লীলাবালি পর্ব ৭৮

লীলাবালি পর্ব ৭৮
আফনান লারা

আকাশে চাঁদ না থাকলে আকাশটা অসুন্দর লাগে? একদমইনা।চাঁদ ছাড়া আকাশের আবার রুপ অন্যরকম।
তারা আছেনা??তারা’রা একাই একশো।
পা ঝোলানো বারান্দায় বসে সেই তারার মেলার আকাশটা দেখা হচ্ছে কুসুমের।অর্ণব ও চেয়ার টেনে ওরই পাশে বসা ছিল।

চাঁদবিহীন আকাশটা ওর কাছে অপরুপ লাগলেও অর্ণবের কাছে একেবারে অসুন্দর মনে হয়।তবে কুসুমের এই আকাশের প্রতি অগাধ মুগ্ধতা তাকে এই আকাশকে সুন্দর বলতে বাধ্য করেছে।
তার পরেও সে ঐ আকাশটাকে দেখা প্রয়োজন বোধ করলোনা।সে দেখছিল কুসুমকে।
ওর পা দোলানোটাও দেখছে সাথে।বেশ কিছুক্ষণ দেখা শেষে বললো,’জানো কুসুম?আমি জুথিকে ভালোবেসে ছিলাম কিনা আদৌ জানিনা।তুমি বলতে পারবে ওকে ভালবেসেছিলাম কিনা?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কুসুম পা দোলাতে দোলাতে বাড়ির সামনের সেই ফাঁকা পাকা পথটা দেখছিল।অর্ণবের প্রশ্নের জবাবে বললো,’না বাসেননি’
অর্ণব গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো সে কি করে জানে।
‘যদি বাসতেন তবে বিয়েটা আটকাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতেন।সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে হলেও আপনি মিননয়ি আপুকে নিজের করে নিতেন।’

‘ধরো পারিনি,নিয়তি জোর করলো,তবে?’
‘তবে বিয়ের পরেরদিনই সব যোগাযোগ বন্ধ করে ফেলা আপনার জন্য এত সহজ হতোনা।আজকালকার বুড়োরা ভালবাসা কি সেটাই জানেনা।নামেই এত বয়স হলো’
কথাটা বলতে বলতে কুসুম উঠে চলেও গেছে।কিন্তু অর্ণবের গায়ে লাগলো কথাটা একেবারে তীক্ষ্ণ কাঁটার মতন।
এত বড় খোঁচা!

‘আমি বুড়ো?আমি ভালবাসা চিনিনা?
না না,ঠিকই তো বলেছে।আসলে খোঁচা দিয়ে যেটা বলা হয় সেটা সত্য কথা হয়, নাহলে গা জ্বলতোনা।
আমি সত্যি জানিনা ভালবাসা কি।জুথিও জানেনা!ও ভাবছে আমি ওরে ভালবাসি,ও আমাকে ভালবাসে।একচুয়ালি আমরা একজন আরেকজনকে ভালোই বাসিনি।দুদিনের মোহে দুজন দুজনকে প্রাক্তন উপাধি দিয়ে দিয়েছি।ধুর সত্যি আমি বুড়ো হয়ে গেছি’

কুসুম বিছানায় বসে মিটমিট করে হাসছিল পাশ থেকে ওর কথাগুলো শুনে।অর্ণব চেয়ার থেকে উঠে রুমে ফিরে আসতেই কুসুমকে মুখে হাত দিয়ে হাসি আটকাতে দেখে ফেলেছে।বুড়ো বলে সে যে কত মজা নিচ্ছে তার হুটহাট প্রমাণ।
অর্ণব কোমড়ে হাত রেখে কপাল কুঁচকালো।চেষ্টা করলো একটু রাগী লুক আনার।কিন্তু পারেনি।
তারপর বুক ফুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,’বয়স কত তোমার?নাক টিপলে দুধ বের হবে উনি আমায় বুড়ো বলেন,হুহ!’
‘ছোটরাই তো বড়দের বুড়ো বলে।এটাই তো নিয়ম’

‘রাখো তোমার নিয়ম।আমার শরীর দেখেছো?দেখে মনে হয় একটা বাচ্চার ভাই’
‘কিহ?বাচ্চার বাপ শুনেছি।বাচ্চার ভাই এ প্রথম শুনলাম’
‘শুনবে কি করে?চোখের সামনে তো সব বুড়ো দেখে বড় হয়েছো।আমি শুনেছি কলির থেকে।তুমি ভারতে যেখানে থাকতে ওখানে বৃদ্ধাশ্রমের পাশেই তোমাদের বাসা ছিল।বুড়ো দেখে দেখে বড় হয়েছো।’

