শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৮

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৮
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

রিতা মাথা নুইয়ে নরম গলায় বলল,
‘আমি নিজের ইচ্ছেতেই বিয়ে করেছি। কেউ আমাকে জোর করেনি।’
রিতার মুখের কথা আর তার চোখের ভাষা এক না। রাবীর সেটা বেশ বুঝতে পারছে। সে মেহুলের দিকে তাকায়। মেহুল এখনো অবাক হয়ে রিতাকে দেখছে। বিশ্বাস যেন এখনো তার ধারে কাছে ঘেষছে না। সাদরাজ এবার বলল,
‘মেহুল, আপনি খুশি নন? আপনার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড বিয়ে করেছে, আর আপনি তাতে খুশি হওয়ার বদলে এমন মনমরা হয়ে আছেন কেন?’

মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে সাদরাজের দিকে তাকায়। রিতাও ভীত চোখে তাকায় তার দিকে। সাদরাজ হেসে বলে,
‘দোয়া করবেন আমাদের জন্য। আর রাবীর খান, তোমাদের জন্যও আমার অনেক অনেক দোয়া রইল। সুখে সংসার করো। আর তোমাদের সংসারে যেন কারো নজর না লাগে।’
তারপর সে রিতার দিকে চেয়ে বলে,
‘তোমার আর কিছু বলার আছে? নাহলে আমাদের এখন যেতে হবে।’
রিতা ভয়ে ভয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমি একটু মায়ের সাথে কথা বলব।’
‘ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি কথা বলে এসো।’
রিতা এক পা দু পা করে মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। তার মা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছেন। রিতা মায়ের পায়ের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। কান্না ভেজা স্বরে বলে,
‘আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।’

তিনি কোনো কথা বলেন না। শক্ত হয়ে বসে রইলেন কেবল। মায়ের কাছ থেকে কোনোরূপ উত্তর না পেয়ে রিতা উঠে দাঁড়ায়। সে মেহুলের কাছে যায়। তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শব্দ করে কেঁদে ফেলে। মেহুলও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সেও রিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘এমনটা কেন করলি? তুই তো সিয়ামকে পছন্দ করতি। তাহলে?’

রিতা কিছু বলতে পারে না। সে শব্দ করে কেঁদে চলছে।সাদরাজ বলে,
‘রিতা সিয়াম নামের কাউকে পছন্দ করতো না। আর করেও থাকলে সেটা তার অতীত। আর নতুন বিয়ে হওয়া হাজবেন্ডের সামনে তার ওয়াইফের অতীতকে টেনে না আনাই ভালো। রিতা, হয়েছে তোমার? এবার গিয়ে গাড়িতে বসো।’
মেহুল রেগে বলল,

‘আপনি কি ভেবেছেন, আপনার ষড়যন্ত্র আমরা বুঝি না? আপনি এসব রিতাকে ভয় দেখিয়ে করিয়েছেন। ও না হয় কখনোই আপনাকে বিয়ে করতো না। আপনার মতো একটা খারাপ মানুষকে কি কেউ জেনে শুনে বিয়ে করবে? জীবনেও করবে না। আর আপনি যদি আমার বান্ধবীর সাথে এইটুকুও অন্যায় করেন তাহলে আমি কিন্তু আপনাকে আর ছেড়ে কথা বলব না।’
সাদরাজ শব্দ করে হাসে। বলে,
‘ভয় পেয়েছি মিসেস খান, ভীষণ ভয় পেয়েছি। সেসব পরে দেখা যাবে। আগে তো আমরা আমাদের নতুন জীবন শুরু করি। রিতা, এবার চলো।’

এই বলে সে রিতার হাত টানতে টানতে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। আর রিতা পুরোটা সময় পেছনে তাকিয়ে কাঁদতেই থাকে। মেহুলেরও ওকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়। রাবীরের সারা শরীর রাগে রি রি করছে। তার সাথে শত্রুতা মেটাতে সাদরাজ কি শেষে রিতাকে বিয়ে করেছে? আর তাছাড়া রিতাকে বিয়ে করার ওর আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? সে ভীষণ চিন্তায় পড়ে।
মেহুল রিতার মা’র কাছে যায়। উনাকে বোঝায়। কিন্তু, তিনিও তো বুঝতে পারছেন তার মেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রিতার মুখে সাদরাজের কথা তিনিও শুনেছেন। মেয়ের জন্য কষ্টে উনার বুকটা এখন খা খা করছে। রাবীর বলে,

‘আন্টি, চিন্তা করবেন না। সাদরাজ রিতার সাথে কোনো অন্যায় করতে পারবে না। যদি এই বিয়েটা সত্যিই রিতার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে হয়ে থাকে তবে আমরা এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিব। রিতার কিছু হবে না আন্টি। আপনি ধৈর্য্য ধরুন। আর আংকেলকেও বুঝিয়ে বলবেন।’
মেহুল তার মায়ের কাছে গিয়ে বলে,

