সবটাই তুমিময় পর্ব ২৪ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৪
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

থাই গ্লাসের ওপারে বৃষ্টির ফোটা ফোটা পানি একটা আরেকটার সাথে লেগে গরিয়ে পরছে।রাতের গভীরতা অন্ধকার বাড়িয়েছে,তবে বাগানের আলোর অনেকটাই রুমে ঢোকে এদিক দিয়ে।তাই রুমের লাইট অফ হওয়া সত্ত্বেও আবছা আলোতে মোটামুটি সবটাই দেখা যায়।এ ঘর ছেড়ে গেলে অঙ্কুর আগেরবারের মতো উঠে যাবেন কিনা জানি না,তবে যেতে ইচ্ছে করেনি।আবার ঘুমও আসেনি।উঠে এসে তাই গ্লাস ঘেষে দাড়ালাম।বৃষ্টির শব্দ আসছে না একটুও।খানিকটা টেনে দিলাম কাচের দেয়াল।রিনরিন শব্দতরঙ্গ প্রশান্তি এনে দিলো মনজুড়ে।পানিভেজা বাতাস চোখমুখ ছুইয়ে দিতেই মৃদ্যু শিহরনে গা ভাসাতে ইচ্ছে করে ওই পানিবিন্দুর অসংখ্য বর্ষনে।

চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন ওভাবেই রইলাম।মুখসহ গলার দিকটা ভিজে উঠেছে।সামনের চুলগুলো ভিজে কপালের সাথে লেপ্টে গেছে টের পাচ্ছি।চোখ খুলে বিছানার দিকে তাকালাম।কপাল ধরে এপাশ ওপাশ করছেন অঙ্কুর।এতোক্ষন তো ঠিকই ঘুমোচ্ছিলেন,এখন কি হলো ওনার? বাজপরার শব্দ আসতেই মনে হলো হয়তো বৃষ্টির শব্দ কানে গেছে বলে ঘুমে বিঘ্ন ঘটেছে তার।

লাগিয়ে দিলাম গ্লাস।তখনো কপাল চেপে ধরে রয়েছেন উনি।এবার মনে পরলো কান্নার জন্য নির্ঘাত মাথাব্যথা হচ্ছে ওনার।ওষুধটাও খাওয়াইনি।ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগোলাম।মাঝের কোলবালিশটা সরিয়ে অঙ্কুরের বেশ কাছেই এগিয়ে বসেছি।কাপাকাপা হাত মাথায় রাখলাম তার।উনি জাগেন নি।কিন্তু কপালও ছাড়েন নি।আরেকহাতে তার হাত নামিয়ে দিয়ে হাত বুলাতে লাগলাম তার চুলে।উনি নড়েচড়ে আমার দিক ফিরে একদম কোলে মাথা রাখলেন আমার।কোমড় জড়িয়ে ধরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পরলেন।গাল বেয়ে পানি গরিয়ে পরলো আবারো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাত অনেকটাই গভীর হয়েছিলো।অঙ্কুর কাদছিলেন।তাকে জরিয়ে রেখে আমিও কাদছিলাম।বাইরে বজ্রপাতসহ বৃষ্টি।অনেকটা সময় শব্দ করে কাদার পর উনি ছেড়ে দিলেন আমাকে।হুশ ফিরতেই চোখ মুছে তাকে ছেড়ে সরে দাড়ালাম।উনি হাতের পিঠে চোখ মুছছেন,নাক টানছেন।চেহারা লালচে হয়ে গেছে তার।নাকের ডগাটা বেশি লাল হয়ে আছে।উনি আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললেন,
-সরি।

অবাক চোখে তাকালাম।আবারো চোখ জলে ভরে উঠলো আমার।বারবার পলক ফেলে সে চোখের পানি আটকে দিলাম কোনোমতে।নাক টেনে নিজেকে সামলে নিলাম।একটা শুকনো ঢোক গিলে গলা স্বাভাবিক করে বললাম,
-সরি?সরি ফর হোয়াট?
অঙ্কুর বেড ছেড়ে উঠে দাড়ালেন।ধরা গলায় বললেন,
-তোমাকে ওভাবে জরিয়ে ধরার জন্য।
টুপ করে চোখের পানি বেরিয়েই এলো।তৎক্ষনাৎ মুছে ফেলে তাচ্ছিল্যে হেসে বললাম,

