শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩
তাসনিম জাহান রিয়া

গ্রীষ্মের তান্ডব শুরু হয়েছে মাত্র। আকাশে তেজস্বী সূর্য। মুহিব ছাড়া আর সবাই বসে আছে পার্কের দুইটা বেঞ্চ জুড়ে। কিয়ৎক্ষণের মাঝেই মুহিব ঘর্মাক্ত মুখশ্রী নিয়ে হাজির হয়। ধপ করে মিহানের পাশে বসে পড়ে।শুভ্র রঙের শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। শ্রেয়সী এক বোতল পানি এগিয়ে দেয়।

ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানিটা খেয়ে বোতলটা দূরে ছুঁড়ে মারে। মিহান রাগী স্বরে বলে,
তুই কী আমাদের কথা শুনবি না? নিজেকে তোর মানুষ মনে হয় না?
তোদের সব কথায় তো শুনি।
শ্রেয়সী মুহিবের চুল টেনে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কোথায় শুনিস? এডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি হলি না। বললি টাকার সমস্যা। আমরা সাহায্য করতে চাইলাম সেটাও নিলি না। বন্ধুর কাছ থেকে সাহায্য নিলে কী মানুষ ছোট হয়ে যায়? নাকি আমাদের বন্ধুই ভাবিস না?
মুহিব শ্রেয়সীর হাত ধরে বলে,

প্লিজ রাগ করিস না। তোরাই তো আমার সব। তোরা আমার কাছে বন্ধুর থেকেও বেশি। তোরা আমার জন্য যা করেছিস তা ভোলার মতো না। আর কত সাহায্য করবি? ভার্সিটির ভর্তির জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন। আমার বাবা নেই, আম্মু অসুস্থ। আমার আর ছোট আপুর টাকায় সংসার চলে। সামনের মাসেই মেজো আপুর ডেলিভারি। অনেক টাকার প্রয়োজন। এডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি হলে টিউশনি করার সময় পাবো না। ছোট আপুরও তো বিয়ে দিতে হবে। চিন্তা করিস না আমি নিজেই বাসায় পড়ে নিতে পারব। তোরা তো নোটস দিয়ে হেল্প করছিস। তোদের পিছু ছাড়বো না দেখিস। তোরা যে ভার্সিটিতে ভর্তি হবি সেখানে আমিও হবো।

শালা তোর দুলাভাইরে আমার লাইত্তাইতে মন চায়। তোরে কী ওরা মানুষ মনে করে না? বেডার তো টাকা কম নাই। তবুও সবকিছু তোর ওপর চাপাইয়া দেয় ক্যান? পয়দা করবো তার ক্যাসেট আর ডেলিভারি খরচ দিতে হবে তোর আর তোর বোনের।
মুহিব আলতো হেসে বলে,

শালা ডাকিস না। পরে কিন্তু আমার বোনকে বিয়ে করতে হবে।
হুট করে মিহান আনমনা হয়ে যায়। মিহান আনমনা হয়েই জবাব দেয়,
আমি বিয়ে করতে চাইলেও তুই দিবি না।

সবাই অবাক হয়ে তাকায় মিহানের দিকে। মিহান সবার দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে যায়। মিহান বেশ শব্দ করে হেসে দেয়।
বাল সবগুলা আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? আরে বাপ আমি তো জাস্ট ফান করছি। বন্ধুর বোন সবার বোন।
বাকি সবাই আড্ডায় মেতে ওঠে কিন্তু মিহান আনমনা হয়েই বসে থাকে।

সৌভাগ্যবশত সবাই একই ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া নিয়ে প্রিয়ন্তির বাবার একটু দ্বিমত ছিল। কারণ উনার ইচ্ছে ছিল নিজের মেয়েকে মেডিকেলে পড়ানোর। কিন্তু প্রথম বারের মতো প্রিয়ন্তি নিজের বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।

শ্রেয়সী হাতে ঘড়ি লাগাতে লাগাতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল অসাবধানতাবশত উল্টো দিক থেকে আসা ব্যক্তির সাথে ধাক্কা খায়। শ্রেয়সীর হাত থেকে ঘড়ি ছিটকে পড়ে যায়। ঘড়ি ছিটকে পড়ে কয়েক খন্ডে পরিণত হয়।
জ্ঞান হারানো মেয়ে দেখা যায় ধাক্কাও মারতে জানে।
শ্রেয়সী ভ্রু কুঁচকে অনুপমের দিকে তাকায়। অনুপমের দিকে তাকিয়ে বলে,

এই আপনার সমস্যা কী? আমাকে আপনি কী পেয়েছেন? এমন অদ্ভুত ব্যবহার আমার সাথে কেনো করছেন? এখন জ্ঞান হারানো মেয়ে, জ্ঞান হারানো মেয়ে বলে চিৎকার করছেন, মাঝে মাঝে এমন ভাব করেন যেনো আমাকে চিনতেই পারেন না। দেখা হলে ইগ্নোর করে চলা যান।
অনুপম শ্রেয়সীর দিকে চোখ টিপ দিয়ে বলে,

আমি ইগ্নোর করলে বুঝি কষ্ট হয়?
একদম আজেবাজে কথা বলবেন না।
আজেবাজে কথা বলছি বুঝি? তোমার হাব ভাব ভালো ঠেকছে না। ওহে জ্ঞান হারানো মেয়ে আমার প্রেমে পড়ে লাভ নেই। আমার আমি পুরোটাই একজনের নামে বুক করা।
শ্রেয়সী অনুপমকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে যায়। শ্রেয়সী বাসা থেকে বের হয়ে দেখে তন্ময় তাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

