শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৫

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৫
তাসনিম জাহান রিয়া

আকাশে ঝলমলে রোদ উঠেছে।আজকে মোটামুটি গরম। এই গরমের মাঝেও মিহানের ঠান্ডা লাগছে। জ্বর আসার পূর্ব লক্ষণ। জ্বর আসতেও পারে। গতকাল সে গরমের কারণে চার বার গোসল করেছে। রাতেও করেছে একবার। কাউকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। বরং একটা নাপা খেয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।

কিয়ৎক্ষণ কাটতে না কাটতেই মিহান শোয়া থেকে ওঠে বসে। বসে বসে কিছু ভাবে। হাত পা টান টান করে বিছানার ওপর বসে। অসহ্য ভঙ্গিতে মাথার চুল টানে।ফোন হাতে নিয়ে মুহিবকে কল করতে গিয়েও করে না। মিহান অনুভব করতে পারছে তার শরীরের তাপমাত্রা তরতর করে বাড়ছে। পায়ের ওপর থেকে কাথা সরিয়ে বিছানা থেকে নামে। টাওয়াল হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গোসল করার জন্য।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিহানের সামনেই মাঝ বয়সী একটা লোক বসে আছে। লোকটা চায়ের কাপটা নামিয়ে মিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
তুমি দিন দিন বেয়াদবির সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো। তুমি এতোটা দায়িত্ব জ্ঞানহীন কী করে হতে পার?
আপনার বুঝি অনেক দায়িত্ব জ্ঞান আছে?
কী বলতে চাইছো তুমি?

রক্ত তো একই। যার বাবা এমন দায়িত্বহীন তার ছেলে কীভাবে দায়িত্ববান হবে?
তোমার প্রতি কোন দায়িত্ব আমি অবহেলা করেছি?
টাকা দিলেই বুঝি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আপনার জীবনের সব থেকে বড় দায়িত্বটাই আপনি অবহেলা করেছেন মিস্টার জামান শেখ। আপনার দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার জন্য আজকে
মিহানকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় মিসেস শায়লা শেখ।

এটা কেমন অসভ্যতামু মিহান? উনি তোমার বাবা সম্মান দিয়ে কথা বলো।
সম্মান তাকেই করা উচিত যে সম্মানের যোগ্য। আপনার মুখে সম্মানের কথা মানায় না। আমাকে আপনি ধমকাতে আসবেন না। আপনি জানেন আপনার ধমকের পরোয়া আমি করি না।
জামান শেখ মিহানের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একটু কেশে বলে,

তুমি বুঝতে পারছো না তোমার দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার জন্য মিমির কতো বড় ক্ষতি হতে পারতো?
মিহান বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। জামান শেখের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
আমার তো বুঝার কথা না। মিমি আপনার মেয়ে তার সকল ভালো মন্দের দায়িত্ব আপনার, আমার না। নেক্সট টাইম আপনার মেয়ের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে আসবেন না।
কোথায় যাচ্ছো তুমি?

মিহান জবাব দেয়। মিমি ডয়িংরুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।
মিহান মিমির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর মৃদু স্বরে বলে,
তুমি অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। তোমার কোনো দোষ নেই। তবুও আমি তোমাকে সহ্য করতে পারি না। এই দুনিয়ার সব থেকে খারাপ মানুষ আমি। তোমাকে ভালোবাসার অনেক মানুষ আছে। তোমার পরিবার আছে। এই খারাপ মানুষটার ভালোবাসা না পেলে কিছু হবে না। আমার ভালোবাসাটা একজনের জন্যই সীমাবদ্ধ। তার ভালোবাসার ভাগ আমি অন্য কাউকে দিতে পারব না।
মিহান আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে দ্রুত পায়ে হেঁটে সবার দৃষ্টি সীমার অদূরে চলে যায়।

