সঞ্চারিণী পর্ব ৩৪+৩৫+৩৬

সঞ্চারিণী পর্ব ৩৪+৩৫+৩৬
আফনান লারা

যেমন কথা ছিল ঠিক তেমনটাই কাজে পরিণত হয়েছে।তারা দুজনে খুব ভোরে যখন পাখি সবেমাত্র উঠেছে ঘুম থেকে ঠিক তখন বাসা থেকে উধাও হয়ে গেলো।তবে তারা ঢাকাতেই আছে এখনও।
তৃনা আপুর বিয়েতে ভাইকে না দেখলে তিনি মন খারাপ যেন করতে না পারেন তাই শাওন ছদ্দবেশে নিজের বোনের বিয়েতে গিয়ে তাকে সময় দিয়ে আবার পালাবে ভেবে রেখেছে।
শাওন আর মেধা আপাতত ঢাকার এমন জায়গায় আছে যেখানে তাদের দুজনের পরিবার আসার কথা কল্পনাও করবেনা।

একটা কফি শপে কফি খেতে খেতে চোখের মোটা ফ্রেমের চশমা হটিয়ে মেধা বললো,’আজকে কি এমন জোকার সেজে আপনার বোনের বিয়েতে যেতে হবে আমায়??
একটা সময়ে সবাই চিনে ফেলবে আমায়।আমি না গেলে হয় না?’
শাওন তার ঠোঁটের উপর ইয়া বড় গোঁফ টেনে বললো,’না হয়না।আমি আর তুমি হাসবেন্ড ওয়াইফ সেজে যাব।আমি একা গেলে সবাই প্রশ্ন করবে।কই থাকি,কার ছেলে ইত্যাদি ইত্যাদি।’
মেধা কফিতে চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে শাওনের দিকে তাকালো হঠাৎ।
শাওন ও হাসছে।হাসি থামিয়ে বললো,’আমার এখনও বিশ্বাস হয় না তোমার ঐদিনের কথাটা।’
-‘কেন?আপনার কি মনে হয় আমার সাহস নেই?’
-‘প্রচুর সাহস আপনার।আর সাহস দেখতে চাইনা।আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
-‘কি?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

[মালদ্বীপের সেই দুইদিন]
-‘আমি রেদোয়ান আর আশার পরিবারকে এই কেসটা দ্বারা চিনি না।
আমি তাদের চিনি গত এক বছর ধরে।আমার ট্রেনিং শেষ হবার পর গিয়াস স্যার আমাকে অফিসের কাজ অফিসে বসে প্রেক্টিস করতে ময়মনসিংহ যেতে বলেছিলেন আমাদের অন্য একটা শাখাতে।আমি তৈরি হচ্ছিলাম।সব ঠিকঠাক ছিল।দুপুরবেলা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম বাস স্টেশনে।
বাস আসার কয়েক মিনিট আগে আমার সামনে একটা বিরাট কার এসে থামলো।যেহেতু দেখতে অনেক সুন্দর ছিল,আমার চোখ গেলো বরাবর কারটার দিকে।নীল রঙের ছিল।এত সুন্দর!!

দেখলাম তার থেকে জ্যাকেট পরা একজন লোক বের হলেন।ওপাশে কারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে লাগলেন তিনি।তার দু মিনিট পরেই কার থেকে একটা মেয়ে বের হলো।গায়ে বেগুনী রঙের শাড়ী।হাতে পায়ে হাজারটা চোটের নিশান।সে কেঁপে কেঁপে বের হয়ে ঐ লোকটার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে কিসব বলছিল।লোকটা সেদিকে তোয়াক্কা না করে ফোনে কথা বলছে।যেন কোনো ভিখারী ভিক্ষা চাচ্ছে আর সে ভিক্ষা দেবেনা বলে ঠিক করে রেখেছে।মেয়েটা অনেকক্ষণ আকুতি মিনতি করে পেছনে তাকাতেই আমাকে দেখলো।আমি চোখ নামিয়ে বাসের অপেক্ষায় অন্যদিকে মুখ করে থাকলাম।ভেবেছিলাম বিষয়টা এখানেই শেষ।কিন্তু নাহ।

মেয়েটা আমার কাছে এসে দাঁড়ালো হঠাৎ।এসেই বললো,’আপনার ফোন নাম্বার দিবেন??’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’আপনার কি কোনো সমস্যা হয়েছে??
আমি সাহায্য করবো?আমি একজন ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিসার’
মেয়েটা আমার কোটে লেগে থাকা কলমটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে বললো,’আমার হাতে আপনার নাম্বারটা লিখে দিবেন?’
আমি বুঝলাম সে আসলেই বিপদে আছে।এখন বলতে পারছেনা।
যদি তার কোনো সাহায্য করতে পারি।তাই নাম্বারটা লিখে দিলাম।মেয়েটা ছুটে আবারও কারের কাছাকাছি চলে আসলো

লোকটা পেছনে তাকিয়ে মেয়েটার দিকে ইশারা করে কিসব বলতেই সে দেরি না করে কারে ঢুকে গেছে। লোকটার মুখ আমি এইবার স্পষ্ট দেখলাম।চিনতে পারলাম লোকটা আসলে কে।ওটা ছিল রেদোয়ান।রেদোয়ানকে সবাই চেনে।আমিও চিনে ফেললাম।কিন্তু তার ওয়াইফের চোখ মুখের এমন বেহাল দশাতে আমি তাকে চিনতে পারিনি এতক্ষণ।অথচ বহুবার তাকে টিভিতে দেখেছি।বড় বড় শো তে দেখেছি রেদোয়ানের পাশে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে থাকতে।