-ও।বুঝলাম।আসলে কি বলুন তো?কনফিউজড্ হয়ে গিয়েছিলাম,ঠিক কোন কারনে সরি বললেন আপনি আমাকে।আদৌও কোনো কারনের জন্য আপনার গ্লানি আছে কি?আমার কি দোষ ছিলো বলতে পারেন?কি দোষ করেছিলাম আমি?কি না শুনতে,দেখতে হয়েছে,হচ্ছে আমাকে?প্রথমে আমাকে আপনার বাচ্চার সেরোগেট মাদার বানাতে চাইলেন,মানা করেছিলাম বলে আটকে রাখলেন আমাকে,মনিমার অসুস্থ্যতার কথা বলে আমার অমতে বিয়ে করতে বাধ্য করলেন,বিয়ের পরপরই বললেন বিয়েটা শুধু বেবির জন্যই করেছেন আপনি।আজ জানতে পারলাম,এই বিয়েটা দু বছরের কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ!এতোসবের পরেও এখন যখন আপনাকে….

-আমাকে কি অদ্রি?
-কিছু না।আপনার শুকরিয়া আদায় না করে পারছি না।যখন যখন আমি কোনো এক অজানা অনুভূতির অববাহিকায় নিজের লক্ষ্যকে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছি,প্রতিবার আপনি আমাকে জানান দিয়েছেন,আমি কে,আপনি কে,আপনার উদ্দেশ্য কি,আর সেখানে আমারই‌ বা কি করনীয়।যাই হোক,থ্যাংকস্!এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন।আপনার বাবা কিভাবে মারা গেছেন?

-চুপ করে থাকবেন না অঙ্কুর!আমার উত্তর চাই!
উনি চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো করে নিয়ে বললেন,
-প্রশ্ন করো না অদ্রি।প্লিজ!
-কেনো?
-কারন সবটা এখন তোমাকে বলতে পারবো না।আর এটুকো জেনে,বরাবরের মতো তুমি শুধু ভুল বুঝবে আমাকে।
-আপনার মনে হয় আমি আপনাকে ভুল বুঝেছি?
-তোমারও এমনটাই মনে হবে।

বুঝলাম,উনি কোনো জবাব দেবেন না আমাকে।আমার প্রশ্নের উত্তর আমাকেই খুজে নিতে হবে।আর সেটা একজনই দিতে পারবে।প্রদীপ সরকার।সে অবশ্যই জানবে,তার বিজনেস পার্টনার অনিক আফতাবের কতোটুকো,কি জেনে গিয়েছিলো বাবা মা।এজন্য তাদের কি কি ক্ষতি হয়েছিলো।আর সবচেয়ে বড় কথা!কোনোভাবে আমার বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য এই প্রদীপ সরকারই দায়ী কি না!সবটা শুধু উনিই জানেন।ওনার কাছ থেকেই সব কথা বের করতে হবে আমাকে।একবার ওই নোংরা লোকটাকে হাতে পাই,এতো ভয়ংকর ভাবে অত্যাচার করবো,সবটা স্বীকার করতে বাধ্য হবে সে।নিজেকে স্বাভাবিক করে অঙ্কুরের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-বেশ।আর কোনো প্রশ্ন করবো না আপনাকে।আপনাকে ঠিক বুঝতে চাই।অপেক্ষায় থাকবো,আপনার নিজের স্বীকারোক্তির।
অঙ্কুরের চোখ চকচক করে উঠলো যেনো।এতোক্ষন এতোটা কষ্টে এতোটা কান্নার পরও এই কথাটায় তার এমন রিয়্যাক্ট অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো আমার।উনি হাতের পিঠে নাকটা ডলে উৎফুল্লভাবে বললেন,
-সত্যি বলছো?
-হ্যাঁ।আপনি যখন চান আমি আপনাকে প্রশ্ন না করি,আর প্রশ্ন করবো না আপনাকে।আপনার যখন খুশি,তখনই না হয় উত্তর দেবেন।এখন রেস্ট নিন।
ওনার তৃপ্তির হাসি।চলে আসছিলাম।উনি বললেন,
-খেয়েছো অদ্রি?
-না।গুড নাইট।
-আমিও খাইনি।