মিহান যখন বাসায় ফিরে তখন রাত দশটা বাজে। শরীর তাপমাত্রা তরতর করে বাড়ছে। ঠিক করে হাঁটতে পারছে না। নিজেকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে মিহান। হাঁটার শক্তিটুকুও ঠিক পাচ্ছে না।
সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে মিহান?
মিহান জামান শেখের দিকে তাকায় না। সামনের দিকে তাকিয়েই উত্তর দেয়,
আপনার অবহেলার জিনিসগুলো দেখতে গিয়েছিলাম।
মিহানের কথার পৃষ্ঠে আর কোনো কথা বলে না জামান শেখ। দৃষ্টি নত করে নিজের রুমে চলে যান। মিহান স্লান পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে যায়

হলে এখন পর্যন্ত সিট না পাওয়ায় নিতু ইভাদের বাসায় থাকে আর প্রিয়ন্তি তার খালার বাসায়। নিতু আর ইভা ডিনার শেষ করে মাত্রই রুমে আসে। অনলাইনে আসতেই দুজনের ফোন একসাথে বেজে ওঠে। নিতু ফোন রিসিভ করেই বলে,
প্রিয়ন্তি এমন বোয়াল মাছের মতো ‘হা’ করে আছে কেনো?
মিহান অনেকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,
দোস্ত আমরা সবাই মিলে ঠিক করছি কক্সবাজার ট্যুর দিমু।
নিতু ভ্রু কুঁচকে বলে,

কক্সবাজার যাব এটা তো ভালো কথা। কক্সবাজার যাওয়ার সাথে প্রিয়ন্তির ‘হা’ করে থাকার সম্পর্ক কী?
ইভা নিতুর মাথায় থাপ্পড় মেরে বলে,
বুঝস না ক্যান বাল? হেতির প্রফেসার বাপ হেতিরে যেতে দিবে না।
প্রিয়ন্তি নাক টেনে বলে,
তোরা কবে যাবি?

ওলে বাবুটা কাঁদে না। তোর যাওয়ার ব্যবস্থা মুহিব করে দিবে। একদম টেনশন নিবি না।
শ্রেয়সীর কথায় মুহিব আঁতকে উঠে।
আমি কীভাবে কী করবো?
শ্রেয়সী মুহিবের দিকে তাকিয়ে সবগুলো দাঁত বের করে একটা হাসি দেয়। মুহিব চোখ বড় বড় করে বলে,
তোর হাসি সন্দেহজনক। আমাকে ফাঁসানোর ধান্দা করছিস।
দেখ মাথায় উল্টা পাল্টা চিন্তা ভাবনা আসলে ঝেড়ে ফেলে দে।

মামা আমরা সবাই জানি আমাদের বন্ধুমহলের সবার মাঝে তোকেই প্রিয়ন্তির বাবা একটু অন্যরকম চোখে দেখে। আমাদের সম্পর্কে প্রিয়ন্তির বাবার ধারণা হচ্ছে ফাজিল, ফাঁকিবাজ। দুনিয়ার সব থেকে অভদ্র আমরা। আর তোর সম্পর্কে ধারণা গুড বয়। তুই বললে আংকেল অবশ্যই প্রিয়ন্তিকে যেতে দিবে।
মুহিব আর্তনাদ করে বলে উঠে,

আমি পারব না। ভাই যেমনে তাকায় কলিজাসহ কাঁপায়া দেয়। বললে সবাই একসাথে বলবো।
তন্ময় একটু কেঁশে বলে,
আমি নিজের বাপকেও যতটা ভয় না পাই তার থেকেও বেশি প্রিয়ন্তির বাপ আর শ্রেয়সীর ভাইকে ভয় পাই। সালা দুইটা মাল।

তন্ময়ের কথায় প্রিয়ন্তি প্রতিবাদ করে বলে উঠে,
এই একদম আমার সামনে স্ল্যাং ইউজ করবিনা আর আমার বাবাকে তো কিছু বলবিই না।
আমার ভাইয়ের নামে কিছু বললে মাথা ফাটিয়ে দিব একদম। কক্সবাজার যাওয়া নিয়ে প্লেন করছিস ঐটা কর। কীভাবে যাবি?

