শেষটা সুন্দর পর্ব ৩২

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩২
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

বুধবারের সকাল,
লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে রাবীর বলল,
‘ দেখুন তো ওদের আপনি চিনেন কিনা?’
রাবীরের ফোনের ছবিটা দেখে লোকটা ভয়ে আঁতকে উঠল। অসহায় সুরে বলল,
‘ওদের দয়া করে কিছু করবেন না, স্যার। ওরা কিছু জানে না। ওরা নির্দোষ।’
রাবীর ফোনটা পকেটে রেখে বলে,

‘ওরা যে নির্দোষ সেটা আমিও জানি। কিন্তু, যেহেতু আপনি অন্যায় করেছেন সেহেতু এখন আপনাকেই সেই অন্যায়ের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এখন বলুন,কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত করবেন? সত্য কথাটা বলবেন। নাকি আপনার স্ত্রী আর সন্তানকে কষ্ট পেতে দেখবেন?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লোকটা দুর্বল। কিছু বলতেও আজকাল কষ্ট হয় তার। চোখ মেলে তাকাতেও কষ্ট হয়। তাও নিজের জীবনের চেয়ে সে তার পরিবারকে ভালোবাসে। তার স্ত্রীকে, সন্তানকে ভালোবাসে। সে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আমি এখন কী করব? সত্য বললেও আমার স্ত্রী আর সন্তানের বিপদ। আর মিথ্যে বললেও আমার স্ত্রী আর সন্তানের বিপদ। প্লিজ, ওদের ছেড়ে আপনারা আমাকে মেরে ফেলুন। আমি মরে গেলেই সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে।’
রাবীর রেগে টেবিলের উপর একটা বারি মেরে বলল,

‘সেটা আপনাকে বলতে হবে না। আপনাকে মারার প্রয়োজন বোধ করলে তাই করব। আপনার অনুমতি নিয়ে কিছু করা হবে না। তবে এখন সত্যি না বললে আমরা বাধ্য হব আপনার বউ বাচ্চাকে কষ্ট দিতে। আর যদি সত্য বলে দিন তবে আমি নিজে আপনার শাস্তি মওকুফের ব্যবস্থা করব। তাই দয়া করে এবার সত্যিটা বলুন। কে এসব করেছে? কার কথায় আপনি এসব করেছেন?’

লোকটা এখনো কাঁদছে। সে বলে,
‘সত্যি বলে ছাড়া পেলেও ঐ লোকগুলো তো আর আমাদের ছাড়বে না।’
‘কোন লোকগুলো?’
লোকটা ভয়ে ভয়ে রাবীরের মুখের দিকে তাকায়। সে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। রাবীর তাকে আশ্বস্ত করে বলে,
‘আপনি ভয় পাবেন না। আপনার আর আপনার পরিবারের সুরক্ষা আমি দিব। আপনারা আমার হেফাজতে থাকবেন। তাও দয়া করে সত্যিটা বলুন।’

লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
‘আমাকে আগে এক গ্লাস পানি দিন, প্লিজ।’
রাবীর এক গ্লাস পানি তার দিকে এগিয়ে দিল। লোকটা ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্ত করল। অতঃপর ভীত সুরে বলল,

‘এইসব কিছু আমি সাদরাজ আহমেদের কথায় করেছি। উনি আমাকে ভয় দেখিয়ে এসব করিয়েছেন। আমি কখনোই এমন কিছু করতাম না। কিন্তু, উনি বলেছেন, আমি যদি উনার কথায় রাজি না হই তবে উনি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে মেরে ফেলবেন। আর আমি সেই ভয়েই এসব করিছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন, স্যার। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।’
রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অফিসারের দিকে চেয়ে বলে,

‘আর কোনো প্রমান লাগবে, অফিসার? আশা করছি এবার আপনারা উনার বিরুদ্ধে সঠিক স্টেপ নিবেন।’
অফিসার বললেন,
‘হ্যাঁ, তা এবার নিতেই হবে। উনি কেবল রাজনৈতিক শত্রুতার জেরে এতগুলো মানুষের ক্ষতি করতে পারেন না। আমি উনাকে এরেস্ট করব। তার আগে এইসব কিছুর একটা লিখিত জবানবন্দি নিতে হবে।’
‘যা করার তাড়াতাড়ি করুন।’

‘স্যার, আমার বউ বাচ্চার কোনো ক্ষতি হবে না তো?’
রাবীর লোকটার কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। ওরা এই কয়দিন আমার হেফাজতেই থাকবে। আর সেখানে ওদের কোনো ভয় নেই। যেহেতু আপনিও অন্যায় করেছেন। সেহেতু কোর্টে তো আপনাকেও যেতে হবে। তবে আমি চেষ্টা করব, আপনার শাস্তি মওকুফ করানোর জন্য। আর হ্যাঁ, কোর্টে গিয়েও কিন্তু আপনি সব সত্যি কথাই বলবেন। নাহলে শাস্তি কিন্তু আপনাকেই পেতে হবে। বুঝতে পেরেছেন?’
‘আচ্ছা, স্যার।’
‘আর অফিসার, আমি সাদরাজ আহমেদের নামে এখনই মামলা দায়ের করব। আপনি সেই ব্যবস্থা করুন।’

পরপর দুবার কলিং বেলের শব্দে মেহুল বিরক্ত হয়ে তার রুম থেকে বের হয়। মা কোথায়, দরজা কেন খুলছে না। সে রান্নাঘরে গিয়ে মা’কে পায় না। হয়তো ওয়াশরুমে। পরে সে নিজেই যায় দরজা খুলতে। তবে দরজা খুলে রীতিমতো ভুত দেখার মতো চমকে যায় সে। বিস্ময়ে যেন বাকরুদ্ধ। দরজার উপারের লোকটি হেসে বলল,
‘কী হলো, চমকে গিয়েছেন নাকি?’
মেহুল হতভম্ব হয়ে বলল,
‘আপনি এখানে?’

