লুকানো অনুরক্তি পর্ব ১১

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ১১
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

অবনি নিজের মুখে নিজেকে আধ পা*গল বলায় দম ফাটা হাসিতে লুটিয়ে পড়ল নাদিয়া। হাসির জন্য কথাই বলতে পারছে না। পেট চেপে আছে।
রাগ হলো অবনির। দুই ভাই বোন পেয়েছেটা কি তাকে? দাঁত কিড়মিড় করতে করতে নাদিয়ার মোবাইল থেকেই মাহফুজ কে কল করে। রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করে মাহফুজ।

‘হ্যা নাদু বল।’
এপাশ থেকে উত্তর করল না অবনি। রাগে শুধু গজগজ করছে। মাহফুজও বুঝে গেল কলটা আসলে কে করেছে। মোবাইল কানে ঠেকিয়ে নৈঃশব্দ্যে হাসতে লাগল সে।
‘আমি আধ পা*গল? আমাকে তোমার পা*গল মনে হয়?’
হাসি থামায় মাহফুজ। অবাক হওয়ার ভান করে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ওমা আমি তোকে পাগল কখন বললাম?’
‘তুমি নাদুকে মেসেজে বলোনি?’
মাহফুজ অবাক কন্ঠে বলে,
‘সেখানে কোথায় তোর নাম নিয়েছি কি? আমি তো শুধু বলেছি আধ পা*গল কে দেখে রাখতে। তোর জ্বলছে কেন?’
পুনরায় কন্ঠে রসিকতা মিশিয়ে বলে,

‘দেখলি দেখলি পড়ল কথা হাঁটের মাঝে। যার কথা তার গায়ে বাজে। তুই কি আসলে,,,,’
ঠাস করে কল কে’টে দিল অবনি৷ এই ছেলের সাথে কথায় পেরে উঠবে না সে। বরং তাকে আরো কথার জালে ফাঁসাবে। প্রচন্ড ক্ষোভে মোবাইল দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে ফেলতে নিলেই খপ করে ধরে ফেলে নাদিয়া।
‘মোবাইল কি তোর বর কিনে দিয়েছে? অবশ্য তোর হবু শ্বশুরমশাইয়ের দেওয়া।’
রাগে দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাদিয়ার দিকে। তারপর হনহনিয়ে চলে গেল।

আজান পড়েছে অনেক্ক্ষণ। আঁচলের ত্রিকোণ দিয়ে কপালের ঘাম মুছেন আফসানা খানম। বাজখাঁই গলায় বললেন,
‘অবনি? নাদিয়া? গোসলে গেলি দুজন? আজান পড়েছে কিন্তু।’
ডাকের সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নাদিয়া।
‘অবনি তোমার সাথে না?’
‘অবনি আমার সাথে হতে যাবে কেন? আমি তো ছিলাম রান্নাঘরে।’
আফসানা খানম কথাটা শেষ করার সাথে সাথে নাদিয়া সদর দরজার দিকে তাকায়। দরজা চাপানো হলেও লক খোলা।
‘অ*সভ্য টা হয়তো ছাঁদে।’

আফসানা খানম চিন্তিত গলায় বলেন,
‘এই রোদের মধ্যে ছাঁদে?’
‘তোমার ভাইঝি তো এলিয়েন।’
বলে সেও গেল ছাঁদের দিকে।
আফসানা খানম এলেন নিজের কক্ষে। কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছেন শহিদুল হক।
‘গোসলে না গিয়ে এই অসময়ে শুয়ে আছো? আজ শুক্রবার নামাজে যাবে না? নাকি শরীর খারাপ তোমার?’
কপাল থেকে হাত সরান তিনি।

‘একটু বসবে আমার পাশে?’ বলে তিনিও আধশোয়া হয়ে বসলেন।
‘তোমার কি শরীর ভালো নেই?’ প্রশ্নটা করে শহিদুল হকের কপালে হাত ছুঁয়ালেন তিনি।
‘কিছু হয়নি আমার।’ মুখের কথাটুকু শেষ করে আফসানা খানম এর একটা হাত নিজের বুকের উপর রাখলেন।
আফসানা খানম হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললেন,

‘করছো টা কি? মেয়ে দু’টো বাসায় আছে তো।’
হাত ছাড়লেন না তিনি। আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন বুকের সাথে।
‘কতগুলো দিন একসাথে পার দিলাম আফসানা। সবটা কেবল কল্পনা মনে হয়।’
শহিদুল হকের মুখের দিকে তাকালেন তিনি। আসলেই তো। কতগুলো দিন। বছর হিসেব করে তো বত্রিশ। বত্রিশ বছরের সংসার জীবন। দিন হিসাব করলে হাজারের ঘর ছাড়িয়ে লাখের যাবে নিশ্চয়ই?

