সঞ্চারিণী পর্ব ৩১+৩২+৩৩

সঞ্চারিণী পর্ব ৩১+৩২+৩৩
আফনান লারা

শাওন একটা বিসকিট নিয়ে ধন্যবাদ জানালো তাকে।উনি এবার গেছেন চা আনতে।মেধা তার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।শাওন ওর গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে দূরে সোফায় গিয়ে বসলো।মেধার সাথে হওয়া এসবের পেছনে দোষটা কিন্তু ওর।একটা কথা জানার জন্য সে কতটা কষ্ট ওকে দিয়েছে তার মাশুল এখন সে নিজেকে দিয়ে দিচ্ছে।যা করেছে একদম ঠিক করেনি,এসব ভাবতে গিয়ে কোনো কিছুই আর ভালো লাগেনা।মেধা মাথা তুলে বললো,’গিয়াস স্যার ছুটি দেবেন?কাল একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে আমায়।ফ্যামিলির সাথে’

-‘আমাকে দিছেন।তোমাকে দেবে কিনা জানিনা।রেদোয়ানের কেসের কোনো উন্নতি হলো না আজ এতটাদিন কেটে গেছে।স্যারের মেজাজ বিগড়ে আছে।
হয়ত বুঝতে দেননা।তবে পরপর চা খেতে দেখে আমি টের পেয়ে গেছি’
হঠাৎ মেধার বাবার গলার আওয়াজ শুনে শাওন পুনরায় মাস্ক টেনে ফেললো।মেধার বাবা ঔষুধ, ইনজেকশান রেখে বললেন,’এসব ঠিকমত দিয়ে দিন,আমার জরুরি কাজ আছে। অফিস থেকে কল এসেছে’
শাওন বললো আচ্ছা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জনাব ফেরদৌস থেমে গিয়ে বললেন,’আপনার কণ্ঠ অনেকটা শাওনের মতন মনে হয়।যাই হোক, পরে আলাপ হবে। আমার এখন জলদি যেতে হবে’
মেধা দম ফেলে শাওনের দিকে তাকিয়ে বললো,’আপনাকে দিতে হবেনা।আমি ফার্মেসীতে গিয়ে দিয়ে আসবো।আপনি পারবেন না’
-“রশ্নি আমায় সব শিখিয়েছে’

কথাটা বলে শাওন এগিয়ে এসে ইনজেকশানের প্যাকেট খোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।মেধা আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছে একটা কথা।আর তা হলো শাওন রশ্নিকে এখনও ভালোবাসে কিনা।আর রশ্নি কি মেধার সামনে আসতে ভয় পায়’
শাওন উত্তরে কিছু বললোনা।ইনজেকশান রেডি করে দেওয়া ধরতেই মেধার মা এসে বললেন,’আমি এসব দেখলে গা গুলিয়ে আসে।মেধাকে তো ধরতে হবে তাইনা?’
শাওন মানা করলো কিছু না করতে।তাই উনি কোনোরকম চায়ের কাপটা রেখে দরজার ওপারে চলে গেছেন।এসব তিনি দেখতে পারেননা।তার উপর নিজের মেয়ের এমন হাল।নির্ঘাত জ্ঞান হারাতেন।চোখ মুখ খিঁচিয়ে দোয়া করলেন তিনি।

শাওন মেধার হাতে ইনজেকশান দিয়ে দিয়েছে।ও কাত হয়ে শুয়ে বললো,’আপনি যান এখন’
মেধার কিছুই ভালো লাগছেনা।অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছে এমনটা মনে হয়।কিন্তু সেটা একদমইনা।তার পরেও তার কোনো কিছুতেই ভালো মনে হয়না।
শাওন যেতে যেতে বলে গেলো সে ফোন করলে যেন সঠিক সময় রিসিভ করা হয়।

মেধা বালিশ বুকে ধরে চুপ করে থাকলো।এতকিছুর পরেও শাওন এরকম স্বাভাবিক ব্যবহার করছে কি করে তাই ভেবে ঘটকা লাগছে।মেধা স্বপ্নেও ভাবেনি শাওন এরকম স্বাভাবিক হবে মালদ্বীপ থেকে আসার পর।আর বেশি ভাবা তার পক্ষে সহজ হলোনা।গভীর ঘুমে কাতর হয়ে পড়েছে সে।শাওন বাসায় ফিরে ভাইদের সাথে হাত লাগালো ছাদের উপর গায়ে হলুদের কাজ সামলাতে।রশ্নিকে এক নজর দেখেছিল রুমে।সে টব দেখছিল।শাওন ওর সঙ্গে কথা বলার সময় পায়নি।ব্যস্ততা চপপে ধরেছে তাকে।বড় বোনের বিয়ে বলে কথা।

পরেরদিন বিকাল বেলায় মেধা,মৌমিতা আর তাদের বাবা মা এসেছেন শাওনদের বাসায়।মেধা আর শাওন জানত না মোটেও যে এভাবে তাদের দেখা হয়ে যাবে।মেধা বাবাকে জিজ্ঞেস করে শেষে জানতে পারলো তার বন্ধু হলেন শাওনের বাবা।
শাওন ছাদে গিয়েছিল স্টেজের ফাইনাল টাচ আপ করতে।

মেধা ওদের সব রুম ঘুরতে ঘুরতে শাওনের রুমে চলে এসেছে।ঢুকতো না,কিন্তু বারান্দায় রশ্নিকে দেখতে পেয়ে কৌতূহলী হয়ে সেদিকে চললো।রশ্নি ওকে দেখে প্রথমে ইতস্ততবোধ করলেও মেধার কথায় সহজবোধ করেছে।মেধা ওকে জানালো সে ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক।রশ্নি মেধার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে ফ্লোরে বসে পড়েছে।মেধাও বসলো।হলুদ রঙের লেহেঙ্গাটাকে গুছিয়ে রশ্নির উল্টো পাশে বসলো সে।রশ্নি শাওনের পছন্দের একটা ফুলগাছে হাত দিয়ে ধরে দেখছিল। মৌনব্রত ভেঙ্গে মেধা বললো,’তুমি শাওন স্যারকে অনেক ভালোবাসতে তাইনা?’
-‘না।আমি ওকে ভালোবাসিনা।একটুও না।তুমি প্লিজ ওকো ভালোবাসবে??ওকে ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলবে?পারবেনা বলো?’