‘মা, তুমি আন্টিকে বাড়ি পৌঁছে দিও। আর আংকেলকেও তুমি সবকিছু বুঝিয়ে বলো। আমি রিতার সাথে কথা বলব। ওর সাথে কোনো খারাপ কিছু আমি হতে দিব না।’
‘ঠিক আছে মা। তুই নিশ্চিন্তে যা। আমি আপার সাথে আছি।’
এমন একটা খারাপ পরিস্থিতিতে মেহুলের এই জায়গা ছেড়ে যেতেও খারাপ লাগছে। কিন্তু, আজ তো তাকে যেতেই হবে। তাই অবশেষে মা বাবাকে বিদায় দিয়ে সে তার গন্তব্যের দিকে রওনা দিল।

মেহুলের শ্বশুরবাড়ি ভীষণ সুন্দরভাবে সাজানো গুছানো। চারদিকে আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে। শ্বশুরবাড়িতে রাবীরের কিছু কাজিন আছে। তারাই মেহুলকে নিয়ে রাবীরের রুমে যায়। রাবীরের রুমও সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখা। বিছানা জুড়ে ফুলের মেলা বসেছে যেন। একটা তীব্র বেলি ফুলের ঘ্রাণ এসে তার নাকে ঠেকছে। সবকিছু আজ ভীষণ আনন্দের হতো যদি না রিতার সাথে এই অন্যায়টা হতো। সে আজ এত আনন্দের মাঝে থেকেও নিরস। মনে কোথাও একটা দুশ্চিন্তার আর ভয় কাজ করছে। সাদরাজ রিতার সাথে খারাপ কিছু করবে না তো? তার এতকিছুর পেছনে কী উদ্দেশ্য কে জানে?

রাবীরের একজন কাজিন, বয়সটা হয়তো মেহুলের’ই মতো; সে আলমারি থেকে একটা শাড়ি এনে বলল,
‘ভাবি, মামি বলেছেন এখন শাড়ি চেঞ্জ করে এই শাড়িটা পরার জন্য। তুমি কি শাড়ি পরতে পারো, নাকি আমরা হেল্প করব?’
‘না, আমি পারব।’
‘আচ্ছা, আর শাড়ির সাথে এই গয়নাগুলোও পরতে বলেছেন।’
‘আচ্ছা।’

তারা সবকিছু মেহুলকে বুঝিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মেহুল ভেতর থেকে দরজা আটকে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। নিজেকে আয়নায় দেখে রিতার কথা মনে পড়ে তার। মেয়েটাও তো এইভাবে বউ সাজতে চেয়েছিল। একটা সুন্দর সুষ্ঠ বিয়ে চেয়েছিল। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। এমনটা তো না হলেও পারতো। এইসব কিছুর সাথে সাদরাজ রিতাকে কেন জড়ালো? এই মেয়েটার কী দোষ? ওর সাথে এমন অন্যায় না হলেও তো পারতো।

মেহুল ওয়াশরুমের দরজা খুলে বাইরে বেরুতেই চমকে যায়। রাবীরও হঠাৎ তাকে দেখে অবাক হয়। রিতা বুঝতে পারেনি রাবীর যে এখন রুমে থাকতে পারে। তাই সে কোনোরকমেই শাড়ি পেঁচিয়ে চলে এসেছে। যার দরুন শরীরের অনেক অংশ’ই দৃশ্যমান তার। রাবীরও ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। দরজা লক ছিল, চাবি তো তার কাছে সবসময়ই থাকে তাই ঢুকে পড়েছে। ওয়াশরুমে পানির শব্দ শুনে সে বুঝতে পেরেছিল মেহুল ভেতরেই চেঞ্জ করছে। কিন্তু এখন সে মেহুলকে এভাবে দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মেহুল লজ্জা পেয়ে আবার ওয়াশরুমে যেতে নিলে রাবীর বলে,

‘আপনি রুমে আসুন। আমি বাইরে যাচ্ছি।’
সে বাইরে চলে যায়। মেহুল পেছন থেকে ডেকে বলে,
‘নক করা ছাড়া রুমে ঢুকবেন না, প্লিজ।’
‘ঠিক আছে।’
রাবীর বেরিয়ে যেতেই মেহুল গিয়ে দরজা লক করে দেয়।

সবকিছু ঠিকঠাক মতো পরে সে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দেয়। রাবীর বাইরে নেই। আশেপাশে আর কাউকেই সে দেখতে পায় না। তাই আবার ভেতরে গিয়ে বিছানায় বসে। মা’কে কল করে। জানতে পারে রিতার মা’কে তিনি ঠিকঠাক মতো বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। আর রিতার বাবার সাথেও তিনি কথা বলেছেন। উনারা ভীষণ উদ্বিগ্ন। আর তা তো হবারই কথা। একমাত্র মেয়ে উনাদের। চিন্তায় চিন্তায় মানুষগুলো অসুস্থ না হয়ে পড়ে।
মায়ের সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই রাবীরের সেই কাজিন এসে বলে,

‘ভাবি, রেডি তুমি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা। নিচে চলো, মামি খেতে ডাকছেন।’

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৭

মেয়েটা মেহুলকে নিয়ে নিচে যায়। রাবীরও সেখানেই ছিল। তার নতুন বউয়ের দিকে চোখ পড়ে তার। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরেছে। মাথায় ঘোমটা টেনে ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। তাও অসভ্য ঘোমটা যেন থাকতেই চাইছে না। রাবীরের চোখে যেন এই মেয়েটা পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর নারী; যাকে দেখলে মনে মায়া না বরং নেশা জাগে।

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৯