সঞ্চারিণী পর্ব ৪+৫+৬

সঞ্চারিণী পর্ব ৪+৫+৬
আফনান লারা

বাগানে যে শুধু বিদেশীফুল দিয়ে সারি বানানো তা কিন্তু নয়।নামকরা গুটিকয়েক দেশী ফুলও দেখতে পাওয়া যায়।সাদা আর হলুদ গোলাপ নজরে পড়লো সবার আগে।তাছাড়া রজনীগন্ধা, বেলি,জুঁই ও আছে।বিদেশী ফুল রেখে শাওন দেশী ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।দেশী ফুলে আলাদা অনুভূতি জমা আছে।তাদের ছুঁতে আপন আপন ভাব আসে যেটা বিদেশীগুলো থেকে আসেনা।

তার মানে নিশ্চয় মিঃ রেদোয়ান এখান থেকেই ফুল তুলে নিয়ে ফুলদানিতে রাখতেন।তিনি বড়ই সৌখিন মানুষ ছিলেন।তার ওয়াইফ ও নিশ্চয় সৌখিন ছিলেন?কারণ একজনের পক্ষে প্রতিটাদিন শখের জিনিসের এত যত্ন নেওয়া সম্ভব না।মালি ছিল না।নিজ হাতে এই বিরাট বাগান সামলাতেন।
যতদূর জানি তাদের কুক অনলি একজন ছিল।আশ্চর্যকথা!এতবড় কোটিপতি একটা মানুষের কুক মাত্র একজন?তাও সে এই মূহুর্তে নিরুদ্দেশ। অন্তিক স্যার জেনেবুঝে এরকম পোঁচানো একটা কেস আমাদের ঘাড়ে ফেললেন।কুক মালিককে খুন করার সাহস দেখাবে না।তবে সে পালিয়ে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে।ধরা পড়লে পিঠে কয়েক ঘা পড়বে।সেগুলো আমি দেবো।গরুটা থাকলে অনেক ইনফরমেশন পাওয়া যেতো এতক্ষণে।পালিয়ে আমাদের কাজ বাড়ালো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শাওন এবার তার হাতের ফুলটার গাছ খুঁজছে হেঁটে হেঁটে।সবার শেষের সারিতে এসে অবশেষে দেখা পেলো হোয়াট এগরেট ফ্লাওয়ারের।ধবধবে সাদা এই ফুলের পাপড়িগুলোর মাথার দিকে নকশার মতন খাঁজ কাঁটা।
-‘দারুণ!ভাবলাম মিসিং ফুলদানির ফুল পেয়ে গেলাম।কিন্তু আফসোস তা পেলাম না।এখানে দেখি অর্কিড,জার্বেরা,ল্যাভেন্ডার, গ্লাডিওলাস,আইরিশ সহ আরও অনেক বিদেশী ফুলগাছ আছে।মিসিং ফুলদানিটা খুঁজে পেতে হবে তো।!’
মেধা কপালে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসে বললো,’শাওন স্যার আমি আপনাকে ফুলদানিটা খুঁজে দেই?’

শাওন পেছনে তাকিয়ে বললো,’আমার থেকে দূরে থাকো।তোমাকে বললাম না ডিস্টার্ব করবা না।নুহাশের কাছে যাও।দেখতে হসপিটাল থেকে পালানো রোগীদের মতন লাগছে, উনি নাকি আমাদের অফিসের নতুন অফিসার!’
মেধা মন খারাপ করে চলে আসলো নুহাশের কাছে।নুহাশ আর নিতু মজা করছিল একটা ঘটনা নিয়ে।রায়হান নাকি ফুলদানিটা একা উঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ আধ ঘন্টা ধরে।

মেধা ওদের হাসিঠাট্টাতে অংশগ্রহণ না করে সোজা রেদোয়ানের রুমে এসে ঘুরে ঘুরে সব দেখছে।রুমটার মাঝখানটায় বড়সড় একটা বিছানা পাতা।তার দুপাশে সবুজ রঙের ফুলদানি দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জায়গা দখল করে।এই লোকটা ফুলদানি বলতে পাগল ছিল মনে হয়।বেডরুমে কেউ ফুলদানি রাখে?এসবের ভেতরেও টাকা নেই তো?
বারান্দা থেকে পুলের ভিউ আসে।নিচে একটা ছোটখাটো পুল আছে।সেটা ভালো করে না দেখেই মেধা অন্য কাজে আসলো।

আলমারিটা খুলতেই একটা হাতুড়ি গিয়ে সোজা পড়লো ওর পায়ে।ব্যাথা পেয়ে দুম করে নিচে বসে পড়লো সে।পা ধরে বললো,’লোকটা মরেও শান্তি দিলো না হাতুড়ি কেউ আলমারিতে রাখে?আশ্চর্য!’
হাতুড়ি পড়ে মেধার পা অর্ধেক অবশ হয়ে গেছে।উঠার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ।এই পুরো বাড়িটা কুফাতে পরিণত হয়েছে মনে হয়।অনেক কষ্টে শেষে উঠতে পারলো সে।হাতুড়িটা আলমারিতে রাখতে গিয়ে দেখতে পেলো তাতে রক্তের দাগ।তাও শুকিয়ে আছে।জোর গলায় নুহাশকে ডাক দিলো সে।তার বদলে আসলো রায়হান।