‘আমার এখনো মনে হয় এইতো সেদিন বিয়ে করে তোমায় আমাদের সেই মাটির ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। এর মাঝে এতগুলো দিন চলে গেল? বত্রিশ বছরের সংসার জীবনে তুমি আমি কাছে থেকেছি হাতে গুনা কয়েকবছর। একা হাতে সংসার সামলেছ। ছেলেমেয়ে দু’টোকে মানুষ করেছো। আমার শয্যাশায়ী আব্বা আম্মার সেবার করেছে। আমায় নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই তোমার?’
এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শহিদুল হকের কথা শুনলেন তিনি। প্রশস্ত হেসে জবাব দিলেন।
‘না নেই।’

‘কেন নেই আফসানা? তুমি কি আমার উপর রাগ? অভিমান করে আছো? শুনেছি অভিমান জমতে জমতে নাকি মানুষ অভিযোগ করতে ভুলে যায়। তোমার ক্ষেত্রেও কি এমন?’
শহিদুল হকের কর্মঠ হাত দুটো আঁজলিতে নিলেন আফসানা খানম।

‘কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবো? যে মানুষটা আমাদের সুখে কথা চিন্তা করে সব ছেড়ে ছুড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছিল তার বিরুদ্ধে? আমরা ভালো থাকবো বলে যে মানুষটা দিন নেই রাত নেই শুধু পরিশ্রম করেছে তার বিরুদ্ধে? দিনশেষে আমি তো তাও পরিবারের সাথে ছিলাম। ছেলে মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে ঘুমোতে পেরেছি। সে কি পেরেছে? সে তো সারাদিন হাড়ভাংগা পরিশ্রমের আবার নিজে রান্না করে খেয়েছে। কখনো কখনো না খেয়ে দিন পাড় করেছে। সেই মানুষটার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে স্বয়ং আল্লাহও নারাজ হবে। একটা অভিযোগ আছে। আমি মানুষটাকে কাছে পায়নি। এখনো পাই না। সে এখনো টাকার পিছনে ছুটছে। কিন্তু আমার এখন মানুষটাকে চাই। মানুষটার সঙ্গ চাই।’

‘আর কোনো অভিযোগ নেই।’
না বোধক মাথা নাড়েন তিনি। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলেন শহিদুল হক।
‘আমি আর কোথাও যাচ্ছি না আফসানা। আমি একবারে চলে এসেছি।’
চমকালেন আফসানা খানম। বিস্মিত গলায় বললেন,

‘তুমি যে বললে তিনমাসের ছুটিতে এসেছো?’
‘বলেছি। দেখলাম কি করো। তখন তাগড়া ছিলাম। সারাদিন কাজ করে টের পেতাম না কিছু। খারাপ লাগাকে দমিয়ে রাখতে পারতাম। কিন্তু এখন পারি না। তোমাদের কথা ভীষণ মনে পড়ে। পরিবারের সাথে সময় কাটাতে মন চায়। তাই চলে এসেছি।’
‘ভালো করেছো। এখন উঠে গোসলে যাও। জামাআতের সময় চলে যাবে। আমি গোসলে গেলে তো আবার চিল্লাচিল্লি করবা।’

খুপরির মতো ছোট্ট সিঁড়ির ঘরে বসে আছে অবনি। অব্যবহার্য অনেককিছু এখানে জড়ো করে রাখা।
আচমকা কারো হাতের স্পর্শে কেঁপে ওঠে অবনি। পরক্ষণে নাদিয়াকে দেখে বুকে থুথু দেয় সে।
‘এখানে বসে আছিস যে?আজান পড়েছে। চল গোসল করবি।’
উত্তর করল না সে। চুপচাপ, নীরব দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে রাখল।
‘ভাইয়া তোকে আধ পা*গল বলেছে বলে কি তোর খারাপ? আরে বোকা ভাইয় তো মজা করেছে। তোকে রাগানোর জন্যই বলেছে।’ অবনির মাথায় হাত রেখে বলে নাদিয়া।