রশ্নির এমন ব্যবহারে মেধার কথা ভেতর থেকে আটকে গেছে।সে একদমই প্রস্তুত ছিল না রশ্নির এমন উদ্ভট জবাবের।না বুঝতে পেরে বললো,’এসব কি বলছো??’
রশ্নি এবার নিচু স্বরে বললো,’আমি ওকে ভালোবাসিনা।যদি বলি ভালোবাসি তাহলে সে আমার আশা ধরে সারাজীবন বসে থাকবে কিন্তু আমি তা হতে দিতে পারিনা।তুমি তো জানো আমার আর ওর কখনও মিল হতে পারেনা।তাহলে জেনেবুঝে তার জীবন কি করে নষ্ট হতে দিতে পারি বলো?’

-‘বিয়েটাই জীবনের সব কিছু না।তুমি উনাকে লাভ করো,আর উনিও।তাহলে আর কি চাই?’
-‘তুমি জানো আর কি চাই।তুমি বাচ্চা না যে আমি তোমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে।শাওন যদি কখনও তোমার সাথে কথা শেয়ার করতে বসে তাহলে প্লিজ ওকে বোঝাবে,আমার সঙ্গে ওর এরকম রিলেশান ঠিক না।এটার কোনো ফিউচার নেই।পারলে তুমি নিজে আমার জায়গায় এসে ওকে আগলে রাখতে পারো।’
মেধা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।রশ্নিকে পাগল মনে হচ্ছে।ওর মাথার ঠিক নেই।কিরকম করে কথা বলছে সে।
রশ্নি এগোতে এগোতে বললো,’বলবেনা শাওনকে ভালোবাসা দিয়ে ঠিক করবে কিন:

মেধা পিছিয়ে যেতে যেতে ধাক্কা খেলো শাওনের সাথে।শাওনকে দেখে ভয় কমেছে ওর।ভয়ার্ত চোখ শুধু চেয়ে রইলো।শাওন হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো ও এখানে কি করে আর কি হয়েছে এমন ভয় পেয়ে আছে কেন।
মেধা পেছনে তাকিয়ে রশ্নিকে কোথাও দেখলোনা।তাই জবাব দিলো কিছুনা
এরপর ছুটে রুম থেকে চলে গেলো সে।শাওন কিছুই বুঝে উঠতে পারলোনা তাই সেও গেলো ওর পিছু পিছু।
মেধা তার বোন মৌমিতাকে সঙ্গে নিয়ে শাওনদের ছাদের দিকে রওনা হয়েছে।সেখানে সবাই এক এক করে যাচ্ছে।
বাবা মা মনে হয় আগে থেকেই ওখানে আছেন।হঠাৎ শাওন পথ আটকে দাঁড়ালো।ওর ফুফাতো বোন আঞ্জুমের হাতে মৌমিতাকে ধরিয়ে দিয়ে বললো ছাদে নিয়ে যেতে।

মেধা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো শাওন কেন তাকে আটকেছে।শাওন কিছু না বলে ওর হাত ধরে হাঁটা ধরলো।
-‘কোথায় যাচ্ছেন?’
-‘একটা জিনিস দেখাবো তোমায়।এখানো দেখাতে বসলে অতিথিদের জন্য কিছুই পারা যাবেনা।’
শাওন মেধাকে নিয়ে বাসার নিচে নেমে এসেছে।সেখান থেকে গ্যারেজের ভেতরে নিয়ে গেলো ওকে।তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে একটা ভিডিও দেখালো ওকে।মেধা ভিডিওটাতে দেখলো রকি একটা মার্কেটে শপিং করতে গেছে।সে মাথা তুলে বললো,’এটা কবে কার?’

-‘পাঁচ মিনিট আগের।রকি আজিমপুরের আশেপাশেই আছে।সে ভেবেছে আমাদের কাছাকাছি থাকলে আমরা তাকে দূরে খুঁজবো।কাছে থাকতে পারে তা কখনওই ভাববো না।এক্সাক্টলি তাই হয়েছে।আমরা দূরে খু্ঁজে যাচ্ছিলাম ওকে।কিন্তু সে তো আমাদের চোখের সামনেই।’
মেধা মাথায় হাত দিয়ে বললো,’তাহলে চলুন ওকে ধরি আমরা’
-‘আমি নুহাশকে বলে দিয়েছি’
-‘আপনার কি মনে হয়?নুহাশ ভাইয়া পারবে?’
-‘ঠিক বলেছো।ও পারবেনা।শুধু শুধু দায়িত্ব দিলাম।আমার মনে হয় আমাদের যাওয়া উচিত।নাহ।শুধু আমার যাওয়া উচিত।তুমি থাকো’

