রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৯

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৯
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“সুনেরার বিয়ের পরপর তাহুরার বিয়ে দিবো।ছেলে ঠিক করা আছে।আমার শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়।”
গর্জে উঠে মুন্সী মিয়া।তাহুরা কেঁদে উঠে শব্দ করে।উমাইরকে ইশারা করে।অথচ উমাইর কিছু করতে পারলো না।তার হাত পা যেনো বাঁধা। তখনই কক্ষে এক পুরুষালি অবয়ব ভেসে আসে।অবয়বটি তাহুরার পানে যাচ্ছে। ভীত,অশ্রুসিক্ত তাহুরা পিছপা হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে।শব্দ করে বলে,

–“এই যে দেখুননা,লোকটা আমার দিকে ভয়ংকর ভাবে আসছে।”
উমাইর সম্মুখে এগোতে চায়।তার পা আটকে।মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে।অদ্ভুত সকল দৃশ্য।তার পায়ে শিকল বাঁধা।আবার মেঝেটা মাটির।পা নাড়াতে অক্ষম সে।শব্দ করতে চাইলো মুখ দিয়ে।পারলো না। ঠোঁটে হাত রাখে,তার দুঠোঁট যেনো চিপকে আছে একসাথে।আচমকা লোকটা গলা চেপে ধরে তাহুরার।মেয়েটা আর্তনাদ করলো না,মুখ ফুটে কিছু বললো।বুঝলো না উমাইর। তবে অনুভব করলো লোকটা তাহুরাকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে তার থেকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এলার্মের টিটি শব্দে মুখরিত কক্ষ। উমাইরের চোখ জোড়া এক নিমিষে খুলে। উপরিভাগের সাদা সিলিং দৃশ্যমান।পর্দার অন্তরালে ভেদ করছে কঠিন আলো। মোটা দামী পর্দাখানা আলো ঠেকাতে হিমশিম খায়।অকারণে ঘেমে আছে সে।অথচ কম পাওয়ারে এসি চলছে।

এই মুহূর্তে তার মস্তিষ্কে চলমান একটাই বাক্য “তাহুরা”। স্বপ্ন দেখেছে উমাইর।বিশ্রী এক স্বপ্ন। জোরে শ্বাস ফেলে।উদাম শরীর হতে কম্বল সরায়। তর্জনী,বৃদ্ধাঙ্গুল সহিত কপাল চেপে ধরে।বুকের উঠানামা দ্রুত।এমন বাজে স্বপ্ন না দেখলেও হতো। বালিশের পাশ হতে মোবাইল হাতড়ে নেয়। ঘড়িতে সকাল ছয়টা বেজে চার মিনিট।প্রভাতে বাহিরে দৌড়ানো তার দৈনন্দিনকার রুটিন। মোবাইল হাতের মুঠোয় নিয়ে আধ শোয়া অবস্থায় বসে।

হোয়াটস অ্যাপে ঢুকে।দু’দিন মেয়েটার দেখা পায়নি উমাইর। এতে এমন অস্থিরতা সৃষ্টি হলো যে,একেবারে বিভৎস এক স্বপ্ন দেখেছে।না খুন ছিলো,না কোনো নৃশংসতা!তাও স্বপ্নটা বিভৎস।তাহুরা উমাইর থেকে দূরে যাবে,এটা বিভৎসতা নয় তো কি?
মোবাইলে নজর বুলায় উমাইর।শেষ মেসেজটা তাহুরা দিয়েছিলো,

–“আপনার চারা কাল পেয়ে যাবেন।এখন ঘুমায়।খোদা হাফেজ।”
মেসেজ পাঠানোর সময়কাল রাত দুটো। বোনের শ্বশুর বাড়ির জন্যে প্রস্তুতি নিতেই হয়তো রাতের অনেক সময় অব্দি কাজ সেরেছে তাহুরা।
উমাইর কাল রাতে জলদি ঘুমিয়েছিল।ফলস্বরূপ এখন সে মেসেজ পাঠায়,
–“দেখা যাক কবে পায় চারা। এতো রাতে অনলাইনে ছিলে কেনো?”

