শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২
তাসনিম জাহান রিয়া

কিয়ৎক্ষণের মাঝে জ্ঞান ফিরে আসে শ্রেয়সীর।
অনুপম মৃদু স্বরে বলে,
এই যে জ্ঞান হারানো মেয়ে, তোমার জ্ঞান হারানোর বাটন কী আমাকে দেখেই চালু হয়ে যায়?
ভয় চোখ নামিয়ে নেয় শ্রেয়সী। অনুপম আর কিছু না বলে দ্রুত পা ফেলে চলে যায়। অনুপমের সাথে আসা দুজন শিক্ষকও অনুপমের পিছন পিছন চলে যায়। একটা ম্যাম শ্রেয়সীর মাথায় হাত রেখে বলে,

এখন কেমন লাগছে? পরীক্ষা দিতে পারবে তো?
পারবো ম্যাম।
আবার পরীক্ষা শুরু হয়ে যায় এবং নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শেষ হয়। শ্রেয়সীদের সাত জনের একটা ফ্রেন্ড সার্কেল। চার জন মেয়ে আর তিন জন ছেলে। পরীক্ষা হল থেকে বের হয়েই প্রিয়ন্তি উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
শ্রেয়সী তোর কী বেশি খারাপ লাগছে? সবকিছু ঠিকঠাক লিখতে পারছিলি?
তাদের গ্রুপের ছেলে তিনজনও চলে আসে। মুহিব জিজ্ঞেস করে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তোদের ক্লাসে শুনলাম একটু গন্ডগোল হয়েছিল। শ্রেয়সীর কিছু হয়েছিল নাকি?
আর বলিস না ইয়ার। ম্যাজিসেট্রট আসতেই
শ্রেয়সী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
নিতুর কথায় মিহান হেসে বলে,

আহঃ কী টাইমিং দোস্ত। ম্যাজিসেট্রট আসলো আর আমাদের শ্রেয়সী রাণী জ্ঞান হারালো। এই দোস্ত তুই আবার ম্যাজিসেট্রটের ওপর ক্রাস খাসনি তো?
তন্ময় ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় মিহানের পিঠে। মিহানের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
সবসময় তোর ফাজলামো। এই শ্রেয়সী তুই সব আন্সার করছস তো?
মিহান বিরক্ত হয়ে বলে,

বাল সবসময় থাপ্পড় মারস ক্যান? শ্রেয়সীর যদি সব লেখা শেষ না হতো এতক্ষণে কেঁদে কেঁদে সব ভাসিয়ে দিত। জীবনে অনেক কাহিনী শুনছি, মামা তোমার কাহিনী একদম সুপারহিট। বাসায় গিয়ে দেখবি প্রতিটা চ্যানেলে নিউজ দিচ্ছে শ্রেয়সী নামক এক সুন্দরী রমনী পরীক্ষার হলে সুদর্শন ম্যাজিসেট্রটকে দেখে কাইত।
মিহানের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। শ্রেয়সী কটমট করে তাকায় মিহানের দিকে।ইভা নিজের চশমাটা ঠিক করে বলে,
শ্রেয়সী ম্যাজিসেট্রট তোকে কী বলছে? এক্স ফেল করে দিবে না তো?
ছয় জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে শ্রেয়সীর উত্তর শোনার অপেক্ষায়। শ্রেয়সী এদিক ওদিক দৃষ্টি ভুলাচ্ছে। মিহান ইভার মাথায় চাটি মেরে বলে,

বুঝছ না বলদ ম্যাজিসেট্রটও ক্রাশ খেয়েছে আমাদের শ্রেয়সীর ওপর। মামা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে তলে তলে টেম্পো চালাওনি তো? ঐ হালায় তোর বয়ফ্রেন্ড। বয়ফ্রেন্ডকে ম্যাজিসেট্রট রূপে দেখে চমকে টমকে গিয়ে মটকা মারিসনি তো?
শ্রেয়সী দুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয় মিহানের পিঠে। নাক ফুলিয়ে বলে,
একদম ফাজলামো করবি না আমার সাথে।

