লীলাবালি পর্ব ৭৭

লীলাবালি পর্ব ৭৭
আফনান লারা

রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল কুসুম।অর্ণবের আসার কথা ছিল বিকেলে।বিকেলে একবার ফোন করারও কথা হয়েছিল।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে,সূর্য ডুবে অন্ধকারে ছেয়েছে সবটাতে।ঝিঁ ঝিঁ পোকা জানান দিয়ে গেলো সন্ধ্যা নেমে গেলো বলে।

সেই আবছা আলোর সন্ধ্যাটা শেষ হয়ে ছিল রাতের আগমনে।সেই আগমনের এখন রেশও চলে গেছে,অথচ কুসুমের অপেক্ষার প্রহর কেবল দীর্ঘতর হয়ে উঠছে।এত প্রহর গুনতে গুনতে একটা সময়ে সে ঘুমে কাতর হয়ে গেছে।ঠিক সেসময়ে অর্ণব এসেছে।
মায়ের কাছে জানতে পারলো কুসুম না খেয়ে ঘুমিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ দেরি হবার অন্য একটা কারণ আছে বৈকি।আর সে কারণ মুখে বলার সাহস অর্ণব পাচ্ছিলো না।কাজ থেকে ফেরার পথে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের সাথে আলাপ করেছিল কুসুমের টিউমার নিয়ে।ডাক্তার বলেছেন যত দ্রুত সম্ভব বাহিরের দেশে চিকিৎসাটা করিয়ে নিতে নাহলে হাতে আর কটা দিন, বা মাস আছে।সঠিক করে কিছুই বলা যাচ্ছেনা।এই সময়ে এসেও অর্ণবের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এসব কিছু সত্য।কুসুমের কিছু হয়নি এখনও সেটাই মাথায় ধরে বসে আছে সে।

বাবা মাকে বলতে পারছেনা ডাক্তারের কথাটা। এটা শুনলে সবাই ভেঙ্গে পড়বে ভেবে।
কটা দিন বলতে কি বুঝালো ডাক্তার?এতগুলো টাকা কই পাবো?
টাকার চিন্তায় বিভোর হয়ে বাবার রুমের দরজার কাছে এসে থেমেছে সে,দশ মিনিট হলো সে এখানে,তাও বুকে সাহস জুগিয়ে নিতে পারছিলনা।

শেষে বাবা ওকে দেখতে পেয়ে ভেতরে আসতে বললেন।ভেতরে গিয়ে চুপচাপ বাবার সামনে বসে আছে সে।তাও টাকার প্রসঙ্গে কিছু বলতে পারছেনা।
বাবা ওর মুখ দেখে আন্দাজ করতে পারলেন হয়ত টাকার বিষয়ে কথা বলতে ওর এখানে আসা তাই তিনি নিজেই কথা বলা শুরু করেছেন।

‘শুন অর্ণব,জমি দুই জায়গার দুইটা বিক্রি করবো বলে ভাবছি।এখন সমস্যা হলো দাম একেবারে কম দেবে বলে ঠিক করে সবাই।
তুই কি বলিস?ডাক্তার কি বলেছে?আর কটাদিন অপেক্ষা করলে সমস্যা হবে?আসলে যারে ধরেছি সে একেবারে পানির দামে কিনতে চায়।লসের উপর লস।

যদি ক্ষতি না থাকে তবে আমি আরও কটাদিন পর জমি বিক্রি করবো।তোর কি মত?’
অর্ণব কিছু বলতে পারছেনা।বুক ফেটে কান্না আসছে তার।কোনোরকমে কান্না দমিয়ে উঠে চলে আসলো।রুমের আলো নেভানো।সে ইচ্ছে করে জ্বালায়নি।অন্ধকারে ওরই পাশে বসেছিল।কুসুমের হাতে এক জোড়া বালা আছে।স্বর্নের নয়,সিটি গোল্ডের।এগুলো ওর মা কিনে দিয়েছিল।এপাশ থেকে ওপাশ করতেই ওগুলোর আওয়াজ শোনা গেছে।অর্ণবের চিন্তা গুলো সরে তার মন গেলো কুসুমের দিকে।কথাটা বাবাকে জানাতেই হবে ভেবে বিছানা থেকে উঠতে চাইলো সে।কিন্তু কুসুমকে ছেড়ে এই মূহুর্তে এক কদম ও নড়তে ইচ্ছে করে না।