উমাইর মোবাইল রেখে দু হাত উপরে উঠিয়ে কোমর বাঁকিয়ে কিছুক্ষণ অনুশীলন করে।অধরে তার হাসি লেপ্টে।স্বপ্নের জন্যে তার মোটেও কোনো দ্বিধা নেই।বরংচ মেয়েটার উপর সে আরো গভীর নজর জারি করবে। অন্য কারো অবয়বের পবন অব্দি লাগতে দিবে না তার রূপসীর অবয়বে।বিছানা হতে নামতে নামতে সে আপনমনে বলে,
–“দুঃস্বপ্ন বলতে কিছু নেই,কেবল আছে একটাই স্বপ্ন।তুমি আমার বাহুডোরে আবদ্ধ হবে সারাজীবনের জন্যে।এই স্বপ্নটাকে আমি বাস্তবে রূপ দিবো,প্রাণ।”

আলগোছে নিজের বিছানার চাদর পরিপাটি করে গায়ের পাতলা চাদর গুছিয়ে রাখে পায়ের কাছটায়।পরক্ষণে টিশার্ট এবং থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট নিয়ে বাথরুমে যায়।আজ আটটা থেকে তার ক্লাস।কিছুক্ষণ এক্সারসাইজ করে আবার অফিসে ছুটতে হবে।অবশ্য আজ তার কলেজ ছুটিও তাড়াতাড়ি হবে।
জগিংয়ে যাওয়ার সময়ে নিচতলা ফাঁকা হলেও এখন আবার কাজের লোক হতে শুরু করে চাচী,মাকে দেখা যাচ্ছে।বাগানে নিবরাসকেও দেখেছিল উমাইর।
সিঁড়ির নিকট এলে তার সম্মুখে আসে মেঘলা বেগম।ছেলেকে অনুরোধের সুরে বলে,

–“আজ জলদি আসবে?”
–“হ্যাঁ।ক্লাস কম আজকে।ধরো বারোটার আগে ফ্রি হবো।”
উমাইর ক্লান্ত মুখে জবাব দেয়।
–“তাহলে সোজা ঐবাড়িতে এসে যাবে?”
–“নাহ।আগে বাসায় আসবো।দেরী হচ্ছে আমার।নাস্তা দাও।”
কথা বাড়ায় না আর উমাইর।দ্রুত পায়ে উপরে উঠে। আফিয়াকে অবলোকন করে সে।তবে আফিয়ার আগানো দেখেও থামেনি উমাইর। তৈরি হবে সে।

শার্টের বাটন ঠিক করে,চুলে চিরুনী চালায় উমাইর। গতদিন ট্রিম-শেভ করার দরুণ গালে খোঁচা দাড়ি।হাতের ঘড়ি ঠিক করে মোবাইল চার্জ হতে ছুটায়।আলো জ্বললে সেথায় ভেসে উঠে তাহুরার মেসেজ।উমাইর কক্ষ হতে বেরুনো অবস্থায় মেসেজ চেক করে।মেয়েটা মিষ্টি একখান মেসেজ দিয়েছে,
–“আপনাদের বাড়ির সকলের জন্যে আয়োজনে ব্যস্ত ছিলাম,তাই মেসেজ দিতে পারিনি। পরে আপনার মেসেজের উত্তর দিতে এসেছিলাম।আপনি আসছেন আজকে?”
বাঁকা হাসে উমাইর।মাথায় ত্যাড়া উত্তর কিলবিল করে।হাঁটা অবস্থায় মোবাইলে দৃষ্টি রেখে লিখে,

–“কেনো?আমি আসলে কি হবে?আমার আসা কি ফরজ?”
উমাইরের অধর প্রসারিত হয়।নিশ্চয় মেয়েটা এই মেসেজ দেখে বিচলিত হবে।উমাইর কি বুঝাতে চেয়েছে এটা ভেবে মাথা চেপে বসবে!