‘আমার থেকেও তো কত হাজার গুণ সুন্দরী আশেপাশে আছে। ইভেন আমাদের ভার্সিটিতেও কত ভালো ভালো মেয়ে আছে। তারপরও তোরা কেন আমার পিছু পড়লি?’ অবনির অসহায় কন্ঠস্বর।
অশান্ত অবনির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নাদিয়া।
‘আমার ভাইয়ের মন তো এখানে। আমি আশেপাশে দেখে কি করবো?’
‘তোরা দুই ভাইবোন কেন বুঝতে পারছিস না? এমনটা সম্ভব নয়।’

‘কেন সম্ভব না অবনি? আমার ভাই নেশা করে? নাকি তার মেয়েলি কোনো সমস্যা আছে? বুকে হাত রেখে বলতে পারবি ভাইয়ার জন্য তুই কিছু অনুভব করিস না? তোর চোখও যে ভালোবাসার জানান দেয়। তোর চোখের ভাষা বড্ড সহজ। সহজে পড়ে ফেলা যায়।’
সহসা নাদিয়া কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অবনি। হু হু করে অন্তঃস্থল কেঁদে উঠছে। স্মৃতির মানসপটে ভেসে উঠে দেড় বছর পূর্বে ঢাকায় আসার আগেরদিনের ঘটনা।

অবনির মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন ফাতেমা আমিন। খুব যত্নসহকারে।
‘রশীদের বউ? ও রশীদের বউ? বাড়ি আছোনি?’
হাঁক ছেড়ে ডাকতে ডাকতে উঠোনে হাজির হলেন পাশের বাড়ির মজিদ মিয়ার মা।
ফাতেমা আমিন ঘোমটা টানলেন।
‘জ্বি চাচি আছি।’

‘মুরগা যে আনছো ওইডার টেহার লাইগা আইছি।’ বলে বৃদ্ধা ঘরের দরজায় বসলেন।
‘যা তো মা। ব্যাগের সাইড পকেটে দেখবি চারশো টাকা আলাদা করে রেখেছি। ওটা নিয়ে আয়।’
অবনি উঠে ঘরের দিকে গেল।
টাকা নিয়ে ফিরে এসে দেখল ফাতেমা আমিন এর মুখটা গম্ভীর। টাকা টা উনার হাতে দিয়ে বলেন,
‘মা?’
‘ঘরে যা অবনি।’

দ্বিরুক্তি করল সে। একবার বলাতেই ঘরে চলে গেল।
রাতে নিজের প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে মাত্রই একটু বসল অবনি। রাত পোহালেই অচেনা শহরে পাড়ি জমাবে সে। নতুন জায়গায় যাওয়ার জন্য যেমন উদ্দীপনা কাজ করছে তেমনি বাবা মা ছেড়ে যাবে মন খারাপও হচ্ছে। ফাতেমা আমিন এলেন তার ঘরে। পাশে বসল তার। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনিমেষ।
‘কিছু বলবে মা?’

ফাতেমা আমিন অবনির একটা হাত মুঠোয় নিলেন।
‘আগুন আর লোহাকে যদি পাশাপাশি রাখা হয়। তবে আগুনের প্রখর উষ্ণতায় একটা সময় পর লোহা গলতে শুরু করে। কঠিন, মজবুত লোহা চোখের পলকে তরলে পরিনত হয়। তবে সেই গলিত লোহা হাত দিয়ে স্পর্শ করলে কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। হাত দগ্ধ হয়। মাংস উঠে আসে।’
এই কথাগুলোর মানে বুঝল না অবনি। নির্বোধের মতো ফাতেমা আমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
‘কেন কথা বললাম কথাগুলো বুঝিসনি তো?’

এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে সে।
‘আফসানা আপার ছেলে আছে। আর তুই মেয়ে। বিপরীত বস্তুর দিকে মানুষের আজীবন ঝোঁক থাকে। হয়তো দুজনের মাঝে একটা আকর্ষণের সৃষ্টি হতে পারে। তোর দিক থেকে কিংবা তার দিক থেকে। আবার নাও হতে পারে। আমি শুধু আমার মনের ভয়টা বলছি। ছেলে মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকবি মা। কেউ যেন তোর দিকে আঙুল তুলতে না পারে। পড়াশোনা করতে যাচ্ছিস মন দিয়ে পড়াশোনা করবি।’

‘বিকেলে কি এইজন্য তোমার মন খারাপ ছিলো? মজিদ চাচার মা তোমায় কিছু বলেছে?’
‘সন্তান বড় হলে বাবা মায়ের মান সম্মান সেই সন্তানের কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভর করে। সন্তান ভালো কাজ করলে সমাজে বাবা মায়ের মাথা উঁচু হয়। সবাই সম্মান করে। আর একটা খারাপ কাজ করলে বাবা মায়ের মাথা নিচু হয়। সমাজে সম্মানের জায়গাটা আর থাকে না। তখন শুধু তোর মজিদ চাচার মা না কথা শোনানোর লোকের অভাব হয় না।’
‘তাহলে ফুফুর বাসায় না গিয়ে হলে কিংবা মেসে উঠি?’

