সঞ্চারিণী পর্ব ২৮+২৯+৩০

সঞ্চারিণী পর্ব ২৮+২৯+৩০
আফনান লারা

হোটেল ম্যানেজমেন্টের লোকেরা ভেবেছিল শাওন আর মেধা নিউ কাপল।তাই তারা হানিমুন প্যাকেজে স্পেশাল ডিস্কাউন্ট দিয়ে রুম সার্ভিসের লোকের হাতে কার্ড পাঠালো।নক হওয়ায় শাওন উঠে আসলো দরজা খুলবে বলে।মেধা বিছানার স্ট্যান্ডের সঙ্গে মাথা হেলান দিয়ে বসে ছিল।শাওন লোকটার হাত থেকে কার্ড নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।কার্ডের লেখা পড়া মেধার দিকে তাকিয়ে বললো,’ওরা আমাদের হাসবেন্ড ওয়াইফ মনে করছে।হাস্যকর!’
মেধা চুপ করে থাকলো।শাওন কার্ডটা ছেলেটার হাতে ফেরত দিয়ে ক্যানসেল করে নাস্তার অর্ডার দিয়ে আবারও দরজা লাগালো।এবার সে মেধার পাশে এসে বসলো।মেধা পা ভাঁজ করে একটু সরে বসে বললো,’আমি বললাম তো রেদোয়ানকে আমি মারিনি,যদি মারতাম তাহলে রকি আমাকে কেন বাঁচাতে চাইবে বলুন?তার ভাইকে মেরেছি আমি, তার তো আমাকে দেখলেই মেরে ফেলার কথা।’

শাওন মেধার বুলেট লাগা হাতটা ধরে বললো,’হুম সেটাই।শুধু শুধু কেউ কাউকে এত ইম্পরট্যান্স দেয় না।নিশ্চয় তোমার সঙ্গে জড়িত এমন কিছু আছে যেটা কিনা রকির দূর্বলতা।আর তাই সে তোমাকে রেখে আমাদের সব অফিসারের উপর হামলা চালাচ্ছে’
মেধা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,’তো দেখুন আমার কাছে কি আছে।খুঁজুন!আন্দাজে কাউকে ব্লেম করার আগে ভেবে দেখুন দোষারোপ করাটা আদৌ ঠিক হচ্ছে কিনা।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শাওন আবারও হাতটা ধরে ফেলেছে।মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’শুরু থেকে আমার মনে ঘটকা লেগে ছিল।তোমার প্রথমে বোকা হওয়ার নাটক।তারপর একের পর এক তোমার রুপ সম্পর্কে জেনে যাওয়া।হঠাৎ করে বোকাসোকা মেয়েটার নাম বদলে সঞ্চারিণী হয়ে উঠলো।এই সঞ্চারিণীকে আমি নিজে বোকা,সব চেয়ে দূর্বল ভাবতাম।অথচ আমার ধারণার বাহিরে ছিল, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসবে।হয়ত রেদোয়ানের সঙ্গে তোমার পুরোনো শত্রুতা ছিল,আর নয়ত আশা তোমার কাছের কেউ ছিল।যার কারণো প্রতিশোধ নিতে তুমি রেদোয়ানকে মেরেছো।আমি জানি তুমি স্বীকার করবেনা।ঐ কোণাটা দেখছো?ঐ যে সামনের দরজার উপরে কালো করে একটা বক্সের মতন দেখছো?ওটা আসলে বক্স না।একটা ক্যামেরা।যতদিন না তুমি স্বীকার করছো তুমি রেদোয়ানকে মেরেছো ততদিন তুমি এই ক্যামেরার সামনে নজরবন্দি থাকবে।ভাবছো তুমি উঠে ক্যামেরা সরিয়ে নিতে পারবে?এত সহজ না।তা হচ্ছেনা।’

কথাটা বলে শাওন রুমটার যে টেবিল ছিল তার ড্রয়ার থেকে রশি বের করে খাটের সঙ্গে বেঁধে মেধার এক হাতকে সেই রশি দিয়ে বেঁধে ফেললো।তারপর ওর পাশে বিছানায় উঠে বসে বললো,’এই রশির প্রতিটি গিট্টু এক হাতে খুলতে তোমার পাক্কা বিশ মিনিট সময় লাগবে।আর আমি তোমায় এই রুমে বিশ মিনিটের বেশি সময় ধরে একা রাখবোনা।তাছাড়া ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পাবো তুমি রুমে কি করছো।আর এই দড়িটা নিয়ে তুমি নিচে পানিতে যেতে পারবে,ওয়াশরুমে যেতে পারবে কিন্তু দরজা অবধি গেলেই তোমার রশির আয়তন কমে যাবে।তুমি দরজা অবধি পৌঁছাতে পারবেনা।তাই ক্যামেরাও স্পর্শ করতে পারবেনা’

