শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৭

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৭
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

“এত বড়ো নেতার বিয়ে, সাংবাদিক তো আসবেই।”
আশেপাশে এমনই সব গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সাংবাদিক দেখে অনেকেই বেশ উৎসুক। অনেকে আবার এমন একটা ভাব নিয়ে আছে যেন, তাদের এসবে বড্ড জ্বলছে। সাংবাদিকরা সব মেহুল অর রাবীরকে প্রশ্ন করতে ব্যতিব্যস্ত। যদিও সব প্রশ্নের উত্তর কেবল রাবীর’ই দিচ্ছে। মেহুলের মাথায় এমনি বিশাল দুশ্চিন্তা। তার উপর এখন আবার সাংবাদিকের এত এত প্রশ্নে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে সে। না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। রাবীর বুঝতে পারছে ব্যাপারটা। তাই সে বেশি সময় না নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলল,

‘প্রশ্নের পালা শেষ হয়ে থাকলে এবার আপনারা গিয়ে খেতে বসুন। আসলে মেহমানরাও অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছেন। উনাদেরও একটু সময় দিতে হবে।’
একজন সাংবাদিক তখন বললেন,
‘জি, আমরা অবশ্যই খেতে বসব। তবে শেষ একটা প্রশ্ন; আপনার ওয়াইফ আপনাকে রাজনৈতিক ব্যাপারে কতটুকু সাপোর্ট করেন? আপনার এত ব্যস্ততায় উনার কোনো অভিযোগ নেই?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাবীর প্রশ্ন শুনে মেহুলের দিকে তাকাল। বলল,
‘এই প্রশ্নের জবাব আমার ওয়াইফ’ই ভালো দিতে পারবেন।’
মেহুল হালকা হাসার চেষ্টা করল। মৃদু সুরে বলল,

‘আমার উনার কিছুতেই কোনো অভিযোগ নেই। আর ভালো কাজে তো সবাই সাপোর্ট করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে উনি উনার এত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে যতটুকু সময় দিচ্ছেন আমি তাতেই খুশি।’
‘আর ম্যাডাম, আপনিও কি সবকিছুতে স্যারের সাপোর্ট পাচ্ছেন? মানে আপনার সব ইচ্ছা অনিচ্ছাতে?’
মেহুল রাবীরের দিকে তাকায়। রাবীরও তার দিকে চেয়ে আছে। রাবীর জানে মেহুলের উত্তর কী হবে। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে মেহুল বলল,

‘জি, উনিও আমার সবকিছুকে সাপোর্ট করেন। অবশ্যই সেটা যদি আমার জন্য ভালো হয় তবে।’
‘ঠিক আছে ম্যাডাম। আমরা আর বিরক্ত করব না। এবার আপনারা আপনাদের বিয়ে এনজয় করুন।’
রাবীর একজনকে ডেকে বলল, সব সাংবাদিকদের খাবার টেবিলে বসানোর জন্য।
তারপর সে গিয়ে আবার মেহুলের পাশে বসে। মেহুলের চোখে মুখে এখনো চিন্তার ছাপ। রাবীর জিজ্ঞেস করল,

‘রিতার ফোন এখনো বন্ধ?’
মেহুল অসহায় সুরে বলে,
‘হ্যাঁ।’
‘কোনো সমস্যায় পড়েছে নাকি?’
‘আমিও তাই ভাবছি। নয়তো এমনি এমনি ও কেন উধাও হয়ে যাবে? ঐ দেখুন, রিতার মা বাবাও কেমন অস্থির অস্থির করছেন। উনারাও ভীষণ দুশ্চিনায় আছেন।’
‘আচ্ছা, কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুর বাড়ি যায়নি তো?’