‘জি, এইদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, আপনার বাবাকে একবার দেখে যাই। তা, আমাকে ভেতরে আসতে বলবেন না।’
মেহুল মেকি হেসে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভেতরে আসুন।’
সাদরাজ ভেতরে প্রবেশ করে। মেহুল মৃদু হেসে বলে,
‘আপনি বসুন। আমি মা বাবাকে ডেকে আনছি।’

সাদরাজও হেসে সম্মতি জানাল। মেহুল রুম থেকে বেরিয়ে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই লোকটা এখানে কী করে এল। তার বাড়ির ঠিকানা সে কীভাবে পেল। পরে তার মনে পড়ে, সেদিন তো কথার ছলে সে নিজেই তো বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিল। উফফ, এবার এসব রাবীর জানলে কী হবে কে জানে। ঐ সাদরাজকে তো খুন করবেই সাথে তাকেও আস্ত গিলে খাবে।

রামিনা বেগম তখন রান্নাঘরে যাওয়ার সময় মেয়েকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন,
‘কিরে, এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
‘মা, সাদরাজ এসেছেন।’
‘কে সাদরাজ?’
‘আরে মা, ভুলে গেলে? ঐ লোকটা, বাবাকে যিনি রক্ত দিয়েছিলেন।’
‘ওহহ, ঐ ছেলেটা! আমাদের বাসায় এসেছে নাকি?’

‘হ্যাঁ, বাবার সাথে দেখা করতে।’
‘ভালো তো। কিন্তু, ও আমাদের বাসার ঠিকানা কোথায় পেয়েছে?’
‘ঐ সেদিনই আমি কথার ছলে বলেছিলাম আরকি আমরা এখানে থাকি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, তুই গিয়ে তোর বাবাকে বল। আমি ওর জন্য নাস্তা নিয়ে যাই।’
‘আচ্ছা।’

‘তোমাকে দেখে কিন্তু আমি খুব খুশি হয়েছি, বাবা।’
সাদরাজ হেসে বলল,
‘আপনাকে দেখে আমার আরো বেশি ভালো লেগেছে, আংকেল। আপনাকে এতটা সুস্থ দেখে সত্যিই আমি খুব আনন্দিত।’
‘সেদিন তুমি ছিলে বলেই তো আজ আমি সুস্থ। নাহলে কী যে হতো।’
‘কিছুই হতো না। আমি না থাকলে আল্লাহ অন্য কাউকে আপনার সাহায্য করতে পাঠিয়ে দিতেন। আচ্ছা আংকেল, আপনার আর এখন রক্ত নিতে হয়না। আমি তো মেহুলের কাছে আমার কার্ড দিয়েছিলাম আমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য। কিন্তু, উনিও তো আর কোনো যোগাযোগ করলেন না।’

‘না না বাবা, চিন্তা করো না। রক্ত নিয়ে এখন আমাদেরও আর ভাবতে হয় না। আমার তো একটা ছেলেও আছে। আমার মেয়ে জামাই। ও সবকিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছে। এখন আর রক্ত নিয়ে আমাদের কষ্ট করতে হয় না।’
‘আচ্ছা। উনার কথা অবশ্য আমি মেহুলের কাছ থেকে শুনেছি। বেশ বড়ো রাজনীতিবিদ।’
‘হ্যাঁ। তুমি নাও না। চা নাও। কিছুই তো খাচ্ছো না।’
‘না, এই তো খাচ্ছি। আপনিও নিন। আন্টি, আপনিও নিন না।’

‘আমরা খেয়েছি, বাবা। তুমি খাও।’
‘উম্ম, মেহুলকে তো দেখছি না। উনি কোথায়?’
‘আছে হয়তো, নিজে রুমে বসে আছে।’
‘ওহহ, আচ্ছা।’

মেহুল রাবীরকে কখন থেকে কল করছে। কিন্তু, তার কল উঠানোর কোনো নামই নেই। ইশ, রাবীরকে এখন যেকোনো উপায়ে এখানে আনতে হবে। দুজনকে এখন মুখোমুখি করতে পারলেই একটা ধামাকা হয়ে যাবে। কিন্তু, এই লোকটা কাজের সময় কেন কল ধরে না কে জানে।মেহুল কলের উপর কল দিয়েই যাচ্ছে। একসময় কল রিসিভ হয়। মেহুল কিছু বলার আগেই রাবীর বলে,

‘আমি একটু ব্যস্ত আছি, মেহুল। পরে কল করছি।’
‘আরে শুনুন শুনুন। কল কাটবেন না। জরুরি কথা আছে।’
‘কী একটু তাড়াতাড়ি বলুন।’
‘সাদরাজ আহমেদ আমাদের বাসায় এসেছেন?’
রাবীর সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে বলে,
‘কী?’

‘হ্যাঁ, আপনি তাড়াতাড়ি এখানে আসুন।’
রাবীর চোয়াল শক্ত করে কর্কশ সুরে বলে,
‘ফোন রাখুন। আমি এক্ষুনি আসছি।’

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩১

মেহুল কল কেটে দিয়ে মনে মনে হাসে। সাদরাজ যখন আজ সরাসরি রাবীরের মুখের সামনে পড়বে তখন জানি বেচারার কী অবস্থা হয়। হয়তো বোকা হয়ে যাবে। বিস্ময়ে আর কথাই বলতে পারবে না। আর রাবীর, তাকে নিয়ে তো আবার দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। সে আবার রাগের মাথায় কিছু করে না বসে।

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৩