কীরে তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
তোকে নিতে এলাম।
বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলি কেনো ভিতরে গেলেই পারতি।
আমারে তো পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে তোদের বাসায় যাব তোর প্রফেসার ভাইয়ের ডায়লগ শুনতে। তোর ভাই এমন একটা ভাব করে যেনো পৃথিবীর আর কোনো মানুষ পড়াশোনা করে না।

একদম আমার ভাইয়ের নামে উল্টা পাল্টা কথা বলবি না।
তোমার ভাই তো হাজি সাহেব কোনো কিছু বলা যাবে না। তো হাজি সাহেব আপনাকে সন্ধ্যাবেলা বাসা থেকে বের হতে দিল?
আমি ছাড়া আর কেউ বাসায় নেই।
আচ্ছা চল।

তন্ময়ের বাইকের পিছনে বসে শ্রেয়সী। মিনিট দশকের মাঝে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌছে যায়। শ্রেয়সী আর তন্ময় ছাড়া সবাই চলে এসেছে আগে। শ্রেয়সী টং দোকানে দেখে খুশি হয়ে যায়। শ্রেয়সীকে দেখা মাত্রই নিতু শ্রেয়সীর গাল ধরে বলে,
কীরে তোর ম্যাজিসেট্রট বাবুর কী খবর? তোদের মাঝে প্রেম টেম চলছে নাকি?
নিতুর কথা শুনে শ্রেয়সীর গাল জুড়ে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে। শ্রেয়সী লজ্জা মিশ্রিত গলায় বলে,

ধুর এমন কিছু না।
বুঝি বুঝি আমরাও বুঝি।
মুহিব সবার জন্য চা নিয়ে আসে। সবাই আড্ডা দেওয়া শুরু করে। ইভা ডায়েরীতে কিছু লিখছে। মিহান গিটারে টুং টাং আওয়াজ তুলছে।

কথা হবে দেখা হবে,
প্রেমে প্রেমে মেলা হবে,
কাছে আসা আসি আর হবে না।
চোখে চোখে কথা হবে,
ঠোঁটে ঠোঁট নাড়া দেবে,
ভালোবাসা বাসি আর হবে না।
মুহিব কাপ আর প্লেট দিয়ে আওয়াজ করছে। তন্ময় চিৎকার করে বলে,
মামা অস্থির।

তন্ময়ের কথা শেষ হতে না হতেই তন্ময়ের গালে সপাটে একটা চর পড়ে। সেকেন্ডের মাঝেই কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ নিরব হয়ে যায়। তন্ময় হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর দিকে।
বাড়িতে মা-বোন নেই? রাস্তা-ঘাটে মেয়ে দেখলেই লালসার দৃষ্টিতে তাকাতে হয়। তোদের মতো কিছু জানোয়ারের জন্য ভদ্র ঘরের মেয়েরা রাস্তা-ঘাটে চলতে পারে না।

তন্ময় একদম শান্ত। হুট করে মাথা গরম করা ফেলা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। সে সব জায়গায় মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। এখানে সবাই বুঝতে পারছে মেয়েটা তন্ময়কে মিস আন্ডারস্ট্যান্ড করছে। কিন্তু মিহান সেটা মানতে নারাজ। হুট করে মাথা গরম করে ফেলা তার স্বভাব। তার বন্ধুকে অপমান করেছে আর সে ছেড়ে দিবে। ঠাস করে মেয়েটার গালে সেও চড় বসিয়ে দেয়। মেয়েটার ফর্সা গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসে যায়। মুহিব পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মিহানকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরে।

তুই তো খুব ভদ্র ঘরের মেয়ে না? তোর স্বভাব দেখেই বুঝা যাচ্ছে তুই কেমন ভদ্র ঘরের মেয়ে। আমার বন্ধু তোর দিকে তাকায়ছে না তোকে কিছু মিন করে বলছে? তুই কী মনে করছিস তোদের মতো মেয়েদের আমি চিনি না? তোদের ধান্দা বুঝি না আমি। তোকে খুন করার আগে এখান থেকে চলে যা।
পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখে মেয়েটা দ্রুত কেটে পড়ে। এদিকে মানুষ বেশি না থাকায় তেমন ঝামেলা হয় না।

এই মেয়ে তুমি আমার আব্বুর দিকে তাকিয়ে থাকো কেনো?
শ্রেয়সী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। একটা বাচ্চার কন্ঠস্বর শুনে পাশের বারান্দায় তাকায়। শ্রেয়সী ভ্রু কুঁচকে বলে,
আমি কখন তোমার আব্বুর দিকে তাকালাম?

সবসময় আমার আব্বুর দিকে তাকিয়ে থাক। সেদিন আব্বু সিঁড়ি দিয়ে নামছিল তুমি হা করে তাকিয়ে ছিলে।
তোমার আব্বু কে? তোমার আব্বুকে তো আমি চিনিই না।
মিথ্যা বলো কেনো? দাঁড়াও এখনি দেখাচ্ছি আমার আব্বু কে। আব্বু? আব্বু?
আসছি মামুনি।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২

শ্রেয়সীর হাত পা কাঁপছে। তার মনে হচ্ছে সে এখনি পড়ে যাবে। অনুপমের কন্ঠস্বর চিনতে তার একটুও অসুবিধা হলো না। কীভাবে পারলো মানুষটা তাকে ঠকাতে? শ্রেয়সী আর এক মুহূর্তও বারান্দায় দাঁড়ায় না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