শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪
তাসনিম জাহান রিয়া

পর্ব ৪-৭ পর্যন্ত আবার নতুন করে সাজিয়ে লেখা হয়েছে সবাই আবার পরেন এই পর্ব গুলো 

ধড়ফড় করা ঘুম থেকে ওঠে শ্রেয়সী। ঘামে ভিজে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বেড সাইড টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানিটা খেয়ে ফেলে। শ্রেয়সী বুঝতে পারছে না এমন অদ্ভুত স্বপ্ন সে কেনো দেখলো? ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তিনটা সাতাশ বাজে। বাকি রাতটা আর শ্রেয়সী ঘুমায় না। বারান্দায় পায়চারি করে কাটিয়ে দেয়।

পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। শ্রেয়সী গায়ে উড়না জড়িয়ে নিজের রুম থেকে বের হয়। টিভির পাশ থেকে ছাদের চাবিটা হাতে নেয়। খুব সাবধানে পা ফেলে তাদের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। ধীর পায়ে হেঁটে ছাদের সিঁড়ির কাছে আসে। ছাদের দরজা খোলা দেখে শ্রেয়সী একটু অবাক হয়। এতো সকালে সাধারণত কেউ ছাদে আসে না। এখন বাজে সকাল পাঁচটা এই সময়টাই এই বিল্ডিংয়ের বেশির ভাগ মানুষ ঘুমিয়েই থাকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সবার নিজস্ব ফ্ল্যাট হওয়ায় ছাদটাও ভাগ করা। সবাই সবার পছন্দ মতো গাছ লাগিয়েছে ছাদে। শ্রেয়সী নিজের ভাগের জায়গাটুকুই ফুলগাছ লাগিয়েছে। রোজ নিয়ম করে ফুল গাছগুলোর যত্ন নেয়। সেই ফুলগাছগুলোর উপর কাউকে ঝুঁকে থাকতে দেখে মাথা গরম হয়ে যায় শ্রেয়সীর। প্রতিদিন কেউ যত্ন সহকারে ফুল ছিঁড়ে নেয় শ্রেয়সীর গাছ থেকে। শ্রেয়সী মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে,

এই ছেলে আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আপনি আমার গাছ থেকে, এই শ্রেয়সীর গাছ থেকে ফুল চুরি করেন।
শ্রেয়সীর চিৎকারে যে ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে সেটা তার ভাব সাব দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়েই পিছন ঘুরে তাকায়। ছেলেটার মুখশ্রী দেখে শ্রেয়সী আরো অবাক হয়। শ্রেয়সীর ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে অনুপম। পড়নে কালো রঙের ট্রাউজার আর ব্লু রঙের টি-শার্ট। হাতে ফোন আরেকটা ইয়ারফোন। অনুপম নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা আর শ্রেয়সীর সামনে প্রকাশ করে না। অনুপম মৃদু স্বরে বলে,

জ্ঞান হারানো মেয়েদের এতো জুড়ে চিৎকার করা মানাই না। আগে শুধু জানতাম তুমি জ্ঞান হারাও এখন তো দেখি তুমি বোকাও। ফুলগাছ থেকে মানুষ ফুল তখনি ছিঁড়ে যখন গাছে ফুল থাকে।
শ্রেয়সীর নিজের গালে একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করলো। এতো বড় বোকামি সে কীভাবে করলো? গতকালই তো কেউ একজন তার গাছের সব ফুল ছিঁড়ে নিয়েছে।

আপনি এখানে কী করছেন?
তুমি যা করছো আমিও তাই করছি।
আপনি সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে পারেন না। আপনি এই বিল্ডিংয়ে কী করছেন? আগে তো কখনো আপনাকে এখানে দেখিনি। আত্নীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসছেন? কিন্তু আত্নীয়ের বাড়িতে কেউ রোজ রোজ আসে না। ব্যাপার কী বলুন তো? বাসে আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই নিয়ম করে আপনার সাথে দেখা হওয়া যেনো রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই যে জ্ঞান হারানো মেয়ে আমার ব্যাপারে এতো ভেবো না। প্রেমে পড়ে যাবে।

ট্রাউজারের পকেটে ফোন আর ইয়ারফোন ঢুকিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে শ্রেয়সীকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় অনুপম। কিছু একটা ভেবে শ্রেয়সী অনুপমের পিছু নেয়। কিন্তু শ্রেয়সীর ভাবনায় এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে অনুপম নিজের ফ্ল্যাটে না গিয়ে গেইট দিয়ে বাসার বাইরে বেরিয়ে গেলো। শ্রেয়সী ভেবেছিল অনুপমের পিছু নিয়ে সে জেনে নিবে তার ম্যাজিস্ট্রেট বাবু কোন ফ্ল্যাটে থাকে। শ্রেয়সী হতাশ হয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে।

খুব সকাল সকাল শ্রেয়সীদের বাসার কলিংবেল বেজে ওঠে।নাহিন দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নাহিন। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়সীর বন্ধুমহল। নাহিনকে দেখেই সবাই ভদ্র হয়ে যায়। মিনমিন করে সালাম দেয়।
নাহিন গম্ভীর কন্ঠে সালামের উত্তর দেয়।
এতো সকালে তোমরা এখানে?