মেধ হাতের বাঁধনের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসলো তারপর শাওনের দিকে ফিরে বললো,’আমাকে দমিয়ে রাখতে এত কিছু?ভয় পান আমাকে?’
-‘তোমায় আমি ভয় পাইনা।পেলে কাজটা সাজিদকে দিতাম।বাট আমি নিজে আগে জানতে চাই রেদোয়ানকে কে মেরেছে।তাছাড়া সাজিদ আমার মতন রিমান্ড নিতে পারেনা।
তোমার এই চোখজোড়া দেখলে ও এক নিমিষে গলে পানি হয়ে যাবে।ও পারবেনা তোমার চেখের নেশা কাটিয়ে তোমার মুখ থেকে কথা বের করতে’
মেধা ভ্র‍ু নাচিয়ে বললো,’তো আপনি নেশা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন?নাকি দেখা গেলো কদিনে আপনিও নেশায় লেপটে গেলেন’

শাওন বিছানা থেকে নেমে চেয়ারের উপর থেকে অফিসের কোটটা নিয়ে গায়ে দিতে দিতে বললো,’আমি তোমার দুচোখের দিকে একসাথে তাকাইনা।মেয়েদের চোখ ডেঞ্জারাস। যদি একসাথে তাদের দুচোখ এক মিনিট ধরে দেখা হয় তাহলে নেশায় লেপটে যাবার চান্স ৯৫%।আর আমি রিস্ক নিতে চাইনা’

শাওন চলে গেলো রুম থেকে।সাথে সাথে মেধা বিছানা থেকে নেমে দরজা অবধি যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেও পারলোনা।এক বিঘের জন্য যেতে পারছেনা।রুমটার শেষ কোণায় খাট।আর শাওন ওকে খাটের সঙ্গেই বেঁধেছে।রাগ করে ফিরে এসে দড়িটাকে খোলার চেষ্টা করলো সে।কিন্তু হাতের ব্যাথার জন্য একটা গিট্টু ও খুলতে পারলোনা।
শাওন আবারও ফেরত এসেছে হাতে খাবার নিয়ে।মেধা ফ্লোরে বসে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’খাবো না কিছু’
-‘কে বললো তোমার জন্য এনেছি এগুলো?আমি আমার জন্য এনেছি। তোমাকে তো না খাইয়ে রাখবো।খাওয়ার জন্য কাঁতরাবে তুমি।’

শািন মেধার সামনে এসে মেঝেতে বসে খাওয়া শুরু করেছে।মেধাকে দেখিয়ে দেখিয়ে।কাল সকালে নাস্তার পর থেকে মেধার কিছুই খাওয়া হয়নি।ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে।শাওন দেখিয়ে দেখিয়ে পুরো খাবারটা খেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানার উপরে গিয়ে।মেধা মাথা উঁচু করে দেখলো শাওনের চোখ বন্ধ
তাই সে নিচে বসা অবস্থায় একটু একটু করে গিট্টু খুলা শুরু করে দিয়েছে।অনেক কষ্টে একটা গিট্টু সে ছুটাতে পারলো।আরেকটা ছুটাতে গিয়ে মাথা উঁচু করতেই দুটো চোখ জোড়া দেখা নড়ে উঠলো সে।ভয় পেয়ে গেছে শাওনকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে।একটু পিছিয়ে গিয়ে চুপ করে রইলো চোরের মতন মুখ করে।শাওন পুনরায় গিট্টু লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,’আমার থেকে পালানো এত সোজা না।’

সারাদিন গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেলো।
মেধা খিধায় মনে হয় মরে যাবে।গলা শুকিয়ে কাঠ তার।নিজেকে তার সব চেয়ে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে।শাওন দুপুরের খাবারটা খায়নি।মেধার সামনে খেতে বসলে ওর খাওয়া আর হয়না।সকালে অনেক কষ্টে খেয়েছিল।আজ দুদিন রশ্নি তার সামনে আসেনা সেই বিষয়টা একেবারে মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে তার।
মেধা ঘুম থেকে উঠে সামনে দেখলো শাওন ফোনে কথা বলছে।মনে হলো নুহাশের সঙ্গে।মেধা চেঁচিয়ে বললো,’নুহাশ হেল্প মি’

শাওন সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে দিয়ে মেধার কাছে এসে হাত ভাঁজ করে বললো,’আমাকে টপকে নুহাশ তোমায় বাঁচাবে??অনেক বার বেড়েছো।জানতাম, না খেলে শক্তি অপচয় হয়।কিন্তু এখন দেখছি তোমার শক্তি আরও বাড়ছে।’
পকেট থেকে টেপ বের করে শাওন মেধার মুখে টেপ মেরে দিয়ে ঐ হাতের সঙ্গে এবার বাকি হাতটাও বেঁধে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো ফোনে কথা বলতে বলতে।নুহাশকে কোনো মতে বুঝালো যে ওটা মেধার ভয়েস ছিলনা।মেধা ভাবছে তার এখন কি করা উচিত।এভাবে তো দিন চলতে পারেনা।শাওন যে নাছোড়বান্দা।রেদোয়ানের খবর বের করতে যদি মেধাকে নিয়ে এক বছরও এখানে তাকে থাকতে হয় তাও সে থাকবে।

-‘এদিকে আমি না খেয়ে থাকলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবো।তাকে যাই বলি বিশ্বাস করেন না।’
শাওন রুমে ফিরে এসে বললো,’কি ভাবছো?সত্যি কথা বলে দিবে নাকি আমার হাতে আরও অত্যাচারিত হতে চাও?’
মেধা কাঁচুমাচু করতে করতে ইশারা করলো ওর মুখ থেকে টেপ সরাতে।শাওন এগিয়ে এসে টেপ সরিয়ে দিয়ে বললো,’খাবে কিছু??কিন্তু তার আগে তো সত্যি কথা জানাতে হবে’
মেধা মুখ ঘুরিয়ে নিলো রাগে ক্ষোভে।পরে মনে আসলো রাগ দিয়ে শাওনকে দমানো যাবেনা তাই আবারও ওর দিকে ফিরে বললো,’আপনি সোজা করে বলুন আমার থেকে কি শুনতে চান?’