রক্ত দেখে সে সোজা শাওনের কাছে চলে গেছে।মেধা আলমারির জামাকাপড় সব সরাতে গিয়ে হাতুড়ির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সব লোহা তামার জিনিস পেলো।স্ক্রু ডাইভার ও কেউ জামা কাপড়ের সঙ্গে রাখে?
শাওন হাতুড়িটাকে ল্যাবে পাঠিয়ে রেদোয়ানের রুমে আসলো পুনরায়।মেধা আলমারি দেখছে নিজে অর্ধেক ভেতরে ঢুকে।শাওন ওকে সরিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো,’তোমার গ্লাভস কই?’
মেধা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেলে কি আমাকেও ধরে নিয়ে যাবেন নাকি?আর যদি পান ও,সেটা স্কিপ করবেন।সিম্পল ‘

-‘তার চেয়ে ভালো হবে তুমি গ্লাভস পড়লে।এটা নিয়ম।এত বার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরীক্ষা করার ঝামেলা থাকবেনা তাহলে’
—-
এক এক করে সব ধাতু পাতের সরঞ্জাম একসাথ করেছে রায়হান আর নুহাশ মিলে।সবার মুখ ফ্যাকাসে।সব গুলো সরঞ্জামে রক্ত লেগে আছে।এগুলো দিয়ে কাকে টর্চার করা হতো?আর কেন?’

ময়নাতদন্তের রেসাল্ট আসা অবধি অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে।আজকের জন্য কাজ শেষ।যে যার বাসায় ফিরছে।
শাওন ও বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।মেধা রেদোয়ানের বেডরুমের আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আয়নাটা ছুঁয়ে দেখে ভয় পেয়ে ছুটে চলো গেলো।পায়ে হালকা ব্যাথা বলে ছুটতে চেয়েও অর্ধেক পথে গিয়ে আস্তে হাঁটতে হলো তাকে।সন্ধ্যা হয়ে গেছে।রেদোয়ানের বাসা থেকে বের হবার পর যে রোডটার মুখোমুখি হতে হয় সেটা বড় রাস্তার মোড়।গাড়ী গোড়ার অভাব নেই।খুব সহজেই একটা রিকশা পেয়ে গেছে মেধা।

শাওন তার প্রাইভেট কার ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছে।আজিমপুরের বহুতল ভবনগুলোর মধ্যে একটি ভবনের আটতম তলায় সে থাকে।তার পুরো পরিবারকে নিয়ে।বাবা,মা আর ছোট দুটো বোনকে নিয়ে।গাড়ী পার্ক করে লিফটে ঢুকলো সে।স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে পাশে তাকিয়ে একজনকে দেখে মুখে হাসি ফুটলো ওর।তার পাশেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রশ্নি।
শাওন ওর হাত ধরে ঘুরিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,’তা ম্যাম আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’

-‘উহু’
শাওন হাত ভাঁজ করে বললো,’পারফেক্টলি বলো’
রশ্নি ভ্রু কুঁচকে পিছিয়ে গিয়ে বললো,’রাগ হলো একটুখানি।তবে সেটা চলে যাবে।সমস্যা না।যদি শাওন স্যার আমার চুলে বেনি করে দেন তো!’
শাওন নাথা নাড়িয়প বললো,’যথা আজ্ঞা’
——
অষ্টম তলা আসতেই লিফট খুলে গেলো।শাওন রশ্নির দিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসতে হাসতে এসে কলিংবেলে চাপ দিলো।ওর বড় বোন তৃনা এসে দরজা খুলেছে।শাওন ওর মাথায় হালকা পাতলা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো,’কি অবস্থা বিয়ের কনে?’
-‘এই তোর আসার সময় হলো?আমি না বললাম আজ তোকে নিয়ে শপিংয়ে যাব?’
-‘আজকে না।আমি অনেক টায়ার্ড ‘

কথাটা বলে গিয়ে কাঁচের ডাইনিং টেবিলটার পাশে চেয়ার টেনে বসে গ্লাসে পানি ঢালছে শাওন।তৃনা কোমড়ে হাত দিয়ে এদিকে এসে বললো,’সমস্যা কি??কিসের এত টায়ার্ড তুই?সারাদিন কাজ আর কাজ।যখন আমি বিয়ে করে চলে যাব তখন বুঝবি আমি কি ছিলাম’
-‘এই যে আপা শোনেন!!আপনার শ্বশুর বাড়ি বেশি দূরে না।
প্রতিদিন গিয়ে একবার করে দেখে আসতে পারবো।এত সেন্টি খাওয়ার কিছু নেই’
তৃনা মুখ বাঁকিয়ে ওর জন্য চা বানাতে চলে গেছে।শাওন দরজার কাছে এসে রশ্নির হাত ধরে ওকে ভেতরে নিয়ে এসে দরজা লাগালো।তারপর সোজা নিয়ে গেলো নিজের রুমে।

-‘ম্যাম আপনি বসুন।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি’
রশ্নি মাথা নাড়ালো।শাওন তোয়ালে হাতে চলে গেছে।
তৃনা চায়ের কাপ হাতে পাক্কা দশ মিনিট পর শাওনের রুমে আসলো।দরজায় নক না করেই ঢুকতেছে সে।শাওন বসে বসে রশ্নির চুলে বেনি করে দিচ্ছিলো।রশ্নি নিচে কার্পেটে বসে আছে গোল হয়ে আর আর শাওন বিছানায় বসে আছে।দুজনের মুখেই হাসি আর কত আড্ডা!
শাওনের রুমে ইয়েলো টোনের আলো জ্বলছে।বারান্দায় লাল, নীল, সবুজ, হলুদের ছোটবড় লাইট ঝুলছে।লম্বা বাতাসে টবে ঝুলন্ত ফুলগাছগুলো দুলছে।শাওন বেনি টান দিয়ে বললো,’টব দুলছে বাতাসে।তুমি কিসের জন্য দুলছো?’
রশ্নি মাথা বাঁকিয়ে বললো,’আমি দুলছি শাওনের কেয়ারিংয়ে’