রেদোয়ান সহ কারে উঠে চলে গেলো সেবার।আমি অপেক্ষা করলাম মেয়েটার কল আসার।সেদিন আর কল আসলোনা।আমি ময়মনসিংহ চলে এসেছি। ময়মনসিংহ থাকার দুইদিন পর বিকেল বেলা আমার ফোনে একটা কল আসলো।সেই কলটা রেদোয়ানের স্ত্রীর ছিল।কল রিসিভ করায় সে শুরুতেই বললো তার নাম আশা।সে রেদোয়ানের স্ত্রী। সে সাহায্য চায়।বাঁচতে চায়,স্বাধীন ভাব শ্বাস নিতে চায়’

আমি বুঝলাম রেদোয়ান তাকে অত্যাচার করে।কিন্তু তার মুখ থেকে অত্যাচারের ধরণ শুনে বুঝলাম রেদোয়ান আসলে মানুষ না,একটা জানোয়ার।কোনো মানুষ এরকম অত্যাচার করতে পারেনা।আশা আমায় বলেছিল এই অত্যাচারের কারণ হলো রেদোয়ান বাড়িতে একবার একজনকে আনবে বেড শেয়ার করতে কিন্তু আশা মুখ বন্ধ রেখে সব সইবে।
সব শোনার পর আমি বললাম তাহলে কেস করো।সে হাসলো।বললো কেস করলে তাকেই জেলে যেতে হবে।রেদোয়ান যাবেনা।
আমি বললাম তাহলে ডিভোর্স দাও।সে বললো ডিভোর্স দিলে তাকে আর তার বাবাকে পথে বসতে হবে,রেদোয়ানের টাকায় তারা বেঁচে আছে।

শেষে জিজ্ঞেস করলাম কি করলে আশা শান্তি পাবে।সে আমায় বললো শুধু যে রেদোয়ান টর্চার করে তা নয়,রকিও তাকে টর্চার করে।শারীরিক এবং মানসিক দুটোই।
আমাকে বললো প্রমাণ জোগাড় করতে।এই প্রমাণ কোর্টে গেলে রেদোয়ানের আর রকির জেল কেউ ঠেকাতে পারবেনা।
আমি রাজি হলাম।ময়মনসিংহে কাজ সেরে অফিসারের লুক পাল্টে হয়ে গেলাম রেদোয়ানের পি.এ।অবশ্য তার আরেকজন পুরুষ পি.এ ও ছিল।কিন্তু সে লন্ডনে গিয়েছিল রেদোয়ানের একটা কাজে।যার কারণে জরুরি ভিত্তিতে পি.এ প্রয়োজন ছিল।

অবশ্য এটার জন্য অনেক কাঠকড় পোড়াতে হয়েছিল আমায়।
আমার মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছিল রকি।সে শুরুতেই আমাকে অফার করে বসে তার সাথে রাত কাটাতে।আমি রাজি হয়ে যাই।
মদের সঙ্গে অজ্ঞান হবার ট্যাবলেট সচরাচর ছেলেরা খাওয়ায়।কিন্তু সেই রাতে আমি ওরে খাইয়ে দিয়েছিলাম।পরেরদিন সকালে সে চোখ খুলে আমার গায়ের সেই জামা দেখে অনেক হেসেছিল।বলদকে বলদ বানাতে অনেক ভালো লাগে তাই না??
আমিও হাসলাম অনেক।গায়ের জামাটা খুলে ওর মুখে ছুঁড়ে চলে এসেছিলাম আর সে বলদ ভেবেছিল আমি বুঝি তার সঙ্গে সারা রাত ছিলাম।

তো সে আমাকে আরেকটা রাত থাকতে বলে।আমার শরীরের কোন অংশ সে ছুঁয়েছে তার নাকি মনে পড়ছেনা।
ভেবেছিলাম সে বলদ,এখন মনে হলো শেয়ানা বলদ।যাই হোক এবারও রাজি হলাম।তার সাথে রুমে ঢুকে শুরুতেই চেয়ারে বসে একটা ভিডিও প্লে করলাম পাশের টিভিতে।রকির সঙ্গে একটা মেয়ের ভিডিও।এটা আমাকে একটা ছেলে জোগাড় করে দিয়েছিল।তার নাম আনিসুল।
যে মেয়েটা ছিল ভিডিওতে সেই মেয়েটা ঐ ছেলের প্রাক্তন ছিল।রকি ভিডিওটা দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো -‘হু আর ইউ??’
আমি উত্তরে বললাম’আই এম ইউর মিসফরচুন’

সে পাগলামি করলো অনেক সময় ধরে তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বললো ভিডিও ডিলেট করার বদলে আমাকে টাকা দেবে।আমি বললাম টাকা লাগবেনা।চাকরি লাগবে।সে রাজি হয়ে গেলো।তার সামনে ভিডিও ডিলেট করলাম।সুযোগ পেয়ে সে আমাকে টাচ করার জন্য এগোতেই বলে দিলাম একটা কথা।আর সেটা হলো,’ভিডিওটা যার থেকে নিয়েছিলাম তার বাসার ফোন,ল্যাপটপ,পিসিতে সেভ করা আছে’