তন্ময় আমতা আমতা করে বলে, শ্রেয়সীকে দেখতে এলাম।
শ্রেয়সীকে দেখার কী আছে? শ্রেয়সীকে আগে কখনো দেখনি?
মাহিন দাঁত কেলিয়ে বলে, আজকে তো ভার্সিটির প্রথম দিন। আমরা সবাই একসাথে যাব। তাই শ্রেয়সীকে নিতে এলাম।
এতো সকালে তোমরা ভার্সিটিতে যাবে?

নিতু কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে, আপনি আমাদের সাথে এমন আজব ব্যবহার কেনো করছেন? যেভাবে জেরা করছেন মনে হচ্ছে আপনি পুলিশ আর আমরা চোর। আপনাদের বাসায় মেহমান আসলে বুঝি এভাবে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখেন?
ভিতরে আসো।
নাহিন বলা মাত্রই এক লাফে সবাই বাসায় ঢুকে পড়ে। নাহিন দরজা লাগিয়ে রুমে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে,
সবগুলো ড্রামাবাজ।
নাহিন নিজের রুমে যেতেই সবগুলো হুড়মুড় করে শ্রেয়সীর রুমে ঢুকে পড়ে। মিহান শ্রেয়সীর বিছানার ওপর বসতে বসতে বলে,

শ্রেয়সীরে কই তুই? শুনলাম তুই নাকি ম্যাজিস্ট্রেটের প্রেমে পড়ে দেবদাস হয়ে যাচ্ছিস। গাঞ্জা-টাঞ্জা খাবি নাকি?
শ্রেয়সী বারান্দা থেকে এসে ঠাস করে মিহানের পাঠে চর বসিয়ে দেয়। মিহানের দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
তুই সবসময় আমার সাথে এমন কেনো করিস? সবসময় ফাজলামো ভালো লাগে না। এটা আমার জীবন মরণের প্রশ্ন একটু সিরিয়াস হ।
মিহান একটু কেঁশে গলা পরিষ্কার করে বলে,

যা আমি এখন ভীষণ সিরিয়াস। বন্ধুর জীবন মরণের প্রশ্নে আরেক বন্ধু ফাজলামো করতে পারে না। বল তোর জন্য কী করতে পারি? ঐ ম্যাজিসেট্রটকে তুলে নিয়ে আসবো? তুই একবার শুধু বল দেখ আমরা কি করি। ঐ ম্যাজিসট্রেট যদি বাসর ঘরেও বসে থাকে, তাহলে বাসর ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসবো।
সবাই মিহানের সাথে তাল মিলায়। শ্রেয়সী সবার দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

ঐ বেডা তো তোদের লাইগা বাসর ঘরের দরজা খুলে বসে থাকবে। মধুর স্বরে ডেকে বলবে, আসো তোমরা আমাকে তুলে নিয়ে যাও। তোরা আমার সমস্যা সমাধান করার বদলে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিস।
ইভা শ্রেয়সীর পাশে বসে। শ্রেয়সীর মুখ উল্টে পাল্টে দেখে বলে,
বলতো তোর সমস্যাটা কী? তোর হাব ভাব আমার ভালো ঠেকছে না।

ঐ বেডা যেখানেই আমাকে দেখে সেখানেই জ্ঞান হারানো মেয়ে বলা ডেকে বসে। এতো পরিমাণে আমাকে ডিস্টার্ব করছে যে আমি স্বপ্নেও উনাকে দেখছি। স্বপ্নে দেখি ঐ লোকের মেয়ে বলতাছে, তুমি আমার আব্বুর দিকে তাকিয়ে থাকো কেনো? একদম আমার আব্বুর দিকে তাকাবে না। উনার মেয়ে আছে দেখে আমি কেঁদে কেটে অস্থির। বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো ভাব শুরু করছি। বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা কতো সাংঘাতিক ।

তোরা আইডিয়া দে কীভাবে ঐ বেডার কথা মাথা থেকে বের করে দিতে পারবো?
ঐ বেডার কথা তুই আর মাথা থেকে বের করতে পারবি না। তুমি ঐ পোলার প্রেমে পা পিছলে পড়েছ। ঐ পোলারে চাইলেও বুলতে পারবে না। তোমার মন মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু একজনেরই বসবাস।
ইভা তন্ময়ের পিঠে থাপ্পড় মেরে বলে,

