সবটাই তুমিময় পর্ব ২৫ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৫
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

হানিমুন!!!শব্দটা কয়েকবার কানে বাজলো আমার।সকাল সকাল ঘুম ভাঙার পরপরই এতোবড় একটা কথা শুনে মোটামুটি শকে পরে গেছি।বিয়েটা স্বাভাবিক হলে,এ শব্দটাও স্বাভাবিক লাগতো আমার।কিন্তু বিয়েটাই তো চুক্তির বিয়ে।দু বছরের।বেবির জন্য শুধু।বেবির কথা মাথায় আসতেই নিস্তেজ হয়ে গেলাম।বেবির জন্য হলে কেনো এখনো অঙ্কুর কাছে আসেননি আমার?কেনো আমার সমর্থন জেনেও এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছেন উনি?আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন অঙ্কুর।চিকন স্লিভস্ গেন্জি আর ট্রাউজার পরে।মাথা মুছতে মুছতে ব্যাগ,লাগেজ,জামাকাপড় নামাতে শুরু করলেন উনি।আমি বেডেই বসে।উনি ব্যস্ততা থামিয়ে আমার দিক তাকিয়ে বললেন,

-এভাবে বসে আছো কেনো?প্যাকিং করো!হানিমুন যেতে হবে তো!
-মানে?ক্ কোথায়?
-হানিমুন!হানিমুন!বাংলা মানে মধুচন্দ্রিমা!এন্ড ইটস্ ইন সিডনে।সুইডেন যাচ্ছি আজ আমরা।
-আমরা মানে?
অঙ্কুর থেমে গেলেন।তোয়ালেটা চেয়ারের উপর রেখে বেডের দিকে এগোলেন।আমার সামনে খানিকটা ঝুকে দাড়িয়ে বললেন,
-মানলাম তুমি জেনে গেছো বিয়েটা এগ্রিমেন্টাল,তবুও তুমি আমার বউ।দু বছরের হলেও বউ।রাইট?

-তো কোথাও শুনেছো,হানিমুনে বর বউকে ছাড়াই চলে যায়?হানিমুনে আমরা দুজনেই যাবো।
নির্বাক হয়ে শুনছি শুধু তার কথা।এবার শব্দ করে হেসে দিলেন উনি।সোজা হয়ে দাড়িয়ে আলমারী থেকে কিছু একটা বের করতে করতে বললেন,
-ডোন্ট প্যানিক।আমার নেক্সট ম্যাচ সিডনিতে।জায়গাটা সুন্দর।তাই ওখানে তোমাকেও সাথে করে নিয়ে যাবো ভাবছি।
বুঝলাম।হানিমুন কাকে বলে।কিছুটা কড়া গলাতেই বললাম,
-ম্যাচ আপনার,আমি গিয়ে কি করবো?
উনি শার্টের হাতা গুটাচ্ছিলেন।একটু থেমে ঠিকঠাকমতো পরে আমার দিকে ফিরে শান্ত গলায় বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-তোমাকেই তো আগে প্রয়োজন অদ্রি।
-মানে?
-মানে তুমিও যাচ্ছো।বললাম না?জায়গাটা সুন্দর।ঘুরে আসলে ভালোলাগবে তোমার।এমনিতেও তোমাকে এভাবে বাসায় রাখা নিয়ে মনেমনে অভিশাপ দাও হয়তো।এ সুযোগে বেরোনোও হবে আর তুমি তোমার বান্ধবী,বন্ধু,মনিমাকে বলতে পারবে,হানিমুনে গিয়েছিলে তুমি।আমার মনে হয় দ্বিতীয় কারনটা এনাফ।
আমি কিছু বলার আগেই অঙ্কুর সেই ফাইলদুটো বের করলেন।আটকে গেলাম আমি।উনি কোনোদিক না তাকিয়ে ফাইলদুটো ব্যাগে পুরতে পুরতে বললেন,
-এনাফ!তাইনা?

ফাইলদুটো রেখে এবার আমার দিক তাকালেন উনি।চুপ রইলাম।উনি বললেন,
-এখন যদি তুমি না যাও,এখানে একা একা থাকো,তোমার মনিমা ভাববে না,তার দেখা আর সব ছেলেদের মতো আমিও আমার বউকে ভালোবাসি না।শুধু টাকা ভালোবাসি।ক্যারিয়ার ভালোবাসি।এইসব।তোমার ভালোলাগবে সেটা?
মুচকি হাসলাম।সবগুলো উল্টো নয়কি অঙ্কুর?ভালোবাসেন?আপনার দু বছরের চুক্তির বউকে?টাকা ভালোবাসেন না আপনি?আপনার ক্যারিয়ারকে ভালোবাসেন?তাহলে ম্যাচ ডিল করতে পারতেন?এ প্রশ্নগুলোর উত্তর কি অঙ্কুর?হাহ্!প্রশ্নতাক করবো না আপনাকে।বলেছি তো!এসব প্রশ্ন আমার মনেই থাক!ছোট একটা শ্বাস ফেলে বললাম,
-আপনি তো টিমের সাথে যাবেন।সেখানে আমি কিভাবে…

