সবটাই তুমিময় পর্ব ২২ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ২২
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

মাঝে পুরো একটা দিন কেটে গেছে।অঙ্কুর বাসায় ছিলেন না।সে সুযোগে আমার সারাটা দিন কেটেছে খাতাকলমে।সারাদিনে ওই নয়টা বর্নের হাজারটা বিন্যাস বানিয়ে ফেলেছি।লাভ হয়নি।কোনোভাবেই কোনো শব্দ মেলাতে পারি নি।আরো বেশি ঝামেলায় পরেছি কোন দুটো বর্ন দুইবার ব্যবহার হয়েছে এ নিয়ে।
শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম এবার বুদ্ধিটাই কাজে লাগাতে হবে।অঙ্কুরকে দিয়েই তার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড বের করাতে হবে।এইসবই ভাবছিলাম ব্যালকনিতে দাড়িয়ে।হঠাৎই কোথথেকে একটা বল এসে সামনে পরলো আমার।ভাবনায় এতোটা মগ্ন ছিলাম,বলটা ব্যালকনিতে পরায় আতকে উঠেছি একপ্রকার।লাফিয়ে পিছিয়ে গেলাম।কেউ হাক লাগিয়ে বললো,

-তুমি ভয়ও পাও?
এগিয়ে এসে রেলিং ধরে নিচে তাকালাম।অঙ্কুর!উনি কখন আসলেন?কোটসুট পরে ফর্মাল ড্রেসে বেরিয়েছিলেন উনি।এখন ওটা ছেড়ে একটা খয়েরি টিশার্ট আর গ্রে প্যান্ট পরে আছেন।তারমানে রুমে ঢুকে চেন্জও করেছেন উনি।কখন?খেয়ালই করিনি।আমাকে ডাকেন নি কেনো?উনি মুখে হাত দিয়ে গলা উচিয়ে বললেন,
-বলটা পাস করো!

হাতে নিলাম বলটা।এটা বাস্কেটবল খেলার বল।উকি দিতেই দেখলাম নিচে একটু দুরেই পোলে বাস্কেট আটকানো।যা আগে কখনো চোখে পরেনি আমার।হয়তো চাইনি দেখতে।ব্যালকনি থেকেই বাস্কেট লক্ষ্য করে বলটা ছুড়লাম।ওটা সোজা বাস্কেট হয়েই পরলো।অঙ্কুর দেখে বললেন,
-বাস্কেটবলটা ভালোই পারো মনে হচ্ছে?
চুপ রইলাম।অনেক খেলেছি বাস্কেটবল।জিতেছি।তাকে কেনো বলবো?উনি বললেন,
-ইফ ইউ ওয়ান্ট?হয়ে যাক কম্পিটিশন?মানে মেইনটার আগে একটা ট্রায়াল?দেখি,আমাকে ওপোনেন্টে তোমার জেতার সম্ভবনা কতো!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যদিও জানি,উনি স্পোর্টম্যান,খেলাধুলায় পারদর্শীই হবেন,তবুও তার প্রকাশ্য চ্যালেন্জকে মানা করতে পারলাম না।জীবনে চুড়ান্তবার হারানোর আগে একবার এই খেলাতেই হারিয়ে দেখাই আপনাকে মিস্টার অঙ্কুর!ডেমো দিতে তো দোষ নেই কোনো।বাসা থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে এসে দাড়ালাম।উনি বাকা হেসে বললেন,

-সত্যিই চলে এলে চ্যালেন্জ নিতে?
-হ্যাঁ।আসলাম…জিততে।
-হুম?তারমানে তুমি বলতে চাইছো আমাকে হারাবে?এএসএ’কে?
-আগেই বলেছি তো,আপনিও জানেন,আপনাকে হারাবো বলেই এখানে আসা আমার।
-নট ব্যাড!আই লাইক ইওর স্পিরিট!বেশ।তবে হয়ে যাক?তিনবার বাস্কেটের জন্য বল ছুড়বো।প্রথম দুবার ট্রায়াল,তৃতীয়বার ফাইনাল।
-ডান!

