শেষটা সুন্দর পর্ব ১৫

শেষটা সুন্দর পর্ব ১৫
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

মেহুল’ই হয়তো প্রথম মেয়ে যার কিনা তার শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় খারাপ লাগছে। তারা যাওয়ার পর সেখানে আরো আত্মীয়স্বজন আসেন। আর সবাই তাকে বেশ আদর করে। এই পরিবারের সবাই বেশ মিশুক। মেহুলকে কত সহজেই আপন করে নিয়েছে। এখন সবাই গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাদেরকে বিদায় জানানোর জন্য। অদ্ভুত ভাবে মেহুলের যেন সবাইকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু, এখানে থেকে যাওয়ার আপাতত কোনো উপায় নেই। তাই তাকে যেতে হবে। সবাইকে বিদায় জানিয়ে সে গাড়িতে উঠে বসে। তারপর গাড়ি চলতে আরম্ভ করে। গাড়ি চালাচ্ছে রাবীর। মেহুল তার পাশেই বসেছে। আর পেছনে বসেছে তার মা বাবা।

রাবীরকে বিদায় দিয়ে রামিনা বেগম স্বামীকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। মেহুল চুপচাপ বসে আছে। রাবীর তার দিকে চেয়ে বলল,
‘কী হলো, বাসায় যাবেন না?’
মেহুল মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,
‘আপনার পরিবারের সবাই খুব ভালো। আমার সবাইকে খুব পছন্দ হয়েছে। খালি আমার শাশুড়ি মা আমার গান গাওয়াটাকে সাপোর্ট করলেই সব একদম ঠিকঠাক হতো।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘মা’কে সময় দিন, মেহুল। হয়তো একদিন মাও ঠিক আপনার কথা বুঝবেন।’
‘তার আগে, পরীক্ষার পর যে প্রোগ্রাম আছে সেখানে গান গাওয়ার অনুমতি কিন্তু আপনি দিয়ে দিয়েছেন।’
‘হ্যাঁ, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘মা’র সাথে তাহলে কথা বলবেন, প্লিজ।’
‘ঠিক আছে।’
মেহুল এবার হেসে গাড়ি থেকে নামতে নিলেই রাবীর তার হাত ধরে। মেহুল তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হলো?’

‘আমার মতো এমন প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ মারা গেলে দেশের কিন্তু বেশ ক্ষতি হবে। তাই এভাবে শাড়ি গায়ে হুটহাট চলে আসবেন না। হৃদপিন্ডকে সামলাতে বড্ড কষ্ট হয়। পরের বার শাড়ি পরার আগে আমাকে জানাবেন, আমি তাহলে আগে থেকেই হৃদপিন্ডকে সামলে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখব।’

মেহুল বোকা বোকা চোখে চেয়ে থাকে। কী জবাব দিবে সে? লোকটার এসব কথায় মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ছে তার। উপযুক্ত উত্তর মেলাতে পারছে না। রাবীর তার হাত ছেড়ে দেয়। মেহুল গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। দুকদম এগিয়ে আরেকবার পেছনে আসে। রাবীর তখনও তার দিকে চেয়ে আছে। মেহুল মৃদু হেসে বলে,
‘যদি শাড়ি পরে কাউকে নিহত করা যায়, তাহলে আমি আরো একশোবার শাড়ি পরব। বুঝেছেন, নেতা সাহেব?’
রাবীর উত্তর দেয় না। মেহুল চলে যাওয়ার পর সে আলতো হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

‘তোমার লজ্জা করে না, সাদরাজ আহমেদ; এত সম্পত্তির মালিক হয়েও সামান্য ছয় শতক জমিও তুমি ছাড়ছো না?’
সাদরাজ বরাবরের মতোই তার কুৎসিত হাসিটা হেসে বলে,
‘হোক ছয় শতক, সাদরাজের নজর একবার যেখানে পড়ে সেখানে থেকে সেই নজর আর কেউ সরাতে পারে না।’
রাবীর তার দিকে এগিয়ে আসে। দু হাত পেছনের দিকে নিয়ে একহাত দিয়ে অন্যহাতে আটকে ধরে। চোয়াল শক্ত করে বলে,

‘অন্যের জিনিসের উপর নজর দেওয়ার স্বভাব তোমার কবে যাবে? এই স্বভাবের জন্যই আজ তুমি এতকিছু হারিয়েছো। ভালোই ভালোই এই জমির উপর থেকে তোমার সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলো। নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।’
সাদরাজের কপালের রগ ফুলছে। রাগ যেন চোখে মুখে উপচে পড়ছে তার।
‘আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলার সাহস দেখাবে না, রাবীর। আর বাকি রইল এই জমির কথা? এই জমির উপর থেকে আমার সাইনবোর্ড কখনোই উঠবে না।’