তাহুরা ঘরের সকল কাজ শেষ করেছে দ্রুত।সকালে উঠেছে জলদি।রাতে দেরীতে ঘুমিয়ে ফের উঠে যাওয়াতে মাথা ধরেছে মেয়েটার।অথচ কাউকে বুঝতে দেয়নি সে।অতিথিদের আপ্যায়নের জন্যে সবটা গুছিয়ে নিচ্ছে মা বোনের সহিত।কাজ মুটামুটি আয়ত্বে এলে তাহুরা মায়ের নিকট যায়।মা বিছানার চাদর ঠিক করছে।রান্নার সকল আয়োজন গতদিন থেকে আজ পর্যন্ত মিলে সব শেষ।
তাহুরা চারা কিনতে যাবে।কলেজের সম্মুখে নার্সারি থেকে সদা চারা কিনে সে।মাকে সে ভাবলেশহীন বলে,

–“মা,আমি একটু কলেজ যাবো।”
–“এখন?বারোটা বাজে।মেহমানরা আসবে।”
শিউলি বিরক্ত।
–“উমাইর স্যারের জন্যে চারা কিনতে হবে।উনি চাচ্ছিলেন।”
তাহুরা হাতে হাত ঘষে জবাব দেয়।
উমাইরের নাম শুনলে নিভে যায় শিউলি।মানা করার বদলে হুশিয়ারি স্বরে বলে,
–“জলদি আসবি।তোর বাবা যেনো টের না পায়।আর হ্যাঁ,দেখে শুনে ভালো চারা কিনবি।”
–“আচ্ছা।”

তাহুরা ব্যাপক খুশি। মা সহজে মেনে যাবে,ভাবেনি মেয়েটা।শিউলি কেবল তাকে গাড়ি ভাড়াটুকু দেয় হিসাব করে।
তাহুরা বোনের বোরকা পড়ে।মাথায় কালো হিজাব বাঁধে।মুখ উন্মুক্ত।কলেজ ব্যাগে রাখা চারার আলাদা টাকা মায়ের দেওয়ার ভাড়ার সাথে অন্য ছোট পার্সে নেয়। তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে পড়ে।বাবা আসবে দোকান হতে বেলা আড়াইটায়। অসময়ে বিনা কারণে মেয়েকে বাহিরে যেতে দেখলে চিল্লিয়ে ঘর মাথায় তুলবে মুন্সী।

কারো কথার ধার ধারবে না।
দোয়া দরুদ পড়ন্ত তাহুরা বাসে উঠে।মোবাইল নিয়ে আসেনি ভুলে।এই নিয়ে মনে শঙ্কার দানা বাঁধে।বাস থামলে সোজা যায় ফুলের দোকানের সামনে।আশ্চর্য হলেও পরিচিত দোকানে আজ গোলাপের চারা ফুরিয়েছে। বিচলিত মেয়েটা আরো হাঁটতে থাকে।কলেজের গেট বরাবর শেষ দোকানে গোলাপের চারা দেখে সে।তবে দাম আকাশচুম্বী।হঠাৎই দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ বুঝেনি। তাহুরা ধীর স্বরে জিজ্ঞাসা করে,

–“আগে এমন দাম ছিলো না।আজ দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ?”
–“আরে আপা,গোলাপের মার্কেট দাম বাড়ছে।সেজন্যে দাম বাড়লো।”
দোকানির কথায় ভাবুক হয় তাহুরা। হিসাবকৃত টাকা থেকে আরো পঞ্চাশ টাকা লাগবে।যা তাহুরার আসার ভাড়া।দোকানে ভিড় বাড়লে মেয়েটা নুয়ে যায়।সাত পাঁচ না ভেবে তার উমাইর স্যারের জন্যে চারা গাছ কিনে নেয়।

তাহুরা দোকান থেকে বেরুলে,বিপত্তি ঘটে। ফুলের দোকানের পাশের দোকান আবার বড় গ্রোসারি শপ।একই সময়ে উমাইরের অবয়ব বেরিয়ে আসে অত্র দোকান হতে।তাহুরার হাত হতে চারা পড়তে নিলেও সে সামলে নেয়।উমাইর তাহুরাকে দেখেনি।সে সোজা নিজ প্রাইভেট কারের দিকে এগোচ্ছে।
তাহুরা নিজে উমাইরের পানে ছুটে।একে, বোনকে ফোন করতে সুবিধা হবে,নাহলে আবারও কলেজে গিয়ে কোনো স্যার,ম্যাডাম থেকে বোনকে ফোন করতে হতো।তার তো দোকান হতে ফোন দেওয়ারও পয়সা নেই।এছাড়াও অজানা লোক হতে ফোন করতে ভয় করে মেয়েটা।

