি কান্না আসবে না।আমি খুব ধমকাবো তোমাকে।”
তির্যক হাসে উমাইর।তাহুরা নিশ্চয় মুখে আঁধার মেখেছে।মেয়েটা অযথা ভয় পায় সর্বক্ষণ। তাহুরার দিকে ফিরতে চেয়েও ফিরলো না উমাইর।মেইন রোডে গাড়ি চালাতে হয় সুরক্ষিত ভঙ্গিতে।
উমাইরের ধারণা অনুযায়ী ঠিকই তাহুরা দমে যায়। উমাইরকে প্রশ্ন করে,

–“কেনো?”
–“আমার ইচ্ছা।জানো,আমি আমার ইচ্ছাকে দাম দিই বেশ।”
–“অনেক ধমকাবেন?”
ভীতু প্রশ্ন তাহুরার।
–“দেখি।আমি যা বলি শুনবে কিন্তু। চারা কবে দিবে?”
উমাইর জবাব দেয়।
–“আপনি যখন বলেন।”
–“বাসায় গিয়ে মেসেজ দিবে আমাকে।আমি বলবো কবে নিবো।”
স্টিয়ারিং ঘুরায় উমাইর দক্ষ হাতে।
তাহুরা ভোঁতা মুখে জবাব দেয়,

–“আচ্ছা।”
বাড়িতে পৌঁছায় তারা পৌনে নয়টার দিকে।তাহুরার আঁখিতে জল।ঘরের কাছাকাছি এসে ব্যাপক ট্র্যাফিকে পড়েছিল তারা।উমাইরকে বলেছিল,
–“নেমে যায় আমি?সামনেই তো বাসা।”
জবাবে উমাইর ধমকে উঠে,
–“এতো পাকনামি কিসের? ট্রাফিকে আটকে থাকা সকলকে তোমাকে দেখাতে চাইছো?নাকি নিজে দেখতে চাইছো?”
ব্যস এতটুকু কথায় তাহুরা কেঁদে অস্থির।লোকটাকে বাসায় আসতে বললেও বিনা উত্তরে চলে যায় সে।কি অভিমান লোকটার!

কোনোভাবে নিজেকে শান্তনা দেয় তাহুরা।ওড়নার কিনারায় অশ্রুজল মুছে। মা এসে চা দেয়। প্রশ্ন করলেও উত্তর দেয়নি সে। শিউলি কাজের তাড়নায় মাথা না ঘামিয়ে চলে যায়।।সুনেরা বাবার সাথে আলোচনা করছে।জুবায়ের কিছু কথা বলে তাকে বিয়ে সম্বন্ধে।সেই ঘটনা বাবাকে বলছে বড় মেয়ে।
তাহুরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ব্যাগ হতে জমানো টাকা বের করে।উমাইরের জন্যে চারা কিনতে হবে।নাহলে দেখা যাবে আবারও দাঁতে দাঁত চেপে কথা শুনিয়েছে তাকে।আগেভাগে টাকা তুলে রাখে তাহুরা।আবার যদি খরচ হয়ে যায়! চারার টাকা অন্য পকেটে রাখে ব্যাগের।মনে আসে উমাইর বলেছিলো,মেসেজ দিতে।

সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তাহুরা মোবাইল হাতে নেয় দ্রুত। উমাইরের দেওয়া মেসেজ দেখে সাথে সাথে,
–“এই যে,নামটা সুন্দর।আমি ছাড়া অন্য ছেলের সাথে যেনো মেসেজে বা ফোনে কথা না বলো।বুঝেছো?”
এমন আবদার!এমন উপদেশ!তাহুরার জীবনে উমাইর ব্যতীত কেউ বলেনি।এহেন উপদেশে টান খুঁজে পায় তাহুরা।অনুভব করে বুকের শীতল অনুভুতি। গালের জ্বলন।তার আবার হলো কি?

দুই অধর চেপে জোরে শ্বাস নেয় তাহুরা।আঁখিতে ভেসে উঠে উমাইরের হাসি,তার রাগী চক্ষুদ্বয়,তার সুঠাম স্বাস্থ্য। অনেক্ষণ ভেবে চিন্তে তাহুরা উমাইরকে মেসেজ পাঠাতে গেলে গ্রুপকল আসে।তাড়াহুড়োয় রিসিভ করে কল।
একে একে স্বাগতা,চৈতালি কথার ঝুড়ি খুললে তাহুরা মন দিয়ে সব শুনে উত্তর দেয়।পরক্ষণে বোনের বিয়ের সুসংবাদ দেয়,

–“আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কার সাথে জানিস?”
–“ওহ মাগো।কবে বিয়ে?আমি উড়ায় নাচবো।”
চৈতালির হাসির সুর।
–“আমি তোদের বাসায় তিনদিন থাকবো, তাহু।”
স্বাগতা বিনা দ্বিধায় বলে।
অট্টহাসি শোনা যায় তাহুরার। বান্ধুবিদের সহিত ব্যাপক উল্লাস করবে সে।হাঁটু গুঁজে বসে সে বিছানায়।লম্বা কেশ স্থুপাকারে হেলিয়ে পড়ে বিছানায়,

