শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১৫

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১৫
তাসনিম জাহান রিয়া

আপনি তো আয়াত ভাইয়ার বন্ধু। ঐদিন আয়াত ভাইয়ার সাথে উনার বাসায় গেলেন।
হ্যাঁ আমি আয়াতের বন্ধু। কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত আয়াতের বাসায় যায়নি। আমি তোমাকে বিষয়টা ক্লিয়ার করে বলি। আমি রুপম আর আমার ভাই অনুপম।

আমরা দুজন যমজ। তুমি যাকে চিনো সে অনুপম। তুমি আমাদের দুজনকে এক ভেবে ভুল করে ফেলছো। ভুল অবশ্য আমারও ছিল। আমি, অনুপম আর আয়াত একই সাথে পড়াশোনা করেছি। প্রফেশনের দিক দিয়ে আমি ওদের থেকে আলাদা হয়ে যাই। তাই আয়াতের সাথে আমার যোগাযোগটা একটু কমে যায়। ভার্সিটি লাইফ থেকেই আমার সাথে রূপার সম্পর্ক।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছাত্র থাকা কালীন অবস্থায় আমি আমি রূপাকে বিয়ে করি। এই তো বছর খানিক হলো তোমাদের এই বিল্ডিংয়ে ওঠেছি। তোমার সাথে পরিচয় হয়নি তবে তোমার মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেক ভালো। আমার বাবা-মা গ্রামে থাকেন। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন। উনারা এখানে থাকতে চান না, বেশি দিন থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত। তাই আমরা আর জোর করি না এখানে থাকার জন্য।

অনুপমও আমাদের সাথে থাকে না। ও আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। হাজার বার বলার পরও ও এখানে থাকতে রাজি হয়নি। আমার ভাই ছোটবেলা থেকেই একটু বেশি বুঝদার। ও হয়তো ভেবেছে কাছে থাকলে সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ে। রূপা অবশ্য তেমন না। রূপাও অনুপমের খুব ভালো বন্ধু।

আমি বুঝতাম ও আমাদের দুজনকে স্পেস দেওয়ার জন্য আমাদের সাথে থাকতো না। কিন্তু একদিন সন্ধ্যাবেলা হুট করেই ব্যাগপত্র নিয়ে আমাদের এখানে হাজির। আমাদের অবাক করে দিয়ে বলে, সে আজ থেকে এখানেই থাকবে। অনুপম এখানে থাকবে এটা শুনে রূপা আমার থেকেও বেশি খুশি হয়েছিল। ও একজন সঙ্গী পাবে।

কিন্তু আমরা তখনো বুঝতে পারিনি অনুপমের এখানে এসে থাকার কারণটা তুমি। অনুপম এই বাসায় আসার সপ্তাহ খানিক আগে তোমার সাথে আমার সিঁড়িতে দেখা হয়েছিল। আমি সেদিনই লক্ষ্য করেছিলাম তুমি আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিলে।

এরপর থেকে প্রায়ই খেয়াল করতাম তুমি আমার দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাও। প্রথমে এতোটা গুরুত্ব না দিলেও পরে দেখি ব্যাপারটার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে। পরে তুমি হয়তো কোনো ভাবে জানতে পেরেছিলে আমি বিবাহিত। পরে ছাদে ঐ ঘটনাটা ঘটলো। তখনো আমি বুঝতে পারিনি তুমি আমাকে অনুপম ভেবে এরকমটা করেছিলে।

ঐ ঘটনার পর থেকেই খেয়াল করতাম অনুপম কেমন মন খারাপ করে থাকে। এর কিছুদিন পরেই অনুপম আবার নিজের আগের বাসায় গিয়ে উঠে। আমাদের সাথেও যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। রূপা এর জন্য নিজেকে ব্লেম করা শুরু করে। নিশ্চয়ই তার পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি হয়েছিল তাই অনুপম এখান থেকে চলে গেছে। অনুপম খুব চাপা স্বভাবের।