-তুমি যাবে?
-ঠিকই বলেছেন আপনি।যাওয়ার কারনটা এনাফ।মনিমাকে বলতে চাই হানিমুনে গিয়েছিলাম।তাকে বোঝাতে চাই,বিয়েটা করে অনেক খুশি আমি।পাব্লিক না করার বিষয়টা নিয়ে এখনো আমার উপর রাগ তার।কারন পুরো বিষয়টা আমি নিজের উপরই নিয়েছি।
ওনার বাকা হাসিটা বলে দিলো,তোমার যাওয়ার কারন আমি জানি অদ্রি।মুখে বললেন,
-একচুয়ালি,ইটস্ আ ডিফারেন্ট প্লান।আমি টিমের সাথে কাল সকালে রওনা হবো।এমনটাই ডিসিশন হয়েছে।আর রোহান এক বিজনেস ট্রিপে আজই‌ যাচ্ছে।তো তুমি রোহানের সাথে যাবে।আজ বিকেলেই।বলতে পারো,আমার সাথে তোমার ম্যাচের আগে দেখা হবার সম্ভবনা খুব কম।তবে রোহানকে বলা আছে,ইট উড বি সেইম হোটেল।সো,টেনশন করতে হবে না তোমাকে।

সেইম ঘর না,সেইম হোটেল!আমি আজ রোহান ভাইয়ার সাথে বেরোবো,উনি পরদিন সকালে টিমের সাথে যাবেন।কি দুর্দান্ত প্লান তার!যাকে বলে,সাপও মরবে,লাঠিও ভাঙবে না!আমাকে তার সাথে নিয়ে যাওয়াটাও হবে,কেউ জানতেও পারবে না,এএসএ কাউকে নিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন!কিন্তু আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কি‌ কারন?
-ওভাবে আর কতোক্ষন বেডে বসে থাকবে অদ্রি?ফ্রেশ হও?প্যাকিং শেষ করো জলদি!
চুপচাপ উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম।এরমাঝেই অঙ্কুর ফাইলের ব্যাগটা কোথাও সরিয়ে ফেলেছেন।আমাকে বেরোতে দেখে উনি বললেন,

-তোমার কি কিছু শপিংয়ের দরকার আছে?মানে,বাইরে যাচ্ছো,কিছু….
-হ্যাঁ।
-ফাইন।এক কাজ করো তুমি,রেডি হয়ে,মাস্ক পরে,মুখ ঢেকে চলে যেও।ড্রাইভার নিয়ে যাবে তোমাকে।উম্…চাইলে তানহা,আস্থা ওদেরকেও ডেকে নিতে পারো।
মাথা নাড়লাম।এটা বোঝার আর কোনো অবকাশ নেই যে উনি চাননা আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করি।তাকে আর প্রশ্ন করবো না বলেছি,তাই তার কথামতোই সবটা করবো।বেরোবো মুখ ঢেকে।উনি বললেন,
-তোমার মনিমার সাথে দেখা করতে যাবে আরেকবার?

মনিমার কথা মনে পড়তেই চোখ ভরে উঠতে লাগলো আমার।অনিক আফতাব মারা গেছেন।যার সাথে মনিমা নয় বছর সংসার করেছে,সে মানুষটা আর নেই।তিনি যেমনটাই ছিলেন,মনিমার বর ছিলেন।মনিমা তার মৃত্যুর খবর মানতে পারবে?কষ্ট হবে না তার?অঙ্কুরের সবটা জেনেও তার চোখের জল দেখে আমার যে তীব্র কষ্ট অনুভব হয়েছে,সেখানে মনিমার তো…..
-বাবার মৃত্যুর বিষয়টা এখনই কাউকে জানিও না অদ্রি।
অবাক চোখে তাকালাম।অঙ্কুর আবারো বললেন,

-চার চারটে বছরে কাউকে জানতে দেইনি।আমি চাইনা তুমিও কাউকে জানাও।ইটস্ আ রিকুয়েস্ট।
আমার বিস্ময় বাড়লো।কাকে জানাতে মানা করছেন উনি?কোনোভাবে মনিমাকে নয়তো?কিন্তু কেনো?উনি বললেন,
-অনুরোধটুকো রাখবে না?
-আজ প্রথমবার আমাকে বাধ্য না করে অনুরোধ করছেন আপনি অঙ্কুর।কি করে ফেলনা করে দেই বলুন?আপনাকে বললাম না কাল?এবার থেকে আর আমার প্রশ্ন আপনাকে কষ্ট দেবে না।আমার অবাধ্যতার জন্যও আর কষ্ট পেতে হবে না আপনাকে।তেমনটাই হবে,যেমনটা আপনি চান।