-‘শাওন শুনছিস?’
শাওন চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো তৃনা আপু হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে। সে উঠে গিয়ে তৃনার হাত থেকে কাপটা নিয়ে বললো,’মা কোথায়?’
-‘তার রুমে’
শাওনকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না তৃনা।সোজা হেঁটে মায়ের রুমে চলে গেছে সে।মা তখন একটা নামকরা ম্যাগাজিন পড়ছিলেন বিছানায় বসে বসে।তৃনা ছুটে এসে বললো,”মা কিছু একটা করো’
মা মাথা তুলে বললেন,’কেন?কি হলো আবার?’

-‘শাওনকে এই ঘটনাটা থেকে বের করো মা।আর কতদিন এটা চলবে?’
মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ম্যাগাজিনটা গুছিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বললেন,’মানুষের দেহের চিকিৎসা হয়।কিন্তু মনের না।ওকে নামিদামি ডাক্তার দেখিয়ে কি লাভ হলো আমাদের?সেই তো অফিস থেকে ফিরে সারা রাত ধরে গল্প করে রশ্নিকে নিয়ে।আফসোস হয়।রশ্নিকে আমরা কেন দেখিনা।’
তৃনা মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো,’যে ওকে পাগলের মতন ভালোবাসতো সেই তো ওকে দেখার সৌভাগ্যটা পেয়েছে’
-‘এটা সৌভাগ্য না তৃনা।এটা একটা রোগ।চেয়েও কিছু করতে পারছিনা আমরা।’

-‘চলো রশ্নি! আমরা বিয়ে করে ফেলি।আমাদের সংসার হবে।বাচ্চাকাচ্চা হবে।আর কত অপেক্ষা করবো বলো?বয়স তো কম হলোনা’
রশ্নি চুল ঠিক করে উঠে বারান্দায় চলে গেছে।শাওন ওর পিছু পিছু এসে পা উঁচু করে উপরের ঝুলন্ত টবটা থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে বললো,’আর কত পালাবে?বিয়ের কথা বললেই পালাও কেন বলোতো?’
কথা শেষ করে শাওন ওর কানে ফুলটা গুঁজে দিতে যেতেই ফুল গড়িয়ে ফ্লোরের উপর পড়ে গেলো।শাওনের চোখে সাথে সাথে পানি চলে এসেছে।রশ্নি হাত দিয়ে ওর মুখ স্পর্শ করে বললো,’প্লিজ এই সামান্য বিষয় নিয়ে এখন কাঁদবেনা’

শাওন রশ্নির হাত ধরে বললো,’আমি তোমায় ছুঁতে পারলে ফুল কেন তোমায় ছুঁতে পারেনা?’
রশ্নি হাত বাড়িয়ে অশ্রুসিক্ত শাওনের চোখজোড়া মুছে দিয়েছে।তারপর নিচের ফুলটার দিকে তাকিয়েই তাচ্ছিল্য করে হেসে ফেললো সে।শাওনের রাগ হলো।খুব রাগ হলো।
তার কপালের রেখায় রেখায় বাঁকাভাব ফুটে উঠেছে।নাক লাল হয়ে গেছে।
কেন রশ্নি হাসছে?আমি কাঁদছি তাহলে সে কেন হাসছে?সে কি আমার প্রশ্নের জবাবে সবসময় এভাবে হেসেই উড়িয়ে দেবে?সে কি বোঝে না আমি তাকে নিয়ে সিরিয়াস?
এই ভেবে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো সে।রশ্নির তারপরেও হাসি পাচ্ছে।শাওনের রাগ ভাঙ্গানো উচিত বলে মনে করে
হাসি থামিয়ে শাওনের সামনে এসে বললো’ফুলটাকে মেরে দিবো?তাহলে ভালো লাগবে?’
শাওন মুখ ঘুরিয়ে বারান্দা থেকে চলে আসলো।

রশ্নির জানা আছে।শাওন এখন চাদর মুড়িয়ে কড়া ঘুম দিবে।একেবারে পরেরদিন সকালে চোখ খুলে তাকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে আবার।শাওনের রাগ নাকের আগায় থাকে।আর সেই রাগ চোখের পলকে কিংবা এক রাত পার হলেই দমে যায়।এটার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই।শাওনের রাগ করা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি ভালোবাসাটাকে আরও ঘাড়ো করতে রাগ করে বসে থাকে।
আসলে সহজ কথা হলো,একটা সম্পর্কে রাগ ভাঙ্গন সৃষ্টি করেনা সবসময়।মাঝে মধ্যমে এটা সেই সম্পর্কটাকে আরও মজবুত করে তোলে।আপনি পাগল হয়ে যাবেন সম্পর্কটার নেশায় আবদ্ধ হতে।শাওন এখন তাই করছে।সে আমায় তার প্রতি আরও আসক্ত করে তুলছে।