-‘তুমি তো বলছো রেদোয়ানকে মারোনি।তাহলে আমি জানতে চাই রকির লোকেরা তোমাকে কেন মারতে গিয়েও মারেনা?তোমাকে কিডন্যাপ করার পেছনে তাদের কি ইচ্ছা ছিল?কিডন্যাপ করে তারা তোমাকে মারেনি কেন?’
-‘আমি জানি না কেন কিডন্যাপ করেছে।আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল রেদোয়ানের সম্পত্তি কার নামে লেখা’
-“এটা তো সাধারণ মানুষ ও জানবে।বেছে বেছে তোমাকে কিডন্যাপ করে জিজ্ঞেস করতে গেলো কেন?’
মেধা ভ্রু কুঁচকে বললো,’আমি কি জানি?তাদের জিজ্ঞেস করেন গিয়ে’

-‘তাদের অবশ্যই জিজ্ঞেস করবো কিন্তু তার আগে তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও।নাহলে এক ফোঁটা পানিও পাবেনা’
-“যেই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই সেটা বারবার জিজ্ঞেস করে কি পাচ্ছেন আপনি?’
শাওন বিরক্ত হয়ে মেধার মুখে আবারও টেপ লাগিয়ে দিয়ে গ্লাস সরিয়ে সিঁড়িতে গিয়ে বসলো পা পানিতে চুবিয়ে রেখে।মেধা শুয়ে শুয়ে মুখ থেকে টেপ সরানোর চেষ্টা করে অনেকক্ষণ বাদে পারলো খুলতে।তারপর চেঁচিয়ে বললো,’আপনি আমাকে শুধু শুধু টর্চার করছেন।এর মাশুল আপনাকে দিতে হবে’
শাওন পানিতে হাত রেখে মুচকি হাসলো।মেধাকে নিয়ে এখানে আসায় একটা লাভ হয়েছে আর তা হলো এত সুন্দর ভিউ দেখার সুযোগ হয়ে গেলো।

-‘অফিসের কাজ,রহস্যের সন্ধানে ছুটতে ছুটতে কখন যে জীবনটা স্বাদবিহীন হয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি।এখন জীবনটাকে চাঙ্গা মনে হয়।মন চায় এখানেই থেকেযাই।’
মেধা হাত নড়াচড়া করতে করতে বললো,’হাত খুলে দিন।আমার বমি পাচ্ছে’
শাওন পেছনে তাকিয়ে বললো,’হাত খুলে দিলেও পালাতে পারবেনা।নাটক করতে হবেনা।তোমার নাটক দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত।একটু শান্তি দাও আমাকে’
মেধা রেগে বললো,’সত্যি আমার বমি আসছে।বিছানায় করে দেবো’
শাওন উঠে এসে মেধার একটা হাত খুলে দিলো।ও ছুটে ওয়াশরুমে গিয়ে সত্যি সত্যি বমি করছে।শাওন রুম থেকে বের হবার দরজা খুলতে খুলতে বললো,’আসামিকে এনেছি নাকি একটা রোগীকে তা ভেবে পাইনা।কিছুক্ষন পরেই ডাক্তার ডাকতে হয়।’

দরজা খুলে বের হবার সময় শাওন কি ভেবে পুনরায় ওয়াশরুমের কাছে এসে দেখলো মেধা ফ্লোরে বসে মাথা দেয়ালে ঠেকিয়ে রেখেছে।শাওন ওর হাত ধরে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো,”তাও বলবেনা রেদোয়ানকে কেন মেরেছো?’
মেধার মুখে কথা নেই।শাওন বাধ্য হয়ে ওকে কোলে তুলে বিছানায় এনে নামিয়ে দিয়েছে।তারপর গেলো ডাক্তার আনতে
চোখ খোলার পর টেবিল ভর্তি খাবার নজরে আসলো।মেধা আস্তে করে উঠে খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে কি মনে করে আবার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছে।রাগে শরীর থেকে গরম তাপ উঠছে ওর।মন চাইছে শাওনকে খুন করে বসে থাকতে।

সে সময়ে শাওন ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে একটা প্লেটে খাবার নিয়ে ওর সামনে বসলো।মেধা সরে গিয়ে বললো,’খাবো না!আমি মরলে তার পর এসব দরদ দেখাতে আসবেন’
শাওন একটু চেপে বসে ভালো করে লোকমা বানিয়ে মেধার মুখ টিপে ধরে লোকমাটা খাইয়ে দিলো।কোনো কথা বললোনা তারপরেও।মেধা হনহনিয়ে নিচে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে লোকমাটা ফেলো এসে বললো,’আমি মরে যাব তাও খাব না।আমাকে দুদিন ধরে যে কষ্ট আপনি দিছেন এরপরে আবার এত সব আশা করেন?মরে যাব তাও আমি কিছু খাবোনা।আপনার হাত থেকে তো জীবনেও না’
শাওন প্লেট রেখে হাত ধুতে চলে গেছে।