‘আমি কিন্তু আইনী পদক্ষেপ নিব, সাদরাজ।’
‘সাদরাজ কাউকে ভয় পায় না, সেটা তোমার থেকে ভালো হয়তো আর কেউ জানে না।’
রাবীরের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সে রাগের চোটে জমির উপর লাগিয়ে রাখা সাদরাজের সাইনবোর্ডটাতে গিয়ে জোরে লাথি মারে। সাইনবোর্ডটা ডানদিকে হেলে পড়ে। আরো দুইটা লাথি মারতেই সেটা পুরোপুরি বাঁকা হয়ে পড়ে যায়। তা দেখে রাগে টগবগ করছে সাদরাজ। রাবীরকে এই মুহুর্তে এই জমিতেই জ্যান্ত পুঁতে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু, আপাতত সেই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখেছে সে। সামনে তার আরো বড়ো সুযোগ আসবে। এইসব কিছুর বদলা সে হাড়ে হাড়ে নিবে।
রাবীর দাঁত খিঁচে বলে,

‘আজ থেকে এই জমি জনগণের। আর এই জমিতে আমি প্রাইমারী স্কুল বানাব। এই জমিতে ভবিষ্যতেও যদি আর কারোর কুদৃষ্টি পড়েছে তবে তার দৃষ্টি আমি উপড়ে ফেলব। কথাটা যেন মাথায় থাকে।’
রাবীর তার কথা শেষ করে গাড়িতে উঠে যায়। সাদরাজের গায়ের রক্ত গরম হয়ে উঠেছে। সে নিজের রাগকে কন্ট্রোলে নিতে পারছে না। সবকিছু তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার।

পরীক্ষা শেষ আজকে বেশ কিছুদিন হয়ে গিয়েছে। এখন মূলত সামনের প্রোগ্রামে গান গাওয়ার প্রস্তুতি’ই নিচ্ছে মেহুল। সকালে ভার্সিটি গেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয় তার। তারপর খেয়ে দেয়ে এক ঘুম দেয় উঠে রাত নয়টাই। তারপর আবার মা বাবার সাথে কথা বলে, এক মগ কফি খেয়ে সময় কাটে তার। আর রাতে খাওয়ার পর রাবীরের সাথে কথা বলাটা তো আজকাল তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

একদিনও যদি রাবীর ব্যস্ততার কারণে তাকে কল না দেয় বেচারির আর সেই রাতে ঘুম হয় না। রাবীরের কথা ভাবতে ভাবতেই রাত পার হয় তার। মানে কী ভয়ংকর ব্যাপার, ভাবা যায়? সে তো রাবীরের প্রেমে রীতিমত হাবুডুবু খাচ্ছে। অবশ্য কেবল হাবুডুবু না একেবারে ডুবে মরার উপক্রম। আর তার উপর ঐ লোকটার হুটহাট করে বলা বেশরম কথাগুলো শুনলে তো তার আরো আগেই ম’রে যেতে ইচ্ছে করে।

অডিটরিয়ামে বসে অন্য সবার মতোই গানের প্র্যাকটিস করছিল মেহুল। সেসময় সেখানে একজন ছেলে আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘এখানে মেহুল কে?’
মেহুল তার দিকে তাকায়। বলে,
‘এই যে আমি।’
ছেলেটা তার দিকে এগিয়ে যায়। তারপর তার হাতে রাখা বেলি ফুলের গাজরাটা মেহুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘এটা আপনার জন্য।’
মেহুল ভ্রু কুঁচকে তিক্ত সুরে বলে,

‘আপনি আমাকে গাজরা কেন দিচ্ছেন? কে আপনি?’
‘না, আমি আপনাকে গাজরা দিচ্ছি না। কেউ একজন ভার্সিটির গেইটের সামনে এসে এটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের থারটিন ব্যাচের মেহুলকে দেওয়ার জন্য। আর এখানে এত স্টুডেন্ট দেখে মনে হলো সেই মেয়ে এখানে থাকতে পারে। তাই এখানেই এটা নিয়ে এলাম। নিন ধরুন।’
মেহুল গাজরাটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কে এই গাজরা দিয়েছে? সে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা, আপনি ঐ লোকটার নাম জানেন?’

‘দুঃখিত আপু, আমি উনার ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমাকে গাজরা দিতে বলেছেন আর আমি সেটা দিয়ে দিয়েছি, এইটুকুই।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
মেহুল বেশ চিন্তায় পড়ে। পাশ থেকে তার বন্ধুরা মজা করে বলে,
‘এটা নিশ্চয়ই তোর নেতা সাহেবের কাজ।’
মেহুল ভেবে বলে,

‘উনার এত সময় আছে নাকি আমার জন্য গাজরা কিনে পাঠাবে? আর যদি এতোই দেওয়ার ইচ্ছে হতো তাহলে তো নিজেই এসে দিয়ে যেতে পারতেন, এত কাহিনী করার কী দরকার ছিল।’
রিতা তখন বলল,
‘আরে বোকা, ভাইয়া তোকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছেন। তুই তো দেখি কিছুই বুঝিস না।’

শেষটা সুন্দর পর্ব ১৪

ব্যাপারটা এমন হতেই পারে। তবে মেহুলের মনের দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না। তাই সে রাবীরকে কল দিয়ে বসে। আর রাবীরের কল ব্যস্ত দেখায়। রাবীর এই সময় ব্যস্ত থাকে সেটা মেহুল খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু, এত ব্যস্ততার মাঝেও রাবীর কখন এসব করল সেটাই সে বুঝতে পারছে না।

শেষটা সুন্দর পর্ব ১৬