আর দ্বিতীয়ত, উমাইরকে ফুল গাছ এখানে দিতে পারবে।
–“এই যে!শুনুন?”
মিষ্টি মধুর ডাক। উমাইরের অন্তর শীতল হয়।হাতের প্যাকেট পেছনে সিটে রাখে।তৎক্ষণাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
পেছনে বাক ফিরলে বক্ষদেশে ধাক্কা অনুভব করে।তাহুরার হাসিমুখ।মেয়েটার আঁখিদ্বয়‌ও হাসে। রৌদ্রের তেজে মেয়েটার নাকে ঘামের আস্তরণ।
হিজাবে কেমন পরিপূর্ণ লাগছে তাহুরাকে।অত্যধিক মোহনীয় মেয়েটা পুরোটাই!
উমাইর নিজেকে সামলে নেয়।থমথমে গলায় প্রশ্ন করে,

–“তুমি?এইখানে?”
পরপর লক্ষ্য করে মেয়েটার হাতের ফুলের চারা।এটা কিনতে এসেছে?
–“চারাটা নিন। মাত্র কিনলাম।”
উমাইর নেয়নি।চেয়ে রয় কেবল। হুঁশ হারাচ্ছে সে‌।
রোদের তাড়নায় হাঁসফাঁস করছে তাহুরা। বোরকার হাতায় নাক মুছে।
–“গাড়িতে উঠো।”

নির্দেশনা দিয়ে উমাইর দ্রুত গতিতে বসে।তাহুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।সে কেনো গাড়িতে বসবে?আপুকে ফোন দিয়ে বলবে মিনিট দশেক পর ঘরের দরজার নিকট ভাড়া নিয়ে দাঁড়াতে।সে সিএনজিতে আসবে।মা জানলে বকবে আবার!
তাহুরা উমাইরের জানালার ধারে যায়।সেথায় ঠকঠক করলেও কাঁচ নামায়নি উমাইর।কালো কাঁচ ভেদ করে কিছু দেখা যাচ্ছে না।অতঃপর তাহুরা হেঁটে অপরপাশে দরজা খুলে বসে।গাড়ি সম্মুখে অগ্রসর হয়।
কলেজের এলাকা পেরিয়ে প্রধান সড়কে গাড়ি উঠলে তাহুরা বলে,

–“গাড়ি থামাবেন?”
উমাইর গাড়ি থামায়।অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–“কোনো সমস্যা?”
–“আপনার মোবাইলটা দিবেন?আপুকে একটা ফোন করবো।”
ভীত সুর তাহুরার।উমাইর আবার না বকে বসে।উমাইর সুনেরার নাম্বার তুলে স্ক্রিন লক করে দেয়।মেয়েটার ছবি ডিসপ্লেতে।

–“আপু তুমি দশ মিনিট পর,একশো টাকার মতো নিয়ে গেটের সামনে এসো।আমার টাকা শেষ। লোকাল গাড়িতে আসতে পারবো না।তাই সিএনজিতে আসবো।মাকে বলবে না কিছু।”
তাহুরা ফোন রাখে কথা শেষে।দ্রুত মোবাইল নেয় উমাইর।ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
–“মোবাইল নেই,টাকা নেই,ঘর থেকে বেরিয়েছো কেনো?রাস্তায় রাস্তায় মানুষ থেকে সাহায্য খুঁজতে?”
কথাখানা কেমন অপমানিত করলো তাহুরার হৃদয়কে।আঁখি জলে ভরে।সে কখনো অচেনা কারো থেকে সাহায্য এইভাবে নিতো না। উমাইর তাকে সাহায্য করে খুব বিরক্ত?