ওর এরকম শান্ত স্বভাবে মেধা চমকালোনা।বিছানায় গিয়ে বসতে চাইলো সে,কিন্তু তার আগেই শাওন হাত ধুয়ে এসে ওর হাত খপ করে ধরে পেলেছে।আজ মেধার গালে চড় মারতে চেয়েও পারলো না।হাত উঠিয়েছিল কিন্তু আজ সে ভুল করে ফেলেছে।তার সেই ভুল যেটা না করে এতদিন গর্ববোধ করছিল আর আজ সেই ভুলটা সে করেই ফেললো।ষাট সেকেন্ড ধরে মেধার ঐ দুচোখের দিকে তাকিয়ে ভুল করে ফেললো সে।
যেই শাওন রিমান্ডে হাত উঠাতে দু সেকেন্ড দেরি করে না,তার হাত আটকায় না, আজ সেই শাওনের হাত এক মিনিট আটকে থেকে সারা জীবনের জন্য থমকে গেলো।আর উঠবেনা।
মেধা হাত ছাড়িয়ে দূরে যেতে যেতে বললো,’আমি রেদোয়ানকে মারিনি।আপনি আমায় রেহায় দিন।বাঁচতে চাই।শান্তিতে বাসায় ফিরতে চাই আমি’

শাওন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।মেধা বিছানার অপর প্রান্তে গিয়ে বসে পড়লো।শাওন অনেকক্ষণ কি যেন ভেবে গ্লাস খুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পানির দিকে চলে গেছে।
এক ঘন্টার বেশি সময় হয়ে যাবার পরও শাওনের কোনো খোঁজ না পেয়ে মেধা বাধ্য হয়ে এদিকে আসলো দেখতে।রিসোর্টের রুমটার আলো যতদূর যায় ততদূর অবধি মেধা তাকিয়ে রইলো।কিন্তু শাওনকে কোথাও না দেখে ফেরত যাওয়া ধরতেই মুখোমুখি হলো শাওনের।সে পানি থেকে অনেক আগেই উঠে গিয়েছিল।মেধা কিঞ্চিত ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ালো তন্মধ্যে।
শাওন গম্ভীর গলায় বললো,’তুমি সত্যি কিছু খাবেনা?’

-‘কেন?আমি তো রেদোয়ানকে মেরেছি কিনা সেসব কিছুই বলিনি।হ্যাঁ বা না ও বলিনি।
তাহলে আমাকে খেতে দিবেন কেন?’
শাওনের রাগ হচ্ছে অনেক।মেধা শক্ত চোখে তাকিয়ে থেকে আবার বললো,’আমি রেদোয়ানকে মেরেছি।বিশ্বাস করেছেন নাকি জানতেন??আপনার কাছে কোনটা সত্য হবে?আমি যেটা বলবো সেটা নাকি যেটা প্রমাণ হবে সেটা?
আমাকে আপনি না খাইয়ে মেরে ফেললেও আমি একই কথা বলবো আর তা হলো আমি মারিনি।’
শাওন মেধার হাতের দিকে তাকালো।ওর হাতে বিছানার সাথের সেই দড়িটা ঝুলছে।মেধা এবার গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললো,”যদি কখনওই আপনার প্রশ্নের জবাব আমি না দেই তাহলে কি মেরে ফেলবেন একটা সময়ে?তাহলে তো আপনিও খুনী হলেন!!’

শাওন মেধার কাছে এসে ওর দুকাঁধে হাত রেখে একটা ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেললো ওকে।
মেধা সাঁতার জানে।বেশ কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করে পানি থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো শাওন সিঁড়িতে বসে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।মেধা পানির গভীরের দিকে যেতে যেতে বললো,’আমি আর ফিরছিনা।অনেক হয়েছে।হয় এই পানিতে মরবো নাহয় দূরে চলে যাব সাঁতরে’

দুই কদম ফেলতেই সে টের পেলো তার হাতে বাঁধা দড়িটা শাওনের হাতে।টান খেলো হাতে।শাওন হাসতে হাসতে বললো,’ভাবলাম তোমায় একটু পানিতে চুবানো উচিত।তাহলে অফিসারের সঙ্গে মেজাজ দেখানোর চিন্তাধারা বদলাবে হয়ত।কি হলো দাঁড়িয়ে কথা শুনছো কেন?যাও না।আরও গভীরে যাও।দাঁড়াও আমিও আসছি’
শাওন দড়িটা নিজের হাতে বেঁধে নিজেও নেমে গেলো।মেধা পিছোতে পিছোতে বললো,’এটাকে রিমান্ড বলেনা।আপনি রিমান্ড নিতে চান তো রিমান্ড নেন।এগুলো কেমন ব্যবহার??’
শাওনের মুখে আরও বেশি করে হাসি ফুটলো।এগোতে এগোতে বললো,’কখন বললাম তোমার রিমান্ড নিচ্ছি??আচ্ছা তোমার যখন রিমান্ডের শখ।সেটাই পূরণ করি।’

