লীলাবালি পর্ব ৭৯

লীলাবালি পর্ব ৭৯
আফনান লারা

‘নানু তুমি কি জানতেনা,আমি মৃদুল ভাইয়াকে বলে যাব না দেশে?এটা কি করলে!’
‘সরি,ভুল হয়ে গেলো’
নানু হাঁটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে।ঐ হাঁড়ি আর জোড়া লাগবেনা।

‘এদিকে যত যাই হয়ে যাক না কেন মা আমাকে ছাড়া দেশে যাবেনা আর ওদিকে মৃদুল ভাইয়া সমস্ত জোগাড় করে ফেলতেছে আমাকে রিসিভ করতে আসার।এত বড় ভুল কি করে হয়ে গেলো।আমি ভাবতেও পারিনি নানু এ সময়ে এই কথাটা বলে দেবে।এখন কি করে কি হবে!ধুর ভাল্লাগেনা’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অর্ণব চেয়েছিল আরও কিছুক্ষণ ধমকে ধামকে কুসুমকে ভয় দেখাবে,কিন্তু সেই সময়ে হঠাৎ শেয়ালের ডাকে তার ভাবনায় ছেদ হয়ে গেলো।আপাতত শেয়ালের ভয়ে কুসুমকে ধরে দৌড় মেরেছে।কোনদিকে দৌড় মেরেছে তা সে জানেনা,কুসুম তো জানেইনা। অন্ধকারে ঠিক কোন রুমে চলে এসেছে তারা বুঝলোনা।বিছানায় হাত রেখে দুজনে চুপচাপ বসেছে।তখন কুসুম ফিসফিস করে বললো,’এটা মনে হয় আমাদের না,চাদর দেখেন, খসখস করে।নরম না তো’

‘আমারও মনে হলো।কার রুমে এসেছি বুঝতেছিনা’
‘অর্ণব বাবা নাকি?’
কুসুমের বাবার কণ্ঠস্বর শুনে দুজনে আর দেরি না করে সামনের দিকে ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।কুসুম বিরক্তি নিয়ে হাত ছাড়িয়ে বললো,’আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা।দেখে শুনে বাবার ঘরটাই পেলেন ঢুকার জন্য?’
“আরে অন্ধকারে কিছু দেখতে পাইনা, কি করি বলোতো?’

দুজনে ঝগড়া করছিল সেসময়ে কারেন্ট এসে যাওয়ায় তাদের ঝগড়ার ইতি ঘটলো শেষে।
দুজনে এবার ভালমতন হেঁটে রুমে চলে এসেছে।কুসুম ভাবলো অর্ণব বুঝি ভুলে গেছে ওকে বুড়ো বলবার কথা।চোখ বুজে ওটাই ভাবছিল নিরবে।
পরে নিশ্চিন্ত মনে পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো অর্ণব চেয়ে আছে।ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ব্রু নাঁচিয়ে বললো,’কি বলছিলে তখন?’

‘ভুলে যাননি?’
‘প্রশংসা ভোলা যায়,খোঁচা ভোলা যায়না’
‘আর বলবোনা কখনও।একেবারে আক্কল হয়েছে আমার’
‘এই তো মেধাবী ছাত্রীর মতন কথা বললে।একেবারে বুঝদার।ঘুমাও এবার।আমাকেও ঘুমোতে দাও’

‘এই বিমানে আমার জুথি হবেনা সিওর’
‘তোমার মাথা একেবারে হেট হয়ে গেছে মৃদুল ভাইয়া’
‘কবে ভাল ছিল?’
‘আজ জথিপু আসবেনা দেখো’

‘ওটা আমিও জানি।খবর নিছি।সিঙ্গাপুরের যে একটা ফ্লাইট ছিল সেটা আসতেছে।আর আমি মাত্র জুথির সাথে কথা বললাম, সে তার ঐ সাদা চামড়ার অবফের সাথে আলাপ করছিল’
‘অবফ কি আবার?’
‘মানে বফ না,কিন্তু হইতে চায়’

‘ভাইয়া তুমি না একটা জিনিস!!যে পাবে সে জিতবে কিনা এটা বুঝতে তার বছর খানেক লেগে যাবে’
তমালের গলা জড়িয়ে মৃদুল এয়ারপোর্ট থেকে চলে আসতে আসতে বললো,’বুঝলি আমাকে পাইলে জুথি জিতবে এটা যদি সে জানতো তবে এত অবহেলা,অনাদর করতোনা রে।মেয়েটা একটা অবুঝ’
‘জুথি আপুকে অবুঝ বললে কুসুম ভাবীকে কি বলবে?’