-‘ঐদিন হাত ভেঙ্গেছিলি আর আজ মাথাও ফাটিয়েছিস?তোকে কে বলেছে অফিসার হতে?’
-‘তোমরাই বলেছিলে।বাবার আদর্শ পালন করছি।ভুলে যাবা না আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার।এখনও রিটায়ার্ড হয়নি।আর আমি কিন্তু অফিসার হওয়ার আগেই হাত ভেঙ্গেছিলাম এটা আর ওটা এক না।’
-“একই।অফিস অফিস করে করেই তো হাত ভেঙ্গেছিলি।এখন আবার কপালে কি হলো তোর?’
-‘ও কিছুনা।জলদি খাবার রেডি করো।খুব খিধে পেয়েছে আমার।’
মা চলে যেতেই মেধার ছোট বোন মৌমিতা এসে হাজির ওর কাছে।ক্লাস টু তে পড়ে সে।মেধা ওর চুলগুলোকে গুছিয়ে দিয়ে বললো,’কই ছিলি এতক্ষণ? ‘

-‘মটু পাতলু দেখছি।তুমি দেখবেনা?’
-‘দেখবো তো।আপু ফ্রেশ হয়ে আসি?তুই যা টিভি দেখ’
মৌমিতা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।মেয়েটা বড্ড সহজ সরল।অবশ্য বাচ্চারা হয়ই সহজ সরল।তাদের মুখে যেমন মায়া, মনেও তেমন মায়া।আগে বাসায় ফিরলেই তাকিয়ে থাকতো যতক্ষণ না ব্যাগ থেকে ক্যাটবেরি বের করে তার হাতে দিতাম।
আর এখন কদিন হলো সে আর চকলেটই চায় না।দূর থেকে উঁকি মেরে দেখে আবার চলে যায়।কারণটা মা বলেছিলো আমায়।আমি হেসেছিলাম তার ভাবনার কথা শুনে।এক হাত ভাঙ্গা বলে আমি নাকি চকলেট কিনে ব্যাগে পুরতে পারবোনা তাই সে আর চকলেট চায়না।আজ ভুলে গিয়েছিলাম কাজের চাপে।নাহলে আমি তার জন্য চকলেট আনতে ভুলিনা।’

মৌমিতার কথা ভাবতে ভাবতে গায়ের কালো কোটটা অনেক কষ্টে খুলছে সে।হাতের ব্যাথাটা তাজা এখনও।এই তো ঐদিনই হাতে চোট পেয়েছিলো।
প্রচুর ব্যাথা হয়েছিলো তখন।প্রচুররররর
চুলগুলোকে ক্লিপ দিয়ে বন্দি করে অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়েছে মেধা।হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শুয়ে থেকেই পায়ের উপর পা তুলো বললো,’আমার নাকি হাত কাঁপে শুট করতে।আমি কোনো কাজের না।আহারে!আফসোস হয় তাদের উপর যারা আমার বাহ্যিক রুপ দেখে সিওর হয় আসলে আমি নামক মানুষটার ক্ষমতা কতদূর।সে জানেও না মেধা কি জিনিস।অবশ্য কখনও জানবেও না।সারাজীবন ভীতূর ডিম মেধাকেই চিনবে তারা।এর পেছনে লুকিয়ে আছে যে সঞ্চারিণী তাকে সঞ্চার করা ওদের কারোর কাম্য নয়।স্পেশালি মিঃ শাওনের।ঐ লোকটার এমনিতেও মাথার তার ছিঁড়া।আমার ক্ষমতা জানতে তাকে নজর রাখতে হবে আপকামিং ক্রাইম স্পটে।সে বুঝবে এটা এক সঞ্চারিণীর কাজ,তবে সে জানবেনা এটা কোন সঞ্চারিণীর কাজ।সঞ্চারিণীরা নাম দিয়ে বেড়ায়না।তাদের পদবি তারা সঞ্চারিণী’

-‘মেধা দেখ তো কে এসেছে।তোর বাবা কিনা গিয়ে দেখ।মৌমিতা দরজার নাগাল পাবেনা।আমার হাতে ডিম লেগেছে’
মেধা উঠে গেলো দরজা খুলতে।চেক না করেই খুলে ফেললো আজ।দরজার ওপারে কেউ নেই।ভ্রু কুঁচকে মেধা বাহিরে বেরিয়ে করিডোরের দুপাশে তাকালো তাও সব ফাঁকা দেখে পুনরায় বাসায় ঢুকে দরজা লাগাতে যেতেই খুব জোরে একটা ধাক্কায় ছিটকে ফ্লোরে গিয়ে পড়লো সে।হাতের ব্যাথাটা যেন আরও গাঢ় হয়ে গেছে।মনে হয় হাত আলগা হয়ে গেলো বুঝি।

অন্য হাত দিয়ে হাতটা চেপে মাথা তুলে দেখলো তিনজন এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে।সবার মুখে মাস্ক লাগানো।দুটো চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না।
গান তাক করে রেখেছে মেধার দিকে।মৌমিতা অপরিচিত মানুষ দেখে চিৎকার করে বসলো।একটা লোক এগিয়ে এসে ওর মুখ চেপে ধরে অন্য রুমে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে বাহিরে দিয়ে লক করে আবার মেধার সামনে এসে দাঁড়ালো।মৌমিতার আওয়াজে মা ছুটে এসে এসব দেখে তিনিও চিৎকার করতে গিয়েও পারলেন না।মেধা ঠিক হয়ে বসে বললো,’আমার মায়ের কপাল থেকে গান সরাও’