ব্যস তার পর থেকে রকি আমাকে পারে না সালাম করে।যাই হোক চাকরিটা পেতে কম কষ্ট করিনি।এত কষ্ট আমি আমার এই চাকরি পেতেও করিনি।চাকরি পেয়ে রেদোয়ানের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে গেলাম।আশা আমাকে দেখেই চিনে ফেলেছিল।আমি সিসি ক্যামেরা লাগানোর জন্য তৈরি হচ্ছিলাম।বাসায় একটা গার্ড সবসময় থাকতো।তারা কুক আর আমার উপর নজর রাখতো।
আশা আমাকে বলেছিল আমি যেন তাদের বেডরুমে ক্যামেরা না লাগাই।লজ্জা পেয়ে বলেছিল এটা।তাই আমি সেই রুমে ক্যামেরা লাগাইনি।
কিন্তু সমস্যা হলো রেদোয়ান ওর গায়ে হাত তুলতো বেডরুমেই।একদিন আশা সব লজ্জা দূরে কাটিয়ে বললো আমি যেন বেড রুমেই ক্যামেরা লাগাই।

ঐ দৃশ্য আপনি নিজে চোখে দেখলে বিশ্বাস করতেন।ক্লিপটা আমি এক জায়গায় রেখেছি।আপনাকে দেখাবো।
প্রমাণ হাতে আসতেই আমি শেষ বারের মতন পি.এ হিসেবে গিয়েছিলাম রেদোয়ানের বাসায়।শেষ বার বললাম কারণ ঐদিনই আশা মারা গেছে।আমি থাকলে আমি ওকে মরতে দিতাম না।,বাঁচাতে পারলাম না ওকে।নিজেকে দোষী মনে হয়।
আমি তাকে মরে যেতে দেখেছি।আমার চোখের সামনে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে ছটফটাতে দেখেছি।সবার চোখ এড়িয়ে ছুটে এসে তার হাত ধরে বুঝতে পারলাম সে মারা গেছে।রেদোয়ান হাসছিল পাশে সোফায় বসে বসে।তার পাশেই সিঁড়ি ছিল।

যেই ফুলদানি মিসিং ছিল ওটা সিঁড়ির উপরে রাখা ছিল।কেন জানিনা।
লোক ধরিয়ে সেটাকে উপরে এনে রেখেছিলো রেদোয়ান।আশাকে মারা যেতে দেখে সিঁড়ির কাছে এসে অট্টহাসিতে মেতে ছিল সে।
আমিই তাকে মেরেছি সেদিন।হ্যাঁ আমি!!!
ধাক্কাটা আমি দিয়েছিলাম।তবে এত উঁচু লম্বা সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়েও সে মরেনি।আমার মাথার সেই রাগ আরও কড়া হয়ে দাঁড়ালো।আপনারা এতগুলো পুরুষ মিলেও ফুলদানিটাকে নাড়াতে পারলেন না,আর আমি একজন নারী হয়ে সেটাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিলাম।সেটার চাপা পড়েই রেদোয়ান মরেছে।তবে সেটা ওর মাথায় লাগেনি।বুকে লেগেছিল।মাথায় লাগলে তে মাথা থ্যাঁতলে যেতো।

ফুলদানি ফেলতে আমার জন্য সহজ হয়েছিল কারণ ফুলদানিটা সিঁড়ির কিণারায় ছিল।লোক ধরিয়ে সেটাকে এখানে রাখতে বলা হয়নি।ভেতরে রাখতে বলা হয়েছিল কিন্তু তারা ভুল করে কিণারায় রেখে চলে গিয়েছিল।আমি সব বাদ দিয়ে নিচে এসে ফুলদানির ভাঙ্গা টুকরো আর মাটি সরিয়ে ফেলেছি।সব একটা বস্তাতে।
গার্ডরা আসার আগেই ঐ বস্তার ভাঙ্গা সব অংশ একটু একটু করে আমি সরিয়েছি রেদোয়ানের বাসার কোণায় কোণায়।
মাটিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছি।আর ভাঙ্গা টুকরো গুলোকে টেনে হিঁচড়ে শহরের বাহিরে নিয়ে এসেছি।
রেদোয়ানের বাসার কুক,সেই গার্ড, রকি,এ্যামিলি ছাড়া আমাকে আর একটা মানুষ ও চিনে না।কেন জানেন??শুনলে হাসবেন।আমি এরকম মোটা ফ্রেমের চশমা আর কালো রঙের মেক আপ করে আসতাম প্রতিদিন।মুখে থাকতো মাস্ক।শুধু চোখ দেখে তারা দ্বিতীয়বার দেখে আমাকে চিনলেও খুনি বলে দোষারোপ করতে পারতো না,মনে সংশয় রয়ে যেতো।একটা ফর্সা মেধা,আর আরেকটা কালো মেধা।

তাদের ভাবনার বাহিরে ছিল রেদোয়ানের পি.এ হিসেবে আসা নতুন মেয়েটাই খুনি।আসলে আমাকে কদিন ধরে খুব কম লোকই দেখেছে।যারা দেখেছিল তাদের কজনকে আমি নিরুদ্দেশ করে দিয়েছিলাম।মারিনি।শহর ছাড়া করেছি।এবার বলুন আমায় কি শাস্তি দেবেন?’
শাওন উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কোটটা হাতে নিয়ে মেধার দিকে চেয়ে বললো,’তুমি ভুল করেছো!’
মেধা মাথা নিচু করে বসে আছে।শাওন ওর গায়ে কোটটা পরিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,’শুট করতে।তাকে বারবার করে মারতে।এত সহজ মৃত্যু ঠিক হলোনা’
মেধা অবাক হয়ে শাওনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।শাওন ওকে বিছানা অবধি এনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাতের দড়িটা খুলছে চুপচাপ।মেধা কল্পানাও করতে পারছেনা তার সঙ্গে কি হচ্ছিল।