আব্বুকে বলে গাড়ি নিয়ে নিব। এক গাড়িতেই আমাদের সবার হয়ে যাবে। সাথে ড্রাইভার নিব না। সাতদিনের ট্যুর দিব।
কবে যাব সব ফাইনাল করে ফেলি। আমার আর নিতুর তো টিউশনি থেকে ছুটিও নিতে হবে।
মুহিবের কথায় শ্রেয়সী একটু ভেবে বলে,
বাসা থেকে আগে সবাই পারমিশন নেই। প্রিয়ন্তির বাবাকেও তো রাজি করাতে হবে।

এখন বাজে বিকেল পাঁচটা। মুহিব দ্রুত পায়ে হাঁটছে একটা প্রশস্ত গলি দিয়ে। এই এলাকায় হাই সোসাইটির লোকেরা বাস করে। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় দালান। মাথার ওপরের সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। একটা তীক্ষ্ম আলো এসে পড়ছে মুহিবের চোখে।

মুহিব হাঁটতে হাঁটতে বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। প্রাইভেট পাঁচটায় আর মুহিবের রাস্তার মাঝেই পাঁচটা তিন বেজে গেছে। মিনিট দুয়েক পরেই ১৫৩ নাম্বার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লিফটে করে পাঁচ তলায় উঠে। লিফটের বাম পাশের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজালো। কলিংবেল বাজার সেকেন্ডের মাঝেই দরজা খুলে দিল ১৪-১৫ বছরের শ্যাম বর্ণের এক মেয়ে। মেয়েটা যেনো কলিংবেল বাজার অপেক্ষায় ছিল। মেয়েটা মুহিবকে দেখেই মৃদু স্বরে সালাম দেয়,

আসসালামু আলাইকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
মুহিব মেয়েটার দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। নিজের বরাদ্দকৃত জায়গায় বসে পড়ে। মেয়েটাও মুহিবের পিছন পিছন এসে মুহিবের অপোজিট চেয়ারে বসে। মেয়েটা মুহিবকে প্রাণোচ্ছল কন্ঠে বলে,
স্যার আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
মুহিব মেয়েটার কথা এড়িয়ে যায়। অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলে,

রিম তোমার কাল কেমিস্ট্রি এক্সাম না?
রিম মুহিবের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তর শোনার জন্য। মুহিব রিমকে হালকা ধমক দিয়ে বলে,
এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? বই বের করো।
রিম মুহিবের দিকে ছলছল নয়নে তাকায়। আবারও মৃদু স্বরে বলে,
স্যার বললেন না তো আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
মুহিবের এতদিন এতটুকু ধারণা হয়ে গেছে যে রিম প্রচন্ড জেদি একটা মেয়ে। মুহিব শান্ত স্বরে বলে,
ভালো।

স্যার আপনার তো কক্সবাজার যাচ্ছেন। তাহলে তো কিছুদিন পড়াতে আসবেন না?
তোমাকে কে বললো আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি?
মিহান ভাইয়া বলছে।
মিহানের সাথে তোমার কোথায় দেখা হলো?
রিম মাথা নিচু করে জবাব দেয়,
ফেসবুকে কথা হয়েছে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪

রিম তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো কিছুদিন পরেই তোমার এক্সাম? এরকম করলে কিন্তু আমি আর পড়াতে আসবো না। তোমার পড়াশোনা ছাড়া আর সবকিছুতেই মনোযোগ বেশি। আর তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার শিক্ষক। আমাদের মাঝে প্রফেশনাল সম্পর্ক ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে নাক গলানো বন্ধ করো। মিহান তোমার ফ্রেন্ড অথবা ক্লাসমেট কোনোটাই না। তাই ওর সাথে কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করছি না।
সরি স্যার।
এখন পড়াশোনায় মনোযোগ দাও।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৬