শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১৩

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১৩
তাসনিম জাহান রিয়া

থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রেয়সী। আয়াতের পাশে অনুপমকে সে মোটেও আশা করেনি। আয়াত আলতো হেসে বলে,
শালি সাহেবা তাহলে এসে গেছেন। আপনাকে এই গরীবদের বাড়িতে স্বাগতম।
শ্রেয়সী অনুপমের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আয়াতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শ্রেয়সী ভ্রু নাচিয়ে বলে,

আপনি গরিব? আপনি গরিব হলে আমরা তো ফকির মিসকিন। তবে এটা ঠিক আপনি
কিপ্টা। যাকে বলে হাড় কিপ্টা।
কী বলো শালিকা? আমাকে দেখে তোমার কিপ্টা মনে হয়? আমার ইনকাম যেখানে দুই টাকা সেখানে আমি খরচ করি তিন টাকা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমার তো মনে হয় না। কিন্তু আপনার বউ আমার কাছে অভিযোগ করেছে আপনার টাকা শেষ হয়ে যাবে বলে আপনি শান্তা নামক রমনীকে নিজের গোষ্ঠীর কাছে ফোন করতে দেয় না।
আমার নামে এত বড় মিথ্যা অপবাদ। আমি শান্তা নামক রমণীকে অভিশাপ দিলাম তার দুইটা বাচ্চা হবে। বাচ্চা দুটো হবে দুনিয়ার দুষ্টু। শান্তা নামক রমণীর মাথার চুল সব ছিঁড়ে ফেলবে।

আয়াত বন্ধ করবি তোর নাটক ফাটক। আমার প্রচুর গরম লাগছে। বাসায় না নিয়ে গেলে আমি চলে যাচ্ছি।
দোস্ত রাগ করিস না প্লিজ। অনেকদিন পর দেখা হলো তো। তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ও হচ্ছে শ্রেয়সী। আমার একমাত্র বউয়ের একমাত্র বোন আর আমার একমাত্র শালিকা। শ্রেয়সী ও হচ্ছে আমার বন্ধু অনুপম।

আসসালামু আলাইকুম।
অনুপম গম্ভীর কন্ঠে জবাব দেয়,
ওয়ালাইকুম আসসালাম।

তাদের মাঝে আর বিশেষ কোনো কথা হয় না। আয়াত অনুপমকে নিয়ে ভেতরে আসে। শ্রেয়সী শান্তাকে নিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দেয়। শ্রেয়সী কাজের মহিলার সাথে মিলে সব খাবার ডাইনিং টেবিলে এনে সাজিয়ে রাখে। শান্তা অনেক বার শ্রেয়সীকে বারণ করেছিল কিন্তু শ্রেয়সী শান্তার কথা পাত্তা দেয়নি। আয়াতও ফ্রেশ হয়ে এসে শ্রেয়সীদের সাথে খাবার রেডি করতে শুরু করে। সব খাবার রেডি করে সবাই একসাথে খেতে বসে।

শ্রেয়সী তোমাদের গোষ্ঠী তো ভয়ানক গোষ্ঠী। তোমাদের গোষ্ঠীর সবার বিয়ে নির্ভর করে তাদের মুডের ওপর। তোমার আপু বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙে দিতে চায় কারণ, তার বিয়ে করার মুড নেই। তুমি প্রথমে বিয়ে করতে রাজি হলে না কারণ তখন তোমার বিয়ে করার মুড ছিল না। এখন তোমার বিয়ে করার মুড তাই তুমি বিয়ে করবে।

কী সাংঘাতিক মুড তোমাদের।
নিস্তব্ধতার মাঝে আয়াতের কথাগুলো যেনো বজ্রপাতের মতো পড়লো। শ্রেয়সী খুব মনোযোগ দিয়ে আয়াতের কথাগুলো শুনে। আয়াতের কথা শেষ হতেই শ্রেয়সী আয়াতের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে আলতো হেসে বলে,
বুঝতে হবে আয়াত ভাইয়া এটা যেই সেই গোষ্ঠীর মুড না। সরকার গোষ্ঠীর মুড। আমাদের গোষ্ঠী তো তাই একটু ইউনিক।
শান্তা চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

