সবটাই তুমিময় পর্ব ২৩ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৩
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

ব্যালকনি দিয়ে বাইরের বিদ্যুৎ চমকানোর আলোটা চোখে পরছে।ঠান্ডা বাতাসও গায়ে এসে লাগছে।পর্দা উড়ে উঠেছে সে বাতাসে।মেঘের ডাকাডাকি শুরু।হয়তো বৃষ্টি হবে আজ।রাতের আধারটাকে কালো মেঘ আরো নিকষ,কুৎসিত কালো বানিয়ে দিচ্ছে যেনো।চোখ‌ সরিয়ে অঙ্কুরের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আপনি সবটাই জানতেন!

যেভাবে রেডি হয়ে বেরিয়েছিলেন উনি,সেভাবেই এসেছেন।ঠোটে টেডিস্মাইল‌ নিয়ে পকেটে একহাত গুজে এগোলেন ঘরের ভেতরে।তারপর আয়নার সামনে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে ঘড়ি খুলতে লাগলেন।ল্যাপটপ ছেড়ে বিছানা থেকে নামলাম।হাত মুঠো করে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম।উনি শার্টের উপরের বোতামদুটো খুলে আমার সামনে দাড়িয়ে গোটানো হাতা ছাড়াতে ছাড়াতে লাগলেন।আমার প্রশ্নে থেমে গিয়ে হাসিটা রেখেই তাকিয়ে রইলেন শুধু।আবারো বললাম,
-বলছেন না কেনো?সবটা বুঝে গিয়েছিলেন আপনি?

উনি আরো প্রসারিত এক হাসি দিলেন।কোমড়ে দুহাত গুজে বেশ মজা নিয়ে বললেন,
-তোমার কি মনে হয়?হুট করে এ বাসায় তোমার চুলের রুপচর্চা করার ইচ্ছা জাগ্রত হবে,আমার কাছে হেল্প চাইবে,হাত ধুতে না দিয়ে বউয়ের মতো আদর করে হাত ওড়নায় মুছিয়ে দেবে,অসময়ে দরজা লাগাতে গিয়ে তোমার হাতে ব্যথা লাগবে,তোমার মাথাব্যথা না থাকা সত্ত্বেও ফার্স্ট এইড বক্স ওই রুমে নিয়ে যাবে,আর তো আর,সে বক্স হাতের সামনে না রেখে একপ্রকার লুকিয়ে রাখবে,তোমার এসব মাত্রাতিরিক্ত অস্বাভাবিক ব্যবহার,আমি স্বাভাবিকভাবে নেবো?
তারপর আমার দিকে আরেকটু ঝুকে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-তাছাড়া মেঝেতে থাকা একটুকরো লিটমাস পেপার আর লেবুর রসের ঠিক কি সম্পর্ক থাকতে পারে তার আইডিয়া আছে আমার।অতোটাও বোকা আমি নই!
ভুলটা ঠিক ওখানেই‌ ছিলো।তাড়াহুড়োয় হয়তো পরে গিয়েছিলো লিটমাস কাগজ।বললাম,
-সবটা জেনেও আপনি আমাকে….
-হ্যাঁ,চাইলে তখনই তোমার….!তোমার এই ভালোমানষির মুখোশ খুলে দিতে পারতাম।তবে তোমাকে কিছুতে ব্যস্ত রাখা প্রয়োজন ছিলো।যাতে সেটুকো সময় ফাইলগুলোর উপর থেকে নজর সরে তোমার।
বুঝলাম।উনি ডিসট্র্যাক করতে চাইছিলেন আমাকে।মাথা নিচু করে রইলাম।অঙ্কুর বললেন,
-এভাবে অপরাধীর মতো দাড়িয়ে আছো কেনো?অপরাধ করেছো?

-কথা বলছো না যে!কোনো….অন্যায়টন্যায় করে ফেলোছো?
-আপনার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড লাভ ইউ মা?যখন আপনার মা তো আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।এ বাসায় তার পরিচয়,সে মৃত,যেখানে তার মৃত্যুর বিষয়ে কেউ‌ কিছুই জানে না।সে আদৌও মৃত কি না তার সত্যতা নেই।ঘৃনা করে তাকে নাকি?তারপরও পাসওয়ার্ড লাভ ইউ মা?
সোজা হয়ে দাড়িয়ে পকেটে হাত গুজলেন উনি।হাসিটা রেখেই বললেন,
-বাস্তবতা দিয়ে পাসওয়ার্ড যাচাই করবে?এতটা বোকা তুমি নও অদ্রি!
-সব জেনেও পাসওয়ার্ড পাল্টান নি কেনো?