মেধা আর পিছোতে পারছে না।পানি তার গলা অবধি এখন।শাওন ওর কাছাকাছি এসে গেছে।ওর সামনে এসে পানির নিচ দিয়ে মেধার দুহাত শক্ত করে ধরলো সে।
মেধা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।শেষে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বললো,’আমি মরলে আপনি জেলে যাবেন। যত বড় অফিসারই হোন না কেন আপনাকে জেলে যেতে হবে’
শাওন মেধার দুহাত নিজের এক হাতের মুঠোয় বন্দি করে নিজের অন্য হাত দিয়ে মেধার চুল ধরে ওকে পানিতে এক ডুব দিয়ে আবার উঠিয়ে এনে বললো,’অফিসার তো অফিসারই।তোমাকে পানির স্বাদ পাইয়ে দেবো আজ।একজনরে তো মারছোই,তোমার চোখে আমি স্পষ্ট দেখি খুনী হবার সেই উড়নচণ্ডী চেতনা।’

কথাটা বলে শাওন আরও দুইটা ডুব দেওয়ালো মেধাকে।মেধা কাশির জন্য কথা বলতে পারছেনা।
শেষবারের সময় শাওন হেসে হেসে বললো,’আর ডুব খাবে মিস অতিরিক্ত? ‘
-‘আমি মরলে আপনিও মরবেন কথাটা নোট করে রাখেন।সেই নোট আপনার অদৃশ্য প্রেমিকা দেখবে কিন্তু আপনি দেখার জন্য আর ভূত হয়ে ফিরে আসবেন না’
শাওন এবার নিজেই মেধাকে নিয়ে পানিতে ডুব দিয়ে পানির অনেক নিচে যাবার পর ইশারা করে ওকে পেছনে তাকাতে বললো।মেধা পেছনে তাকিয়ে মাথার উপরে বিশাল বড় একটা মাছ দেখে চোখ কপালে তুলে শাওনের কাছে চলে আসলো।শাওন ওকে নিয়ে পানির উপরে চলে এসেছে আবার।

মেধা শাওনকে ছেড়ে চটজলদি পেছনে তাকিয়ে দেখলো একটা তিমি মাছের বেলুন।পাশের রুমের কাপলদের বাচ্চার বেলুনটা পানিতে ভেসে এদিকে চলে এসেছে।মেধার কলিজা কাঁপছে এখনও।রেগেমেগে শাওনকে ধাক্কা মেরে দূরে চলে গিয়ে সে বললো,’আপনি নাটক করছেন না এখন?রিমান্ড নিন না।মানা করছি আমি??এরকম নাটক কেন করেন?’

শাওন দড়িটা ধরে আরেকটা টান দিয়ে বললো,’ফাইন।রিমান্ডই নিবো তাহলে’
কথা শেষ করে দড়ি টানতে টানতে সে চলে যাচ্ছে।মেধা হাতে ব্যাথা পেয়ে বাধ্য হয়ে শাওনের পিছু পিছু চললো।শাওন সিঁড়িতে বসে দড়িতে জোরে একটা টান দিলো।মেধা এসে সিঁড়িতে ধপাস করে পড়েছে।রাগে মাথা তুলে তাকাতেই শাওন বললো,’এভাবে তাকাও কেন?রিমান্ড নিচ্ছি আমি’
-“এটাকে রিমান্ড বলেনা”

শাওন মাথার চুল ঝাড়ছে শান্ত হয়ে।মেধা বসে বসে হাতের দড়িটা খুলছে দাঁত দিয়ে।শাওন দড়ি খিঁচিয়ে ধরে ফিসফিস করে বললো,’তুমি চাও আরও জঘন্য কিছু করি??’
মেধা শাওনের কথা শুনে হাত না ছুটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’হ্যাঁ আমি মেরেছি রেদোয়ানকে।এবার কি করবেন করেন’
শাওন হাতের দড়িটা নিয়ে রুমের ভেতরে গিয়ে পুনরায় খাটের সাথে বাঁধছে।মেধা ছুটো এসে বললো,’ এবার কিছু করছেন না কেন?এটাই তো জানতে চাইতেন’

শাওন দড়ি বাঁধা শেষে মুখ ঘুরাতেই মেধা সামনে এসে পথ আটকালো।প্রশ্নের উত্তরের আশায় চেয়ে আছে এখনও।শাওন মেধার পা থেকে মাথা অবধি দেখে বললো,’চেঞ্জ করে নাও’
মেধা ধপ করে বিছানায় বসে গিয়ে বললো,’কি গায়ে দেবো আমি?আমার জন্য কি আলমারি ভর্তি পোশাক রেখেছেন???পানিতে ফেলেছেন আপনি।আমার দোষ নেই।সো জামাকাপড় এনে দেওয়ার দায়িত্ব আপনার।’
শাওন তার কোটটা এনে মেধার মুখে ছুঁড়ে মেরে বললো,’এটা পরে থাকো।আমি জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করে আসছি’
শাওন তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে চলে গেলো রুম থেকে।