–“আমি নেমে যাবো।গাড়ি স্টার্ট দিবেন না প্লিজ।”
তাহুরা নাক টেনে বলে।কেমন আঘাত করলো উমাইরের বাক্যগুলো।
উমাইর পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দেয়।সে যেমন বেখবর।পরপর কড়া শব্দে সে তাহুরাকে ভস্ম করে,
–“আর কখনো এমন হুঁশ জ্ঞান ছাড়া বের হবে না বাসা থেকে।বাহিরের সবাই ভালো সাহায্য করে না।মাথামোটা।”
–“আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি।”

ততক্ষণে তাহুরার নাক রক্তিম, গালে অশ্রুপানি।
–“ইচ্ছে করে না হোক।তুমি দুনিয়া সম্পর্কে কি জানো না?”
–“আমি কলেজ থেকে আপুকে ফোন করবো ভেবেছিলাম।”
–“ভাবতে থাকো।”
উমাইর আর উত্তর দেয়নি।তাহুরা মিনিট পাঁচেক পর নিজেকে শান্ত করে।নিজে ফের বলে,
–“চারা নিবেন না?”
–“না নিলে খুঁজেছি?”
উমাইর কেমন ধমকে উঠে।তাহুরা কিঞ্চিৎ কাঁপে।ফিচেল কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

–“আপনি আমার সাথে রেগে?”
–“কেনো?রাগলে কি রাগ ভাঙাবে?”
তাহুরা উপর নিচ মাথা নাড়ে।সে ভাবে উমাইর খেয়াল করেনি ব্যাপারটা।কিন্তু,উমাইর খেয়াল করেছে।মূলত তার মাথায় অন্য কিছু চলছে আজ।তাহুরার প্রতি মায়ায় পরিপূর্ণ উমাইর নিজেকে সংযত রাখতে হিমশিম খায়।কারণবশত আজ কারণে অকারণে মেয়েটাকে ধমকে নিজেকে শান্তি দিচ্ছে।
তাহুরার কোলে পড়ে থাকা শুভ্র হাতটা ধরতে মনটা অস্থির হয়ে উঠে উমাইরের। তাহুরাদের বাড়ির রাস্তার কাছাকাছি এলে উমাইর গাড়ি থামায়,

–“নামো।”
–“জ্বী?”
প্রশ্ন করলে তাহুরা তার পানে ফিরে উমাইর।দুজনের দৃষ্টি মিলে।তাহুরার ভীত হৃদয়ে উমাইররের মুখশ্রী দাগ কাটে মুহূর্তে।লোকটার প্রতি অদ্ভুত মায়ায় পড়ছে সে।ধমক দিলেও লোকটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে তার।ভুলেও যায় সে,উমাইর তার কলেজের স্যার!
–“বাড়ি যাও।”
ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে জবাব দেয় উমাইর।
–“আপনি যাবেন না?”
তাহুরার প্রশ্নে উমাইর মলিন হাসে অন্তরে।মেয়েটা হয়তো সকালের মেসেজ দেখেনি তার।ফের এমন প্রশ্নে উমাইর শক্ত মুখে জবাব দেয়,

–“চারা নিয়ে বাসায় যাও।”
তাহুরা আর কি বলবে ভেবে পায়নি।যাওয়ার পূর্বে ঝুঁকে বলে,
–“আমার জন্যে রাগ করে থাকলে সরি।প্লিজ রাগ করবেন না!”
উমাইর না ফিরলো,না কিছু বললো।রোবটের মতো বিনা উত্তরে গাড়ি নিয়ে ছুটে।তাহুরা ব্যথিত মনে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে।
উমাইরের অন্তর শান্ত নেই।চোখ জোড়া আজ বড্ড বেসামাল হচ্ছিলো।কই আগে এমন বেসামাল হতো না।এখন তাহুরাও উমাইরের সাথে সহজ হতে চাইছে বলে মনটাকে সামলানো এমন কষ্টের হচ্ছে?চুলে হাত বুলায় উমাইর,

–“বোকাটা এমন মন কাড়ে,বেসামাল না হয়ে উপায় কি?”
বাড়িতে কেউ নেই।বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড হতে জানে,সবাই মাত্র বেরিয়েছে।
উমাইর ফের গোসলের সিদ্ধান্ত নেয়।
ভেজা চুলে তাওয়াল চালিয়ে শুকাতে ব্যস্ত উমাইর।পড়নে কালো রঙের জিন্স প্যান্ট।উদাম শরীর হতে পানির বিন্দুকণা পুছতে গেলে আফিয়ার গলার আওয়াজ শুনে। উমাইরের নাম ধরে আর্তনাদ।