মেধা শাওনকে থামিয়ে বললো,’আমিও যাব।আমি থাকলে সে হামলা করতে পারবেনা’
শাওন রাজি হলো।মেধাকে সাথে নিয়ে মার্কেটে এসে পৌঁছালো।নুহাশ সেখানে আছে।মার্কেটের মেইন যে দুটো দরজা ছিল সে বন্ধ করে ফেলেছে গার্ড দিয়ে।
শাওন আর মেধা ভেতরে ঢুকে ওর সাথে কথা বলে জানতে পারলে রকি এখনও এই মার্কেটেই আছে। বের হতে পারেনি।

শাওন সামনের দিকে ছুটে গেলো
মেধা গান হাতে শাওনের পিছু পিছু গেছে।নুাহশ ওকে থামিয়ে বললো অন্য দিকে যেতে।কিন্তু সে মানা করে দিয়েছে।মূলত সে এখানে এসেছে শাওনকে সেফ রাখতে।রকি যেকোনো পরিস্থিতিতে শাওনকে মারতে চাইবে।কারণ শাওন ওর অনেক ক্ষতি করেছে।তাই সবার আগে শাওনকে বাঁচাতে হবে।রকিকে পাক বা না পাক তাতে মেধার কিছু যায় আসেনা।

শাওন গ্রাউন্ড ফ্লোর চেক করে উপরের দিকে গেলো।মেধা লেহেঙ্গা ধরে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে।কাস্টমাররা এক এক করে চলে যাচ্ছে।নুাহশ সবাইকে চেক করে বের হতে দিচ্ছে।রকি ছিল থার্ড ফ্লোরে।একটা ম্যানিকুইনের পাশে দাঁড়িয়ে পালাবার রাস্তা খু্ঁজছিল সে।শাওনকে দূর থেকে আসতে দেখে গান তাক করলো মারবে বলে। মেধা উল্টো পাশ থেকে এসে ম্যানিকুইনে শুট করে দিতেই রকি সজাগ হয়ে পালিয়ে গেলো।শাওন ছুটে এসে বললো,’রকিকে দেখেছো?’

-‘হুম’
-‘শুট করলেনা কেন?’
-‘আপনাকে মারতে চেয়েছিল।আমার কাছে আগে আপনার সেফটি ইম্পরট্যান্ট ‘
-‘মেধা কাম অন!এখানে আবেগের কিছু হচ্ছেনা।ভুলে যেওনা তুমি একজন অফিসার।আমি বাঁচি মরি সেসব পরে হবে।আগে রকিকে আমাদের পেতে হবে’
মেধা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো।শাওন সোজা ৪র্থ তলার দিকে গেছে।রকি ততক্ষণে ৫ম তলায় এসে একটা বাচ্চা মেয়ের কপালে গান ধরে বললো পেছনের দরজা খুলে দিতে।শাওন চিৎকার শুনে গ্র্যান্ড ফ্লোরে এসে দেখলো ৫ম তলায় রকিকে। সে গান ধরে রেখেছে বাচ্চা মেয়েটার মাথায়

মেধা তখন ৫ম তলায় উঠে এসেছিল।রকি ওকে দেখতে পায়নি এখনও।
মেধা চুপিচুপি ফোন নিয়ে শাওনকে কল করলো।শাওন ফোন কানে ধরতেই মেধা ওকে একটা কাজ করতে বললো।শাওন নুহাশকে কাজটা সম্পুর্ন করার দিকনির্দেশনা দিয়ে হাতের গানটা নিচে নামিয়ে মাইক হাতে বললো,’শোনো রকি।আমরা তোমাকে শুট করবোনা।তোমার ক্ষতি হবেনা।তুমি মেয়েটাকে ছেড়ে দাও’
রকি পাগলের মতন বিহেভ করছে।মেয়েটাকে এমনভাবে ধরেছে।গুলি না করলেও হাত থেকে নিচে ফেলে দিতে পারে সে।বারবার বলছে কেউ যদি উপরে আসার চেষ্টা ক্করে সে শুট করতে দেরি করবেনা।

মেধা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে।রকি মেয়েটাকে সামনে রেখে শাওনকে বাজে ভাষায় কথা বলা শুরু করে দিলো।মেধার কাছে এখন সবার আগে জরুরি হলো মেয়েটাকে বাঁচানো।মেয়েটা মেধাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলে ফেললো,’আমাকে বাঁচাও’
রকি সাথে সাথে পেছনে তাকিয়ে মেধাকে দেখে এবার গান ওর দিকে ধরে বললো,’বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাও তাইনা???’
-‘না রকি।আমি তোমাকে বাঁচাবো।তুমি মেয়েটাকে ছেড়ে দাও’

-‘তুমি আমাকে বাঁচাবেনা। তোমাকে আমি চিনি।’
মেধা এগোতে এগোতে বললো,’বাচ্চাটাকে ছেড়ে দাও।আমি তোমায় পালিয়ে যেতে হেল্প করবো’
রকি মেধার দিকে গান ধরে আছে তা দেখতে পেলো শাওন নিচে থেকে।মেধা ফোনের স্ক্রিনে একটা ক্লিক করেছে ওর নজর এড়িয়ে।রকির হাত কাঁপছে শুধু।মেয়েটাকে চেপে ধরে পাগলের মতন ব্যবহার শুরু করেছে সে।যেন আজ মেধাকেও মেরে ফেলবে।