দেখতে দেখতে সবগুলো পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। পরীক্ষার পর এক সপ্তাহ কেটে গেলো। শ্রেয়সীদের এই সাতদিন কারো সাথে কারো দেখা হয়নি। দেখা না হওয়ার কারণটা মূলত মিহান। মিহান একদম স্পষ্ট বলে দিয়েছে সে কারো সাথে দেখা করবে না। সাতদিন শুধু ঘুম আর ঘুম।

আজকে তারা সবাই ময়মনসিংহের অলিতে গলিতে ঘুরবে। আজকে দেখা করার আরেকটা রিজন আছে নিতু আর মুহিব তাদের গ্রামে চলে যাবে। প্রিয়ন্তি কিশোরগঞ্জ চলে যাবে। তারা তিনজন হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো।
সবাই প্রথম মিট করবে ব্রিজে এসে।

শ্রেয়সী অনেকক্ষণ ধরে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আজকে একটাও রিকশা পাচ্ছে না। রোদে শ্রেয়সীর মুখ লাল হয়ে গেছে। শ্রেয়সীর সামনে দিয়ে খুব দ্রুত গতিতে একটা মাইক্রো চলে গেলো। চলে যাওয়ার আগে গাড়ির জানালা দিয়ে একটা হাত একটা রুমাল বাতাসে ছেড়ে দিয়েছে। রুমালটা একদম শ্রেয়সীর মুখ বরাবর পড়েছে। শ্রেয়সী রুমালটা হাতে নিয়ে দেখে রুমালে কিছু লেখা। শুভ্র বর্ণের রুমালে লাল রঙের কলম দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,

এই যে, জ্ঞান হারানো মেয়ে রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকো না। তোমার তো আবার হুট হাট জ্ঞান হারানোর অভ্যাস আছে। এখানে তোমাকে হেল্প করার জন্য আমি থাকবো না।
শ্রেয়সী গাড়িটার যাওয়ার দিকে কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শ্রেয়সীর ইচ্ছে করছে গাড়ির ভিতরে থাকা লোকটাকে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতে। একটা খালি রিকশা পেতেই শ্রেয়সী ওঠে বসে।

আজকে সাত জনই শুভ্র রঙের ড্রেস পড়েছে। প্রথমে তার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হইচই করতে করতে নদীর পাড়ে আসে। ঘাসের ওপর সবাই বসে পড়ে। মিহান গিটারে টুং টাং আওয়াজ তুলে।সবাই একসাথে তাল মিলিয়ে গাইতে শুরু করে।

পুরো পৃথিবী একদিকে আর আমি অন্যদিক।
সবাই বলে করছো ভুল আর তোরা বলিস ঠিক।
তোরা ছিলি, তোরা আছিস আর জানি তোরাই থাকবি।
বন্ধুওওও বুঝে আমাকে,
বন্ধুও আছে, আর কী লাগে?

সুসম্পর্ক-দূরসম্পর্ক, আত্নীয়-অনাত্মীয়, শত্রু-মিত্র, রক্ত সম্পর্কে কেউ বা দ্বিতীয় সদা সদূরের কাছে বৈধ-অবৈধ,
হাজারো ঐ সম্পর্ক ভাঙে থাকে শুধু ঐ বন্ধুত্ব।
তোরা ছিলি, তোরা আছিস আর জানি তোরাই থাকবি।
বন্ধুওওও বুঝে আমাকে,
বন্ধুও আছে, আর কী লাগে?