-‘শাওন কি কাউকে জানাবেনা যে আসল খুনী আমি??
আচ্ছা! আপনি আমার নাম বলবেন না?’
-‘কেন?’
-‘আমি রেদোয়ানকে মেরেছি যে তাই।আসল খুনী তো আমি’
-‘না।
আসল খুনি রেদোয়ান নিজেই,এবং রকি,এ্যামিলিও।তুমি খুনী না।আমি ভুলে গেলাম কিছুক্ষণ আগে তুমি আমায় কি বলেছিলে।এখন রেস্ট নাও।আমি খাবার আনছি।পরশু আমরা ফিরে যাব’
শাওন চলে গেলো।মেধা অবাক হয়ে ওর চলে যাওয়া দেখেছে।একটা সত্যি কথা জানার জন্য এতটাদিন কত টর্চার করলো আর আজ সত্যিটা জানার পরেও এত স্বাভাবিক ব্যবহার করছে সে।সে তো পারে আজকেই রেদোয়ানের কেসটা অফ করতে কারণ সে খুনী পেয়ে গেছে।তাহলে কোন আমাকে বাঁচাচ্ছে??’

(বর্তমান সময়)
-‘বলুন কি বলবেন?’
-‘নাহ কিছুনা।চলো আমরা তৃনা আপুর বিয়ে খেতে যাই’
-‘চলেন’
দুজনে পাঞ্জাবী স্টাইলে সেজেগুজে তৃনার বিয়েতে হাজির হয়েছে।মাস্ক আর মোটা ফ্রেমের চশমায় সকলের চোখে ধুলো দিতে তারা প্রথম স্থান অধিকার করতে পেরেছে।
তৃনার সাথে শাওন আলাদা ভাবে কথা বলছিল।মেধা ওদিকে তাকাতে তাকাতে খাচ্ছিল। ভুলে বিরাট বড় চিংড়ি মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে ভয়ে কাঁচুমাচু করছিল সে।ভয় হচ্ছিল ধরা না পড়ে যায়।
চিংড়িতে ওর এতবেশি এলার্জি যে হঠাৎ করে হাঁচি দিয়ে বসলো।চশমা খুলে চুল এলোমেলো হয়ে গেলো তার ঐ হাঁচিতে।

ঘোমটা সরিয়ে মুখ মুছে চশমা পরতে গিয়ে মেধা দেখলো শাওনের বোন আরিফা কোমড়ে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।চটজলদি ঘোমটা টেনে বসলো সে।শাওন তৃনাকে বিদায় দিয়ে ফিরে মেধার কাছে এসে বললো,’কি হয়েছে?সর্দি লেগেছে তোমার?’
-“ধুরো!ভুলে চিংড়ি মাছ খেয়ে ফেলেছি।চলুন আমরা যাই।আমার শরীর খারাপ লাগছে’
শাওন মাথা নাড়িয়ে ওকে নিয়ে দু পা এগোতেই দেখলো তাদের দুজনের বাবা হাত ভাঁজ করে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।আরিফা পেছনে থেকে দাঁত কেলিয়ে চেয়ে আছে।

মেধা ঢোক গিলে শাওনের দিকে তাকালো।শাওন তার গোঁফ ঠিক করে হাসার চেষ্টা করে মেধার হাত ধরে তাদের পাশ দিয়ে যাওয়া ধরতেই জনাব ফেরদৌসের কয়েকজন দারোগা এসে শাওনের পথ আটকালো।
শাওনের বাবা হেসে বললেন,’শাওন আর পালাতে হবেনা।দয়া করে স্টেজে গিয়ে বসলে আমরা উদ্ধার হতাম এখন’
শাওন পেছনে তাকিয়ে হিন্দিতে বললো,’কেয়া?আপ কেয়া বোল রাহি হে?’
জনাব ফেরদৌস মেধার ঘোমটা সরিয়ে বললেন,’হাম তো মাজাক কার রাহি হে’
শাওন কপালে হাত দিয়ে চুপ করে আছে।খুব জোরে গান বেজে উঠেছে।তাদের দুজনের বাবাই দুজনকে জোর করে স্টেজে নিয়ে আসলেন।শাওন বারবার করে বলছে সে বিয়ে করবেনা

মেধাও মানা করেছে।কিন্তু এরা কেউ তো আসামি না যে গুলি করে ল্যাটা চুকানো যাবে। সবাই গুরুজন।
শাওন বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে বরের সিটে বসে পড়লো শেষমেষ।
মেধা হাঁচি দিতে দিতে সেও বসেছে।যা মনে হচ্ছে আজ বিয়েটা হয়েই ছাড়বে।
শাওন কপাল টিপতে টিপতে মেধার দিকে তাকিয়ে বললো,’পালাতে পারবে?’
-‘চিতা বাঘের স্পীডে দৌড়াতে হবে হাইচ্চু!!’
-“তুমি এই শরীর নিয়ে চিতা বাঘের স্টাইলে দৌড়াবে?এক কাজ করো,তুমি থাকো! আমি বরং পালাই
আমি না থাকলে তোমাকে কার সঙ্গে বিয়ে দেবে?’
-‘আপনি না থাকলে কেবলাকান্ত একটা ধরে ওর সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে’
-‘তাও ভালো আমার বউ হতে হবেনা তোমায়।আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।জানো তো কারণটা কি’
-“জানি।আর আপনাকে আমিও বিয়ে করতে চাইনা।মোট কথা আমি এখন বিয়েই করতে চাইনা’