মেধার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।শাওনের এই কোটটাকে কেঁচি দিয়ে কেটে কুচি কুচি করতে মন চাচ্ছে এই মূহুর্তে।এটা নাকি তাকে পরতে হবে।জীবনেও না।
এক ঝটকায় ছুঁড়ে মারলো কোটটা।
-‘দরকার হলে এমন ভেজা শরীরে বসে থাকবো তাও ঐ লোকটার কোট আমি পরবো না।কখনও না’
শাওন রুম সার্ভিসের লোকদের থেকে Towel set নিয়ে এসেছে।এসে দেখলো মেধা ওর কোটটা নিচে ফেলে বসে আছে।বিষয়টা দেখে চমকালো না সে।মেধা যে ঘাঁড়ত্যাড়া তা সম্পর্কে ধারণা আছে।তাই Towel Set টাকে ওর দিকে মেরে বললো,’নাও এটা পরে আসো।’

-‘আমি আপনার সামনে এই পোশাক পরে থাকবো?’
শাওন দেয়ালে হাত রেখে মুখ নিচু করে বললো,’তো এরকম ভেজা শরীরে বসে থাকতে লজ্জা করছেনা তোমার?’
মেধার মনে হলো সঙ্গে সঙ্গে কেউ ওর শরীরে এক বালতি লজ্জা ঢেলে দিয়েছে।তড়িগড়ি করে বিছানার চাদর টেনে গা ঢেকে বললো,’আপনি যান রুম থেকে’
শাওনের মন চাইলো ওকে তুলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারতে।মাঝে মাঝে এত রাগ আসে।মেধার জায়গায় অন্য কেউ হলে এক হাঁড় ও এতক্ষণে সচল রইতো না।মেধার প্রতি দূর্বলতা কাজ করছে তা শাওন ভালোমতন টের পাচ্ছে।কিন্তু টের পেয়ে লাভ নেই।পিছু হটার দিন শেষ।চেয়েও আগের জায়গায় ফেরা যাবেনা।রাগটাকে কোনোমতে দমিয়ে সুন্দর সুরে সে কথা সপলো।

বললো,’চেঞ্জ করার জন্য মানুষ রুম ব্যবহার করে তখন যখন তার পার্টনার থাকে।আই মিন হাসবেন্ড।বাট এখন। আমি তোমার পার্টনার না,হাসবেন্ড ও না।সো তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করবে’
মেধা মেনে গেলো।অফিসের পোশাক বদলে সে তোয়ালের জামাটা পরে বের হয়েছে।তখন শাওন ছিলনা।সে রুম থেকে চলে গেছে অনেক আগেই।

নুহাশের ফোন এসেছিল।সে জানালো রকির লোকেশান জানা গেছে।সে এখন বাংলাদেশে।রকি এই খুনের সব জানে।তার থেকে সব কথা জানা যাবে।তাই শাওন সবাইকে দেশে ফিরে যেতে বললো।নুহাশ পাল্টা জিজ্ঞেস করলো শাওন আর মেধা ফিরবে কিনা।শাওন বললো তারাও ফিরবে।তবে এখানে রেদোয়ানের সঙ্গে জড়িত কিছু কাজ আছে।সেটা সলভ্ করে একেবারে ফিরবে।
শাওন চাইলেই এখন মেধাকে নিয়ে ফিরতে পারে কিন্তু সে তা করবেনা।মেধার মুখ থেকে একটা শব্দ ও সে বের করতে পারেনি এখন পর্যন্ত।তাহলে কি লাভ হলো।যাতে এতদিনের কষ্ট লস না যায় তাই সে মোক্ষম চাল চালবে ভেবে নিয়েছে।

রুমে ফেরত এসে দেখলো মেধা ঘুমাচ্ছে গায়ে চাদর টেনে।শাওন ঘড়িতে চোখ রেখে সময়টা জেনে নিলো।রাত এগারোটা বাজে এখন।সে এগিয়ে আসলো মেধাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে বলে কিন্তু ওর ঘুমন্ত চেহারা দেখে তুলতে পারার শক্তি হারালো নিমিষেই।হাত কাঁপছে অনবরত।হঠাৎ পাশে রশ্নিকে দেখতে পেলো সে।
রশ্নি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলছে,’চুলে হাত বুলিয়ে দাও মেয়েটার।চাদর টেনে দাও পায়ের দিকে’

শাওন সরে দাঁড়ালো।কিছুটা অভিমানের সুরে বললো,’নাহ।ও আমার থেকে কেয়ার পেতে পারেনা।ওকে আমি টর্চার করতে চাই।এই কেসের সব কিছু বলতে গেলে বেশিরভাগই মেধা জানে।ওর থেকে কথা বের করলে আমাকে আর কাঠখড় পোড়াতে হবেনা।’
শাওন আগে রশ্নির কথা শুনতো।কিন্তু আজ ওর এমন উত্তরে সে আশা হারিয়েছে।যেন তার কথার কোনো মূল্যই নেইই।

তাই রশ্নি চলে গেছে।শাওনের খবর নেই সে মেধার হাত ধরে এক টানে উঠিয়ে ফেললো সে সময়টায়।মেধা রাগান্বিত হয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শুধু।শাওন হাত ভাঁজ করে গোল হয়ে বসে বললো,’বলো রেদোয়ানকে কেন মেরেছো?’
মেধার এত রাগ হলো যে এতদিনের টর্চারে ক্ষিপ্ত হয়ে এবং এক প্রকার বাধ্য হয়ে শাওনের মুখে একটা কিল বসিয়ে দিয়েছে সে।শাওন নাকে হাত দিয়ে দূরে সরে বললো,’মাথা গেছে তোমার’
মেধা শাওনের পকেট থেকে চাবির গুচ্ছ নিয়ে দরজার দিকে ছুটে গেলো।কিন্তু তার হাতের দড়িটা যে বিছানার সাথে লাগানো ছিল সেটা মনে ছিলনা।দরজা অবধি এসে নিচে পড়ে গেলো সে।শাওন বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,’তোমার উড়নচণ্ডী রুপটা দেখানো খুব দরকার ছিল?’