‘আফসানা আপার সাথে তোর বাপের কেমন সম্পর্ক তা তো জানিস। আপন ভাইবোনের চেয়ে কোনো অংশে কম না। তাদের বাসা থাকা সত্বেও যদি হলে উঠিস তাহলে হয়তো তোর বাবার সাথে সম্পর্কই রাখবে না।’
অবনি দু’হাতে ঝাপটে ধরে ফাতেমা আমিন কে।
‘টেনশন করো না মা। এমন কোনো কাজ করবো না যাতে তোমাদের মানের হানি হয়। কেউ তোমাদের দিকে আঙুল তুলতে পারে। আমি মাহফুজ ভাই থেকে দূরে থাকবো।’

‘ওয়াদা করবি মা? কেউ যেন আমার দেওয়া শিক্ষার উপর আঙুল তুলতে না পারে। কেউ যেন উঁচু গলায় বলতে না পারে আমার দেওয়া শিক্ষায় ঘাটতি আছে।’
মায়ের কথাটা কেমন করে যেন মিলে গেল। মায়েদের কি কোনো দৈব শক্তি আছে? না হলে বুঝলো কি করে এমনটা হবে? এদের করা ভবিষ্যৎ বানী কিভাবে যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।

নাদিয়া পিঠে হাত রাখতেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ে তার।
‘কিছু বলছিস না কেন অবনি?’
চট করে নাদিয়া কে ছেড়ে দেয় সে। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘বাসায় আয়। নামাজের সময় যাচ্ছে।’
অবনির অদ্ভুত আচরণে সেকেন্ডের মধ্যে নাদিয়া আহাম্মক বনে গেল। সেও ছুটলো অবনির পিছু পিছু।

চোখের পলকে সাতটা দিন শেষ। গুনা দিন খুব দ্রুতই চলে যায়। লাস্ট মিটিং শেষ করে সেই যে মাহফুজ ঘুমিয়েছে এখনো উঠেনি। প্রেজেন্টেশন মনমতো হয়নি বলে টানা দুইদিন এটার পিছনে দিয়েছে। না ঘুমিয়েছে না খেয়েছে। মিটিং শেষ করে হোটেল রুমে যে শুয়েছে এখনো ঘুম ভাঙেনি তার।
বার বার মোবাইলের রিংটোনে তন্দ্রা হালকা হয়ে এলো তার। তারপরও ঘুমের জন্য চোখ মেলতে পারছে না। নাম্বার না দেখে কল কে’টে দিলো সে। আবারও রিং হলো। ঘুমের মাঝে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেল তার। কোনো রকম রিসিভ করে কানে ঠেকায় মোবাইল।

‘হ্যালো?’ ঘুম জড়ানো কন্ঠ মাহফুজের।
‘কোথায় থাকো তুমি ভাইয়া? একশোর উপরে কল দিলাম।’
‘কি বলবি তাড়াতাড়ি বল। ঘুমাবো আমি।’
‘মামু অবনিকে গ্রামে নিয়ে গেছে।’
‘তো যাক। কয়দিন ঘুরে আসুক বাড়ি থেকে।’
‘বেড়ানোর জন্য নিয়ে যায়নি। ওকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।’
তন্দ্রা ভাব কে’টে গেল মাহফুজের। চট করে উঠে বসে সে।
‘কি বললি? আবার বল।’

‘পাত্রপক্ষ আসবে বলে অবনিকে মামু বাড়িতে নিয়ে গেল।’
রাগে হাত মুঠো করে ফেলে মাহফুজ। তন্দ্রাচ্ছন্ন লাল চোখ রাগে আরো লাল হয়ে গেল।
‘এই মেয়েটা এতো অবাধ্য। হাতের কাছে পেলে কানের নিচে দিবো কষিয়ে।’
‘ওর কোনো দোষ নেই। ও তো জানেও না। মায়ের সাথে বলছিল মামু। তাই আমি শুনেছি।’
‘আচ্ছা ফোন রাখ।’ বলে কল কে’টে দিলো মাহফুজ।