‘কি কপাল ভাবেন।বিয়েও করেছি বুড়োকে।আজীবন আমায় বুড়ো দেখে যেতে হবে ‘
অর্ণব এগিয়ে এসে ওর গাল টিপে ধরে বললো,’আমি কি?’
‘জোয়ান এবং জোয়ান,হিরো’
‘হুমম।আমার বয়স কত হবে?’
‘আমার সমান’
‘আমি দেখতে কেমন?’
‘সুন্দর,নায়কের মতন’

‘ছেড়ে দিলাম গাল।আর কোনোদিন বুড়ো বললে আবার ধরবো।’
চোরকে যেন বলা হয়েছে চুরি না করতে।কুসুম আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে গেলো।অর্ণব শুরুতে বোঝেনি।এরপর কুসুম নেমে দৌড় দেওয়ার আগে বলে গেলো,’বুড়ো!’
অর্ণব তখন এক পা বিছানায় উঠিয়ে ছিল শোয়ার জন্য।কুসুমের মুখে আরও একবার বুড়ো শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখলো সে উধাও।

এত দুষ্টামি ওর আসে কই থেকে।
ছুটে রুম থেকে বের হয়েছে সে ওকে ধরবে বলে।ঘুমাতে যাবার আগে সমস্ত লাইট নিভিয়ে এসেছিল তখন।এখন এই অন্ধকারে তো ওকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।যে দুষ্টুর দুষ্টু!লাইট না জ্বালালে জীবনেও খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
লাইটে টিপ দেওয়ার আগে সে খেয়াল করলো রুমের আলো নিভে গেছে।তার মানে কারেন্ট ও চলে গেছে।তারপরেও সিওর হতে কয়েকবার সুইচ টিপ দিলো।

নাহ!সত্যি সত্যি কারেন্ট গেছে।
কোনে উপায়ান্তর না পেয়ে অন্ধকারে পা ফেলে চললো সে।কেউ যাতে জেগে না যায় তাই ফিসফিস করে বলছে,’কুসুম!!এ্যাই কুসুম!!শুনতে পাও?তুমি কই?দেখো অনেক রাত হয়েছে।এখন মজা করার সময় না।ঘুমাতে যেতে হবে।’

কুসুমের কোনো সাড়া নেই।অর্ণব ভেবেছে ও বুঝি বারান্দাতে লুকিয়ে।
তাই সবার আগে ওখানেই পা রাখলো।কিন্তু তার ধারণা ভুল হলো।কুসুম সেখানে নেই।
কোমড়ে হাত দিয়ে ভাবছিল এবার কোথায় গিয়ে খুঁজবে ওকে ঠিক সেসময়ে কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজে শুনতে পেলো,’বুড়ো,বুড়ো বুড়ো’

কুসুম কথাটা বলে পালাতেই চাইছিল কিন্তু অর্ণব আন্দাজ করে ওর হাতের কব্জি ধরে ফেলেছে।
কুসুম অন্ধকারের মাঝে হাতটাকে ছাড়ার অনেক অনেক চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ।অর্ণবের শক্তির কাছে তার শক্তি একটা পিঁপড়া সমান।অর্ণব বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বললো,’ধরে ফেললাম।এইবার বলো কি বলছিলে?’

‘কিছুনা’
‘বলো বলো।দেখি তোমার কত সাহস’
‘আপমি নায়কের মতন দেখতে।অনেক সুন্দর।’
‘তুমি যে স্বভাবের।এখন আমি হাত ছেড়ে দিলে যেতে যেতে আবারও বুড়ো বলবে আমায়।’
‘না সত্যি।আর কোনোদিন আপনাকে বুড়ো বলবোনা’

‘মা জুথির জামাকাপড় গুলো সব গুছিয়ে নেও তো।ঐ ঢংগী তো নিজের জামাকাপড় নেবেই না।বলতে গেলে টেনে হিঁচড়ে নেওয়াচ্ছি।কাল তো আমরা সময় পাবোনা।সারাদিন পাসপোর্ট অফিসে কেটে যাবে’
জুথির নানু ওর জামাকাপড় সব ব্যাগে পুরছেন তার রুমে এসে।আর সে মাথা ঝুলিয়ে শুয়ে ছিল বিছানায়।নানুর কাজ দেখে বলো,’মাকে অন্তত বোঝাও,আমি যাব না।আমার ভাল লাগছেনা’