‘ওটা তো দুধের শিশু।ওটা তো আওতাধীনই না।ম্যাচিউরদের সাথে ম্যাচিউরদের কথা খাটে।আমরা একে অপরকে অবুঝ বলবো,বয়স্ক বলবো।কিন্তু এর মাঝে শিশুদের কোনো জায়গা নাই।তাদের একটাই পরিচয় সেটা হলে তারা শিশু ‘
তমাল মুচকি হেসে বুক ফুলিয়ে বললো,’কুসুম ভাবীর যদি মেয়ে হয় ঐ মেয়েকে আমি বিয়ে করবো।আমি জানি তার মেয়ে তার মতনই সুন্দরী হবে’

‘অর্ণব তোর কাছে তার মেয়েকে বিয়ে দেবেনা।আর ওর মেয়ে যুবতী হইতে হইতে তোর দাঁত পড়ে যাবে সব এক এক করে।অর্ণব অন্তত দাঁত শূন্য জামাই ঘরে আনবেনা’

‘কিরে জুথি?কোনো বিষয়ে ডিপ্রেসডৃ নাকি তুই?এমন মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন সকাল থেকে।মোরকো বললো তুই নাকি আজ ওর সাথে দু মিনিটের বেশি কথা বলিসনি,কথার মাঝ দিয়ে নাকি দরজা বন্ধ করে চলে এসেছিলি?ওর সাথে ঝগড়া হলো নাকি?’
‘আর কি বলবো তোমায়।নানুর কারণে মৃদুল ভাইয়া জেনে গেছে আমরা দেশে ফিরতেছি।এখন প্রতি এক ঘন্টায় ভাইয়া ভিডিও কল দিচ্ছে’

‘ব্লক করতে বুকে বাঁধে?’
মায়ের কথা শুনে জুথির কথা হাওয়া।কথাটা মা কি প্রসঙ্গে বললেন শুরুতে বোঝা যায়নি।পরে যখন সে বুঝতে পারলো তখন চট করে সোফা থেকে উঠে রুমের দিকে ছুটে এলো।
‘আম্মু কি ভাবছেন আমাকে আর মৃদুল ভাইয়াকে নিয়ে??’

কুসুমের হাসি মুখ দেখলে অর্ণব ভুলে যায় ওর কঠিন রোগটার কথা।একেবারে ধুয়ে মুছে যায় ঐ কথা স্মৃতি থেকে। সকালে উঠার পর কুসুমের শরীর খারাপের কথা শুনে আবার মনে পড়ে গেলো ওকে জলদি বিদেশ নিতে বলেছে ডাক্তার।মুখটা কোনোরকমে ধুয়ে ছুটে গেছে সে বাবার কাছে।বলবে জমি পানির দামে হলেও বিক্রি করে দিতে।টাকার বড্ড প্রয়োজন

কিন্তু তার আগেই বাবা কুসুমের শরীর খারাপ শুনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন জমি বিক্রি করার,এবং সেটা আজই।জমির সব কাজ সাগর করবে।কারণ জমিটা সাগরের নামে।
সব বন্দবস্ত হয়েছে শুনে অর্ণব রুমে ফেরত চলে এসেছে।মুখে হাসি ফুটেছে কুসুম সুস্থ হয়ে যাবে ভেবে। কত কি স্বপ্ন বুনা হয়ে গেছে তার।

কুসুমের মা ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলেন।ওর চোখ দুটো বন্ধ।আস্তে আস্তে বলছে তার নাকি অসহ্যকর যন্ত্রনা হচ্ছে মাথার ভেতর।
অর্ণব ওর মাকে ইশারা করে নিজে তার জায়গায় বসেছে।কপালে অর্ণবের হাতের ছোঁয়া লাগতেই কুসুম বুঝে গেলো এটা ওর হাত।চোখ না খুলেই বললো,’কেন সুখের পরমূহুর্তেই কষ্ট চলে আসে জানেন?’