পিছন ফিরলাম।এর আগেও একবার এই কথাটা বলেছিলেন উনি।যা অসমাপ্ত মনে হয়েছিলো আমার।অঙ্কুর বললেন,
-আ্ আমিও খাইনি।খাইয়ে দেবে?
আজ কথাটা পুর্ন বলে মনে হচ্ছে।তবে কেনো জানিনা তাচ্ছিল্য আসছিলো ভেতর থেকে প্রচন্ডভাবে।সেটাকে আটকিয়ে বললাম,
-আপনি তো রেডি হয়ে বেরিয়েছিলেন শুধু আমাকে দেখাবেন বলে।সত্যিসত্যি ডিনার করতে গেলে খেয়েই আসতেন।
এটুক বলেই সোজা কিচেনে চলে আসলাম।কিছু খাবার ওভেনে গরম করে ট্রে ভর্তি করে নিয়ে আসলাম রুমে।অঙ্কুর ততক্ষনে চেন্জ করে বেরিয়েছেন।যাওয়ার সময় সুটবুট পরে,সাজগুজ করে এমনভাবে বেরিয়েছিলেন,যেনো সত্যিই‌ ডিনারে যাচ্ছেন।বেডে মাথা চেপে ধরে বসে আছেন উনি।মাথাব্যথা করছে হয়তো।কান্না তো কম করেন নি।ট্রে টা সামনে রেখে বললাম,

-খেয়ে নিন।
-তুমি কিচেনে কেনো গেছো?
-আগুনের কাছে যাইনি।খাবার ওভেনে গরম করেছি।
-কথা সেটা নয়,কথা হলো,আমার জন্য খাবার আনতে গেলে কেনো তুমি?
-আপনিই তো বললেন খাননি,খাইয়ে দিতে।
-খাইয়ে দেবে?
কথা না বাড়িয়ে বিছানায় তার পাশেই বসলাম।খাবার নিয়ে তার মুখের সামনে ধরতেই ওনার সেই‌ চোখে জল মুখে হাসি চেহারা।চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।উনি খাবার মুখে নিলেন।নিচদিক তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে বললেন,
-আবারো অভিনয় করছো?
চোখ তুলে তাকালাম আবারো।উনি আমার মুখের সামনে খাবার তুলে বললেন,
-বলছো না যে?
-খাবো না।

-খেতে হবে।এন্ড আন্সার মি,আবারো নাটক করছো?এবার বুঝি আরো বড় কোনো প্লান তোমার?
একটা ছোট শ্বাস ফেলে খাবার মুখে নিলাম।বললাম,
-আমি ঠিক কি করছি তা আমি নিজেও জানি না।তবে এই সহমর্মিতাটা,এটা মন থেকেই আসছে এটা জানি।আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন।
-আমার মতো একটা খারাপ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা?কেনো?

-বড্ড অদ্ভুত মানুষ আপনি অঙ্কুর।নিজে তো বলে দিলেন প্রশ্ন করো না অদ্রি।আর প্রতিটা লাইনে লাইনে আমাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে উত্তরের আশা করছেন।যাই হোক,সহমর্মিতা দেখানোর কারন কষ্ট হয়েছে আমার।আপনি পিতৃহারা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে।আমারও বাবা নেই।তাই বাবা না থাকার কষ্টটা অনুভব করতে পারছি।এদিক দিয়ে আপনার আমার কষ্টটা এক।তাই আপাতত আপনাকে অন্যকোনো কথা,কাজ বা প্রশ্নে কষ্ট নাইবা দিলাম।