লোকটা গান সরিয়ে ইশারা করলো একজনকে।সে মৌমিতা যে রুমে আছে ঐরুমে মাকেও রেখে এসে বাহিরে দিয়ে আবার দরজা লাগিয়ে ফেললো।
-‘কে তোমরা?আদৌ জানো আমি কে?’
-‘তুমি কে সেটা আমাদের জানার বিষয় না।
আমাদের জানার বিষয় হলো যে ক্লিপটা তোমার কাছে আছে সেটা ফেরত দাও।নাহলে আজ তোমার পুরো পরিবার শহীদ হবে।’

লোকটা থুঁতনিতে হাত রেখে দাঁত কেলিয়ে আবারও বললো,’আর তোমাকে আমরা এমনি এমনি মারবো না।এত সুন্দর জিনিসকে কি আর সোজাসুজিভাবে মারা যায়??’
মেধা পকেটে চাপ দিয়ে টের পেলো ওটাতে গান নেই।তখন কোট খুলেছিল অফিস থেকে ফিরে।কোটের ভেতর গানটা ছিল।উপায় না পেয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে এখন।
লোকটা গান মেধার কপালে ঠেকিয়ে ধরে বললো,’কাজ শুরু করবো নাকি ক্লিপ দিয়ে দিবা?’

মেধা তার পায়ে হাত দিয়েছে।পায়ের টাকনুর কাছাকাছিতে তার গান আরেকটা থাকে প্যান্টের নিচের ভাগে যার কারণে দেখা যায়না।ভাগ্যক্রমে তখন সেটা খুলে রাখেনি সে।লোকটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।এরপর পায়ের থেকে গান নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কপালে তাক করে বললো,’ওদের সবাইকে বলো গান নিচে নামাতে।নাহলে তোমায় আমি শুট করবো।আর এটাও খুব ভালো করে জানি যে তোমরা আমায় মারবেনা।আমায় মারলে ক্লিপ পাবে কি করে?

বুঝলে,ট্রেনিং করার সময় ভুলে কজনের গায়ে সত্যি সত্যি গুলি মেরে দিয়েছিলাম।আশেপাশে হসপিটাল ছিল বলে তারা বেঁচে গিয়েছিলো।কিন্তু আমার বাসার আশেপাশে তো দূরে থাক,দূর দূরান্তেও এমন হসপিটাল নেই যেখানের ডাক্তার গুলি উঠিয়ে সারিয়ে তুলতে পারবে তোমায়।
আর এখন তো ট্রেনিং শেষে একেবারে পাকাপোক্ত অফিসার হয়েছি।কিন্তু এবারও যদি ভুল হয় তাও মরবা।আর ভুল নাহলেও মরবা।’
লোকগুলোর মধ্যে প্রধান যে আছে তার আদেশের অপেক্ষা করছে বাকিরা।মেধা গানটা আরও জোরে চেপে ধরে বললো,’সুন্দর করে মারার কথা ছিল না?আমিও তোমায় খুব সুন্দর করে মারবো।শুধু ছেলেরা মেয়েদের টর্চার করে মারবে কেন।মেয়েরাও টর্চার করুক।থ্যাংক গড বাবা কাল অনেকগুলো মোমবাতি কিনে এনেছিলো।টর্চারের সূচনা পর্ব ওটা দিয়েই শুরু হোক?’

-‘রশ্নি শুনতে পাও??রশ্নি?’
শাওন শোয়া উঠে বসে দেখলো রশ্নি নেই কোথাও।
-‘কই গেলো মেয়েটা।আমি অভিমান করেছি বলে সে উল্টে অভিমান করেনি তো?’
বিছানা ছেড়ে নেমে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে বারান্দার পর্দা টেনে ফেললো শাওন।সকাল সকাল তার রুমের পর্দা সরানো মোটেও পছন্দ না তার।কেউ তার অপছন্দের এই কাজটা ভুলেও করেনা।
তাহলে আজ কে করলো এমনটা।চোখ টনটন করছে।সবেমাত্র ঘুম থেকে ওঠা চোখ আমার।শুরুতেই এত আলো সহ্য হয় নাকি।রশ্নি কই তুমি?
পর্দা তুমি সরালে?

শাওনের মুখের বুলি আটকে গেলো।রশ্নি কিভাবে সরাবে।রশ্নি কি তাহলে ফিরে এসেছে?
মুখে এক রাশ হাসি নিয়ে শাওন রুম থেকে বের হতেই বাবার মুখোমুখি হলো।বাবা ওর ঘাড়ে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে বললেন,’কি হলো শাওন?ভয় টয় পেলো নাকি?ওহ হ্যাঁ আজ তো আমি তোমার রুমের পর্দার সরালাম।বাবা তোমার অপছন্দের কাজ করে ফেলেছি।এখন কি বকবে?’