-‘শোনো!তোমাদের মতামত জিজ্ঞেস করিনাই।মেধা যাও শাড়ী পরে আসো।তোমার আম্মু সব রেডি রেখেছে।আর শাওন তোমার গায়ে তো পাঞ্জাবি আছে।তুমি বসে থাকো’
-‘আঙ্কেল আপনি অন্তত আমার বাবাকে বোঝান।আমি বিয়ে করতে চাইনা।বিয়েটা দুই পরিবারের মাঝে হয় ঠিক কিন্তু মেইন পয়েন্ট হলো স্বামী স্ত্রীর মতামত।আমরা কেউই কাউকে বিয়ে করতে চাইনা,সেরকম করে পছন্দ ও করিনা’
-‘তো বিয়ের পরে পছন্দ করবে।সমস্যা কোথায়?’
মেধা ফিসফিস করে বললো,’আমার বাবাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।তারা দুজনে হাত মিলিয়েছে।আপনি চিন্তা করবেননা।আমি রেডি হতে গিয়ে পালাবো।’
কথাটা বলে মেধা চোখ মেরে চলে গেলো মায়ের সঙ্গে।তৈরি হবে বলে।
শাওন চিল মুড নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসেছে।
বাবা কোথা থেকে এসে বললেন মাথার পাগড়ি পরে বসতে আর সাথে শেরোয়ানি রেডি আছে ওটা পরে আসলে আরও ভালো হয়।

বাবা নিজে পছন্দ করে কিনেছিলেন।
তারা জানতো আজ শাওন মেধা এখানে আসবে তাই সব তৈরি রেখেছিলেন।কিন্তু তারা যে ছদ্দবেশে আসবে তা একেবারে ভাবতে পারেনি কেউ।আরিফা দেখিয়ে না দিলে তাদের ধরাই যেতো না।
মেধা লাল বেনারসি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে জানালা দিয়ে স্টেজ খালি দেখে ভাবলো শাওন হয়ত পালিয়েছে।তার মানে তাকে আর কষ্ট করে পালাতে হবেনা।
মাথা থেকে বোঝা নেমে গেলো।নেচে নেচে মায়ের সঙ্গে স্টেজে এসে শান্তি মতন বসলো সে।হাসিখুশি এদিক সেদিক তাকিয়ে দূরে শাওনকে শেরোয়ানি পরে আসতে দেখে চট করে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।শাওন ও চমকে গেছে ওকে এখানে দেখে।কাছে এসে বললো,’তুমি না বলেছিলে পালাবে?তাহলে এখানে কি করছো?’
-‘আমি ভাবলাম আপনি পালিয়ে গেছেন তাই তো আর পালানোর বৃথা চেষ্টা করলাম না’
-‘তোমাকে আমি!! কাঁচা চিবিয়ে খাবো কাসুন্দি দিয়ে’
মেধা অসহায়ের মতন লুক নিয়ে বাবার দিকে চেয়ে বললো,’বাবা একটু ওয়াশরুমে যাব।পাঁচ মিনিটে চলে আসবো।যাই?’

-“বিয়ের পরে যেও।এই তো পাঁচ মিনিটেই বিয়ে হয়ে যাবে।বসো মা।’
-‘বাবা জরুরি অনেক।আমাকে যেতেই হবে”
-‘মা!আপাতত এই বিয়ের চেয়ে জরুরি আর কিছু না।চুপচাপ বিয়ে করে নাও তারপর পাঁচ মিনিট কেন?সারা রাত ওয়াশরুমে বসে থেকো কেমন?’
মেধা রাগ করে স্টেজের সিটে ধপ করে বসে গেলো।শাওনের কাছে গান আছে অথচ সে এর ব্যবহার করতে পারছেনা।মুখ কালো করে সেও বসলো।
জোরাজুরি করে বিয়েটা অবশেষে সম্পূর্ন হয়েছে।
বাবা মেধার মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন,”এবার যাও ওয়াশরুমে’
শাওন মেধার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে।আসলে দোষটা মেধারই।সে ভুল করে সুযোগ পেয়েও পালায়নি।ইচ্ছে করছে মেধাকে মেরে ভূত বানিয়ে দিতে।

কি থেকে কি হয়ে গেলো এসব।মাথা কাজ করছেনা।সেই জোর করে বাসর ঘর অবধিও এসে যেতে হলো।মেধা চোরের মতন বউ সেজে বিছানার এক কোণায় বসে ছিল।শাওনকে রুমে ঢুকতে দেখে মুখটা চোরের বড় বোনের মতন করে ফেললো নিমিষেই।শাওন পেছনে তাকিয়ে হনহনিয়ে এসে একটা গোলাপ সামনে তাক করে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো,”তোমার কারণে হয়েছে সব!!তোমার কারণে!!!’
মেধা গোলাপটা নিয়ে বললো,’ধন্যবাদ।স্বর্নের/ডায়মন্ডের কিছু দেবেন না?’
-‘চুপ!!মজা করার মুডে নেই আমি।’
-‘বিয়ে হয়ে গেছে।এখন চেঁচামেচি করে লাভ নেই।’
শাওন নিজের ঠোঁট কামড়ে কোমড়ে হাত দিয়ে মাথা এগিয়ে এনে বললো,’তুমি এত স্বাভাবিক কি করে সেটা বুঝতেছিনা’

