সবটাই তুমিময় পর্ব ২৯ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৯
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

এয়ারপোর্টে গাড়িতে বসে অপলক দৃষ্টিতে অঙ্কুরের হাসিমুখ দেখে চলেছি।প্রেস-মিডিয়া আর অঙ্কুরভক্তের জনস্রোতের মাঝেও খয়েরী শার্ট পরিহিত,সানগ্লাস চোখে,সুঠাম দেহের অধিকারী সে ব্যাক্তিকে ঠিকই চোখে পরছে।চারপাশে পাঁচ ছয়জন কালো শার্টপ্যান্ট পরা লোকজন হাত দিয়ে ঘিরে রেখেছে তাকে।এগোতে এগোতে কখনো দুচারজনের হাতে হাত ছুইয়ে দিচ্ছেন,তো কখনো হাত থেকে কাগজ নিয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন।হঠাৎই কারো সাথে দাড়িয়ে যাচ্ছেন সেলফির জন্য।এমনিতেও উনি যথেষ্ট সময় ওনার ফ্যানদের সংস্পর্শে থাকেন।ম্যাচ জিতে এসে যেনো আরো বেশি মিশে যেতে চাইছেন সবার মাঝে ।

আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রোহান ভাইয়া কোথাও গেছেন।অঙ্কুরের সাথে আর কথা হয়নি আমার।তবে আসার সময় এলিনার সাথে দেখা করেছিলাম।একই ফ্লাইটে এসেছি আমরা।তবে সেই অচেনা হয়ে।চেনা কি কোনোদিনও ছিলাম?আদৌও চেনার চেষ্টা করেছিলাম কি?করেছিলাম তো!কিন্তু আপনিই বারবার ভুল পরিচয় দিয়েছেন নিজের অঙ্কুর।হ্যাঁ তবে সেটারও যথেষ্ট কারন ছিলো।ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।এরমধ্যেই রোহান ভাইয়া গাড়িতে এসে বসলেন।ইতস্তত করে বললাম,

-আ্ আমি আমার বাসায় যাবো রোহান ভাইয়া।
উনি সিটবেল্ট লাগাতে ব্যস্ত ছিলেন।চোখ তুলে স্বাভাবিকভাবে বললেন,
-হ্যাঁ।অঙ্কুর তো এমনটাই বলেছে।তোমাকে তোমার বাসায় নিয়ে যেতে।আমরা ওখানেই যাচ্ছি।
জোরে শ্বাস ছাড়লাম।চোখ ভরে উঠছিলো,তবুও কান্না থামিয়ে দিলাম কোনোভাবে।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম।এই রাস্তায় আগে আসা হয়নি,নতুন রাস্তায় আশপাশটা দেখায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম সর্বোচ্চ।লাভ হয়নি।হুটহাট চোখের জল বেরিয়ে আসছিলো।মুছে নিচ্ছিলাম তৎক্ষনাৎ।বারবার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অনেকটা রাস্তা আসার পর রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার।দেখলাম গাড়ির সামনে রাখা রোহান ভাইয়ার ফোনটা বাজছে।কানে গোজা হেডফোনে কল রিসিভ করলেন উনি।কিছু না বলে মুচকি হেসে গাড়ি ব্রেক করলেন রোহান ভাইয়া।একটু বিস্ময়ে তাকালাম তারদিক।উনি নেমে গিয়ে পেছনে রাখা তার ব্রিফকেস,ট্রলি আর কোটটা নামিয়ে নিলেন।তারপর আমার জানালার পাশে একবার ঘড়ি দেখে ফাকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।বললাম,
-এখানে থামলেন কেনো?এসবই বা নামালেন কেনো?
উনি নিরুত্তর।পরপরই পেছনে কিছু একটা দেখে আমার দিকে সৌজন্যে হেসে বললেন,

-হ্যাভ আ নাইস জার্নি।বাই।
ট্রলি টেনে চলে গেলেন রোহান ভাইয়া।সিটবেল্ট খুলতে খুলতে চেচাতে লাগলাম,
-মানে?কোথায় যাচ্ছেন আপনি র্….
সিটবেল্ট খোলা শেষ হয়নি আমার।না কথা শেষ হয়েছে।টের পেলাম পাশে ড্রাইভিং সিটে এসে বসেছেন কেউ।মাথা তুলে তাকাতেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো আমার।অঙ্কুর!ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন উনি।বেশ কিছুটা সময় বিস্ময়ে তাকিয়ে সিটবেল্টটা আবারো ঠিকঠাকমতো লাগিয়ে নিলাম।মাথা নিচু করে সরু গলায় বললাম,
-আপনি এখানে?