শাওন হাসার চেষ্টা করে বললো,’নাহ।আচ্ছা!আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।একসাথে নাস্তা করবো’
বাবার চোখের সামনে থেকে সরে শাওন রুমে আসতেই ফোন বেজে উঠলো তার।রায়হানের কল।
সে জানালো একটা গ্যাংয়ের তিন সদস্য হাতে পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়েছে কাল রাতে।তাদের সবাইকে কে গুলি করেছে বলতে পারছেনা কেউই।শুধু মমমম করছে।’
-‘মমম?ট্রমা ছাড়ুক।নাম বলে দেবে।বাট আমাকে জানাচ্ছো কেন এসব?’
-‘ঐ গ্যাংটাকে ধরতে মাস খানেক আগে আমরা অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিলাম স্যার।মনে আছে?একেবারে নেত্রকোনা’

শাওন কপাল টিপে ধরে বললো,’হ্যাঁ মনে পড়েছে।লিয়াকতের গ্যাং না ওটা?ব্রাভো!!ঐ তিনটাকে গার্ড দিয়ে পাহারা দাও।কান টানলে মাথা ঠিক চলে আসবে’
মুচকি হেসে ফোন রেখে শাওন ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে দেখতে পেলো রশ্নিকে।শাওনের শখের গাঁদা ফুলগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচে বসে আছে সে।শাওন কাছে এসে বললো,’এতবার ডাকলাম।শুনলেনা?’
রশ্নি মাথা তুলে বললো,’তোমাদের বাসায় আজ একটা পরিবার আসবে’

-“জানি।তৃনা আপুর হবু শ্বশুর বাড়ির লোক’
-‘হুম।কিন্তু তুমি কি জানো?তৃনা আপার হবু বরের ছোট বোন তোমায় পছন্দ করে।তোমার বাবা চায় তার সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা আলাপ জমাতে।এবং সেটা আজকেই।আর….’
শাওন রশ্নির হাত ধরে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো,’তোমাকে না বললাম আমার রুম ছেড়ে কোথাও যাবেনা?কথা শোনো না কেন?যেটা দেখলে মন খারাপ হয় সেটা জেনেবুঝে দেখতে যাও কেন?’
রশ্নি শাওনের দুহাত মুঠোবন্দি করে ধরে বললো,’প্লিজ শাওন।এবার বিয়েটা করে ফেলো।তোমায় সুখে দেখলে আমারও শান্তি লাগবে’

-‘না লাগবেনা।কাল মেধার হাত ধরায় তোমার চাহনি আমি দেখেছিলাম।আমি জেনেশুনে তোমায় কষ্ট দিতে পারিনা।সরি!’
সোফায় বসে খবরের কাগজের পাতা ভাঁজ করছেন বাবা।চোখ মুখে গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে।এমনটা ঠিক তখনই হয় যখন বাবা মনে মনে পাহাড় পর্বত সমান চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন।তার একদম পাশেই ইয়া লম্বা এক বারান্দা।বাতাসে মন ভালো হয়ে যায় বলে তিনি এ সময়টাতে এসি বন্ধ রাখেন।তার মতে প্রাকৃতিক সবকিছু উপভোগ করতে হলে যান্ত্রিক সবকিছুকে বন্ধ রেখে দিতে হয় তা নাহলে প্রকৃতির স্বাদ মেটে না ভালোমতন।
মেধা দরজা জানালা লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে।কাল ঐ তিনটেকে জায়গা মতন রাখতে রফাদফা হয়ে গিয়েছিলো।অনেক রাত অবধি জেগে থাকতে হয়েছিল তাকে।বাসায় ফিরে মাকে হাজার রিকুয়েস্ট করেও দমাতে পারেনি। খবরটা মা বাবার কানে পৌঁছেই দিয়েছেন শেষে।

মৌমিতা স্কুলে যাবে বলে তৈরি হয়ে দুটো বেনি ঝুলিয়ে পা দুলাচ্ছে বাবার পাশে বসে।বাবা নাস্তা সেরে ওকে নিয়ে বের হবেন।প্রতিদিন ওকে সাথে নিয়েই বের হোন তিনি।তার অফিসের আগেই মৌমিতার স্কুল পড়ে।
সেসময়ে মা টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বললেন,’আমি কিছু শুনতে চাইনা।তুমি মেধার সঙ্গে কথা বলবেই বলবে।বুঝতে পারছো তুমি?আমার কপালে বন্দুক ধরেছিল।কত বড় সাহস।কি না কি হয়ে যেতো!আমাকে আর মৌমিতাকে রুমে বন্দি করে রেখেছিল।ইশ!মনে করতেই গা গুলিয়ে আসছে আমার।না আমি কিছু শুনতে চাইনা।মেধার সঙ্গে তুমি আজই এই বিষয় নিয়ে কথা বলবে।

একজন পুলিশ অফিসারের বউ হয়েছি আর ক্রাইম ব্রাঞ্চে কর্মরত মেয়ের মা হয়ে বলে কি আমায় রোজ রোজ এসবের সম্মুখীন হতে হবে?আমার ছোট মেয়েটার কি দিন এমনেই চলবে?কাল সারারাত ওর বিক ধুকধুক করছিলো।আমি ওকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম।তোমার মেয়েকে বলো চাকরি ছাড়তে।ভালো, বিদেশে চাকরি করে এমন ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও।আমাদের কাছে থাকলে ওর শত্রু সব রোজ এসে এসে ভেঁংচি দিয়ে যাবে।এই টুকুন মেয়ের শত্রুর অভাব নেই।তোমাকে কি বলছি শুনছো?’