‘গেলে অবশ্যই বলে যেত। এভাবে না বলে কয়ে চলে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই।’
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক। আচ্ছা, আপনি উনার ফোন নাম্বার’টা দিন। আমি আমার পরিচিত একজনকে পাঠিয়ে রাখি, উনি লোকেশেন ট্র্যাস করতে পারবেন।’
‘তাই? দাঁড়ান দিচ্ছি।’
রাবীর তার পরিচিত ব্যক্তিকে রিতার ফোন নাম্বার’টা পাঠিয়ে দেয়। মেহুলকে আশ্বস্ত করে বলে,
‘এবার ঠিক একটা খোঁজ পাওয়া যাবে। আর চিন্তা করবেন না।’

বিয়ে তো আগেই হয়ে গিয়েছিল। আজ কেবল খাওয়া দাওয়া আর পরিচিত পরিজনদের সাথে সাক্ষাতের পর্বটা সমাপ্তি হয়েছে। রাবীরের বাড়ি থেকেও খুব বেশি আত্মীয় আসেনি। রাবীর’ই বারণ করেছিল। সে বলেছে, আত্মীয়স্বজন যা আসবে সব তার রিসিপশনে। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে এত ঝামেলার কোনো দরকার নেই। তাই খুব কাছের মানুষদের উপস্থিতিতেই সবকিছু সম্পন্ন হয়েছে।

মেয়ে বিদায়ের পালা। এইসময় মায়ের চোখের বাঁধ ভাঙে। রামিনা বেগম অঝোরে কাঁদছেন। উষ্ণ জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মেহুলের বাবা খুব শক্ত মানুষ। সহজে কাঁদেন না। তবে তিনিও আজ কাঁদছেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এই কান্নার, এই বেদনার অন্ত নেই। যত কাঁদবে তত আরো কান্না পাবে। মেহুলও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বেচারি যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। তার এখন রিতার জন্যও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা এখন কেন তার পাশে নেই। তার তো আজকে এখানে, তার পাশে থাকার কথা ছিল। তবে সে কেন নেই? মেহুল কাঁদতে কাঁদতে মা’কে বলে,

‘মা, রিতা এখনো কেন আসছে না? ওর কী হয়েছে মা? ও কোথায় গিয়েছে?’
রামিনা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে বোঝাচ্ছেন। রিতার মাও ঐদিকে কাঁদছেন। রিতার বাবা আরো আগেই বেরিয়ে গেছেন মেয়ের খুঁজে।
আশেপাশের সবাই এখন অবাক হচ্ছে। রিতা কে? নতুন বউ রিতার জন্য কেন কাঁদছে? রাবীরের মা গিয়ে তাকে এই প্রশ্নটাই করে। রাবীর মা’কে সব খুলে বলে। তিনিও অবাক হয়ে বলেন,

‘ওমা, জলজ্যান্ত একটা মেয়ে সকাল থেকে উধাও!’
‘হ্যাঁ, মা। এইজন্যই তো মেহুলের মন সকাল থেকেই এত খারাপ। মেয়েটা রিতার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে।’
‘রিতার মা বাবা জানেন?’
‘হ্যাঁ, ঐ যে উনার মাও কাঁদছেন।’
রাবীরের মা’র ভীষণ মায়া হয়। তিনি মেহুলের কাছে গিয়ে বলেন,

‘মা, কষ্ট পেও না। তোমার বান্ধবী ঠিক চলে আসবে। হয়তো কোনো সমস্যার কারণে কোথাও আটকে পড়েছে। চলে আসবে মা। আর কাঁদে না। এবার তো আমাদের যেতে হবে, তাই না। উঠো মা, উঠো।’
তিনি মেহুলকে বসা থেকে ধরে দাঁড় করান। মেহুল ধীর পায়ে রিতার মায়ের কাছে যায়। ভাঙা গলায় বলে,
‘রিতা চলে আসবে আন্টি। আমি খুঁজে নিয়ে আসব ওকে। আপনি চিন্তা করবেন না, ও চলে আসবে।’
রিতার মা কিছু বলেন না। তিনি শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে কাঁদেন।

চাচি মেহুলকে ধরে ধরে সেন্টারের বাইরে নিয়ে যায়। মেহুলের বাবা মেয়ের হাত রাবীরের হাতে দিয়ে বলেন,
‘আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো, বাবা। ও আমাদের একমাত্র সম্পদ। আজ সেই সম্পদকে আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি আমাদের সম্পদের যত্ন নিও।’
রাবীর স্মিত হেসে বলে,