-“কারণ আমি পরিকল্পনা এঁটেছি”
শাওন ধপ করে ওর সামনে বসে বললো,’কি প্ল্যান?”
-“রেদোয়ানের কেস মিটে গেলে আমি দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাব।সেখানে বিন্দাস থাকবো।অন্য জবে ঢুকেও যাব।আপনি আপনার মতন। আমি আমার মতন’
শাওন ব্রু কুঁচকে তাচ্ছিল্য করে হাসলো।তারপর লম্বা হয়ে মেধার অন্যপাশে শুয়েও পড়লো।মেধা ঘুরে বসে বললো,’কি হয়েছে?আপনার কি আমার প্ল্যান ভালো লাগেনি?’
-‘জোস!!তবে আরেকজন যোগ হবে তোমার সঙ্গে।বাবা মা আমাকেও তোমার সাথে পাঠাবে।হানিমুন বলে কথা’
-‘আরে হানিমুনে কে যাবে??আমি তো বলছি পালিয়ে যাবার কথা’
-‘ঘুমাও তো!’

-‘রাত আটটা বাজে।কিসের ঘুম এখন?’
শাওন উঠে ঘড়ির দিকে চেয়ে বললো,’তাহলে সবাই আমাকে ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকালো কেন?বাসর তো রাত এগারোটার পর’
মেধা কপাল কুঁচকে বললো,’কি বললেন?’
-“না কিছুনা।আমি যাই টিভি দেখবো’
শাওন উঠে এসে দরজা খুলতে গিয়ে বুঝতে পারলো বাহিরে দিয়ে আটকানো।কি ঝামেলা।সবাই এক সাথে শত্রু হয়ে গেলো।আশ্চর্য!
মেধা এক এক করে মাথার ঘোমটার সেফটিপিন খুলতে খুলতে বারান্দায় চলে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’আপনার ভূতুড়ে প্রেমিকা আসবেনা?আমাকে দোষ দিতে।না জানি আমাকে মেরেই ফেলে’
শাওন পেছনে তাকিয়ে মেধার পাশে রশ্নিকে দেখতে পেলো তখন।রশ্নি রাগান্বিত চোখে মেধার দিকে তাকিয়ে ছিল।শাওন হাঁটার গতি বাড়িয়ে কাছে এসে মেধাকে টেনে বারান্দা থেকে ভেতরে নিয়ে এসে বললো,’যাও বিছানায় বসে থাকো’

-‘কেন?’
-“বারান্দায় এমন করে দাঁড়াবেনা।আমরা কততলায় আছি সে খেয়াল আছে তোমার?’
-‘আমি উঁচুতে ভয় পাইনা’
-‘চুপ করে বসে থাকো।
আর কখনও কিণারায় দাঁড়াবেনা।’
শাওন বারান্দায় গিয়ে পর্দা টোনে দিয়ে রশ্নির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এবার।মেধা পা টিপে টিপে এসে পর্দাটা একটু সরিয়ে ওদের দুজনকে দেখে চলে যাওয়া ধরতেই কি ভেবে আবারও উঁকি মেরে চেয়ে রইলো।রশ্নি কেঁদে যাচ্ছে।শাওন ওর চোখের পানি না দেখে ধমক দিয়ে বললো,’তুমি কি করতে যাচ্ছিলে?মেধাকে নিচে ফেলতে চেয়েছিলে?’
-‘তোহহহ?আমি ফেলতে চাইলেও পারতাম না সেটা জানো তুমি’

-‘পারো কিংবা না পারো।এসব আর কখনও মাথা আনবেনা।বিয়েটাতে ওর দোষ নেই।ওকে দোষারোপ করবেনা।
আর এমনটা নয় যে আমি আর মেধা স্বামী স্ত্রীর মতন বিহেভ করবো আজ থেকে।আমি আজও তোমায় ভালোবাসি।মেধা আমাকে ভালোবাসেনা’
-‘আমি তোমার রুমে যেতে পারিনা কেন আমাকে একটু বোঝাবে?আজ সকালেও তোমার রুমে হেঁটে পর্দা দেখছিলাম।এখন যেতেই পারছিনা’
-‘জানিনা।তুমি মন খারাপ করবেনা কেমন?আর মাথায় যত খারাপ চিন্তা আছে মেধাকে নিয়ে, সেসব ঝেড়ে ফেলো প্লিজ।রিকুয়েস্ট করছি।মেধার কোনো দোষ নেই কিছুতেই’
মেধা মুখ বাঁকিয়ে বিছানায় এসে বসেছে।শাওন রশ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সেও চলে আসলো।রশ্নি চেয়েও বারান্দার দরজা টপকে রুমে প্রবেশ করতে পারছেনা।মনে হচ্ছে শাওন আর মেধার বিয়ে একটা দেয়াল তৈরি করে দিয়েছে মাঝে।আস্তে আস্তে সে দূরে চলে যাচ্ছে।হয়ত এমন দিন আসবে যেদিন সে এই বারান্দায় ও আসতে পারবেনা।কেন এমন হচ্ছে?’