আফিয়া যায়নি?কোনো বিপদ হয়েছে কি?উমাইর শার্ট জড়িয়ে বেরোয় রুম হতে। সিঁড়ির রেলিং ঘেঁষে হাঁটার সময় কাউকে দেখেনি নিচতলায়।আফিয়ার রুমের দরজায় হাঁক দিলেও খুলেনি দরজা।যেই ধাক্কা দিলো দরজা ,অমনি খুলে যায় দরজা।মেঝেতে গোলাপের পাপড়ি,রুমে কড়া ঘ্রাণ।আফিয়া বিছানায় বসে আপত্তিকর অবস্থায়।বুঝতে বাকি রইলো না উমাইরের।ক্রোধে অন্ধ বনে সে।কপালের রগ দপদপ করছে।গলা ফাটিয়ে গর্জন করে,

–“খালা!”
আফিয়া এমনটা আশা করেনি।সে উঠে কাপড় জড়াতে গেলে উমাইর চিল্লিয়ে উঠে ফের,
–“বেহায়া, স্লাট কোথাকার!”
অন্তরখানা পুড়ে ছাই হয় আফিয়ার।পা থমকে যায়।ততক্ষণে দৌড়ে আসে খালা।আফিয়ার অবয়বে নজর গেলে মুখ ফুটে বলে,
–“আস্তাগফিরুল্লাহ্।”

–“ও চিলাচ্ছিল তখন আসেননি কেনো?আমি ডেকেছি আর হাজির?আফিয়া মানা করেছে?কেনো করেছে দেখেছেন?মা,চাচী আসলে মুখ খুলবেন নিজ থেকে।”
উমাইরের কণ্ঠ ঝলসে দেওয়ার মতো প্রখর।অর্ধ বয়সী রুজি নেতিয়ে। লোভে পড়ে এখন বিপদে ঠেকেছে।
–“দুঃখিত সাহেব…”
–“থামুন।মা,চাচী আসলে নিজ থেকে সবটা বলবেন এই মেয়ের কান্ড সম্পর্কে।আপাতত মানসিক রোগীকে দেখে রাখুন।নাটকের শেষ নেই এর।”
রাগে জ্বলন্ত উমাইরের প্রস্থান ঘটে।আফিয়া কেঁদে যাচ্ছে।রুজি আহম্মকের মতো চেয়ে আছে অর্ধ নগ্ন বেহায়ার পানে।ভাইকে হাত করতে এমন নষ্টামি!

মেহমান আসলে তাহুরা কাজে নিমজ্জিত হয়।নানু বাড়ির সকলেও এসেছে।এক মামা তার।খালা নেই।মামী তাকে সাহায্য করছে। চাচার পরিবারকে দাওয়াত করলেও কেউ আসেনি। ভীষণ ব্যস্ত তারা।সুনেরা পরিপাটি হয়ে সকলের সাথে কথায় মগ্ন।উমাইরের মামা,নানু এরাও এসেছে।বলতে গেলে উৎসব মুখর পরিবেশ। অনেকে বসার ঘর ছেড়ে শোয়ায় ঘরগুলোতে বসেছে।জায়গা হচ্ছে না,এমনটা ভাবতে দিচ্ছে না কেউ। ঘর মাঝারি,ঠিক আছে।আজ কেবল মানুষের আগমন বেশি।আফিয়া না আসায় তাহুরার পরিবার বেশ কয়েকবার শুধায় তার কথা।বিনিময়ে আফিয়ার মা জানায়,তার মেয়ে অসুস্থ।তাহুরা আফসোস করে বেশ। আপুটাকে তার ভালো লেগেছিল।গতবার যখন এসেছিল তখন কতো আলাপ হয়েছে।