নিজের খারাপ লাগা, ভালো লাগা কারো সামনেই প্রকাশ করে না। সে ভালো নেই এই কথাটাও কখনো কাউকে মুখ ফুটে বলে না। গত সপ্তাহে ধরে বেঁধে জিঙ্গেস করার পর তোমার কথা বলে। ও কিন্তু বুঝতে পেরেছিল তুমি ভুল বুঝছো। কিন্তু ঐ যে ইগোর কারণে তোমার কাছে আর যায়নি। নিজেকে নিজে কষ্ট দিচ্ছে। তুমি বাসায় এসেছো শুনেই আমি ছুটে এসেছি। সবকিছুই আমার জন্য হয়েছে। তাই তোমাদের সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।

আশা করি তুমি আমার কথা বুঝতে পেরেছো?
শ্রেয়সী গম্ভীর গলায় বলে, তা বুঝলাম। আপনি বড়?
দেড় মিনিটের বড়। অনুপম আমাকে ভাইয়া বলে ডাকে।

শ্রেয়সী মাথায় কাপড় দিয়ে ঝটপট রুপমের পা ছুঁয়ে সালাম করে লাজুক হেসে বলে,
আপনাকে ভাসুর হিসেবে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আপনার ভাইয়ের ইগো একটু বেশি। এই ইগো যদি আমি কমাতে না পারি তাহলে আমার নাম শ্রেয়সী না। আপনারা ভাইকে ফোন দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আপনাদের বাসায় ডাকুন।

রূপম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শ্রেয়সীর দিকে। শ্রেয়সীর কাজে সে হতবিহ্বল।
হা করে না তাকিয়ে থেকে ফোন করুন আর এখনি আসতে বলুন।
আচ্ছা।

শ্রেয়সী আর মিরাজ সরকার গোপন আলাপ করছেন। তাদের প্লেন করা শেষ হতেই শ্রেয়সী গলার আওয়াজ একটু উঁচু করে বলে,
আব্বু আমরা আজকে ছাদে পিকনিক করবো। আমার বন্ধুদের ফোন করে বলি চলে আসতে?

মিরাজ সরকারও শ্রেয়সীর সাথে তাল মিলিয়ে বলেন,
হ্যাঁ বলে দে। আজকে জমিয়ে বনভোজনের ব্যবস্থা করবো।
এই পিকনিকে কোনো মা, ছেলে এলাউ হবে না। কেউ যেনো আমার বন্ধুদের ছোঁকছোঁক না করে।

নাহিন ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,
তুই কী বলতে চাইছিস? আমরা ছোঁকছোঁক করি?
আব্বু আমি কী কারো নাম মেনশন করেছি? কথায় আছে না, সবার মাঝে পড়লো কথা যার কথা তার গায়ে লাগে।

দুই দলের মাঝে তুমুল যুদ্ধ লেগে গেলো। শ্রেয়সী সবার থেকে একটু দূরে সরে রূপমকে ফোন করে।
হ্যালো ভাইয়া। আপনার ইগোওয়ালা ভাই চলে আসছে।
রূপম ফিসফিস করে বলে,

একটু আগে আসছে। ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে আছে।
আচ্ছা অপেক্ষা করুন। আমিও আসছি।
তুমি কী করতে চাইছো? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সবুর করুন। সবুরে মেওয়া ফলে।

রূপম আর কিছু বলার আগেই শ্রেয়সী ফোন রেখে দেয়। শ্রেয়সী মিরাজ সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলে,
আব্বু আমি একটু রূপম ভাইয়াদের বাসায় যাচ্ছি। উনাদের সাথে তো আমাদের ভালো সম্পর্ক। উনাদেরও পিকনিকে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে আসি। সবাই মিলে করলে মজা বেশি হবে।

শ্রেয়সী লাফিয়ে লাফিয়ে রূপমদের বাসার সামনে চলে আসে। কলিংবেল বাজাতেই রূপা এসে দরজা খুলে দেয়। রূপাকে দেখেই শ্রেয়সী জড়িয়ে ধরে বলে,
কেমন আছেন ভাবি? পিচ্চি কেমন আছে?