বাস্কেট থেকে বেশ কিছুটা দুরে মুখোমুখো দাড়ালাম দুজনে।বল উপরে ছুড়ে মারলেন উনি।লাফিয়ে উনিই আগে ধরেছেন।বাউন্স করাতে করাতে এগোচ্ছিলেন উনি।এক পর্যায়ে ছো মেরে নিয়ে নিলাম বলটা।উনি পথ আগলানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন,
-নাইস প্লে!তবে আমার কাছে এখনো শিষ্য তুমি অদ্রি।আর আমি খুব ভালো গুরু ট্রাস্ট মি।একদম হাতে ধরে শেখাবো তোমাকে ওয়েট!
উনি কেড়ে নিলেন বলটা।বাউন্স করিয়ে বললেন,
-লেসন নাম্বার ওয়ান,কনফিডেন্স ভালো,তবে ওভারকনফিডেন্স ভালো না।
তার এ কথার মাঝেই আমি ছিনিয়ে নিয়েছি বল।উনি তখনো বলছেন,

-ওভার কনফিডেন্সের জন্য হারতে হতে পারে তোমাকে অদ্রি।কাউকে আন্ডারেস্টিমেট করো না।এমনটা না হয়,সেখানটাতেই তোমার হারের শুরু।শেষ মুহুর্তে তোমার সাজানো প্লানটা ভেস্তে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতে পারে সে।
বাস্কেট অবদি পৌছে গেছি।বাস্কেটের জন্য সবে বল ছুড়বো,কথাগুলো শেষ করেই আমার হাত থেকে অঙ্কুর ছিনিয়ে নিলেন বলটা।মুহুর্তেই কি হয়ে গেলো বুঝে উঠিনি।রীতিমতো বল বাস্কেট করেছেন উনি।রাগে পা ছুড়লাম।এমন হার প্রত্যাশিতো ছিলো না আমার।একটা শ্বাস নিয়ে তবুও এসে দাড়ালাম দ্বিতীয় বাস্কেটের জন্য।অঙ্কুর মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে তার কথাগুলো মাথায় রাখতে বোঝালেন আমাকে।বল উপরে ছুড়লাম আমিই।এবার বলও আমিই ধরলাম।বাউন্স করিয়ে বাস্কেটের দিকে এগোচ্ছিলাম খুব সাবধানে।অঙ্কুর বল কাড়ার চেষ্টায়।আগেরবারের রাগটার জন্য বল ছুতেও দেইনি এবার তাকে।উনি বললেন,

-লেসন নাম্বার টু,রাগ সবসময় সফলতার অন্তরায়।রাগকে জয় করে মন দিয়ে লক্ষ্য নির্ধারন করতে হয়।যা মন থেকে করার চেষ্টা করবে না,তা কখনোই পারবে না তুমি।
এটুকো বলে আবারো প্রথমবারের মতো বল কেড়েছেন উনি।বাস্কেটেও ফেলেছেন।কিন্তু এবার বাস্কেট করেছেন আমার দিক তাকিয়ে থেকে।পুরোই উল্টোদিক ফিরে।অঙ্কুর একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বললেন,
-টোল্ড ইউ!আমার সাথে কম্পিট করতে এসো না!
-লাস্ট আর ফাইনাল রাউন্ড এখনো বাকি অঙ্কুর।
উনি বাকা হেসে বললেন,
-হার মানো নি তবে?

-আপনার লেসনের মধ্যে এটাও এড করুন অঙ্কুর।জয় তারই হয়,যে হার মানতে জানে না।
মুচকি হেসে তৃতীয়বার বল ছুড়লেন উনি।বল আমার হাতে ছিলো।এবার যথেষ্ট সতর্কভাবে খেলছিলাম আমি।বেশ অনেকটা সময় অঙ্কুর আটকেছিলেন আমাকে।কিন্তু সুযোগ বুঝেই একসময় তাকে পাশ কাটিয়ে বল বাস্কেটে ছুড়ে মারলাম।এটা একটা বাস্কেট ছিলো।এবার জয়ের খুশিটা আমার হাজারগুন ছিলো।কারন এটাই ফাইনাল রাউন্ড ছিলো।অঙ্কুর কোমড়ে হাত দিয়ে বড়সড় হাসি ঝুলিয়ে বললেন,

-এন্ড লেসন নাম্বার থ্রি,কখনো কখনো হেরে যাওয়ার মধ্যেই জিতে যাওয়ার চেয়ে হাজারগুন বেশি প্রশান্তি অনুভব হয়।যা পৃথিবীর বাকি সবরকমের জয়ের খুশির উর্ধ্বে।তাই হার মানতেও শিখতে হয়।
তীক্ষ্মচোখে তাকিয়ে হেরে যাওয়ার পরও তার চেহারার ওই খুশির হাসিটা দেখছিলাম আমি।পাশেই একলোক গাছে পানি দিচ্ছিলো।উনি বললেন,
-স্যার হেরে গেলেন?আপনি তো বরাবরই জিততে ভালোবাসেন।
অঙ্কুর হেসে বললেন,