উমাইরের মামার ছেলে জাফরান।বয়স চার।ছেলেটা বড্ড পটু এবং চঞ্চল।তার মা সোফায় বসলেও ছেলেটা দূরন্ত।বারংবার ডাইনিংয়ে এসে উঁকি দিচ্ছে।তাহুরা অবশ্য ছেলেটার সাথে হাসি বিনিময় করছে।উমাইরের এক মামার এক পুত্র।
নাস্তা পরিবেশনের পর তাহুরা এবং তার মামী ডাকে নতুন আত্মীয়দের।বাড়তি চেয়ার সমেত টেবিলে বসে সবাই।জাফরান অযথা মাকে বিরক্ত করছে।তাহুরা সেদিকে নজর বুলিয়ে কাছে ডাকে জাফরানকে,
–“আপু খাইয়ে দিই তোমাকে?আমরা পুকুরঘাটে আরাম করে খাবো।কেমন?”
তাহুরার কথায় জাফরান খুশি হয়।হাত উঁচিয়ে বলে,
–“কোলে নাও আমাকে।”

তাহুরা ভারী শরীরের জাফরানকে কোলে তুলে।হাঁপালেও দেখায়নি মুখে।তার একহাতে প্লেটে নাস্তা তুলে দেয় শিউলি।
তাহুরা নিজেকে সামলে নেয়।এরমাঝে নিবরাস দ্রুত হাঁটে।তার মা কারণ জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয়,
–“উমাইর ভাইয়া এসেছে।গেইট খুলতে বললো।”
–“আমি যাচ্ছি!”
ইমন বললে,নিবরাস ফের বলে,
–“ইটস ওকে,ব্রো।”

তাহুরার হৃদয়ে প্রশান্তি।যাক লোকটা এসেছে তবে।জাফরানকে নিয়ে হাঁটতে গেলে বুঝে কদম আস্তে ফেলতে হবে।জাফরান তার কোলে মিটমিট হাসছে এটা সেটা বলছে।তাহুরা আলগোছে কেবল হেসে যাচ্ছে।
উঠানে জুবায়েরদের হাইয়েছ,ইমনদের গাড়ি।তেমন একটা জায়গা নেই আর উঠানে।তবে উমাইরকে মোটর বাইক নিয়ে প্রবেশ করতে দেখে চমকায় তাহুরা।হেলমেট খুলে এলোমেলো চুল ঠিক করে সে।মুখশ্রী শক্ত তার।রেগে আছে মনে হচ্ছে।নিবরাস ভাইয়ের করুণ মুখ দেখে প্রশ্ন করে,
–“কি হয়েছে? সব ঠিকঠাক?রেগে আছো?”
তাহুরা প্রশ্ন শুনে সেদিকে যায়নি আর।উমাইরের কঠোর দৃষ্টি,শক্ত চোয়াল কেমন ভয়ার্ত।সুদর্শন লোকটা রাগে কেনো এমন?

উমাইর তাহুরাকে অবলোকন করে।মেয়েটা বাহিরে কেনো?তাও জাফরানকে কোলে নিয়ে।স্পষ্ট দেখলো কেমন হাঁপিয়ে যাচ্ছে সে। হেলমেট ধরিয়ে দেয় সে নিবরাসের হাতে,
–“নাহ।আমি ভেতরে পরে যাচ্ছি। একটু পুকুরপাড়ে বসবো।আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে,আমি জাফরানের সাথে আছি।”
উমাইর আবার বাচ্চা পছন্দ করে।জাফরান তাদের বাড়ি এলে তাকে নিজ রুমে বসিয়ে রাখে,কোলে নিয়ে গেমস খেলে।তাই ব্যাপারটা সাধারণ লাগলো নিবরাসের।
প্লেট পুকুরের দুধারে অবস্থিত সিমেন্টের বেঞ্চে রেখে জাফরানকে বসানোর চেষ্টায় তাহুরা।ইতোমধ্যে তার ওড়না,কামিজের বেহাল অবস্থা।উমাইর আসে ঠিক তখন।জাফরান তাহুরার জামা আঁকড়ে ধরলে নখের আঁচড় লাগে তাহুরার বুকে।খামচি কেটে যায় সেথায়।মেয়েটা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে,