তুই বলদমার্কা প্রফেসারকে বিয়ে করবি? ওকে যদি কেউ জুতাও ছুঁড়ে মারে তবুও সে দাঁত কেলিয়ে হাসবে। একটু পর দেখা যাবে তার কাঁধ জড়িয়েই হাঁটবে। তার থেকে বড় কথা এখন কী বিয়ে করার সময়? তোর বিয়ের বয়স হয়েছে?
বলদ হোক আর আবাল হোক আমি বিয়ে তো ঐ প্রফেসারকেই করবো। এই ধরনের ছেলেরা অনেক বউ ভক্ত হয়। সারাদিন আমার আঁচল ধরে ঘুরবে। আমি ঝাড়ি দিলেও ঘুরে ফিরে আমার কাছেই আসবে।
আমি এখন বিয়ে না করলে জীবন যুদ্ধে যে পিছিয়ে যাব। তোমরা সবাই বিয়ে ফিয়ে করে বাচ্চা-কাচ্চার বাপ-মা হয়ে যাচ্ছো আর আমি সিঙ্গেল।

অনুপম কেঁশে ওঠলো। অনুপমের বুঝতে অসুবিধা হলো না শ্রেয়সী যে তাকেই খোঁচা দিয়ে কথা বলেছে। শ্রেয়সী অনুপমের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। শ্রেয়সী খাবার প্লেটটা রেখে ওঠে দাঁড়ালো।
আপু আমি এখন যাই। অনেকটা লেইট হয়ে গেছে এমনিতে।

এখনি যাবে? মানে কী? তুমি আসলেই তো মাত্র। তোমার সাথে তো এখনো আড্ডাই দেওয়া হলো না।
আড্ডা অন্যদিন দেওয়া যাবে। আজকে হাতে একদম সময় নেই।
শান্তা মন খারাপ করে বলে, তুই এখনি চলে যাবি?
শ্রেয়সী শান্তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,

মন খারাপ করো না। আমি আবার আসবো। কী করবো বলো? স্যার এক বস্তা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দিছে। সম কমপ্লিট করতে হবে। আজ আসি।
শ্রেয়সী ভেসিনে হাত ধুয়ে ব্যাগ নিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। অনুপমও বেশিক্ষণ থাকে। শ্রেয়সী যাওয়ার পর পরই চলে যায়।

সময়টা বর্ষাকাল। চারদিকে জল থৈ থৈ করছে। রাস্তায় জল জমে, কাঁদা হয়ে হযবরল অবস্থা। রাস্তায় জমে থাকা জল গাড়ির চাকার চাপে ছিটকে চারপাশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। মুহিব ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। ছন্দ তুলে ছাতায় বৃষ্টি পড়ছে। মুহিবের বৃষ্টির শব্দ ভীষণ ভালো লাগে। বর্ষাকালে যখন কোনো কাজ থাকে না তখন মুহিব এক কাপ চায়ের সাথে বৃষ্টি উপভোগ করে।

রাস্তা থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে মুহিব হাঁটছে। হুট করে একটা প্রাইভেটকার বেশ শব্দ করে মুহিবের কাছ ঘেষে দাঁড়ায়। গাড়ি চাকার চাপে রাস্তা সামান্য জল ছিটে এসে মুহিবের প্যান্টে এসে লাগে। মুহিব বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। মুহিব গালি দিতে গিয়েও থেমে যায় পরিচিত মুখশ্রী দেখে।

জানালা দিয়ে এক ভদ্রলোক মুহিবের দিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রলোকটা আর কেউ না রিমের বাবা। লোকটাকে মুহিবের ভীষণ ভালো লাগে। এই লোকের সবকিছু মোটামুটি। যেমন: লোকটার হাইট মোটামুটি, লোকটার গায়ের রং মোটামুটি, কথা বলে মোটামুটি, আচার ব্যবহারও মোটামুটি। মুহিবের মতে এসব মোটামুটি টাইপের মানুষগুলো অনেক জোস হয়। লোকটা মুহিবকে ক্ষীণ স্বরে ডাকে,