শাওন ফোনের দিকে তাকিয়ে মাইক মুখের সামনে ধরে বললো,’রকি পেছনে তাকাও’
রকি বোকার মতন পেছনে তাকাতেই মেধা ছোঁ মেরে ওর থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে নিলো।।
রকি রেগে মেগে বললো,’এটা ঠিক করোনি।কি ভেবেছো আমি পালাতে পারবোনা??
শাওনের কথায় নুহাশ ৫ম তলা অবধি এসে গেছে।সবাই ভেবে রেখেছিল রকি হয়ত মেধাকে শুট করবে।আর নয়ত নুহাশকে।কিন্তু সবার ভাবনাকে পেছনে ফেলে সে শুট করে বসলো শাওনের দিকে।শাওনের পায়ে লেগেছে গুলিটা।
মেধার চোখের সামনে ঘটে গেলো বিপদটা।বাধ্য হয়ে রকিকে সে শুট করেছে।কিন্তু ততক্ষণে সম্পূর্ন মার্কেটের ইলেক্ট্রিসিটি অফ হয়ে গেলো।এই সুযোগে সবার চোখে ধুলো দিয়ে রকি পালিয়ে গেছে।ওর পালানোর পরেই আবারও বিদ্যুৎ চলে আসলো।মেধা ছুটে শাওনের কাছে এসে দাঁড়াতেই শাওন বললো,’ওকে পালাতে দিবেনা।আমার কথা পরে ভাববে। তোমরা গিয়ে ওকে ধরো।’

নুহাশ মার্কেটের বাহিরে বেরিয়ে গেছে রকি খুঁজতে খুঁজতে।কিন্তু মেধা গেলোনা।সে নিচে বসে শাওনের পা ধরে দেখছে গুলি কোথায় লেগেছে।শাওন পা সরিয়ে ধমক দিয়ে বললো নুহাশকে হেল্প করতে যেতে।মেধা তাও শুনছেনা।সে পাশের একটা শপ থেকে সাদা ওড়না এনে শাওনের পায়ে চেপে ধরে গার্ডকে বললো এম্বুলেন্সের জন্য ফোন করতে।শাওন বিরক্তি দেখালো মেধা ওর কোনো কথা না শুনায়।কিন্তু মেধা সেদিকে খেয়াল না করে শাওনের পায়ের রক্ত বন্ধ করার পেছনে লেগে পড়েছে। তার উদ্দ্যোগে সঠিক সময়ে শাওনকে হসপিটালেও নিয়ে আসা হলো।মেধার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।রকির উপর প্রচণ্ড রকম ভাবে রেগে আছে সে।সামনে পেলে খুন করে ফেলতো।
শাওন মেধার ছোটাছুটি দেখছে বেডে শোয়া অবস্থায়।মেধা এতকিছুর ভেতরে ওর একটামাত্র কথা রেখেছে।আর সেটা হলো পরিবারের কাউকে জানায়নি।

ডাক্তারের সাথে আলাপ করে অবশেষে ভেতরে আসলো সে।মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে তার।শাওনের এমন হাল হওয়ায় সে ভীষণভবে নিরাশ।নিজেকে দোষারোপ করছে।এমনটা সে কল্পনাও করেনি।গুলিটা তার গায়ে লাগলেও হয়ত এমন লাগতো না।
শাওন মেধাকে কাছে এসে বসতে বললো।মেধা একটা চেয়ার টেনে হিঁচড়ে কাছে এনে বসেছে তাই।
শাওন হেলান দিয়ে বসে বললো,’আমি তোমার মতন না যে একটা গুলি খেয়ে দশদিন বিছানায় পড়ে থাকবো।আমার অভ্যাস আছে।এর আগেও গুলি খেয়েছিলাম।পায়েই তো লেগেছে। ভালে হয়ে যাবে।এরকম মুখ গম্ভীর করে হাঁটার মানে হয়না।

-‘আপনি বুঝবেন না।যা হয়েছে আমার কারণে হয়েছে।আমি শুট করে দিলে এতক্ষণে এসব দেখতে হতোনা।তাছাড়া আমি আর নুহাশ মিলেও তো রকিকে ধরতে পারলাম না এখনও।’
কথার মাঝে শাওন পা নাড়াতে গিয়ে ব্যথা পেয়ে মেধার হাত ধরে ফেললো হঠাৎ।মেধা ব্রু নাচিয়ে বললো,’আপনি না ব্যাথা পাননা?’

-“হুমম পাইনা।নতুন চোট তো তাই ‘
মেধা চাদর সরিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে কি ভেবে বললো,’রশ্নি আসবেনা?’
শাওনের মন খারাপ হয়ে গেছে কথাটা শুনে।মাথা নিচু করে বললো,’জানিনা ওর কি হয়েছে।ইদানিং আমার সঙ্গে কথাই বলেনা।আমি ব্যস্ত নাকি সে, সেটা বুঝিনা।আমার থেকে দূরে দূরে থাকে সবসময়।
বলতে গেলে পালিয়ে বেড়ায়।জানিনা এমন কেন করছে’
মেধা রশ্নি ওকে কি বলেছিল সেসব আর বলেনি শাওনকে।শাওনের বাবার কল আসছে বারবার । বাধ্য হয়ে ৪বারের সময় রিসিভ করে সে বললো অফিসের কাজে আটকে গেছে।অনুষ্ঠান যেন শুরু করে সবাই।
বাবা রাগারাগি করে পরে মেনে গেলেন

মেধারও একই সিচুয়েশন।সেও তার বাবা মাকে এক কথা বলে বুঝিয়েছে।
রাত নয়টা বেজে গেছে।নুহাশ, নিতু,সাজিদ আর বাকিরা এসেছে শাওনকে দেখবে বলে।মেধা দূরে সোফায় বসে আছে হাতে কফি নিয়ে।যেটা এই গল্পের সত্য সেটা সে শাওনকে মালদ্বীপেই বলে দিয়েছিল।যার কারণে শাওন ওর প্রতি দূর্বল হয়ে গেছে তা সে বুঝতে পেরেছে।কিন্তু এই দূর্বলতা সে মোটেও আশা করেনি।সে ভেবেছিল তার সামনের দিনগুলো অনেক খারাপ হবে।কিন্তু তা না হয়ে আরও সুন্দরের দিকে যাচ্ছে।এমনটা কি নিয়তি?নাকি এর পেছনেও কারণ আছে।শাওন গেমস খেলছেনা তো??