-‘দরজা খোলো কেউ??আমার খিধে পেয়েছে।আমি ডিনার করবো!!মা, বাবা!??আরিফা দরজা খুলো!!
ওপাশ থেকে জবাব এসেছে রাত দশটার পর খাবার পাবে।রেগেমেগে শাওন দরজায় একটা ঘুষি মেরে চলে আসলো।মেধা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার থেকে ববি পিন খুলছিলো এক এক করে।শাওন এক নজর তাকিয়ে বিছানায় এসে লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো।বেশ অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ রাখায় তার ঘুম এসে গেছে।
দশটার দিকে আরিফা দু প্লেট বিরিয়ানি হাতে ওদের রুমে এসেছে।মেধা ওর হাত থেকে খাবার নিয়ে রাখতেই সে ছুটে চলে গেলো আবার।ভয় পাচ্ছে না জানি ওদের ধরিয়ে দেওয়ার শাস্তি পেতে হয় তাকে।
দরজা লাগিয়ে মেধা শাওনের কাছে এসে আস্তে করে দুবার ডাকলো।কিন্তু শাওন উঠলোনা।সে গভীর ঘুমে।তখন খিধায় ছটফট করছিল সেটা মনে আসায় শাওনকে ধাক্কা মেরে উঠিয়ে দিলো সে।ওদিকে আরিফা দরজাটা আবার বাহিরে দিয়ে লাগিয়ে চলে গেছে।

শাওন আচমকা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।গান ধরে মেধার কপালে চেপে ধরতেই হুস আসলো তার।গান সরিয়ে বললো,’আমাকে ঘুম থেকে এমন করে তুলবেনা।নাহলে কোনো একদিন শুট করে বসবো।ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।কেন উঠালে?’
-‘খাবার দিয়ে গেলো আপনার ছোট বোন।’
খাওয়ার কথা শুনে শাওন লাফ দিয়ে উঠে বসে খাওয়া শরু করে দিয়েছে।খুব খিধে পেয়েছে তার।মেধা চামচ নিয়ে সেও খেতে বসলো চুপচাপ।শাওন ওর দিকে চেয়ে বললো,’বিরিয়ানি হাত দিয়ে খেতে হয়।
চামচ দিয়ে খেলে তার টেস্ট পাওয়া যায়না বুঝলে?’
শাওনের কথামতন মেধা হাত ধুয়ে এসে নিজের বিরিয়ানি নিতে গিয়ে দেখলো শাওন তার প্লেট সাবাড় করে এখন চাটছে খালি প্লেট।
মেধা তার প্লেট থেকে কিছুটা আরও দিলো।শাওন দাঁত কেলিয়ে বললো,’আমার অনেক ফেভারিট এটা।দিলে পুরো প্লেটটাই দিয়ে দিতে পারো।মনে কিছু নিব না’

সেই রাতটা শেষ হবার নাম নিচ্ছেনা।মেধা হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে আর শাওন ফোন দেখছে।বোরিং লাগছিল বলে মেধা ঘুরে বসে বললো,’আমার ক্লিপের খবর তো পেলাম না।কাল একবার ব্যাংকে যাব।আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?’
-‘উহু!কাল রেদোয়ানের বাসায় যেতে হবে।রকি,এ্যামিলি মিলে যে আশাকে মেরেছে তা নিয়ে উপযুক্ত প্রমাণ জোগাড় করতে হবে।রেদোয়ানের খবর তো জানিই।তাছাড়া রকিকেও ধরতে হবে।ওর এমন লুকোচুরি আর ভালো লাগেনা।তাছাড়া এখন তাদের হাতে যদি সত্যি তোমার ঐ ক্লিপটা থেকে থাকে,তাহলে ওরা এখন তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।’
মেধা হাসি দিয়ে বললো,’আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করলে খপ করে ধরে ফেলবো।আমাকে চিনেনা তারা’
-“তোমাকে আমি চিনি।আর কারোর চিনতে হবেনা।এখন ঘুমাও।’

মেধা মুখ বাঁকা করে শুয়ে পড়েছে।শাওন ও শুয়েছে।রুমের আলো বন্ধ।
পাক্কা দশ পনেরো মিনিট পর মেধা চোখ খুলে যখন বারান্দার দিকে তাকালো তখন সেখানে রশ্নিকে আচমকা দেখে ভয় পেয়ে একঝটকায় শাওনের কাছে চলে গেলো সে।শাওন ও জেগে গেছে।ল্যাম্প শ্যাড জ্বালিয়ে বললো,’কি হয়েছে তোমার?’
-“ভভভভভূত!’
-‘ভূত?কিসের ভূত?’
-‘আপনার প্রেমিকা ভূত।বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।কেমন চেহারা হয়ে আছে তার।যেন মর্গ থেকে উঠে এসেছে।
আমার ভয় করছে। মনে হয় যেন এখন আমাকে মারতে এসেছে।’
-‘মেধা আন্দাজে কি না কি দেখেছো।শুয়ে পড়ো।শুধু শুধু আমার কাঁচা ঘুমটা একেবারে চোখ থেকে উঠিয়ে দিলে।কই আমি তো কিছু দেখছিনা’

-‘আরে সত্যি বলছি আমি’
শাওন মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়েছে আবার।মেধা আস্তে করে ওর থেকে এক বিঘপ দূরত্বে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভয় করছে এখন।তাই শাওনের দিকে ফিরে শুয়ে পড়লো সে।
শাওন চোখ একবার খুলতেই মেধাকে এত কাছে দেখে ছিঁটকে সরতে গিয়ে বিছানার নিচে পড়ে গেছে একেবারে।
মেধা উঠে নিচে তাকিয়ে বললো,’আপনিও ভূত দেখলেন নাকি?দেখছেন?আমি সত্যি বলছি’
-‘আআআ আমার কোমড়!!
তুমি আমার এত কাছে এসে শুয়েছিলে কেন?’
-‘আপনার ভূতুড়ে প্রেমিকা আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল।নাহলে আমি কেন হুট করে একটা অচেনা,অজানা ছেলের গা ঘেঁষে শুতে যাবো?’