বাবা খবরের কাগজ থেকে চোখ উঠিয়ে বললেন,’হ্যাঁ শুনছি।মেধার উত্তর কি হবে তাও জানি আমি।সে পরামর্শ দেবে, আমরা যেন বাসা পাল্টে দূরে কোথাও গিয়ে থাকি।আর আমার বড় মেয়েকে একা রেখে অন্য কোথাও থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।কিন্তু সে প্রতিউত্তরে এই সাজেশনটাই দেবে।’
মা রুটি ছেঁকার খুন্তি নিয়ে তেড়ে এসে বললেন,’সেটাই ভালো।আমি জানি তোমার ঐ সাহসী মেয়ে বিপদে পড়েও বেঁচে যাবে।কিন্তু আমি?আমার ছোট মেয়েটা?আমরা না পারি মারামারি আর না আমাদের কাছে সবসময় বন্দুক থাকে আত্নরক্ষার জন্য।আমাদের কি হবে?নাহয় তোমরা আমাদের বাঁচিয়ে দেবে।কিন্তু এই যে কদিন বাদেই বন্দুকের মুখোমুখি হতে হয় সেটাতে তো একদিন না একদিন হার্ট এটাক হয়েই বসবে’

-‘মিতুল থামো একটু।আচ্ছা ঠিক আছে,আমি মেধার সঙ্গে আলাপ করবো এই নিয়ে।তুমি জলদি খাবার তৈরি করো।আমার দেরি হচ্ছে।’
-‘বাবা আমার ও তো দেরি হচ্ছে’
-‘জানি তো আম্মু।’

মেধা ঘুম থেকে উঠছেনা দেখে বাবা নাস্তা সেরে মৌমিতাকে নিয়ে চলে গেছেন।ঠিক দশটার দিকে মেধার ফোনে কল আসলো। ঝাপসা চোখে ফোন হাতিয়ে খুঁজে বের করে কানে ধরলো সে।
ওপাশ থেকে কর্কশ আওয়াজে একটা ধমক শুনতেই লাফ দিয়ে উঠে বসলো সে।শাওনের কল এটা।
-‘সরি স্যার।আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম কাল থেকে অফিসে জয়েন হয়েছি।’
শাওন কল কেটে দিয়েছে ততক্ষণে।অফিসে সবাই এসেছে অথচ মেধাই আসেনি।রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে ওর।
নুহাশ কফির মগ নিচ্ছিল রহিমের হাত থেকে।নিতু টেবিলে মাথা রেখে বললো,’আজকেও কি রেদোয়ানের বাসায় যেতে হবে?’

-‘তা নয়ত কি?শাওন খুব ক্ষেঁপে আছে আজ সকাল থেকে।কে জানে কি হলো।মনে হয় আজই খুনির গলা চেপে ধরবে’
-“ক্ষেঁপার কারণ মনে হচ্ছে মেধা।সে এখনও অফিসে ঢোকেনি।দশটা বেজে গেলো।’
শাওন তার কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বললো,’তোমরা সবাই রওনা হও।
আমি গিয়াস স্যারকে সাথে নিয়ে আসবো।তোমরা গিয়ে বাকি যা কিছু ইনভেস্টিগেট করার তা করতে থাকো’
নুহাশ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,’খাবে?’
-‘নাহ।মুড নেই।তোমরা খাও’

শাওন তার কেবিনে ঢোকার দু মিনিট পর মেধা এসে হাজির।টাই ঠিক করতে করতে নিতুর সামনে এসে দাঁড়ালো সে
নিতু ব্র‍ু উঁচু করে বললো,’চুলের এই হাল কেন?চোখ মুখের ওমন অবস্থা কেন?ঘুম থেকে কখন উঠেছো?’
-‘দশ মিনিট আগে।ছুটে এলাম।রেডি হবার টাইমটুকু পাইনি।
শ্যাওলা স্যার,সরি আই মিন শাওন স্যার যে ধমক দিলো আমায়’
নিতু হাসতে হাসতে বললো,’আরও ধমক ওয়েট করছে।যাও ভেতরে’

মেধা মাথার চুল হাত দিয়ে মিহিন করতে করতে ভেতরে গেলো।শাওন টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।চোখ দূরের একটা লেকের দিকে।ওর কেবিন থেকে লেকটা স্পষ্ট দেখা যায়।মেধা ঢোক গিলে এই নিয়ে দুবার জিজ্ঞেস করেছে ভেতরে আসবে কিনা।শাওন তৃতীয় বারের সময় পেছনে ফিরলো।মেধা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে
-‘ইউ নো হোয়াট?তোমার মাঝে আমি মেধা বাদে বাকিসব দেখি।লেট,স্লো,উইক,শাই, এ্যাটসেটরা!’
মেধা চোরের মতন দাঁড়িয়ে শাওনের বকা শুনছে

শাওন টেবিলের উপর ঠাস করে হাত রেখে বললো,’আর একদিন লেট করলে চাকরি খাবো তোমার।’
মেধা এক দৌড়ে পালালো।অফিস রুমে এসে দেখলো কেউ নেই।
শাওন তার ফোন পকেটে ঢুকিয়ে সেও বেরিয়ে একই কাহিনী দেখলো।কোথাও কেউ নেই।ফোনটা আবার বের করে গিয়াস স্যারকে কল করলো।
-‘হ্যালো শাওন।হ্যাঁ বলো কি হয়েছে?’
-‘স্যার আপনি কোথায়?আমার তো আপনার সঙ্গে রেদোয়ানের বাসায় যাবার কথা ছিল আজ।নুহাশ,রায়হান আর নিতুকেও তো দেখছিনা’
-“আরে ওরা আমার সাথে।আমরা অলরেডি রওনা দিয়ে ফেলেছি’
-‘মানে!’