খেললেও বা কি।যা হবার তা গ্রহণ করার জন্য সে সর্বদা প্রস্তুত।তবে রকির কিছু একটা করতে হবে। সে বেশি বাড় বেড়েছে।এমনটা হলে দেখা গেলো এদিন এক অফিসারের মৃত্যুর কারণ হবে সে।তাই বিপদ বাড়ার আগেই তাকে ধরতে হবে।
সবাই শাওনকে দেখে চলে গেছে।রয়ে গেলো মেধা।বাড়ির কাউকে জানানো হয়নি বলে মেধা এজ এ গার্ডিয়ান শাওনের সব কিছু দেখাশুনার দায়িত্বে আছে।শাওন ঘুমায়নি।এমনি চোখ বুজে ছিল।মেধা কাছে এসে শাওনের দিকে চেয়ে আছে।

আজ পর্যন্ত খুব কড়া চোখে, গভীর মনোযোগে এই মানুষটাকে দেখা হয়নি।এই প্রথম দেখা।অফিসারদের যে সুঠাম দেহ থাকতে হয়,ভ্রুতে কড়াকড়ি বুঝে আসতে হয় সেই সবই আছে।তারপরেও শেষে মনে হয় এই মানুষের ভেতরটা পাথর হতে পারেনা।নরম মনের মানুষ।

-‘উনি কেমন মনের মানুষ তা হয়ত আমি আজ কয়েকদিন ধরে বুঝে গেলাম।একটা মানুষ যে কিনা আমাকে পছন্দ করতো না, সে আমার কথা শুনে আমার প্রতি তার চিন্তাধারা বদলে ফেললো এত সহজে।কি অদ্ভুত!”
শাওন চোখ খুলে পাশ থেকে ফোন নিয়ে তৃনা আপুকে কল করে বললো সে আজ বাসায় ফিরবেনা।জরুরি কাজে অফিসের সবার সাথে থাকতে হচ্ছে।এরপর মেধাকে বললো চলে যেতে।কিন্তু শাওনকে একা রেখে তার যেতে ইচ্ছে করলোনা।লুকিয়ে বাবাকে কল করে বললো আজ সে ফিরবেনা।অফিসের কাজ আছে।বাবা রাজি হতে চাইলেন না কারণ মেধা নিজেও অসুস্থ। তারপরেও ওর জোরাজুরিতে রাজি হলেন।

শান্তিতে মেধা সোফায় হেলান দিয়ে বসে গলার থেকে সেটটা খুলতে লাগলো।এক এক করে গলার,কানের ওর্নামেন্টস খুলে টেবিলে রেখে সোফায় পা তুলে বসে ঘুমানের চেষ্টা করলো সে।রাত এগারোটার দিকে হালকা তন্দ্রা থেকে বেরিয়ে শাওন সামনে মেধাকে দেখে চমকে গেলো।সে ভেবেছিল মেধা চলে গেছে।চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে রাগ ও হলো তার।কিন্তু কিছু বলতে পারলোনা।মেধা ঘুমাচ্ছে।

প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা পেয়েছে এসময়ে কিন্তু মেধাকে ঘুম থেকে তুলতেও মুখে বাঁধছে।তাই ভাবলো নিজেই পারবে।চাদর সরিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করলো সে।ফ্লোরে দু পা রেখে হাঁটতে চেয়েই হঠাৎ ধপ করে মেধার কাছে এসে পড়লো সে।মেধা ভয় পেয়ে গান হাতে নেওয়ার জন্য সজাগ হতেই চোখের সামনে শাওনের মুখ দেখে হাত আটকালো তার।চোখ না খুললে শুট করে দিতো।

শাওন উঠার চেষ্টা করতে করতে বললো,’আই এম সরি।আসলে বেসামাল হয়ে পড়ে গেলাম।ভেবেছি হাঁটতে পারবো’
মেধা নড়েচড়ে বললো,’উঠুন!! দেখে মনে হয় না এত ওজন আপনার’
-“আমি মোটেও আমার ওজন দিই নাই।দেয়ালে হাত রেখে আটকেছি।দিলে তো মরে যেতে এতক্ষণে’
মেধা শাওনকে ধরে উঠালো অনেক কষ্টে।তারপর ওর হাত ধরে বিছানায় এনে বসালো।শাওন বললো পানি খাবে।
মেধা তাই পানি আনতে গেছে।মেধা যাবার পরই শাওন তার পাশে রশ্নিকে দেখতে পেলো।রশ্নি কান্না করছে।ওকে কাঁদতে দেখে শাওন বুঝে উঠতে পারলোনা কেন কাঁদছে সে।
বিষয়টা বুঝতে ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,’কি হয়েছে রশ্নি?আই এম সরি।আমি আর ব্যস্ততা দেখাবোনা।এভাবে কেঁদোনা প্লিজ।রশ্নি?’