-না পাল্টিয়ে কি কোনো ক্ষতি হয়েছে আমার?নাকি খুব লাভ হয়েছে তোমার?কিছু পেয়েছো?
উনি বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বিছানার দিকে এগোচ্ছিলেন।বলে উঠলাম,
-আপনার লয়ারের মেইল এসেছিলো।
অঙ্কুর থেমে গেলেন।পিছন ফিরলেন কিঞ্চিত বিস্ময়ে।এবার আমি মৃদ্যু হেসে বললাম,
-সব ডকুমেন্টস্ সরিয়ে ফেলেছেন ঠিকই,কিন্তু সাথে মেইল অপশনটাও হাইড করা উচিত ছিলো আপনার।
অঙ্কুরের চোখমুখ শক্ত হয়ে আসলো নিমিষেই।উনি হাত মুঠো করে বললেন,
-প্রিভিয়াস মেইল ডিলিট করিছি।
-হ্যাঁ।রিসিভ মেইল অপশন তো বন্ধ করেননি তাইনা?মেইল রিসিভ হয়েছে।আর ওনাকে আমি ইমারজেন্সি মেইল করেছি।মেইল‌সেন্ড হয়েছে অঙ্কুর।আর তার রিপ্লাইও দিয়েছেন উনি।
-কি বলেছো তুমি?

-আমি শুধু একবার মেইল করেছি।উনিই প্রথমে মেইল করেছিলেন।সেটাতে লেখা ছিলো,রেজিস্ট্রি পেপার ইস্যুতে আরো সময় লাগবে।বললাম পেপারের কপি সেন্ড করতে,উনি তাই করলেন।এটুকোই!
অঙ্কুর ‌নুইয়ে মাথা নিচু করে রইলেন।তাচ্ছিল্যে বললাম,
-এভাবে অপরাধীর মতো দাড়িয়ে আছেন কেনো?অপরাধ করেছেন কোনো?
উনি টলোমলো চোখে তাকালেন।নিজেকে শক্ত রেখে বললাম,
-কথা বলছেন না যে!কোনো অন্যায়টন্যায় করেছেন?
-অদ্রি ওটা…..

-আমি বলবো?কোনো অন্যায় করেন নি আপনি।বিয়েটা তো বেবির জন্যই করেছিলেন।তা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ হলেই বা কি আসে যায়?আর এটা আমি জানলেই বা কি আসে যায়?আমি কিন্তু স্বাভাবিকই আছি।একদমই অবাক হয়নি,কষ্ট পাইনি।শুধু আমাকে অপমানের ষোলোকলা পুর্ন হলো আপনার।আবার কষ্ট পাইনি বললাম বলে আপনার কষ্ট হচ্ছে না তো অঙ্কুর?
উনি হাত মুঠো করে চোখ বন্ধ করে রইলেন।মৃদ্যু হেসে বললাম,
-দু বছরের কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ!বিয়ের দিন বললেই পারতেন।আমি তো জানতামই,সবাইকে বলা আপনার ভাষ্যমতে ভালোবেসে বিয়ে করছেন না আপনি আমাকে।আমাকে জানালে সমস্যা হতো না আপনার।কিন্তু আপনি হয়তো ভেবেছিলেন কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ দেখলে বিয়েটা করবো না আমি।এজন্যই সেদিন আমার চশমা ছুড়ে ফেলেছিলেন আপনি তাইনা?

-যাই হোক,সফল আপনি।বিয়েতে,আমাকে অপমান করতে,কষ্ট দিতে।এই টপিক নিয়ে কথা নাই বলি আর!
উনি চুপ রইলেন।একপা এগিয়ে বললাম,
-এবার আমার বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন অঙ্কুর!মৃত্তিকা ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রির সাথে আপনার কি সম্পর্ক?
অঙ্কুর বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন আমার দিকে।বললাম,
-এতোটা অবাক হচ্ছেন কেনো?মৃত্তিকা এক্সপোর্টের বিষয়ে আমি কি করে জানলাম এটা ভেবে?

-আপনি বেশ ভুলোমনা অঙ্কুর।ভুলে যাচ্ছেন,মানুষের সার্চ হিস্ট্রি অনেক কথা বলে।ওগুলো ডিলিট করতেও ভুলে গিয়েছিলেন আপনি।যেখানে আপনার সার্চ লগ জুড়ে শুধুই মৃত্তিকা ইম্পোর্ট এন্ড এক্সপোর্টস্!
অঙ্কুর মুখ ফিরিয়ে নিলেন।আবারো তার চেহারায় রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।উনি বললেন,
-কতোটুকো জেনেছো?
-জানি না।আপনাকে যতই দেখি ততই রহস্য লাগে আমার কাছে।আপাতত এটুকো জবাব দিন,আপনার বাবার এতো কষ্টে গড়ে তোলা ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট কোম্পানি,টাকায় টাকায় তাকে ভরিয়ে রাখা,শাইন ইম্পোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট কি করে মৃত্তিকা ইম্পোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট নামে বদলে গেলো?আর তার বর্তমান মালিক কে?প্রদীপ সরকার!এটা কবে,কখন,কেনো ঘটলো?
-তোমাকে কেনো বলবো?
-কারন আমার জবাব চাই!আপনার বাবার সাথে প্রদীপ সরকারের কি সম্পর্ক,জানতে চাই আমি!