‘দেখ জুথি!এবার মা ও আমার সাথে দেশে যাবে।তোকে আমি একা বাড়িতে রেখে যেতে পারবোনা। আমার সাথে তোকে যেতেই হবে।দরকার পড়লে তুই যে দেশে ফিরছিস এ কথা কাউকে জানাবিনা।তাহলেই তো হয়’
‘আমাকে বুঝি বাহিরে মৃদুল ভাইয়া দেখবেনা?’
‘কি করে দেখবে?তুই তো বলেছিলি মৃদুল নাকি তার বাবার বাড়িতে এখন।আর মেসে থাকবেনা।তাহলে সে তোকে কি ভাবে দেখবে?’
‘আচ্ছা ডিসিশান পরে জানাবো।আপাতত আমি এইসবে নাই’

‘বাবা কিছু খাবিনা?’
‘হুম?কি বললে মা?’
মা রুমে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেখলেন অর্ণব কুসুমের মাথার কাছে বসে আছে।মা আরেকটু কাছে এসে আবারও বললেন কিছু খাবে কিনা।
‘খিধে নেই’

‘কুসুম না খেলে তোর খিধে নেই?এত ভালবেসে ফেলেছিস?’
‘বেসে আর লাভ হলো কৈ?সব হারানোর পথে নেমেছি’
‘মানে?’

‘কিছুনা।আমি সন্ধ্যায় পুরি খেয়েছি।খিধে নেই।বুকে জ্বালা করছে,কঠিন জ্বালা।এই জ্বালাতে গলা দিয়ে ভাত নামবে না।তুমি গিয়ে ঘুমাও বরং’
মা আর জোর করলেননা।চলে গেছেন।অর্ণব আগের কাজে মন দিলো।অন্ধকারে কুসুমের চুলে বেনী করছিল।
এখন আলোতে করছে।বেনী শেষ করে হাতে নিয়ে দেখছিল। হঠাৎ চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে।কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে।

বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।এই ফুলের মতন মেয়েটা সত্যি বিলীন হয়ে যাবে?তবে সে ফুল কেন হলো!কেন সে ফুলের মতন হলো?ফুলের মতন নেতিয়ে যাওয়াই যদি তার শেষ অবস্থা হয় তবে সে ফুল কেন হতে গেলো।কেন!!
কেন আর কটা বছর সে সুখে থাকার অধিকার হারালো!’

চুলে একবার টান লাগায় কুসুম জেগে গেছে।অর্ণব জানেনা ওর যে ঘুম ভেঙে গেছিল।সে বেনীতে রাভার বাঁধছে।
কুসুম হঠাৎ উঠে বসায় কিছুটা অবাক হলো সে।চেয়েই রইলো চমকে গিয়ে।
‘আপনি কখন এলেন?’

‘আধ ঘন্টা হলো’
‘এত দেরি হলো যে?’
‘অনেক কককককাজ…’
অর্ণবের গলায় কথা আটকে গেলো।বাকিটা বলতে পারলোনা।গলা ব্যাথা করছে।কুসুম ওর চোখ মুখ দেখে বললো,’ডাক্তার কিছু বলেছে আমায় নিয়ে?’

‘আমি তো ডাক্তারের কাছেই যাইনি’
‘তবে কাঁদছিলেন কেন?’
‘কই??কাঁদিনি তো’

‘আপনার চোখ ফুলে আছে।আমার কাছে লুকিয়ে কি হবে?ডাক্তার কি বলেছে?আর বাঁচবোনা তাই তো?’
অর্ণব হ্যাঁ/না কোনো উত্তরই দেওয়ার সাহস পাচ্ছেনা।কুসুম অবশ্য ওর উত্তরের আশাতে চেয়েও থাকেনি।বিছানা থেকে নেমে গেছে।যাবার পথে বলে গেছে খেতে আসতে, ও নাকি খাবে।অর্ণবের আসার অপেক্ষায় তারও খাওয়া হয়নি।
অর্ণবের হাত পা চলছেনা।একের পর এক ঝটকা সামলানোর ক্ষমতা হারিয়ে বসে আছে।

সব সাজিয়ে কুসুম যখন আবারও এসেছিল ওকে ডাকতে,এসে দেখলো মাথায় হাত রেখে সে তো ঘুমায়,নাকি জেগে বোঝা দায়।
ওর একদম কাছে এসে কুসুম আরও একবার ডাক দিলো ওকে।অর্ণব জবাবে বললো আর কটা মিনিট পর আসবে।
কুসুম মাথা নাড়িয়ে চলেই যাচ্ছিল।