‘জানিনা।আমার জানা থাকলে আমি সুখী মানুষ হতাম’
‘আপনি তো সুখী।অসুখ যার সে জানে সুখ কি নেয়ামত’
অর্ণব তাচ্ছিল্য করে হেসে ফেললো।সুন্দর করে বিলি কেটে কেটে বললে,’নিজের স্ত্রী অসুস্থ হলে স্বামীর মন অসুস্থ হয়ে পড়ে।চাইলেই সে নিজেকে সুস্থ দাবি করতে পারেনা।কারণ টান চেনো টান??’

কুসুম আর কিছু বলেনি।ও সবসময় ছুঁতো খোঁজে একটি কথা বলার।আর তা হলো অর্ণব তাকে ভালবাসেনা,সে অনুভব করেনা যেটা সে অনুভব করে।
অর্ণবের মনে কি আছে তা কেবল সে জানে।যতদিন না প্রকাশ করবে ততদিন সেটা সবার কাছে অজানা থাকবে।আর কুসুমের কাছে মনে হবে কেবল রোগের কারণে দেখানো সহানুভূতি।

‘আর কত?’
‘কি আর কত?’
‘আর কতদিন আপনি আপনার কাজ,পড়াশুনা ফেলে রেখে আমার সেবা করে যাবেন?আগে তো করতেন না এমন।আগেও দিন চলতো’

‘আগে তোমার এই অসুখটা ছিলনা।এখন আছে।আমার কাছে সবার আগে তোমার সুস্থতা তারপর বাকি সব।
কাজ পরে করা যাবে,চাকরির পড়াশুনা পরে করা যাবে।কিন্তু তোমার দেখাশুনা পরে করলে….
‘পরে করলে?’

‘কিছুনা। বলো আমার হাতের কি খাবে?আমি দেখেছি,আমি তোমায় পোড়া,কাঁচা যাই বানিয়ে দেইনা কেন তুমি সেটা তৃপ্তি সহকারে খাও।সেখানে আম্মুর কিংবা তোমার মায়ের বানানো খাবারটা অতোটা তৃপ্তি নিয়ে খাওনা’
কুসুম হেসে বললো,’ডিম ভাজিটা করে আনেন তাহলে।রুটি খেতে ইচ্ছে করেনা।শুধু ডিম খাব’
কুসুমের মা কাঁদছিলেন আড়ালে থেকে।কেঁদে কেঁদে বলছিলেন,’আপা আমার মেয়ের সুখে কার নজর লেগেছিল বলবেন!ছোট থেকে তার যেন কপালটাই একটা কলংক।

এত এত বাধা বিপদ কেটে শেষে কিনা মরণব্যাধি হলো।এত ভাল স্বামী,এত ভাল সংসার পেয়ে কিনা তার জীবন হুমকিতে পড়ে আছে!’
‘আপনি চিন্তা করবেন না বোন।দেখবেন ও ভাল হয়ে যাবে।অর্ণবের ভালবাসায় ওর রোগ সেরে যাবে’
‘এই ভালবাসা যদি তিন বছর আগে দেখতে পারতাম আমরা,আহারে কার কপালে কি আছে তা বুঝি এত আগ থেকে ঠিক হয়ে থাকে!’

আজ ডিম ভাজাটা খুব সুন্দর হয়েছে।একটুকুও ডিমের খোসা পাওয়া যায়নি ভাজিতে।এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট মায়ের।কারণ ডিমটা মা ভেঙে দিয়েছিলেন।বাকিসব অবশ্য অর্ণবের করা।
কুসুম ডিমটা খেয়ে বললো,’যাক,তাহলে রান্না শিখে ফেললেন ‘
‘এই আর এমন কি।আর কি খাবে বলো?আমি সব বানিয়ে খাওয়াবো।হাওয়াই মিঠাই খাবে?’

লীলাবালি পর্ব ৭৮

আজ আর কুসুম অর্ণবের রুমের ধারের কাছে কেউ যায়নি।যেন এই দিনের অপেক্ষায় ছিল সকলে।তাদের আলাদা সময় সবাই দিতে চান বলেই ওদের সাথে দরকার হবার পরেও কেউ কথা বলতে আসেননি।তারা চান ওদের ভালবাসাময় দিনটায় যেন কোনো প্রকার ত্রুটি না যুক্ত হোক।
পারলে দিনটাকে তারা আরও সুন্দর করে দিতেন।

লীলাবালি পর্ব ৮০