-‘তুমি মেধাকে নিয়ে এসো।এতদূর তো সে একা আসতে পারবেনা।টিমের সবাই একসাথে আসা যাওয়ায় মেতে থাকাই ভালো।তাছাড়া তোমার আর ওর বোঝাপড়ায় কমতি পরিলক্ষিত।আমি চাই সেটার সংখ্যা শূন্য হোক।’
শাওন ফোন রেখে মেধার দিকে তাকালো।মেধা চেয়ারের উপর পা তুলে গোল হয়ে বসে কফি খাচ্ছিলো।শাওন আরেকটা ধমক দিয়ে বললো,’আমার সাথে চলো রেদোয়ানের বাড়ি যাবে।গিয়াস স্যারের অর্ডার এটা।নাহলে আমার শখ নাই ভীতুর ডিমকে আমার সাথে নিয়ে যাবার’
মেধা জলদি করে কফিটা শেষ করে ছুটলো শাওনের পিছু পিছু।শাওন কারে ড্রাইভিং সিটে বসেই দেখলো মেধা ওর পাশের সিটের দরজা খুলেছে বসবে বলে’
শাওন থামতে বললো ওকে।

-‘ওখানে না।পেছনে বসো।’
মেধা মুখ বাঁকিয়ে কারের পেছনের সিটে বসলো।শাওন ড্রাইভ করতে করতে ওর পাশের সিটটার দিকে তাকাচ্ছে।এমন ভাব করছে যেন কেউ বসে আছে সেখানে।মেধা একশোবার মাথা সামনে এনে দেখেছে তাও কাউকে দেখেনি তার পরেও শাওন এতবার ওদিকে তাকাচ্ছে কেন?গিলুটিলু আছে নাকি এই লোকটার মাথায়??
একটা সময় কি নিয়ে শাওন হাসতে গিয়ে কার থামিয়ে ফেললো আর একটুর জন্য একটা গাছের সাথে ধাক্কা লেগে যেতো।

মেধা সামনের সিটের সঙ্গে দুম করে বাড়ি খেয়ে এখন কপাল ঘষছে।শাওন পেছনে তাকিয়ে বললো,’কি হয়েছে তোমার?’
মেধা কথা বলছেনা।শুধু কপাল ঘষছে।শাওন আরেকটা ধমক দিয়ে ওর কপাল থেকে হাত সরালো।ব্যান্ডেজের উপরিভাগে লাল আবরণ হয়ে গেছে রক্তের।কালকের ক্ষতে আবারও চোট পেয়েছে সে।আচ্ছা এই মেয়েটা চোট ছাড়া আর কিছু পেতে পারেনা?দেখা হবার পর থেকে দেখতেছি কালি চোটই পাচ্ছে।এর নাম মেধা না হয়ে ব্যাথা হওয়া উচিত ছিল।’

শাওন পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে ওর কপালে লাগিয়ে ধরে বললো,’চেপে ধরে রাখো।কারে বসে সিট বেল্ট লাগাতে হয় জানোনা?এখন দোষ তো আমার দিবা’
-‘অবশ্যই দোষ আপনার।এই সিটের সঙ্গে প্রেম করতে গিয়েই তো আর একটুর জন্য এক্সিডেন্ট করে বসতেন।আপনি তো মরতেন না,আপনার সিট ও মরতো না,ফাঁক দিয়ে আমি মরতাম।আমার হবু বর বিয়ের আগেই হবু বউহীনতা রোগে ভুগতো।’

সঞ্চারিণী পর্ব ৩

-‘সিটের সাথে প্রেম মানে?হোয়াট ননসেন্স! ‘
-‘তা নয়ত কি।আমাকে এই সিটে বসতে দিলেন না।সেই কখন থেকে খেয়াল করছি।সিটটাকে দেখেই যাচ্ছেন।পারছেন না নিজের সিট রেখে উঠে এই সিটকে জড়িয়ে ধরছেন আবার হাসাহাসিও করছেন।এগুলো প্রেম না তো কি ছেলেখেলা?’

শাওন মাথা ঘুরিয়ে বসে গাড়ী স্টার্ট করলো।সমস্যা হলো গাড়ী স্টার্ট হচ্ছেনা।মেধা দাঁত কেলিয়ে শাওনের চেষ্টা করা দেখছে।শাওন অনেকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে মেধার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে নামলো গাড়ী থেকে।মেধাও নামলো।ফাঁকা রাস্তায় এসে গাড়ী নষ্ট হলো।একটা মানুষ তো দূরে থাক কাকপক্ষী ও নেই।সবুজ আর সবুজ মাঝো নীল রাস্তা,আর দুপাশে জঙ্গল আর সেখানে নষ্ট গাড়ী।কি সুন্দর না?

কথাটা আস্তেই বললো মেধা।শাওন খেয়াল করেনি।সে গাড়ীর সামনে গিয়ে পিটাপিটি করছে।রিমোট বাড়ি দিলে রিমোট ঠিক হয়ে যায়,গাড়ী বাড়ি দিলে গাড়ী ঠিক হয় কিনা তারই এক্সপেরিমেন্ট করছে শাওন।মেধা শাওনের পাশের সিটটা জানালার এপারে থেকে দেখছে দৃঢ় দৃষ্টিতে।
-‘কিছুই তো নাই।লোকটা যেভাবে তাকাচ্ছিল যেন এই সিটে বিশ্বসুন্দরী একজন বসে ছিল।আমি তো কিছুই দেখিনা।ধ্যাত!
এই যে স্যার!আর কতদূর??আই মিন হেঁটে যেতে হবে নাকি?’
-‘যাও হেঁটে।তুমি না গেলে তো রেদোয়ানের কেস সলভ্ই হবেনা’
মেধা দাঁত কেলিয়ে বললো,’একদম সত্যি কথা’

সঞ্চারিণী পর্ব ৭+৮+৯