কথাটুকো বলেই পেছন ফিরলাম।অনেকটা সময় নিয়ে উনি বললেন,
-আমি বেরোবো।মিটিং আছে।
কোনো সাড়া না দিয়ে ব্যালকনির সামনে দাড়িয়ে আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছিলাম।হুট করেই পেছন থেকে হাতে টান লাগালেন অঙ্কুর।তার সামনে দাড় করিয়ে সামনের কয়েকটা ভেজা চুল কানে গুজে দিয়ে বললেন,

-জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজের জন্য তৈরী হও অদ্রি।সব প্রশ্নের জবাব দেবো তোমাকে।সময়…আসন্ন।
অঙ্কুর আমাকে ছেড়ে আমারই সামনে পকেটে হাত গুজে দাড়ালেন।বেশ অনেকক্ষন মৃদ্যু হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।আর আমি ওই হাসিটার দিকে।উনি আমার দিক তাকিয়ে হাসিটা রেখেই পেছোতে লাগলেন।বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।বেডে বসে পরলাম আমি।নিজের শরীরকে প্রচন্ড ভারী লাগছিলো।ফোনটা বেজে উঠলো এরমধ্যেই।তানহার ফোন।রিসিভ করলাম।ও উৎফুল্লভাবে বললো,

-কেমন আছিস আন্নু?
-ভালো।তুই?
-ভালো।জানিস আন্নু?আজ আবারো তিহান ফোন করেছিলো আমাকে।
কিছুটা নড়েচড়ে বসলাম আমি।আগ্রহ নিয়ে বললাম,
-সত্যি?ক্ কি বললো রে?
-বেরোতে বলছে।বেতন এডভান্সড্ পেয়েছে কাল।বলছে আঙ্কেল আন্টি আর ত্বোহার জন্য কিছু কেনাকাটা করবে।আমাকে…আমাকে বলছে আমাকে নিয়ে যাবে শপিংয়ে।চুজ করে দেওয়ার জন্য।
খুশিতে চোখ ভরে উঠলো আমার।তানহা বললো,

-এটাও বন্ধুত্ব।তাইনা আন্নু?
-হ্যাঁ।তবে খুব স্পেশাল বন্ধুত্ব।যা খুব তাড়াতাড়িই ভালোবাসার নাম নেবে।দেখিস!
কোনো সাড়া নেই।কাদছে ও।জানি।বললাম,
-তান্নু?সিডনে যাচ্ছি আমরা।
-সিডনে?আর আমরা মানে?
ওকে অঙ্কুরের সুইডেন যাওয়া,আমাকে নিয়ে যাওয়া,সবটা খুলে বললাম।শুধু অঙ্কুরের বাবার বিষয় বাদে।সবটা শুনে তানহা বললো,

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৪

-দু বছরের কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ?এটা কি বলছিস তুই?
-এটাই ঘটেছে।আর আমিও মেনে নিয়েছি।এখন শুধু অপেক্ষায় আছি অঙ্কুরের স্বীকারোক্তির।
-এতো সহজে সবটা….
-হ্যাঁ।আপাতত এতো সহজেই ছাড় দেবো অঙ্কুরকে।
-আপাতত?
-ও কিছু না।রাখছি।
-তুই কিছু লুকোচ্ছিস আন্নু!
-তোর কাছে কেনো লুকাবো?

-সেটা তো তুইই জানিস।তবে আমি বলবো,এএসএ যখন বলেছে সবটা বলবে তোকে,আর তুইও ভেবেছিস একটু সময় দিবি তাকে,তবে তাই হোক।নিজের খেয়াল রাখিস।
-হুম।তুইও সাবধানে থাকিস।
কল রাখলাম।সত্যিই এই প্রথম অনেকটা লুকিয়ে গেলাম তোর থেকে তানহা।আমি নিরুপায়।বাবা মায়ের মৃত্যুর কারন আমাকে জানতে হবে,তাদের শাস্তি দিতে হবে।ঠিক খুজে বের করবো তাদের।আর তারপর ভয়ানক সাজা দেবো।অদ্রির কাছে যে তাদের জন্য এক ভয়ংকর মৃত্যুোৎসব সাজানো আছে।ঠিক যেমনটা ওরা করেছিলো,আমার বাবা মায়ের সাথে!

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৬