শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৫

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৫
তানিয়া মাহি

পয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাসে সাহিল শেখকে একটু হাসতেও দেখা যায় নি কারো সাথে আলাদা করে কথা বাড়াতেও দেখা যায় নি। তিনি নিজের মতো পড়া বুঝিয়ে গিয়েছেন শুধু।
শুভ্রতা আর ফাউজিয়া নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলির মাঝে শুভ্রতা বলে,
” স্যারের কি হয়েছে বল তো? এমন মন খারাপ করে আছে কেন?”
” কি জানি, একটা বিষয় খেয়াল করে দেখেছিস স্যার আজকে একটুও হাসলো না অথচ প্রতিদিন ক্লাসে কত সুন্দর করে হাসে স্যার।”

” এক কাজ কর স্যার ক্লাস শেষ করে বাহিরে চলে গেলে তুইও যা, গিয়ে জিজ্ঞেস কর তো স্যার কাল কোথায় গিয়েছিল? এমনি হঠাৎ দেখেছিস এটাই বলবি।”
” ব্যাপারটা কেমন হয়ে যাবে না? ”
” কেমন হবে? কেউ দেখলে জানতে চাইতেই পারে সাধারণ ব্যাপার এটা।”
” আচ্ছা ঠিক আছে দেখি ক্লাস শেষ হোক আগে।”
” ঘড়িতে তাকিয়ে দেখ, ক্লাস শেষ। তুই রেডি হয়ে যা।”
” তুইও যাবি আমার সাথে, আমি একা যাব না।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ক্লাস শেষ হলে সাহিল স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে শুভ্রতা আর ফাউজিয়া দুজনই স্যারের পিছু নেয়। কিছুটা গিয়েই ফাউজিয়া সাহিল স্যারকে ডাক দেয়। উনি পিছনে ফিরে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ” কিছু বলবেন?”
ফাউজিয়া বলে, ” স্যার আপনি আমাদের ওদিকে বাসা নিয়েছেন? ভার্সিটির সামনের ওই গোলিতে?”

” হ্যাঁ আপনার বাসা ওদিকেই? জানতাম না তো!”
” হ্যাঁ স্যার ওদিকেই। গতকাল আপনাকে দেখলাম সাদা পাঞ্জাবি পরে ফুল হাতে গোলির মুখের দিকে এগিয়ে আসছিলেন।”
” হ্যাঁ গতকাল গ্রামে গিয়েছিলাম। আমার বাবার কবর দেখতে। গতকাল বাবা মা*রা যাওয়ার পাঁচ বছর হলো। মা তো অসুস্থ একটু তাই মা যেতে পারে নি আমি একাই গিয়েছিলাম।”

সাহিল শেখের কথা শুনে ফাউজিয়া আর শুভ্রতা একে অপরের দিকে তাকায়। তারা কি কিই না ভেবে বসেছিল!
ফাউজিয়া বলে, ” ঠিক আছে স্যার, দেখেছিলাম তো তাই জিজ্ঞেস করলাম। আমরা তাহলে এখন আসি স্যার?”
” ঠিক আছে ক্লাসে যান।”
সাহিল শেখ অফিসরুমের দিকে চলে যায়। শুভ্রতা আর ফাউজিয়াও নিজেদের ক্লাস চলে যায়৷ আজ ক্লাসের মাঝে কোন বিরতি নেই। একটানা তিনটা ক্লাস করে দুইটার মাঝেই বাড়ি ফিরে যাওয়া যাবে। দুজন গিয়ে ক্লাসে বসে।

বাড়িতে রান্নাবান্না হচ্ছে সকালের নাশতা হয়ে যাওয়ার পর থেকেই৷ সবাই কাজে ব্যস্ত আর শাকিরা ফোনটা হাতে নিয়ে একের পর এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে যাচ্ছে। গতকাল যখন রায়হানকে কল দিয়েছিল তখন রায়হান বলেছিল আবার কল দেবে কথা বলবে কিন্তু সে আর কলব্যাক করে নি এমনকি শাকিরা বারবার কল দিয়েও তাকে পায়নি। রাতের একপর্যায়ে রায়হান ফোনটাই অফ করে ফেলেছে।

প্রায় শেষরাতের শুরু অবধি শাকিরা কান্নাকাটি করেছে রায়হানের জন্য। সে কেন এমন করল তার সাথে এটা ভেবে। শাকিরা বসে বসে ভাবছে এমন ব্যবহারের পরও কি কারো আশায় থাকা বোকামি হবে না? পরিস্থিতি হয়তো বলছে কোন আশা নেই ওদিকে কিন্তু তার মনটা ঠিকই চাইছে সে আসুক আর এসে সবার সামনে বলুক সে শাকিরাকে ভালোবাসে, তাকে বিয়ে করতে চায়।