রশ্নি হুট করে শাওনকে জড়িয়ে ধরলো।মেধা তখন পানি নিয়ে এসে এমন সিন দেখে আবার বের হয়ে গেছে রুম থেকে।
চুপচাপ পানির বোতলটা নিয়ে করিডোরের একটা চেয়ারে বসলো সে।এখন তার যাওয়া উচিত না ভেবে পা দুলাতে লাগলো বসে বসে।
শাওন রশ্নিকে গায়ের থেকে সরিয়ে বললো,’কি হয়েছে বলো আমায়’
-“তুমি মেধাকে ভালোবাসা তাইনা?’
-“এসব কি বলো।আমি ওরে ভালোবাসবো কেন?’
-‘তাহলে সবাই থাকতে ও তোমার সাথে রয়ে গেলো কেন??আমার দোষ সব।আমি মেধাকে বলেছি তোমায় ভালোবাসতে।কিন্তু ভুল করলাম।আমি তোমাকে অন্য কারোর হতে দেখতে পারিনা শাওন।আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ’

শাওন রশ্নির মাথায় হাত দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বললো,’আমি তোমায় কেন ছেড়ে যাব।এসব কি বলছো?তাছাড়া মেধা আর আমি হলাম জাস্ট কলিগ।এর বাহিরে কিছুনা।আমাকে দেখাশুনার জন্য কাউকো প্রয়োজন তাই মেধা থেকে গেছে।কিন্তু আমি একবারও তাকে বলিনি থাকতে’
-‘তাহলে এখন বলো ওকে চলে যেতে।আমার কিছু ভালো লাগছেনা’
শাওন হাতের গড়িতে চেয়ে দেখলো রাত অনেক হয়েছে।তাই রশ্নির কথা সে শুনলোনা।মানা করে দিলো।বললো এত রাতে মেধাকে চলে যেতে বলতে পারেনা সে।আগে অফিসের গাড়ী থাকত।কিন্তু এখন সেটাও নেই।এমনিতেও শত্রুর অভাব নেই।মেধাকে চলে যেতে বলা যাবেনা।

শাওনের কথায় রশ্নি রাগ করে উধাও হয়ে গেছে।এখানে শাওনের কিছুই করার নেই
তাকে দুটো দিক ভাবতে হচ্ছে।মেধা ওর কারণেই আজ হসপিটালে রয়ে গেছে।এখন রশ্নির কথায় নেচে মেধাকে সে চলে যেতে বলতে পারেনা।
কিছুক্ষণ পর মেধা দরজায় নক করে ভেতরে আসলো।হাসি মুখে শাওনের দিকে বোতল এগিয়ে ধরে দেখলো শাওন ওর দিকে তাকাচ্ছেনা।কেমন একটা অপরাধবোধ নিয়ে পানির বোতলটা সে নিলো।
মেধা ওর পাশে বসে আবারও পা দুলাতে দুলাতে বললো,”রশ্নি আপুর সাথে কথা বলে মুড অন হওয়ার জায়গায় অফ হয়ে গেলো কেন?’

-“তোমার সাথে ওর আজ কথা হয়েছিল?’
-‘হুম।আপু আমাকে বলেছে…থাক বাদ দেন।এখন মন খারাপ কেন সেটা বলুন আগে’
-‘কিছুনা।আচ্ছা ধরো তোমাকে কেউ একটা কিছুর জন্য ফোর্স করছে।কিন্তু তোমার মন সেটা চাইছেনা।মন অন্য কিছু চায়।তাহলে তুমি কি করবে?’
-‘অফ কোর্স আমার মনের কথা শুনবো।কারণ আমার জন্য কি ভালো আর কি খারাপ সেটা আমার মন ভালো জানে’
-‘ধরো ঐ ব্যাক্তির সঙ্গে তোমার মন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।বলতে গেলে একটা অংশ।তখন তুমি কার শুনবে
?’

-‘অংশ হলেই কি আর সে মন হয়ে যায় নাকি?মন হতে আপন হতে হয়।যাই হোক।যেই সিচুয়েশন হোক না কেন আমি সবসময় আমার মনের কথা শুনবো’
শাওন মেধার দিকে দুমিনিট তাকিয়ে রইলো।তার মাথায় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা টপিককে কি সুন্দর করে মিটিয়ে দিলো সে।মাথা হালকা মনে হলো।ওর দিকে মুগ্ধতার চোখে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে পানি সব নিজের গায়েই ঢেলে দিয়েছে সে।মেধা বিছানা থেকে নেমে ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,’আপনার মন কই থাকে?’
-‘তো…….।সরি বুঝতে পারিনি আসলে হাত কাঁপছিল’

-‘আপনি ঘুমান।আমিও দেখি ঘুম আসে কিনা।নাকি রশ্নি আপু চলে আসে আবার।আপনার পাশে দাঁড়াতেও মাঝে মাঝে ভয় হয়।কে জানে আপনার ঘাঁড়ের ভূত এসে আমার ঘাঁড়ে না চেপে বসে।’
শাওন শুয়ে পড়েছে।তার মাথায় ঘুরছে অন্য কথা।রশ্নির হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে যাওয়া মানে কি দাঁড়ায়??সে কি জেলাস?কিন্তু মেধা আর তার মধ্যে তো এমন কিছুই নেই
যাই হোক।হয়ত সে উল্টো ভাবছে।এসব পরে দেখা যাবে।তাকে পরে সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়া যাবে।রশ্নি সহজে সব বুঝে যাওয়ার মতন একটা মেয়ে’