অঙ্কুর আর কোনো কথা বলেননি।খাইয়ে দিতে লাগলেন আমাকে।তারপর নিজের খাওয়াটাও নিজেনিজেই শেষ করে চুপচাপ শুয়ে পরলেন উনি।তাকিয়ে রইলাম তারদিকে কিছুক্ষন।যখন সে কি চায়,তা বলবে না আমাকে,আমি কি করে জোর করতে পারি তাকে?তবে হ্যাঁ,যে প্রতিশোধ,শাস্তি আর ঘৃনার অগ্নিপথ আপনি বেছেছেন অঙ্কুর,তাতে আপনার আমার সম্পর্কের বিষাক্ততা কোনোদিনও মিটবে না।অদ্রি তো এই অঙ্কুরের বিপরীতে চলেছে,চলবে।আপনার বলা সবটাই তুমিময় কথাটা কোনোদিনও সম্ভব না।আমাদের দুজনের পথ এক হতে পারবে না কোনোদিনও।ভেবে অবাধ্য চোখের জল গরাতে লাগলো।

চোখ মুছলাম।অন্ধকারপ্রায় ঘরটাতে অঙ্কুরের উজ্জল চেহারা পুরোপুরি আত্মপ্রকাশে সফল।এমনকি ভ্রুর পাশের লালচে তিলটা অবদি দেখা যাচ্ছে!মাথার একটু বেশিই সিল্কি চুলগুলোতে হাত আটকাতেই পারছি না।নাই বা চোখকে আটকাতে পারছি ওই চেহারার মোহে না পরা থেকে।আস্তেধীরে কোল থেকে সরিয়ে বালিশে তার মাথা এলিয়ে দিলাম।আধশোয়া হয়ে ঝুকে অঙ্কুরের মাথায় হাত বুলাচ্ছি তো বুলাচ্ছি।ক্লান্তি লাগছে না একদমই।এতোটা কাছ থেকে তাকে দেখতে দেখতেই যেনো সব ক্লান্তি উবে যাচ্ছে।মনজুরে একটাই প্রশ্ন,যে লোকটা এতোভাবে কষ্ট দিলো,তার কাছে থেকে এমন প্রশান্তি অনুভব হওয়ার কি কারন?এই গোলকধাধাতেই কোনোভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবো না তো?

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৩

সকালে ঘুম ভাঙার পর নিজেকে কারো বুকে আবিষ্কার করলাম।সে মানুষটার হৃদস্পন্দন কানে বাজছে আমার।এটা অঙ্কুর।একহাতে আমাকে জরিয়ে রেখে আরেকহাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন উনি।আস্তেধীরে মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম।মুচকি হাসছেন অঙ্কুর।উনি জেগে আছেন!চুলগুলো এগোমেলো হয়ে আছে তার।খোচাখোচা দাড়িগুলো প্রানহীন না হয়ে চেহারার মাধুর্য্য বাড়াতে কর্মঠ।চোখজোড়া তাদের গভীরতা বজায় রেখে একটু বেশিই দুরন্তপনা দেখাচ্ছে যেনো আজ।উনি বললেন,

-গুড মর্নিং।
ধ্যান ছেড়ে উঠে চুপচাপ বসলাম।অঙ্কুরও উঠে বসে তার বুকে হাত বুলিয়ে বললেন,
-বুক ব্যথা হয়ে আছে।উফ্!
আড়চোখে তাকাতেই উনি মেকি হাসি দিলেন একটা।ইতস্তত লাগছে।তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে,তাকে দেখতে দেখতে,তারই বুকের উপর শুয়ে পরলাম?অঙ্কুর মাথাটা চুলকে বেড ছেড়ে উঠে গেলেন।গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোলেন।দরজায় একটু থেমে পেছন না ফিরে বললেন,

-কাল রাতে যা যা হয়েছে,ভুলে যাও।আর তোমার মনিমাকে ফোন করে জানিয়ে দাও,আজ বিকেলেই হানিমুনের জন্য বেরোচ্ছি আমরা।পাঁচদিন পর ফিরবো।উনি যেনো টেনশন না করেন!

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৫