যাওয়ার পথে কেউ কেউ ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে এই প্রাণোচ্ছল বন্ধুদের দিকে। অনেকে দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে তাকাচ্ছে।কেউ কেউ ওদের সাথে তাল মিলাচ্ছে।
গান শেষ হতেই একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে বলে,
এই যে, জ্ঞান হারানো মেয়ে এতো গান গেয়ো না। পরে আবার জ্ঞান হারাবে।

ছেলেটার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। বিরক্তিতে শ্রেয়সীর চোখ মুখ কুঁচকে যায়।মিহান ছেলেটার কথা নকল করে বলে,
এই যে, জ্ঞান হারানো মেয়ে এতো বিরক্ত হয়ো না। পরে আবার জ্ঞান হারাবে।
সবাই আবার হেসে ফেলে। নিতু হাসতে হাসতে বলে,

ভাই এই লোক তো পুরো শহর জুড়ে বলে বেড়াচ্ছে তুই জ্ঞান হারাস। একদিন দেখবি পুরো ময়মনসিংহের মানুষ জানবে তুই হুটহাট জ্ঞান হারাস। মানুষ তোকে দেখেই বলবে, এই যে, জ্ঞান হারানো মেয়ে কেমন আছো? এই যে, জ্ঞান হারানো মেয়ে কোথায় যাও? বিষয়টা ইন্টারেস্টিং।

বিষয়টা আরো ইন্টারেস্টিং হবে যখন দেখবি শ্রেয়সী ঐ লোকটার বউ আর শ্রেয়সী বাসর
ঘরে ঠাস করে অজ্ঞান হয়ে যাবে। লোকটা রোমান্স করতে গেলে শ্রেয়সী অজ্ঞান।
প্রিয়ন্তি চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, ছিঃ অশ্লীল।
মিহান মুখ বাঁকিয়ে বলে, ছিঃ অশ্লীল। আইছে প্রফেসারের মাইয়া। সবকিছুতেই ছিঃ অশ্লীল।
তোরে যে পোলাই বিয়া করবো তার জীবন নাশ নাশ হয়ে যাবে। তোর জামাই যদি বলে, বউ একটা চুমু খাই? তুই বলবি ছিঃ অশ্লীল।

প্রিয়ন্তি।
এই একটা ডাকই যথেষ্ট ছিল প্রিয়ন্তির অন্তর আত্না কাঁপানোর জন্য। প্রিয়ন্তি ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকায়।
প্রিয়ন্তি তুমি এখানে কী করছো?
প্রিয়ন্তি মিনমিন করে বলে, বাবা একটু ঘুরতে এসেছিলাম।
প্রিয়ন্তির বাবাকে দেখে সবাই সালাম দেয়। সবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে প্রিয়ন্তির বাবা গম্ভীর কন্ঠে সালামের উত্তর দেয়। উনি প্রিয়ন্তির বন্ধুদের তেমন একটা পছন্দ করেন না। প্রিয়ন্তিকে মিশতে বারণও করে না। উনি জানেন প্রিয়ন্তির বন্ধুরা একটু বেপোরা হলেও, পড়াশোনায় ভালো আর একজন আরেকজনের জন্য জীবন দিতে পারে।

সিঁড়ি দিয়ে ফোন স্ক্রল করতে করতে উঠছিল শ্রেয়সী। হুট করে একজনের সাথে ধাক্কা লেগে শ্রেয়সীর হাত থেকে ফোনটা ছিটকে নিচে পড়ে যায়। সামনের মানুষটাকে দেখে রেগে আগুন হয়ে যায় শ্রেয়সী। শ্রেয়সী কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনুপম শ্রেয়সীকে একদম ইগ্নোর করে চলে যায়। শ্রেয়সী একটু না অনেটাই অবাক হলো। শ্রেয়সী বিড়বিড় করে বলে,
অদ্ভুত লোক। এমন একটা ব্যবহার করলো যেনো আমাকে চিনেই না। এই কিছুদিন যাবৎ আমাকে জ্ঞান হারানো মেয়ে, জ্ঞান হারানো মেয়ে ডেকে ডেকে হার্ট অ্যাটাক করার উপক্রম করে দিয়েছেন।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ১

ভাইয়া একদম সত্যি করে বলবি?
কী বলবো?
তুই আমার কোন বান্ধবীর সাথে টেম্পো চালাচ্ছিস?
নাহিন চিৎকার করে বলে,
হোয়াট? তুই এসব কী বলছিস? পাগল হয়ে গেছিস? আমি কেনো টেম্পো চালাবো? এতো পড়াশোনা করছি টেম্পো চালানোর জন্য?

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৩