-‘বুঝলে ফেরদৌস!শাওনকে নিয়ে চিন্তায় আছি।কয়েকবছর আগের একটা দূর্ঘটনা তার জীবনে এমন আঘাত হেনেছে সে আর কোনো নারীতে আশক্ত হতে পারেনা।’
-“আসক্ত হতে পারেনা নাকি চায়না??পুরুষ যদি চায় সে আশক্ত হবে।আর যদি না চায় তাহলে জীবনেও তার মন গলানো সহজ না।এখন তোমার ছেলের কি সমস্যা সেটা ঠিক করে বলো।আমি তো দেখি বেশ ভালোই চলাফেরা করে।তার সমস্যা আছে বোঝাই গেলোনা।যদি তুমি না বলতে আমি এখন পর্যন্ত তাকে স্বাভাবিক মনে করে এসেছি’
-‘নাহ।সমস্যা আছে।তবে সে বিয়ে করতে নারাজ।যদি জোর করে বিয়ে করিয়ে দিতে পারতাম তাহলে ল্যাটা চুকে যেতো।একটা মেয়ে তার জীবনে বৈধ ভাবে আসলে তার জীবন আরও সুন্দর হবে।সে তার মনের যে নারী আছে তাকে একটু হলেও ভোলার সাহস পাবে,শক্তি পাবে।এখন আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না তাকে জোর করার।আমি পছন্দ করে দিলে সে কড়া কথা বলে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়।বোকাসোকা মেয়ে পেয়ে ভয় দেখায়।আমার মনে হচ্ছে, শাওনের জন্য ওর মতনই একজন দরকার।যে ইটের উত্তর পাটকেল দিয়ে দেবে’

-‘তুমি কি আমার মেয়ে মেধাকে ইশারা করছো?তাহলে ভুল করছো।
আমি যদি রাজি হয়েও যাই,সবাই যদি রাজি হয়েও যায় মেধা তোমার ছেলের মাথা চুরমার করে ওর জীবন সুন্দরের বদলে ওলটপালট করে দেবে।মেধা জেদি মেয়ে।আর ওর মাথায় সারাদিন ঘুরে কোথায় খারাপ কি ঘটলো,গিয়ে সেটা সলভ্ করতে বসবে।সে এসব বাদ দিয়ে শাওনের মাথা ঠিক করার দায়িত্ব জীবনেও নেবে না।আমি মত দিয়ে দিলাম, এবার তুমি ভাবো।’

সেই মূহুর্তে গিয়াস স্যার তার ওয়াইফকে নিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আসলেন।দাওয়াতটা শাওন দিয়েছিল।এসে বসলেন শাওনের বাবার সঙ্গে।এরপর মনটা খারাপ করে বললেন,”ভাল করেছেন অনুষ্ঠান বন্ধ করেননি।শাওন কালকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।ও অনেক স্ট্রং ছেলে।’
গিয়াস স্যারের কথা শুনে সবাই হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।এই খবর তারা মাত্র শুনলো।শাওনের বাবা বসা থেকে উঠে বললেন,’কি হয়েছে ওর?’
-‘গুলি লেগেছে ওর।কেন জানেন না?’
শাওনের বাবা চমকে গেলেন।শুধু প্রশ্ন করলেন কোন হসপিটালে আছে এখন।

মেধার ফোনে আননউন নাম্বার থেকে কল এসেছিল।কানে ধরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনতে পেলো রকির কণ্ঠ।
সে হাসছে।ক্লিপটা নাকি সে পেয়ে গেছে।এটা শুনে মেধার হাত থেকে ফোন গেলো নিচে পড়ে। আওয়াজ পেয়ে শাওন উঠে পড়ে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।মেধা ভীতি স্বরে জবাব দিলো ক্লিপটা রকি পেয়ে গেছে।
রকির উপর প্রচণ্ড রাগ নিয়ে ছুটতে যেতেই শাওন ওকে আটকালো।শান্ত করতে সোফায় বসিয়ে বললো,’ক্লিপ কোথায় রেখেছিলে?’

-‘আমার গলার একটা চেইনের সঙ্গে রেখেছিলাম ব্যাংকে।একাউন্টটা সম্পর্কে আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা,জানতোনা ‘
-‘তাহলে পেলো কি করে?তোমার চোখ এমন পানিতে ভরে এসেছে কেন?চোখ মুছো।’
শাওন হাত দিয়ে মেধার চোখ মুছতে গিয়ে টের পেলো রুমে অন্য কারোর উপস্থিতি।বাবা মা,তৃনা সবাই এসেছে এখানে।শাওন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইলো।খবরটা লিক হলো কি করে তাই ভাবছে সে।এদিকে মেধার বাবা হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে বললেন,’মেধা তুমি এত রাতে এখানে কি করছো?তোমার না অফিসে কাজ?’
-‘না আসলে..’
-‘চলো আমার সাথে’

জনাব ফেরদৌস মেধার হাত ধরে নিয়ে গেলেন।শাওন মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে।শাওনের বাবা, মা সোফায় এসে বসে ওকে রাগান্বিত চোখে দেখছেন আপাতত।কোনোমতে কেঁপে কেঁপে বিছানার কিণারায় এসে বসলো সে।বাবা হাত কপাল থেকে সরিয়ে বললেন,’তোমার গায়ে গুলি লেগেছে তা আমাদের জানালে না।জানালে কলিগকে।তাকে সঙ্গ দিতেও রেখে দিলে।আমি জানতে চাই সে কি আদৌ তোমার কলিগ নাকি আরও কিছু আছে?’
শাওন চোখ বড় করে বললো,’আরও কি থাকবে?এসব কেমন কথা।আমি তোমাদের চিন্তায় ফেলতে চাইনি।তৃনা আপুর বিয়েতে কোনো সমস্যা হোক আমি সেটা চাইনা।আর মেধাকে যেতে বলেছিলাম তাও সে থাকতে চাইলো জোর করে’