-ভালোবাসা?এই শব্দটা অঙ্কুরের সাথে যায় না।তাইনা অদ্রি?
চোখ সরিয়ে নিলাম।হুট করেই মনে পরলো সত্যিই তাই।এটা তার সাথে যায় না।এটা তার বিপরীত।এটা যে তার পাসওয়ার্ড হবে তা কেউ কল্পনাও করবে না।চোখ চকচক করে উঠলো আমার।পরপরই নিজেকে সামলে বললাম,
-আপনি হেরে গেছেন।যাবেন।আসছি।

অঙ্কুর মাথা নিচু করে হাত বাড়িয়ে বাসারদিক ইশারা করলেন।মোটামুটি একছুটে রুমে চলে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম।বর্নগুলোতে চোখ বুলালাম আরেকবার।E,Y,U,O,A,L,V,M,আর স্পেস বাটন।একটা শ্বাস নিয়ে আগে প্রথম শব্দটাই লিখলাম।অঙ্কুরের বিপরীত।LOVE!হাত কাপছে আমার।স্পেস ব্যবহার করে আর বাকি থাকে U,Y,A,M.
Y আর U দেখে চোখ বন্ধ করে LOVE এর পর স্পেস রেখে YOU লিখে দিলাম।ধক করে উঠলো ভেতরটা।A আর M শুধু বাকি আছে।আর যা দিয়ে একটা শব্দই সম্ভব।মা।কাপাকাপা হাতে পুরোটাই লিখে নিলাম আমি।এগারো ডিজিটের পাসওয়ার্ডটা ছিলো LOVE স্পেস YOU স্পেস MA.অঙ্কুরের ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড,লাভ ইউ মা!

এটা কি করে সম্ভব?উনি তো মনিমাকে ঘৃনা করেন!হ্যাঁ।এজন্য সম্ভব!কেউ ধারনাও করতে পারবে না তার পাসওয়ার্ড লাভ ইউ মা হতে পারে।শতভাগ নিশ্চিত হলাম আমি,এটাই তার পাসওয়ার্ড।দরজা খোলার শব্দে তাড়াতাড়ি আড়াল করলাম কাগজগুলো।অঙ্কুর এসেছেন।চেন্জ করে একপ্রকার রেডি হয়ে এসেছেন উনি।যেনো কোথাও যাচ্ছেন।উনি দরজাতে দাড়িয়ে বললেন,

সবটাই তুমিময় পর্ব ২১

-আজ বাইরে ডিনার করবো।ফিরতে দেরি হবে।তুমি খেয়ে নিও।
উত্তর দেয়নি কোনো।উনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।দরজা লাগাতে গিয়ে আবারো থেমে গিয়ে বললেন,
-বি হোয়াট ইউ আর অদ্রি।জোর করো না নিজেকে অন্যকিছু সাজানোর জন্য।জোর করো না।
উনি বেরিয়ে গেলেন।চুপচাপ পিছনপিছন এসে ব্যালকনির একটু আড়ালে দাড়িয়ে দেখলাম গাড়িতে করে বেরোচ্ছেন উনি।একদৌড়ে তার রুমে আসলাম।দরজা লাগিয়ে কাপাকাপা হাতে ধরলাম ল্যাপটপটা।পাসওয়ার্ড দিতেও হাত কাপছে প্রচন্ড।ভয় লাগছে।আর সবচেয়ে অদ্ভুত অনুভুতি!দ্বিধায় পরছি বারবার।বারবার মনে হচ্ছে কোথাও ভুল করছি আমি।যেখানে আমি জানি,অঙ্কুর দোষী।উনি নিজে স্বীকার করেছেন।একটা জোরে শ্বাস নিয়ে পাসওয়ার্ড টাইপ করলাম।LOVE YOU MA.

ল্যাপটপের লক খুলে গেলো।নিজেকে সামলে একে একে সমস্ত ডকুমেন্ট,ফাইল ওপেন করে দেখতে লাগলাম।কিন্তু সেখানে যা যা দেখলাম,তার অনেক কিছুই মানতে পারছিলাম না।অবিশ্বাস্য লাগছিলো।তব্দা মেরে বসে রইলাম।মাথা কাজ করছিলো না।এরমধ্যেই কেউ বলে উঠলো,
-লেবুর রসে থাকা সাইট্রিক এসিড নীল লিটমাসকে লাল করে।সাইন্সটা বেশ ভালোই কাজে লাগিয়েছো তুমি অদ্রি।হ্যাটস্ অফ টু ইউ!তবে এই সাইন্স আমিও কিছুটা জানি।আর তার সাথে তোমার মতো ট্রিকস্ও!

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৩