শাকিরা সকালে মনমরা হয়ে বসে ছিল। তখন তার মা আঞ্জুয়ারা বেগম তাকে নাশতা দিতে আসেন। নাশতা শাকিরার সামনে রাখলেই সে একেবারে নাকচ করে দেয় সে খাবে না।
” কি হয়েছে খাবি না কেন?”
” তোমাদের বাড়িতে তো অনেক বেশি খাচ্ছি তাই না? বেশি বেশি খাচ্ছি জন্যই তো আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছো। বিয়েটা হয়ে যাক, যে বাড়িতে বিয়ে হবে ওই বাড়িতেই গিয়ে খাব। এখানে আমি এক ফোঁটা পানিও খাব না। তোমাদের খাবার তোমরা খাও।”

” এসব কোনধরনের কথা শাকির? তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে, বিয়ে দেওয়ার কথা ভাববো না আমরা? গ্রামেই দেখতো ষোলো, সতেরো বছর বয়স থেকেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় তোর বয়স তবু একুশ হয়েছে৷ কোন মা-বাবা চায় না তার মেয়ের ভালো জায়গায় বিয়েটা হোক? ”

” পরে কি ভালো ছেলে পাওয়া যেত না?”
” তুই কাউকে পছন্দ করিস? পছন্দ করলে বল আমি তোর বাবার সাথে কথা বলি ছেলেকে দেখি।”
” পছন্দ! ওসব আমার ভাগ্যে নেই। বিয়ে দিয়ে দাও সবার ভালো হবে। ”
শাকিরা আর কোন কথা না বলে পাশের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আঞ্জুয়ারা বেগম বেশ চিন্তায় পড়ে যান। ভাবতে থাকেন নিজেরা বেশি বেশি করছে না তো? বিয়ে, দেখতে আসা কি চাপিয়ে দিচ্ছে তারা শাকিরার ওপর? পরে সবকিছু হিতে বিপরীত হবে না তো! তিনি ঠিক করেন, দেখতে এসে পছন্দ হলেও আজ কিছুতেই বিয়ে তিনি হতে দিবেন না।

দুপুর একটায় শুভ্রতার ক্লাস শেষ হয়। শুভ্রতা আর ফাউজিয়া দুজন বেরিয়ে আসে ক্লাসরুম থেকে। সিঁড়িবেয়ে নিচে এসে দেখে নিহান দুই হাত বুকে গুজে সামনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতা নিহানকে দেখা মাত্রই সকালের কথা মনে পড়ে যায়। শুভ্রতা একটা শুকনো ঢোক গিলে হাটতে থাকে। এই লোক যদি রেগে তাকে মাথার ওপর তুলে মাটিতে ফেলে দেয় তাহলে তার হাড়গোড় ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। শুভ্রতা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনই নিহান বলে ওঠে,

” আমি নিশ্চয়ই পিঁপড়ের মতো নই যে আমাকে দেখা যাবে না পায়ে মাড়িয়ে চলে যাবি?”
শুভ্রতা দাঁড়িয়ে যায় সাথে ফাউজিয়াও। শুভ্রতার মুখে কোন কথা নেই। ফাউজিয়ে এতক্ষণে খেয়াল করে পাশে নিহান দাঁড়িয়ে আছে। সে হেসে কথা বলে,
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, ভালো আছেন?”
” জি, আপনি কেমন আছেন?”
” আমিও আলহামদুলিল্লাহ । শুভ্রতা বাইকে ওঠ।”

ফাউজিয়া শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে দেখে সে একদম স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে,মুখে কোন কথা নেই। ফাউজিয়া দুজনের মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে তাই সে আর এক মুহূর্ত সেখানে ব্যয় করতে রাজি নয় তাই বিদায় নিয়ে চলে যায়। শুভ্রতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিহান বলে,
” উঠবি নাকি উঠবি না? বেশি বাড়াবাড়ি করলে একদম পিঁপড়ের মতো পিষে মে*রে ফেলব। যে দেখছ কিছু বলছি না নরম হয়ে আছি ওমনি পেয়ে বসেছ তাই না? একদম সোজা এসে বাইকে বসবি নইলে আমিও দেখব তুই বাড়ি কীভাবে যাস আজকে। ”