মেধা এক হাত দিয়ে পাশ থেকে চেয়ার নিয়ে শাওনের দিলে ছুঁড়ে মারলো।শাওন চেয়ারটা ধরে ফেলে সাইড করে রেখেছে।মেধা এবার টেবিলের উপর যা আছে সব একটা একটা করে মারছে ওর গায়ের দিকে।
শাওন একটা একটা করে ক্যাচ ধরছে আর বলে যাচ্ছে এতদিন ঠিক ছিল হঠাৎ এমন মেজাজ দেখানোর কারণ কি।
মেধা কিছু না বলেই সব নিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারছে।শেষে একটা কাঁচের গ্লাস দিয়ে শাওনের মাথা ফাটানোর পর তার এরকম রেগে যাওয়ার সমাপ্তি ঘটলো।শাওনের কপাল থেকে রক্ত ঝরতে দেখে এক অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে লাগলো মনে।শাওন কপাল মুছতে মুছতে বললো,’এবার শান্তি?’

মেধা মাথায় হাত রেখে ফ্লোরে বসে পড়েছে।শাওন কপাল চেপে ধরে ওর কাছে এসে বসলো।শান্ত গলায় বললো,’আমাকে বলো সেদিন কি ঘটেছিল।রকির কি এমন দূর্বলতা তোমার কাছে আছে যার কারণে সে তোমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে?’
———
………দুইদিন পর……..
[এই দুইদিনে কি হয়েছে তা গল্পের অন্য অংশে জানতে পারবেন]
বাংলাদেশে ফিরে এসেছে শাওন আর মেধাও।মেধা সোজা বাসায় ফিরে গেছে আর শাওন অফিসে।গিয়াস স্যারের সঙ্গে মিটিং আছে।

মেধাকে আধমরা অবস্থায় দেখে সাবরিনের হাত থেকে বই পড়ে গেছে।মন দিল লাগিয়ে পড়ছিল সে।
মেধাকে এমন হালে দেখে চিৎকার চেঁচামেচি করে গলা ফাটিয়ে ক্ষান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো ওর এমন হাল কি করে হলো।হাতে পায়ে দাগ।ঠিকমত হাঁটতে পারছেনা।এর কারণ কি।মেধা সাবরিনকে চুপ করিয়ে সোফায় এসে বসেছে।সাবরিন ফোন নিলো চৌদ্দ গুষ্টিকে জানাবে বলে সেসময়ে মেধা ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বললো,’বললাম না কিছু হয় নাই।আমি যে জব করি তাতে এমন হালকা পাতলা চোট পাওয়াটা স্বাভাবিক। তুমি কাউকে কিছু বলবানা।শুধু শুধু টেনসনে ফেলার কোনো মানে হয়না।

-‘তা নাহয় মানা করলে আমায়।কিন্তু তুমি কি জানো আজ মামা মামি ফিরে আসছেন?’
মেধা অবাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,’কেন?’
-‘আরে মামার নাকি ছোট বেলার বন্ধুর মেয়ের বিয়ে তাই’
-‘ওহ।’
আর দেরি না করে মেধা হনহনিয়ে রুমে চলে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো টুল টেনে। কনসিলার দিয়ে হাতের আর কপালের দাগ হাইড করে ফেলেছে সে।কিছুতেই বাবা মাকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা।এক্সিডেন্ট বলেও কাটানো যাবেনা এমন ভাবে সারা গায়ে চোটের দাগ।
শাওনকে ধরে কেলাতে ইচ্ছে করছে।

মিটিংয়ে মেধার অনুপস্থিতি দেখে গিয়াস স্যার প্রশ্ন করলেন শাওনকে।শাওন জানালো মেধার শরীর খারাপ তাই আসেনি।রেস্ট নিয়ে কাল রেদোয়ানের বাসায় যাবে সোজা।
কালকের কথা বলতে গিয়ে সে গিয়াস স্যারকে মনে পড়ে যাওয়া একটা কথা বললো।বলতে গেলে অনুমতি।কাল তার বোনের গায়ে হলুদ,পরশু বিয়ে,তার পরেরদিন বৌভাত।যার কারণে তিনটা দিন সে সময় দিতে পারবেনা।তবে ইমার্জেন্সি হয়ে গেলে নিশ্চয় আসবে।তার সাথে স্যার আর বাকিদের দাওয়াত দিয়ে সে বাসায় ফিরলো।বাসায় সব আয়োজন নিয়ে ওর খালাতো,ফুফাতো ভাই বোনেরা ব্যস্ত।