একদম আজেবাজে কথা বলবি না। ওর মাথায় একদম আজেবাজে কথা ঢুকাবি না। বাবু তুই আমার কথা শোন। ওদের কথা একদম কানে নিবি না। তুই কোনো প্রেমে টেমে পড়িসনি। ঐ লোক তোকে ডিস্টার্ব করে। সারাদিন উনার কথায় মাথায় ঘুরে তাই স্বপ্নে দেখেছিস। এর থেকে বেশি কিছু না।
প্রেমে পড়া ভালো না। একটা মেয়ে একটা ছেলের প্রেমে পড়লে ছেলের দাম বেড়ে যায়। আরেকটা কথা শোন জীবনেও রিলেশন করবি। রিলেশনের প্রথম দিকে ছেলেরা খুব বেশি সিরিয়াস থাকে। দিন যত বাড়তে থাকে, ছেলেদের অবহেলাও তত বাড়তে থাকে।

মুহিব ধাক্কা দিয়ে ইভাকে শ্রেয়সীর কাছ থেকে
সরিয়ে দিয়ে নিজে শ্রেয়সীর পাশে বসে পড়ে।
শোন শ্রেয়সী একদম ইভার কথায় কান দিবি না। ও কী বুঝে প্রেম ভালোবাসার? সারাদিন শার্ট পেন্ট পড়ে ছেলেদের মতো ঘুরে বেড়ায়। এসব বড়লোকের আদরের দুলালিদের প্রেম ভালোবাসার ফিলিংস সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকে না। ছেলেদের ভালোবাসা সম্পর্কে ওর কতটুকু ধারণা আছে। ছেলেরা যখন সত্যি ভালোবাসে তখন নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে।
তুই তো খুব বুঝিস। জীবনে তো একটা প্রেমও করতে পারলি না।

নিতু মৃদু চিৎকার করে বলে,
এই তোরা চুপ করবি প্লিজ? সবসময় ঝগড়া করে। কখন থেকে দেখছি সবাই ঐ বেডা, ঐ লোক আর উনি বলছিস উনার নামটা কী? তোরা কেউ জানিস?
সবাই এক সাথে মাথা নাড়ায়। কেউ জানে না। এতক্ষণে প্রিয়ন্তি মুখ খুলে,
তোর তো এট লাস্ট জানার কথা ছিল শ্রেয়সী। তোর সাথে সবসময় দেখা হয়েছে।
উনার নাম না জানলেও এটা জানি উনি এই বিল্ডিংয়ে থাকেন। তবে আমি শিওর না। উনার সাথে আমার প্রায়ই দেখা হয়। যেমন ধর ছাদে, যাওয়া আসার সময় সিঁড়ির মাঝে।

অনুপম এই বিল্ডিংয়ে থাকে সেটা জানার পর শ্রেয়সীর বন্ধুমহলে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেই উত্তেজনাই বাটা পড়ে মিরাজ সরকারের আগমনে ।
হাতে ট্রে নিয়ে রুমের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে মিরাজ সরকার। মিরাজ সরকারকে দেখে সবাই সালাম দেয়। মিরাজ সরকার সবার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলে,
তোমরা কী নিয়ে কথা বলছিলে?
শ্রেয়সীর ম্যাজিসেট্রটকে কথা বলছিলাম।

নিতুর কথার বিপরীতে মিরাজ সরকার ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নিতু সবটা খুলে বলে। মিরাজ সরকার মুখটা চিন্তিত করে বলে,
এটা ভাবনার বিষয়। আমার মেয়েটা যে ভীষণ বড় রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছে। এই রোগ সারানোর জন্য যে ঐ ম্যাজিসেট্রটের কাছে যেতে হবে।
মিরাজ সরকার সবার হাতে কফির মগ দেয়। ইভা কফির মগটা হাতে নিয়ে বলে,

আংকেল আপনি এতো ভালো, মিশুক। আন্টি আর শ্রেয়সীও আপনার মতো তাহলে আপনার ছেলেটা এমন কেনো? রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন নাকি? দরজা খুলে আমাদের দেখে এমন একটা ভাব করলো যেনো মুখের ভিতর কেউ এক গ্লাস নিমের রস ঢেলে দিয়েছে। আমাদের সহ্যই করতে পারে না আপনার ছেলে।
নাহিন আমার বড় ভাই হেলাল সরকারের মতো হয়েছে।

সবার কথার মাঝেই শ্রেয়সীর রুমের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে নাহিন। শ্রেয়সীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
গতকাল আমার যে বইটা নিয়েছিলি, সেই বইটা কোথায়?
টেবিলের ওপর রাখা নিয়ে যাও।
নাহিন টেবিলের ওপর থেকে বই নিয়ে যাওয়ার সময় ইভার দিকে এক পলক তাকায়। নাহিন রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই শ্রেয়সী ইভার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩

এই কী ব্যাপার বলতো? ভাইয়া যাওয়ার সময় তোর দিকে তাকালো কেনো? তোদের মাঝে কিছু চলছে না তো? ওপর দিয়ে প্রেম ভালো না, প্রেম ভালো না ডায়লগ দিয়ে তলে তলে টেম্পো চালাও না তো?
ছিঃ কী বলিস এসব? তোর ভাইয়ের সাথে প্রেম করবো আমি? মাথা খারাপ? এসব প্রেম টেমের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট নেই। আর তোর ভাইয়ের মতো আবালের সাথে আরেকটা আবালই প্রেম করবে। আমি না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৫