রূপা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শ্রেয়সীর দিকে। সে শ্রেয়সীকে চিনে না। দুই একবার হয়তো দেখেছে। রূপার অন্যের ব্যাপারে কৌতূহল কম। কিন্তু কেউ যদি তার সাথে নিজে থেকে কথা বলে তাহলে একদম গলে যায়। শ্রেয়সী রূপাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,

আমাকে চিনতে পারছেন না? চিনবেনই বা কীভাবে? আপনার সাথে তো আমার পরিচয়ই হয়নি। ইনফ্যাক্ট আমিও আপনাকে চিনতাম না। আজকেই চিনলাম। আপনি তো রূপম ভাইয়ার ওয়াইফ? আমি আপনার শ্রেয়ার আন্টির মেয়ে শ্রেয়সী।
রূপা আহ্লাদি গলায় বলে,

তুমিই শ্রেয়সী? আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? তোমাকে দেখার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। তোমাদের বাসায়ও গিয়েছিলাম। তখন তুমি কলেজে ছিলে। ফাইনালি দেখা হলো।

এতক্ষণ ভালো না থাকলেও আপনাকে দেখে ভালো হয়ে গেছি।
রূপা আর শ্রেয়সী কথার আওয়াজ শুনে ভিতর থেকে অনুপম আর রূপম চলে আসে। অনুপমকে দেখেই শ্রেয়সী রূপাকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়।
অনুপম ভাইয়া ভালো আছেন?

শ্রেয়সীর কথা শুনে চমকে অনুপম। অনুপম এতো বেশি চমকে গেছে যে কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেছে। অনুপম অবাক হচ্ছে এই কারণে তাকে আর রূপমকে দেখে শ্রেয়সী কোনো রিয়েক্ট করেনি। তার থেকে বড় কথা শ্রেয়সী তাকে আর রূপমকে আলাদা করে চিনলো কীভাবে? অনুপমের অবাক হওয়া দেখে শ্রেয়সী মনে মনে হাসে। সে অনুপম আর রূপমকে আলাদা করে চিনেছে তিল দিয়ে। অনুপমের কানের নিচে পরপর দুইটা তিল আছে কিন্তু রূপমের নেই।

রুপম ভাইয়া আজকে আমরা ছাদে একটা পিকনিকের আয়োজন করছি। আপনি রুপা ভাবি আর অনুপম ভাইয়াকে নিয়ে অবশ্যই কিন্তু যাবেন।
রূপম কিছু একটা ভেবে বলে,

এই সন্ধ্যাবেলায় রুপাকে নিয়ে ছাদে যাব না। কিন্তু অনুপম অবশ্যই যাবে।
অনুপম বিরক্ত হয়ে বলে,
আমি কোথাও যাব না।
শ্রেয়সী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

না বলবেন না প্লিজ। এমনও হতে পারে এটা আমার শেষ পিকনিক। না মানে ধরুন এই মাসে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ে হয়ে গেলো তো আর এখনের মতো জীবনযাপন করতে পারবো না। তাই বলছিলাম। আপনি কিন্তু অবশ্যই আসবেন। আপনার অপেক্ষায় থাকবো।

এমন তো নয় যে আপনি প্রেগনেন্ট। সন্ধ্যাবেলায় ছাদে গেলে কিছু হয়ে যাবে।
শ্রেয়সী যেভাবে লাফাতে লাফাতে এসেছিল সেভাবেই লাফাতে চলে যায়। অনুপম শ্রেয়সীর লাস্ট কথা শুনে হতবিহ্বল।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১৪

রূপা আর রূপম অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। অনুপম খিটখিটে মেজাজ নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। তাকে ইনডিরেক্টলি প্রেগনেন্ট বলে গেলো আর সে হাভার মতো দাঁড়িয়ে ছিল। অনুপমের এই মুহূর্তে শ্রেয়সী ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১৬