” আপনি কেন আমার পিছে পড়ে আছেন বলুন তো? বুঝতে পারছেন না কেন আমি কারো সঙ্গ চাইছি না কোন পুরুষের তো নয়-ই”
শুভ্রতা নিহানের দিকে এগিয়ে এসে কথাটা দাতে দাত চেপে বলে আশেপাশে কেউ যেন শুনতে না পায়।
” আমি ছাড়া তোর লাইফে কেউ আসবে না, কোন পুরুষ তোর আশেপাশে ঘেষবে না। সে ব্যবস্থা অতি তাড়াতাড়ি করা হবে চিন্তা করিস না। এখন আপাতত বাইকে বস নইলে এখানে অনেক খারাপ কিছু হয়ে যাবে। এখানে আমার আর না আসলেও চলবে কিন্তু তোর কিন্তু আসতেই হবে। ”

শুভ্রতা আর কথা বাড়ায় না, সে জানে এখানে ভয়া*বহ কিছু সত্যি সত্যি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নিহান বাইকে বসলে শুভ্রতাও গিয়ে পিছে বসে পড়ে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয়, আজ বাবাকে বলতেই হবে নিহানের আচরণের কথা। বাবাকে এটাও জানাতে হবে যেন তিনি নিহানকে নিষেধ করে দেন তার আশেপাশে আসতে।

শুভ্রতা আর স্নিগ্ধা বিকেলের দিকে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নেয়। দুজন রেডি হচ্ছে শাকিরাদের বাড়ি যাবে জন্য। স্নিগ্ধা চুল বাধতে বাধতে বলে ওঠে,
” আপু আমাকে যদি কেউ পছন্দ করে তার সাথে কি আমার রিলেশনে যাওয়া ঠিক হবে?”
ছোটবোনের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয় শুভ্রতা। বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

” তোকে পছন্দ করে কেউ? কে পছন্দ করল শুনি?”
” কেন, আমাকে কেউ পছন্দ করতে পারে না? এমনভাবে বলছিস যেন আমি দেখতে মোটেও ভালো না!”
” ভালো না কে বলেছে কিন্তু তোকে কে পছন্দ করল? ”
” করেছে কেউ, তাকেও আমার ভালো লাগে। এখন বল আমি কি তার প্রোপোজালে হ্যাঁ বলে দেব?”
” আজব, একটা কথা বারবার জিজ্ঞেস করছি যে কে সে, কে সে সেটার উত্তর না দিয়ে কথা বলেই যাচ্ছিস।”
” আমার ক্লাসের একজন।”

শুভ্রতা হাফ ছেড়ে বাঁচে। গতরাতে স্নিগ্ধার মুচকি মুচকি হাসি দেখে ভেবেছিল হয়তো সে নিহান ভাইকে পছন্দ করে। শুভ্রতা একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বলে,
” পড়ছিস অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে, দুই একবছর যেতে না যেতেই তোর বিয়ে আসা শুরু হবে। বাবা মা হয়তো ভালো ছেলে পেলে বিয়েও দিয়ে দিবে। আর এই অবস্থায় তুই ক্লাসমেটের প্রোপোজালে হ্যাঁ বলবি কি না বলবি সেটা জানতে চাইছিস? মাথায় মগজ আছে তোর? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে। ওই ছেলের বিয়ে করতে এখনো ছয় সাত বছর ততদিনে তো দুই তিনটা বাচ্চা হয়ে যাবে।”

স্নিগ্ধা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, ” সেটাও ঠিক বলেছ। আমার বিয়ে করার হেব্বি শখ। বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বললেই বিয়ে করে নেব, পড়তে হবে না আর। বাবা একটা টাকাওয়ালা ছেলে এনে দেবে সারাজীবন আরামে পায়ের ওপর পা তুলে খাব।”

” হয়েছে হয়েছে এবার চল। মা অনেক আগেই যেতে বলেছে শাকিরাদের বাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো লোকজন চলেও আসবে। আর তাছাড়া শাকিরার সাথে আমার একটু কথাও আছে।”
” আচ্ছা আপু, শাকিরা তো রায়হান ভাইয়াকে পছন্দ করতো তাহলে এখানে রাজি হলো কেন?”
” এই এসব কথা আমাকে যা বলেছিস বলেছিস। এই কথা যেন ওই বাড়িতে গিয়ে মুখ দিয়ে না বের হয় বলে দিলাম। চল এখন তাড়াতাড়ি। ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৪

দুজন একসাথে রুম থেকে বের হয়ে বাড়ির দরজা লক করে শাকিরাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়৷ মেয়েটা একা একা কি করছে কে জানে! কি চলছে তার মনের মাঝে? তাকে যদি আজ পছন্দ হয়ে যায় তাহলে কি বিয়েটা হয়েই যাবে? কিন্তু রায়হান! সে কি এ বিষয়ে জানে? নাকি জেনেও কিছু করবে না!

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৬