মুহিব।
মুহিব লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে সালাম দেয়। লোকটাও বিনয়ের সাথে সালামের উত্তর দেয়।
মুহিব তোমার সাথে কিছু কথা আছে। তুমি কী গাড়িতে ওঠবে?
স্যার আজকে তো আমার সময় নেই পনেরো মিনিট পরেই আমার একটা টিউশনি আছে।
তোমার গন্তব্যে নাহয় আজকে আমার সাথেই গেলে। তোমাকে পৌছে দিতে দিতে নাহয় কথা বলে নিবো। ওঠে আসো।
মুহিব আর দ্বিমত না করে গাড়িতে ওঠে বসে। কিয়ৎক্ষণ কাটে নিরবতা। নিরবতা ভেঙে মুহিব বলে,

আপনি কী বলবেন?
তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমি কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি?
জ্বী। কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি।

তুমি হুট করেই কেনো রিমকে পড়ানো বন্ধ করে দিলে? আমি ভাবলাম তুমি হয়তো অসুস্থ তাই আসছো না। এমনিতে তুমি প্রাইভেট পড়াতে প্রতিদিন আসো। তাই ভাবলাম কিছুদিন ছুটি কাটাও। আমি কাজের জন্য কিছুদিনের জন্য কুমিল্লা চলে গেলাম। কাজের প্রেসারে তোমার কথাটা মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গেছিলো। গতকাল বাসায় ফিরে শুনি তুমি আর রিমকে পড়াতেই যাওনি। ইনফ্যাক্ট তুমি রিমের আম্মুর নাম্বারও ব্লক করে দিয়েছো।

আপনি তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। আপনি আমার থেকে বয়সে যেমন বড়, তেমন অভিজ্ঞ আর বিচক্ষণ। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কেনো রিমকে পড়াতে যাচ্ছি না?
রিম যে তোমাকে পছন্দ করে সেটা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। রিমের ফোনের গ্যালারিতে তোমার হাজার খানিক ছবি দেখে শিওর হয়েছিলাম। আমি চাইলে রিমকে শাসন করতে পারতাম। শাসন করিনি কেনো জানো? তোমাকে আমার ভীষণ পছন্দ। তোমার মাঝে আমি নিজের যুবক বয়সের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।

তুমি অনেক পরিশ্রমী ছেলে। তুমি একদিন সফলতা অর্জন করবে। রিম আমার একমাত্র মেয়ে। আমি রিমের কাছে পৃথিবীর সব থেকে ভালো বাবা হতে চেয়েছিলাম। রিম কখনো আমার কাছে কোনো কিছু আবদার করেনি। নিজে থেকে পছন্দ করে কোনো কিছু চায়নি। কিন্তু প্রথম বারের মতো ও কিছু পছন্দ করলো। তাতে বাধা দেই কী করে বল তো? তুমি সারাজীবন কিছু না করলেও আমার অসুবিধা নেই। আমার যা কিছু সব তো রিমেরই থাকবে।

স্যার আমি জীবনে যতটুকু হয়েছি সবটাই নিজের প্রচেষ্টায়। অন্যের দয়ার পাত্র কখনো হইনি। নিজের পরিশ্রমের টাকা দিয়ে পড়াশোনা করেছি। যখন জীবনে সব থেকে বেশি টাকার প্রয়োজন ছিল তখন যখন কারো দয়ার পাত্র হয়নি আর ভবিষ্যতেও হবো না। এইটুকুও নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পেরেছেন। আপনার মেয়ে রিমকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার কথায় খারাপ লাগলে ক্ষমা করে দিবেন। আসছি আমি।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১২

মুহিব গাড়ি থেকে নেমে হন হন করে চলে যায়। ভদ্রলোক ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মুহিবের যাওয়ার পানে। উনার মনে হচ্ছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তবে একটু ব্যতিক্রম আছে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১৪