‘তুই মা হলে বুঝতি, মেয়েকে একা বাড়িতে রেখে যাওয়ার কথা ভাবাও যায়না।এখন যদি তোর ভাই -বোন থাকতো এখানে,তবে রাখা যেতো।কিন্তু একা একটা মেয়েকে এত বড় বাড়িতে রেখে যাওয়াকে আমি নিজেই সম্মতি দেব না,এবার বল দেখি আমার বাংলা বলা কেমন হলো?গুগল দেখে প্র্যাক্টিস করেছি দু সপ্তাহ ধরে।’

তাঁর কথার জবাব না দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে জুথি ফোন হাতে নিয়েছে।মৃদুলের অনেকগুলো মিসড কল এসে ভীড় জমিয়েছে।
ছেলেটা দিন দিন বেশি করে পাগলামো করছে।রাগ করে ফোনটা রেখে দিয়ে শুয়ে থাকলো সে।দু মিনিটের নাগাদ মনে হলো একবার কলব্যাক করা উচিত।তাই ভেবে এখন কলটা দিয়েছে সে নিজেই।
ওমা রিং হতে না হতেই রিসিভ করে ফেললো মৃদুল।যেন ফোন হাতে নিয়ে তাকিয়ে ছিল,কখন জুথি কল দেবে।
‘হ্যালো!!কি খবর?’

‘প্রতি এক ঘন্টায় কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কি খবর,তখন খবর আর খবর থাকেনা।’
‘এক ঘন্টাতেও খবর বদলায়।যেমন ধরো আমি এক ঘন্টা আগে তোমার সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন বিছানায় ছিলাম,আর এখন ও বিছানায়।খবরটা হলো কিছুইনা।

দেখো, এই কিছুইনা ও কিন্তু একটা খবর।
কি ডট ডট ছ ডট ডট ু-কার ডট ডট ন আ-কার’
বুঝলে?খবরের সংজ্ঞাটাই কত বড়।তার মানে খবর আর খবর।আর তুমি বলো খবর নেই?আসলে তুমি কথা বলতে চাও না সেটা বলো’

‘অসহ্য!’
‘ঘুমাবেনা?’
‘আপনি ঘুমাতে দিলে তো ঘুমাবো’
‘কেন?ও তুমি তো আবার লেট করে ঘুমাও।চলো আমরা গল্প করি।

‘আচ্ছা, আপনি নাহয় পাগল।তাই বলে আমার সুস্থ মস্তিষ্ক টাকে আপনার মতন পাগলাটে বানাতে এমন উঠে পড়ে লেগেছেন কেন বলুন তো?অনামিকা আপুর উপরের রাগ আমার উপর ঝাড়তে চাইছেন?’
‘মোটেও না।ওর উপর তো আমার রাগ নেই।থাকলেও সেটা কয়েক মাসে শেষ হয়ে গেছে।এখন আমি স্মৃতি ভুলে যাওয়া ব্যাক্তি।কেউ অনামিকার নাম না নিলে তাকে মনে পড়েনা।
মানে এখন আমি হইলাম শিশুর মনের মতন।নতুন করে আবার শুরু।’

‘এ্যাই জুথি তোর কোন জামাটা দেশে নিবি?এখানে দেখি সব ওয়েস্টার্ন, দেশে গিয়ে এসব পরবি নাকি?’
নানুর কথা শুনে জুথি ফোন চেপে ধরেছে।মৃদুল বললো,’তোমার নানু কি বলে?দেশে আসতেছো নাকি? হিহি’
‘হেহে!!নানু মজা করতেছে’

লীলাবালি পর্ব ৭৭

‘তাই না?মধ্য রাতে নানু মজা করতেছে??আমাকে বোকা পাইছো?কাল থেকে আগামী দশ দিন আমি এয়ারপোর্টে মৌমাছির মতন ঘুরঘুর করবো,সিঙ্গাপুরের যত ফ্লাইট আছে সব নোট করে।
আমাকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ না মিস মৃন্ময়ী।’

লীলাবালি পর্ব ৭৯