-চুপ করে থাকবেন না অঙ্কুর!জবাব দিন!
-আন্সার মি অঙ্কুর!এ বিষয়ে আজ কোনো আপোষ করবো না আমি!আপনি জবাব না দিলে‌….
-বাবার বিজনেস পার্টনার ছিলো প্রদীপ সরকার।
ওনার শান্ত জবাব।কথাটা শুনে ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো।নিচদিক তাকিয়ে একটু পিছিয়ে গেলাম।এমনটাই মনে হচ্ছিলো আমার।মা বাবার মৃত্যুর বিষয়ে অঙ্কুরের বাবা অবগত।আর প্রদীপ‌ সরকারের মতো জঘন্য লোক ওনার বিজনেস পার্টনার।কোনোভাবে এরা দুজনেই আমার বাবা মাকে….শরীর যেনো ভর ছেড়ে দিচ্ছে এটা ভেবে।অঙ্কুর এগোতে আসলেই হাত দিয়ে থামিয়ে দিলাম তাকে।বললাম,

-ও।উনি বিজনেস পার্টনার ছিলেন প্রদীপ সরকারের?আর এখন আপনি।তা আপনি যেমন প্রদীপ সরকারের কুকর্মের পার্টনার,আপনার বাবাও তেমনটা ছিলেন বুঝি?
-স্টপ ইট অদ্রি।বাবাকে নিয়ে কোনো কথা নয়!
যতোটুকো সম্ভব চেচিয়ে বলে উঠলাম,
-কেনো নয়?কেনো নয় অঙ্কুর?কোথায়?কোথায় আপনার বাবা?কোথায় সে?
-তুমি জানো বাবা নেই এখানে।
-হ্যাঁ।কোথায় সেটাই তো জানতে চাইছি!কোথায় সে?
-জানার সময় আসলে ঠিক জানবে।

-সময় আসে না অঙ্কুর,ও তো ওর মতো বয়ে চলে।শুধু পরিস্থিতি তৈরী হয়।আর আমি আজ,এই মুহুর্তে,এই পরিস্থিতিতে আর কিছুই ভাবতে পারছি না!বলুন!কোথায় আপনার বাবা?কোথায় মিস্টার অনিক আফতাব?লুকিয়ে আছেন কোথাও?নাকি তার কুকীর্তির জেরে শাস্তিভোগ….

সবটাই তুমিময় পর্ব ২২

আমাকে শেষ করতে না দিয়ে অঙ্কুর ছুটে এসে হাত চেপে ধরলেন আমার।ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে চেচিয়ে বললেন,
-বাবা বেচে নেই অদ্রি!মারা গেছে!শুনেছো তুমি?চার বছর আগেই মারা গেছে আমার বাবা!অনিক আফতাব মারা গেছে!
কথা শেষ করে আমাকে ঝারা মেরে ছেড়ে দিলেন উনি।ধপ করে বিছানায় বসে পরলেন।স্থির দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে উনি।আমিও পাথর হয়ে গেলাম যেনো।চোখ দিয়ে পানি পরছে শুধু।বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলো নিরবতায়।কিন্তু বাইরে ঝড় শুরু হয়ে গেছে।বজ্রপাতের তুমুল শব্দ একটু পরপরই কর্নগোচর হচ্ছে।ব্যালকনির থাই গ্লাস দিয়ে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোও দৃষ্টিসীমায় আবদ্ধ হচ্ছে বারবার।

অঙ্কুরের নিরবতা তার ভেতরের কষ্টটাকে জানান দিচ্ছে।কি হলো জানি‌ না,চোখ মুছে আস্তেধীরে এগিয়ে গিয়ে অঙ্কুরের কাধে হাত রাখতেই হুট করে কোমড় জরিয়ে ধরলেন উনি আমার।পেটে মুখ গুজে শব্দ করে কাদতে লাগলেন উনি।কেপে উঠলাম খানিকটা।কিছুক্ষন আটকে থেকে একহাতে তার গলা জরিয়ে মাথার চুলে আঙুল চালাতে লাগলাম।নিজেও কাদছি আবারো।নিজের মা বাবার মৃত্যুসংবাদ সন্তানের জন্য কতোটা কষ্টের,তার ধারনা আছে আমার।হয়তো এজন্যই সহ্য হচ্ছে না অঙ্কুরের কান্না।একদমই সহ্য হচ্ছে না!

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৪