‘জি, চিন্তা করবেন না। নিজের সবটুকু দিয়ে উনাকে আমি ভালো রাখার চেষ্টা করব।’
মেহুল বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর দুজন তাদের মা বাবাকে সালাম করে। অতঃপর যখন গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক সেই সময়ই একটা গাড়ি আসে। গাড়িটা দেখে সবার মনোযোগ সেদিকেই যায়। রাবীর ভ্রু কুঁচকায় গাড়িটা দেখে। গাড়িটা তার চেনা চেনা লাগে। একটু পর গাড়ি থেকে নেমে আসা ব্যক্তিটাকে দেখে রাবীর যেন আরো বিস্মিত হয়। সাদরাজ এখানে কেন? মেহুলও স্তব্ধ। সাথে তাদের মা বাবাও। সাদরাজের মুখে চওড়া হাসি। যেন খুব দামি বস্তু সে জিতে নিয়েছে। রাবীর ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,

‘তুমি এখানে কেন?’
‘মিষ্টি খাওয়াতে এসেছি।’
সাদরাজের মুখে অদ্ভুত হাসি। রাবীর অবাক হয় তার কথা শুনে। সাদরাজ হেসে বলে,
‘অবাক হচ্ছো? তা তো হবেই। দাঁড়াও, একটা সারপ্রাইজ দেই। কোথায়? আমার একমাত্র ওয়াইফ, মিসেস সাদরাজ আহমেদ? এসো।’
সবাই হতভম্ব হয়ে গাড়ির দিকে তাকায়। সাদরাজ এর বউ?

গাড়ি থেকে একটা মেয়ে নামল। মেয়েটার চোখে মুখে ভয় আর অস্থিরতা। তাকে দেখা মাত্রই মেহুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে। গলায় কথা জড়িয়ে আছে। মুখ দিয়ে তবুও কিছু বের হচ্ছে না। সাদরাজ মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে। তাকে নিয়ে এসে সবার সামনে দাঁড়ায়। আগের মতোই হেসে বলে,
‘সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই, আমার ওয়াইফ; মিসেস রিতা আহমেদ।’
রিতার মাও বাকরুদ্ধ। আত্মীয়স্বজন যেই কয়জনই আছেন সবাই’ই যেন বিস্ময়ে কিছু বলতে পারছেন না। এখানে কী হচ্ছে, সবকিছু তাদের ধারণার বাইরে। রিতার মা মেয়ের কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

‘এসব কী, রিতা?’
রিতা জবাব দেয় না। তিনি চিৎকার করে বললেন,
‘কী হলো, চুপ করে আছিস কেন? বল, কী এসব? তুই বিয়ে করেছিস? পালিয়ে বিয়ে করেছিস? এত বড়ো সাহস তোর?’
এই বলে তিনি তাকে চড় মারতে উদ্যত হতেই সাদরাজ উনার হাত ধরে ফেলে। সে বলে,
‘উঁহু শাশুড়ি মা, আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলার সাহস দেখাবেন না। ও যা করেছে আমার ইচ্ছাতেই করেছে। ও এখন আমার স্ত্রী। তাই ভুলেও ভবিষ্যতে এমন কিছু করতে যাবেন না।’

রিতার মা’র শরীর আষাঢ় হয়ে এল। তিনি এক কোণে গিয়ে বসে পড়লেন। তার মেয়ে যে এমন কিছু করতে পারে তিনি তা কখনো কল্পনাও করেননি।
রাবীর আর নিরব থাকতে পারে না। সে রিতাকে জিজ্ঞেস করে,

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৬

‘রিতা, সত্যিই আপনি সাদরাজকে বিয়ে করেছেন? নিজের ইচ্ছাতেই করেছেন, নাকি ও আপনাকে ভয় দেখিয়েছে? দেখুন, আপনি ভয় পাবেন না। সত্যিটা বলুন। আমরা আছি সবাই।’

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৮