এই প্রথমবার তার সুতির শাড়ীর আঁচলে সে টান খেয়েছে।এই টান খাটের সঙ্গে বিধে নাই।
এই টান লাগার কারণ অর্ণব ধরেছে আঁচলটাকে।কুসুম প্রথমে ধরে নিলো আঁচলটা বুঝি খাটে কোনো কোণার সাথে লেগেছে।তাই ভেবে পেছনে না তাকিয়েই স্বাভাবিক ভাবে কটা টান দিয়ে সে চলে আসতে চাইলো।কিন্তু যখন টানের পরেও ছুটলোনা তখন সে পেছনে ফিরলো।

অর্ণবের মুষ্টিবদ্ধে তার আঁচলের কিঞ্চিত অংশ দেখে কুসুম প্রথমে হতবাক হয়ে গেছে।
অর্ণব ওকে ওমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,’আমার মাথাটা একটু টিপে দেবে?তোমার মাথার যন্ত্রনা কম করতে গিয়ে আজ আমার মাথাই ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রনায়’

এক সেকেন্ড ও দেরি না করে কুসুম এগিয়ে এসে ওর কপালে হাত রেখেছে।এ প্রথমবার সে অর্ণবের গায়ে স্ব-ইচ্ছায় হাত রাখলো।হাত প্রথম প্রথম কাঁপছিল অনেক।কিন্তু অর্ণব যখন মজবুত করে আঁচলটা ধরেছিল তা দেখে ওর ভয় কেটে গেছে।মনে হয় ইনি অনেক আপন,অনেকদিনের আপন।এনার সামনে লজ্জা,ভয় খাটেনা।

কুসুমের নরম হাতের ছোঁয়ায় অর্ণব এতটাই মায়া পেয়েছে যে সে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়ে দিয়েছে।বেশ কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলাবার পর ওর ঘুমের কথা বুঝতে পেরে কুসুম আলো নিভিয়ে চলে গেলো খাবার যেখানে রাখা সেখানে।পেটে ভীষণ খিধে,আর এদিকে একটা ধর্ম।

সে না খেলে যেমন অর্ণব না খেয়ে থাকে সেরকম অর্ণব না খেলে তার ও না খাওয়া ধর্ম।
খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকলে যে লোভ জন্মে,অর্ণবের প্রতি প্রেম সেই লোভটাকে মুছে দেয় বারবার।যতবার লোভ আসবে ততবার মুছে দেবে।
প্রেমের কি শক্তি!!!

প্রেম আর লোভের গণনা করতে করতে কুসুম একটা চিরকুটে তার নাম লিখে ফেলেছে।নিজের নাম লিখে ছুটে রুম থেকে অর্ণবের একটা খাতা নিয়ে আসলো।এটাতে অর্ণব একবার সবার নাম লিখে ওকে দেখিয়েছিল।অর্ণবের লেখা কুসুম আর ওর লেখা কুসুম মিলিয়ে দেখলো তার হাতের লেখা বড়ই বিচ্ছিরি।তবে কিছুটা মিলেছে বলে অনেক বেশি খুশি হলো সে।

‘কুসু…..’
কুসুম মাথা ঘুরিয়ে চেয়ে দেখলো ঘাঁড়ে হাত রেখে হাই তুলতে তুলতে অর্ণব আসছে এদিকে।ওর মুখে কুসু শুনে বুকে ধুক করে উঠেছিল।কুসু শুধু মা আর বাবা আদর করে ডাকতেন প্রায় সময়।কিন্তু আজ অর্ণবের মুখে কুসু শুনে সে তো অবাক।আজ সব কিছুতে অবাক হওয়া হচ্ছে।এতদিনকার অর্ণব আর আজকের অর্ণবের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ।
অর্ণব চেয়ারে বসে বললো,’তোমার সেবায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।এমন জানলে রোজ কপাল টেপাতাম তোমাকে দিয়ে।নাও শুরু করো খাওয়া।রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেছে’

লীলাবালি পর্ব ৭৬

‘আচ্ছা,ডাক্তার কি বললো বলবেন না আমায়?’
‘ডাক্তার বললো তোমায় বেশি আদর,যত্ন করলে বহুদিন বাঁচবা’

লীলাবালি পর্ব ৭৮