সময় দেখল সে। সন্ধ্যা এখন। বিছানা ছেড়ে নামল সে। দাঁত কিড়মিড় করে আওড়াল,
‘দাদা শ্বশুরের ছেলে। তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়া আমি বের করছি। আসছি আমি। ঘাড় ত্যাড়া মেয়েকেও সোজা করবো আর সাথে বাপকেও। ঘরের উপযুক্ত পাত্র চোখে পড়ে না।’
নিজের প্রয়োজনীয় সবকিছু লাগেজে নিয়ে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বস তার রুমে এলো।
‘মাহফুজ সাহেব আমরা আজই ঢাকা ব্যাক করছি না। আরো দুইদিন থাকবো সিলেট।’

দুইদিন থাকার শুনে চমকায় মাহফুজ। তার যাওয়া খুব জরুরি।
‘আবার কি নতুন কোনো প্রজেক্ট এসেছে স্যার?’
‘আপনি কোথাও যাচ্ছেন?’
‘কুমিল্লা যাবো স্যার। আরো দুইদিন থাকবো কেন? আবার নতুন কোনো ডিল?’
‘আরে না। লাস্ট প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশনের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। ভাবলাম আমার পক্ষ থেকে একটা ট্রিট দেই।’
মাহফুজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

‘ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
‘কুমিল্লা কেন যাবেন এই রাতের বেলা?’
‘জীবন ম*রন সন্ধিক্ষণে আছি স্যার। শ্বশুরমশাই বউকে আরেক জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।’
তিনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘আপনি বিয়ে করলেন কবে?’
‘বিয়ে করিনি তো।’
‘বিয়ে না করলে বউ পেলেন কোথায়।’

‘মামুর মেয়েকে হাওলাত করে বউ বানিয়েছি। হাওলাত করা বউকে আরেক জায়গায় বিয়ে দেওয়ার জন্য শ্বশুর মশাই উঠে পড়ে লেগেছে।’
‘আপনি এসব কি বলছেন মাহফুজ সাহেব? সবটা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।’
‘কুমিল্লা থেকে ফিরে আপনাকে বুঝিয়ে বলবো স্যার। আপাতত কয়েকদিনের ছুটি লাগবে।’
‘সে না হয় দিলাম। কিন্তু,,,
‘তাইলে গেলাম আমি। আমার যাওয়া খুব জরুরি।’

বাস যখন কুমিল্লা এসে পৌঁছায় তখন ফজরের আজান পড়ছে। বাস থেকে নেমে লম্বা নিঃশ্বাস নেয় মাহফুজ। ভালোয় ভালোয় গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলে স্বস্তি।
ভোর রাত হওয়ায় স্ট্যান্ডে কোনো সিএনজি নেই। লাগেজ নিয়ে একটা টং দোকানের বেঞ্চে গালে হাত দিয়ে বসে রইল সে। চোখে ঘুম। দশ মিনিট অপেক্ষার পরে একটা সিএনজি আসতেই সেদিকে তাড়াতাড়ি করে গেল সে।

‘চাচা যাবেন?’
‘বাবা যেইহানে যাবেন রিজাব যাইতো হইবো। এহন পেসেনজার নাই। আর ভাড়া লাগবো সাতশো।’
‘চাচা আপনারে সাতশো না এক হাজার দিবো। তারপরও নিয়ে চলেন। এক সেকেন্ড আমার কাছে এক বছরের সমান।’
‘তইলে উডেন।’
যতক্ষণে অবনিদের বাড়ি গিয়ে মাহফুজ পৌঁছায় ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পূব আকাশে উঁকি দিয়েছে রক্তিম সূর্য।

গ্রামের বাতাস স্নিগ্ধ, নির্মল। সাত সকালের হিমেল হাওয়া শরীর মন সতেজ করে তোলে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ যেন অন্য এক জগৎ।
উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিলেন রাফিয়া খাতুন। ব্যাগপত্তর সমেত সাত সকালে মাহফুজ কে দেখে চিৎকার করে ওঠেন।
উনার চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মামুনুর রশীদ এবং ফাতেমা আমিন।
মাহফুজকে দেখে যেন তাজ্জব বনে গেলেন জায়গায়। মামুনুর রশীদ অবিশ্বাস্য গলায় প্রশ্ন করলেন,

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ১০

‘মাহফুজ বাবা তুই এতো সকালে?’
গম্ভীর, রাশভারী স্বরে মাহফুজের প্রশ্নের ঝড়,
‘মামু ছেলে হিসেবে কি আমি এতোটাই খারাপ যে, আমাকে তোমার চোখে পড়ে না? আমাকে মেয়ের জামাই করা যায় না?’

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ১২