-‘একটা সোফা নেই যে আলাদা শুবো।দরজাটাও আটকানো।যাও ঐ কিণারায় যাও’
মেধা ঢোক গিলে বললো,’আপনার প্রেমিকাকে বলেন আমাকে যেন ভয় না দেখায়’
শাওন উঠে ঘুরে এসে মেধার পাশে শুয়ে বললো,’এবার হ্যাপি?’
মেধা হাঁপ ছেড়ে বেঁচে শাওনের জায়গায় শুয়ে একবার বারান্দাতে দেখে ফাইনালি চোখ বন্ধ করলো ঘুমানোর জন্য।
সকালে পর্দা সরিয়ে চোখে রোদ ফেলার কাজ শাওনের একটুও পছন্দ না।আর সেই অপছন্দনীয় কাজটা করে বসেছে মেধা।

পর্দা সরিয়ে নিজের বাড়ি থেকে আনা ব্যাগ খুলে সেলোয়ার কামিজ বের করে চলে গেছে ফ্রেশ হতে।শাওন রেগে মেগে কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করার পর ওর মনে আসলো কাল তার বিয়ে হয়েছে।আর এই কাজ তার বউয়ের।
রাগ দমিয়ে রেখে ওয়াশরুমের কাছে এসে মনমত বকাঝকা করে সে বিছানায় এসে বসে রইলো মেধার উত্তরের আশায়।
মেধা নরমালি ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে চুল মুছতে মুছতে শাওনের দিকে না তাকিয়ে আয়নার কাছে চলে গেছে।শাওন একটা কুশন ছুঁড়ে মেরে বললো,’হোয়াট?এত কিছু বললাম পাল্টা জবাবে কিছু বলবেনা?’
-‘কখন বললেন কতকিছু?’
-‘মানে তুমি কিছু শোনোনি?’

-‘কি শুনবো?আমি তো শাওয়ার অন করেছিলাম।এপাশের আওয়াজ কানে আসেনি’
-‘ধ্যাত!!শোনো লাস্ট বার বলছি।আর কখনও সকাল সকাল পর্দা সরাবেনা।সকালের ঘুম রোদ দিয়ে নষ্ট করা লোক আমার পছন্দনা।আর একদিন করলে ধাক্কা মেরে বারান্দা দিয়ে ফেলে দেবো তোমায়’
-‘আমি কি জানি আপনার রোদে এলার্জি আছে?বিয়ের প্রথম দিনেই এরকম চেঁচাচ্ছেন কেন?আমি আপনার রশ্নি না।’
-‘তো তুমি কে?’

সঞ্চারিণী পর্ব ৩১+৩২+৩৩

মেধা চিরুনি নিয়ে এগিয়ে এসে এক পা দিয়ে শাওনের পা মাড়িয়ে ওর গলায় চিরুনি চেপে ধরে বললো,’আমি সেই সঞ্চারিণী যাকে সঞ্চার করতে আপনাকে মালদ্বীপ অবধি চলে যেতে হয়েছিল’
-‘ইউ নো হোয়াট??আমি তোমায় ভয় পাইনা’
মেধা চিরুনি আরও চেপে ধরে বললো,’ভয় পাবেন কি করে?আমি তো এখনও কাটাকাটি করি নাই।যেদিন চামড়া খুলে নিব সেদিন বুঝবেন আমি কি জিনিস’
-‘চামড়া খুলবে কেন?’
-“আপনার রশ্নির জ্বালাতনে’

কথাটা বলে মেধা বারান্দার দিকে তাকিয়ে আবারও রশ্নিকে হঠাৎ দেখে ভয়ে শাওনের কোলেই বসে পড়েছে।শাওন কপাল কুঁচকে বললো,’আমার কাছাকাছি আসার ধান্ধা তাইনা?’
-‘মোটেও না।পেছনে তাকিয়ে দেখুন।আপনার রশ্নি ভূতের মতন দাঁড়িয়ে আছে ওখানে’
-‘তুমি না আমাকে ভয় দেখাতে একজন ক্ষমতাবান নারী?তাহলে রশ্নিকে এমন ভয় পাও কেন?’
-‘মানুষ ভয় পাইনা তা ঠিক,তবে ভূত ভয় পাই তাও ঠিক।আপনার গার্লফ্রেন্ডকে বলবেন আমাকে যেন এমন ভয় না দেখায়।তার এমন কাজে উল্টো রিয়েকশান হচ্ছে তা কি সে জানে??
এই যে কাল রাতে আপনার গা ঘেঁষে ঘুমানো,আজ আপনার কোলে বসে পড়া।এসব দেখেও তার আক্কল হচ্ছেনা??
আমাকে ভয় দেখালে আমি ভয় পেয়ে সেই আপনাকেই ধরবো।কারণ এই রুমে আর কেউ নেই।এটা আপনার গার্লফ্রেন্ডকে বুঝিয়ে দিন।’

-‘উঠো এখন।আসছে সঞ্চারিণী!কথায় কথায় ভয় পায়।ভীতু কথাকার’
-“কিছু বললেন আপনি??ভুলে যাবেননা আমি মেরেছিলাম রেদোয়ানকে’
-‘না ভুলবো কেন?আমি রশ্নিকে বলবো সে যেন আমায় ভয় দেখায়।ঠিক আছে??’
-‘আপনাকেও দেখানোর দরকার নেই।
বলুন একটা ভালো ভূত দেখে বিয়ে করে নিতে।কারণ আপনি তো বিয়ে করে ফেলেছেন।এখানে তার আর কোনো কাজ নেই’

সঞ্চারিণী পর্ব ৩৭+৩৮+৩৯