–“অবশ্যই।আসল কথা শোন।উমাইর স্যারের ভাইয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছে আপুর।আপন ভাই।”
জবাব শুনে দুই বান্ধবীর হুঁশ যায় যায় অবস্থা।চৈতালি গর্জে উঠে,
–“মাগো,কি কথা?স্যার?আমরা নাচবো কেমনে উনার সামনে?”
–“ধুর,লজ্জার কি? আমাকে বল আগে, অ্যারেঞ্জ নাকি লাভ ম্যারেজ?”
চৈতালি প্রশ্ন করে,
–“লাভ।এখনো বিয়ের তারিখ পড়েনি।দুইদিন পর পড়বে।স্যারের দিক স্যার থাকবে,আমরা আমাদের মতো থাকবো।”
তাহুরার সহজ জবাব।

–“হুম ঠিক ঠিক।খুব মজা হবে ভাই।”
চৈতালি বলে।
–“একদম।”
হাসিমাখা উত্তর দেয় তাহুরা।আরো কিছুক্ষণ আলাপ শেষে ফোন কাটে।

তাহুরা বিছানায় শুয়ে পড়ে।মোবাইলের আলো জ্বলছে এখনো। উমাইর আরো দুইটা মেসেজ পাঠিয়েছে,
–“মেসেজ দেখেও উত্তর দাওনি কেনো?”
–“রিপ্লাই দাও।বাড়ি যাওয়ার আগে আমার মেজাজ খারাপ করেছো তুমি।”
মেসেজগুলো পড়ে নিস্তেজ হয় তাহুরার তনু।লোকটা এমন ছটফট করার কারণ কি?
উত্তর ভেবে মোবাইলের কিবোর্ডে আঙ্গুলের নৃত্য চলে তাহুরার।উমাইরের মেসেজের বিনিময়ে পাঠায়,
–“ফ্রেন্ড কল দিয়েছে।বাইরের কারো সাথে কথা বলি না আমি,স্যার।আপনার মেজাজ খারাপ করার জন্যে সরি।”
উত্তর পাঠিয়ে ভাবুক হয় তাহুরা।উমাইরের রাগ কমেছে কিনা জিজ্ঞাসা করবে কি?বেশি হয়ে যাবে আবার?
ভেবেচিন্তে একটি মেসেজ নিজ হতে পাঠায়,

–“আপনার রাগ কমেছে কি?”
ঘরের রিডিং রুমে ল্যাপটপে ইন্টারের প্রশ্ন সেট করছিলো উমাইর।অনবরত হোয়াটস অ্যাপ নোটিফিকেশন লক্ষ্য করে ল্যাপটপ বন্ধ করে।চেয়ারে হেলান দেয়।চোখ হতে রিডিং চশমা খুলে।অত্যধিক টাইপিংয়ের সময় মাথা ব্যথা এড়াতে রিডিং চশমা ব্যবহার করে সে।
তাহুরার মেসেজ দেখে শরীরটা যেনো হালকা হয় তার। বোকা মেয়েটা তার আয়ত্বে আসছে ধীরে ধীরে।অধরে তার তৃপ্তির হাসি।
আলগোছে সে তাহুরাকে মেসেজ পাঠায়,

–“স্যার মানে?তুমি এখন কলেজে?”
উমাইরের মেসেজের অপেক্ষায় ছিলো তাহুরা।এমন প্রশ্ন দেখে দাঁত দ্বারা জিভ কাটে সে।জবাবে পাঠায়,
–“সরি।আর বলবো না।”
–“গুড। চারা তোমাদের বাড়ি এলে সেদিন নিবো।কিনে রেখো।”
উমাইর ফের মেসেজ দেয়।
–“আচ্ছা।আমি এখন যায়।বাসায় কাজ আছে।আসসালামুয়ালাইকুম।”

তাড়াহুড়োয় তাহুরা মেসেজখানা পাঠিয়ে দৌড় দেয়।তার মা ডাকছে।বিছানার চাদর পরিবর্তনের দায়িত্বে ছিলো মেয়েটা।ভুলে গিয়েছিল হুট করে। মা ডাকলে হুঁশ হয়।
উমাইরের উত্তর পরে দেখবে সে।আগে মায়ের বকুনি হতে বাঁচতে হবে।
উমাইর আর জবাব দেয়নি।মনে মনে সালাম গ্রহণ করে।

মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা “স্টুপিড রূপসী” নামটাতে আঙ্গুল বুলায়।এই রূপসী ধীরে ধীরে নিজের বশে আনার উত্তেজনায় অশান্ত তার হৃদয়।তারপরও মনে সন্তুষ্টি।মেয়েটা তার আহ্বানে সাড়া দিতে আরম্ভ করেছে।
মোবাইল পকেটে ঢুকায় উমাইর। ঘাড়ের নিচে দুইহাতের তালু আড়াআড়িভাবে রাখে।স্মৃতিতে ভাসমান তাহুরার মুখশ্রীর ছুটাছুটি।ব্যাকুল মনে বলে,

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৭

–“বোকাপাখিটা আমার প্রতি সহজ হচ্ছে ধীরে ধীরে।পাখিটাকে আমার খাঁচায় বন্ধী করবো সারাজীবনের জন্যে।এই পাখিটা শুধু আমার মন পিঞ্জিরাতে আবদ্ধ হতে বাধ্য।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৯