-‘কেন জোর করেছে?সে কি তোমায় পছন্দ করে?নাকি তোমরা দুজনই দুজনকে পছন্দ করো।আজকের ইন্সিডেন্টটার মতন এই বিষয়টাও কি আমাদের অজানা?’
-‘বাবা এসব কি শুরু করছো??আমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করি মানে?এই টপিক কেন আসছে?’
-‘তাহলে বলো কাকে পছন্দ করো।তোমার ঐ মনের ভূতটার নাম বলোনা প্লিজ’

শাওন কাত হয়ো শুয়ে চুপ করে থাকলো।এত প্যাঁচ ভালো লাগেনা তার।বাবা চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন,’যদি তুমি তোমার মত না দাও তো আমি আমার মন মত মেয়ে ঠিক করে তোমার পাশে বসিয়ে দিতে সময় নেবোনা’
শাওন তাও চুপ করে আছে, বাবা চলে গেছেন বাহিরে করিডোরের দিকে।মা এসে শাওনের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ওর শরীর কেমন আছে। পায়ে বেশি ব্যাথা করছে কিনা।দূরে এক কোণায় তৃনা নিরবে কেঁদে চলেছে।তার বিয়েতে যাতে কোনো সমস্যা না হয় তার জন্য তার ভাই এতবড় ইন্সিডেন্সের কথা চেপে গেলো।কতটা ভালোবাসে সে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ছুটে এসে শাওনের বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেললো সে।শাওন বোনের মাথায় হাত রেখে হেসে বললো,’এখন কাঁদলে মেক আপ নষ্ট হয়ে যাবে কন্যা।পরে ঐ মেক আপ দিয়ে বিয়েতে যাবেন কি করে?বিয়ে পর্যন্ত চালাতে হবে না?’

তৃনা শাওনের গায়ে কিল বসিয়ে হেসে ফেললো।
শাওনের বাবা আর মেধার বাবার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে।তারা ওদের দুজনকে রাগিয়ে তুলে এক প্রকার জোর করে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করতে চান।
মেধাকে বাসায় আনার পর তার বাবা আহামরি কিছুই বলেননি।মেধা ভেবেছিল রাগটা বাকি সবার সামনে অবধি প্রচলিত হয়ত।
কিন্তু নাহ!

মেধা একটু ফ্রেশ হয়ে বসতেই বাবা ওর সামনে এসে হাজির।সে জানেও না বাবা কি বলে বসবে।বাবা ওর সামনে বসে স্বাভাবিক ভাবেই কথা শুরু করেছেন কিছু অতি জরুরি কথা।
তার কথার মেইন টপিক ছিলো “বিয়ে”
মেধার আর শাওনের বিয়ে।এটা শুনে মেধা দাঁড়িয়ে পড়েছে।একই হাল হয়েছে শাওনেরও।চোট পাওয়া পা নিয়েও সে দাঁড়িয়ে পড়েছে।দুজনের বাবাই শক্ত হয়ে বসে আছেন ওদের দুজনের দিকে চেয়ে।মেধা পুনরায় বিছানায় বসে বললো,’এটা অসম্ভব।কি বলছো বাবা??’

সঞ্চারিণী পর্ব ২৮+২৯+৩০

শাওন বললো,’রশ্নিকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করে শুধু শুধু কষ্টে ফেলতে চাইনা আমি’
তাদের দুজনের দুরকম মত দেখে তাদের বাবারা কোনো রিয়েকশানই দেখালেন না।চুপচাপ রুম থেকে গেলেন।আপাতত তাদের সময় দিতে চান বলেই এমনটা করার।তারা একসাথে ফোন নিলো বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবে বলে।একসাথে কল করায় কেউ কারোর সাথে ১০মিনিট ধরে কথা বলতে পারলোনা।শেষে মেধা দম ফেলার সময় নিলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য।তখনই শাওনের কলটা ওর ফোনে ঢুকেছে।রিসিভ করে দুজনে হ্যালো বলে ফেললো।এরপর আবার দুজনে চুপ।

শেষে শাওন বললো,’ জানি না তোমার বাবা তোমায় কি বলেছে।আই গেস তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছে এতক্ষণে।বলতে চাই আমাকেও একই কথা আমার পরিবার বলেছে।তুমি কি করে মানা করেছো বলে দাও।আমিও সেই ট্রিক ফলো করবো।’
মেধা দরজা লক করে বিছানায় এসে বললো,’আমি কিছু বলার আগেই বাবা চলে গেছেন।আমার হাতে সময় দিয়েছেন হয়ত।’
-‘তাহলে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলো যে তারা দুজনে সব ঠিক করেছে।নাহলে একসাথে দুজনের একই ভাব প্রকাশ হতোনা।’

কি করা যায় তা নিয়ে কাল আলাপ হবে বলে শাওন কল কেটেছে।
রাত যত গভীর হচ্ছে দুজনের মনে মনে ভয় জাগছিল তাদের বাবার মেজাজ নিয়ে।দুজনেই তাদের বাবাকে ভয় পায়।মানা করলে না জানি সত্যি সত্যি জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় তা নিয়ে মনে সংশয় জাগছে।এই সংশয় মেটাতে হবে নিরুদ্দেশ হয়ে।

সঞ্চারিণী পর্ব ৩৪+৩৫+৩৬