–“আস্তে বসো,ভাইয়া!”
–“জাফরান তুমি নিজে বসতে জানো না?”
উমাইরের কণ্ঠে তাহুরা নিজেকে সামলে নিতে চায়।কিন্তু, ওড়নার উপর জাফরান বসে।লজ্জায় তাজ্জব তাহুরা।ওড়না নিয়ে টানাটানি করলে উমাইর জাফরানকে কোলে উঠিয়ে অন্য বেঞ্চে বসে।ওড়না নিয়ে দ্রুত ঘোমটা টানে তাহুরা।কিন্তু,লাভ হয়নি।উমাইরের মস্তিষ্ক জ্বলছে।যা দেখার দেখেছে সে।ভাগ্যিস অন্যকেউ ছিলো না! আফিয়ার ব্যাপারে এইভাবে তার মেজাজ বিগড়ে ছিলো।তাহুরা প্লেট নিয়ে তাদের নিকট আসে।জাফরানের মুখে খাবার তুলে দেয় তাহুরা।
সাথে শুনতে পায় সে উমাইরের গগণ বিদারক ধিম শব্দ,

–“কখনো যেনো মাথার কাপড় না পড়ে।যে কাজ পারো না,করতে যাও কেনো? জাফরানকে আলগাতে তোমার আরো ওজন বাড়ানো লাগবে।স্টুপিড।”
তাহুরা অধর চেপে রইলো।বললো না কিছু।কেনো উমাইর তাকে এমন অবজ্ঞা করে!
জাফরানকে খাওয়ানো শেষ হয় দ্রুত।হয়তো বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে।তাহুরা হেসে তাকে বলে,
–“আরেকটু আনবো ভাইয়া!”
জাফরান মাথা নাড়ে,
–“না।না।”

তাহুরা মিষ্টি হাসে।উমাইরের অধর প্রসারিত হয়।মেয়েটা তার মন ভালো রাখার হাতিয়ার।উমাইর তাহুরাকে অবলোকন করতে করতে আফিয়ার ঘটনা ভুলেছে।কমেছে তার ক্রোধ।
উমাইরের দিকে না তাহুরা তাকিয়ে উঠতে নিলে উমাইর তাহুরার গাল চেপে ধরে,
–“আমি শুধু তোমার বানানো খাবার খাবো।বাহিরের কিছু দিবে না।”
চেপে থাকা গালে তাহুরা উত্তর দেয়,
–“আচ্ছা।”
–“নিজের ওড়না,কামিজ সামলে রাখবে সবসময়।তোমার হেয়ালিপনা আমি মোটেও সহ্য করবো না। চেস্টে বার্ন করলে অয়েনমেন্ট লাগিয়ে নিও।”
গাল ছেড়ে দেয় উমাইর।

তাহুরা অপেক্ষা করেনি আর।বিস্ফোরিত নজরে কেবল এক ছলক উমাইরের দিকে তাকিয়ে দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে।সত্যি তার বুকে জ্বলছে প্রচুর।বল প্রয়োগ করে খামচি দেয় জাফরান। চামড়া উঠেছে মনে হয়। উমাইর সবটা লক্ষ্য করেছে! কি শরমের ব্যাপার!তবে তাহুরা খেয়াল করে,তার বুকের জ্বলনের চেয়ে তীব্র অশান্ত।সেথা হতে অনবরত শব্দ আসছে, ধুকধুক। জোরে শ্বাস ফেলে তাহুরা।উমাইরের অধিকারমূলক শাসনের কথায় কেমন আপন মনে হচ্ছে তাকে। লজ্জায়ও মেয়েটার আঁখি ভরে আসে।
তাহুরা যেতে কোলে থাকা জাফরানকে নিয়ে উঠে পড়ে উমাইর।সম্মুখে অগ্রসর হওয়া অবস্থায় উমাইর জাফরানের কান ধরে।হিংসুক সুরে বলে,

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৮

–“আমার তাহুর গায়ে আমি দাগ বসানোর আগে তুমি দাগ বসিয়েছো।দুষ্টু বাচ্চা।আমার আদরের কোলে আর উঠবে না।”
উমাইরের হিংসা জাফরান বুঝলো না কিছু।পোকা খাওয়া ফোকলা দাঁত দেখিয়ে হাসে কেবল।

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১০