শাওন এক কোণায় গিয়ে মেধাকে দু তিনবার ফোন করলো।কিন্তু সে ধরছেনা।আসলে তখন সে বাবা মাকে বাসার নিচ থেকে আনতে গেছে।অনেকদিন পর আজ সে বাবা মাকে দেখবে।তারা গাড়ী থেকে নামতেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তিনজনকে একসাথে।
-‘মেধা?শরীর খারাপ তোমার?পায়ে কি হয়েছে?’
-‘কই পায়ে কি হবে বাবা?ওসব বাদ দাও, তোমরা কেমন আছো সেটা বলো’
-‘তোর বাবা তো ঠিকই বলেছে।তোর গলার স্বর এমন ভাঙ্গা হয়ে গেলো কেন?আর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলি যে?কি হয়েছে খোলসা করে বল’

-‘না তো কিছুনা।আসলে বিরাট জার্নি করেছি তো।টায়ার্ড অনেক।এক ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে।’
বাবা মা সন্দেহের চোখে দেখলেন মেধাকে।সে কোনোমতে পুরো ঘটনাটাকে ধামাচাপা দিয়ে তাদের নিয়ে বাসায় ফিরলো।সাবরিন যেন মুখ ফসকে কিছু না বলে তাই মেধা ওকে বাবা মা আসার দশ মিনিট আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
—–
রাত হয়ে গেছে মেধা রুম থেকে বের হচ্ছেনা দেখে মা দেখতে এসে দেখলেন জ্বরে কাঁপছে সে।চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল রুমের আলো নিভিয়ে।মা বাবাকে ডেকে বললেন ডাক্তার ডেকে আনতে।মেধার শরীর খারাপ অনেক।হাত একটা তো এক ফোটাও নাড়াতে পারছেনা।ব্যাথা ব্যাথা বলে কাতরাচ্ছে।

বাবা ডাক্তার নিয়ে আসলেন।একজন ঠিকঠাক দেখতে,মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত,সার্জিক্যাল মাস্ক পরা ডাক্তারের চোখদুটো জনাব ফেরদৌসের চোখে ধুলো দিতে পারলেও মেধার চোখে দিতে পারলোনা।দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তারকে দেখে মেধা এক পলকে উঠে বসে গেছে।বাবার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো এটা কোন হসপিটালের ডাক্তার?’
-‘আর বলিসনা।সুনীল চট্টোপাধ্যায় নামে আমার একটা ফেন্ড আছেনা?ওর বাসা তো কাছেই।তো ওকে কল করতে গিয়ে ভুলে শাওনকে ফোন করে ফেলেছি।ঐ যে তোর সিনিয়র।

সঞ্চারিণী পর্ব ২৫+২৬+২৭

শাওন বললো সে একটা কাজে হসপিটালে এসেছে।ওখানকার একটা ডাক্তার পাঠিয়ে দেবে’
মেধা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো,’ওহহহ’
মা বিছানা থেকে উঠে বললেন,’আপনি দেখেন তো ওর হাতে কি হয়েছে।আমি একটু আসছি’
নাস্তা আনতে ছুটলেন মা।বাবা হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে আছেন ওদের দুজনের দিকে।ডাক্তার পাশে বসে মেধার হাত ধরতে যেতেই মেধা কেঁপে উঠলো।ডাক্তার মেধার কপালে হাত দিয়ে বললেন,’এক কাজ করুন আমি কিছু ঔষুধ লিখে দিচ্ছি আর ইনজেকশানের নাম লিখে দিচ্ছি ওগুলো নিয়ে আসুন।এখনই উনাকে ইনজেকশান দিতে হবে।’
ডাক্তার ফটাফট একটা প্রেসক্রিপশান লিখে মেধার বাবার হাতে ধরিয়ে দিলো।উনি ও চলে গেলেন আনতে।মেধা ভ্রু কুঁচকে এক টানে ডাক্তারের মুখের মাস্ক সরিয়ে বললো,’এখানে ডাক্তার সেজে আসার কারণ কি?’

-‘চিনে ফেললে?’
-‘বাবাকে কি ভুলভাল লিখে দিছেন?’
-‘ভুলভাল না।আসার সময় জেনে এসেছি বুলেট লাগা হাতে এরকম ব্যাথা দেখা দিলে কি কি ঔষধ খেতে হয়।কি কি ইনজেকশানের দরকার হয়’
-‘তো আপনি দিবেন নাকি?ডাক্তারি করেছিলেন কখনও?’
-“আমাকেই দিতে হবে।নরমাল ডাক্তার আনলে সে তোমার বাবা মাকে বলে দিতো তোমার হাতে কি হয়েছে।’
মেধা ঠিক হয়ে বসে বললো,’থ্যাংকস।’
শাওন মেধার কপালে হাত রেখে মাথা নিচু করে বললো,’আই এম সরি’

মেধা দূরে সরে বললো,’এত আবেগ দেখাতে হবেনা।আপনাকে এসব মানায় না।ঐদিনগুলোর পর তো আমি এসব ভুলেও আশা করিনি।আর আপনি কিনা একেবারে ডাক্তার সেজেই আসলেন?’
-‘ডাক্তার সাহেব নাস্তা করে নিন মেধার বাবা আসা পর্যন্ত।’
মেধার মায়ের কথা শুনে শাওন তড়িগড়ি করে মাস্ক টেনে নিলো। ‘

সঞ্চারিণী পর্ব ৩১+৩২+৩৩