-আমাকে প্রশ্ন করার অধিকার নেই তোমার।
মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম।উনি বললেন,
-মায়ের কাছে যাবো।এখন যখন আমিও যাচ্ছি,আলাদা করে তোমার জন্য রোহানের পেট্রোল খরচ করার কি দরকার?এমনিতেও তো কম করিনি তোমার জন্য।আর তার বিনিময়ে তুমিও কম করোনি।
কিছুই বলার ছিলো না আমার।চাইলে হয়তো জবাব দিতে পারতাম।হয়তো প্রশ্নও ছুড়ে দিতে পারতাম তাকে,আমার দোষটা কোথায়?যখন উনিই বারবার ভুল বুঝিয়েছেন আমাকে,আমার কি করনীয় ছিলো?কিন্তু এসব কথা তোলার কোনো মানে হয়না।এসব ভাবনাচিন্তার মাঝেই বাসায় পৌছালাম আমরা।কোনোদিক না তাকিয়ে টেনেটুনে নিজের ট্রলিটা টেনে বের করে দরজায় দাড়ালাম।

কলিং বেল আমার আগেই অঙ্কুর টিপে দিয়েছেন।পাশে তাকালাম।সানগ্লাস খুলে ফেলেছেন উনি।শার্টটার কলার আর হাতাটা টেনে ঠিক করে নিলেন।চুলগুলো উল্টে দুহাত সামনে রেখে মুখে বড়সর হাসি টেনে এমনভাবে দাড়ালেন যেনো শান্তশিষ্ট কোনো ছোট বাচ্চা।যেনো কেউ তার গাল টেনে তাকে বলে গেছে,এইযে বাবু,এইখানে ভদ্রভাবে চুপচাপ দাড়াও,চকলেট দেবো তোমাকে।আর তিনি সেই চকলেটের আশায় এতো ইনোসেন্সি দেখাচ্ছেন।এসব ভেবে কপাল কুচকে ফেললাম।এই আবোলতাবোল ভাবনার জন্য নিজের উপরও রাগ হলো।দরজা খুলে দিলো মনিমা।সাথেসাথে চোখ দিয়ে পানি পরতে শুরু আমার।ভেতরে ঢুকে আস্তেকরে জরিয়ে ধরলাম মনিমাকে।চোখ বন্ধ করে নিরবে কাদছিলাম।অনেকটাসময় পর মনিমা বললো,

-যা হওয়ার হয়ে গেছে আন্নু।ভুলে যা।
মাথা তুললাম।মনিমাও কেদেছে।মনিমা চোখের পানি মুছে ফেললো।আমারও চোখমুছ মুছে দিয়ে কপালে চুমো দিয়ে সামনে থেকে সরে দাড়িয়ে হাসিমুখে বললো,
-দেখ কারা এসেছেন।
এতোক্ষনে ড্রয়িংরুমে চোখ বুলালাম আমি।অনেকগুলো অচেনা মুখ।এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে আমার দুগাল ধরে কাদতে কাদতে বললো,
-আমার অনিতার মেয়ে!
বিস্ময়ে মনিমার দিকে তাকালাম।মনিমা আস্তেকরে মাথা উপরনিচে নাড়লো।এটা আমার নানীমা।নানীমা জরিয়ে ধরলো আমাকে।আমিও তাকে জরিয়ে কাদছি।একটুপর আরেকজন উঠে এসে কাধে স্পর্শ করলো আমার।তারদিকে ফিরলাম।মনিমা বললো,

-তোর দাদীমা।
দাদীমা বলে তাকেও জরিয়ে ধরলাম।দাদীমা কাদছিলো না।হাসছিলো।তবে চোখে জল ছিলো তার।দাদীমা বললো,
-আমার আকাশের মেয়ে!একদম বাবার মতো হয়েছিস তুই বোনু!
-না সাবু।ও তো আকাশ অনিতা দুজনের মেয়ে।আহানিতা।তবে হয়েছে আমার মতো।তাইনা বোনু?
এটা অবশ্যই দাদু।এগিয়ে যেতেই সেও কেদে দিলো।তারপর চোখের পানি মুছে হাতের লাঠিটা সোফায় ঠেকালো।আমার গালে হাত রেখে বললো,
-এইতো আমার মতো,আমার নাতনি।
তার হাত চেপে ধরে শব্দ করে কাদতে লাগলাম আমি।দাদু বললো,
-আর কাদিস না বোনু।যাদের উপর অভিমান করছিলাম,তাদেরই তো হারিয়ে ফেলেছি আমরা।এখন তুই এভাবে কাদলে যে আমাদের অপরাধবোধ বাড়বে!
নাক টেনে চোখ মুছে নিলাম।হাসি ফোটালাম মুখে।বললাম,

-তোমরা হঠাৎ?
ওরা সবাই একটু আটকে গেলো।মনিমা বললো,
-কালকের নিউজটা দেখে আমিই কল করেছিলাম ওনাদের।তোকে একা সামলানোর সাহস হচ্ছিলো না।
দাদীমা বললো,
-তোর কাকু কাকিমা আসতে চেয়েছিলো।আমরাই আনি নি।সময় করে নিয়ে আসবো।
-হ্যাঁ হ্যাঁ দাদীমা।ও তুমি শুধু কাকু কাকিমা কেনো?তোমার গ্রামের ঝাড়সুদ্ধ নিয়ে এসো।সময় আমি করে দেবো।ডোন্ট ওয়ারি।

অঙ্কুরের কথায় বাকশুন্য হয়ে রইলাম।তবে ওনাকে দেখে আরো অবাক হয়েছি।গায়ের খয়েরি শার্টটার বদলে এখন কালো টিশার্ট,ট্রাউজার।কপালের সামনের চুলগুলো ভেজা।বোঝাই যাচ্ছে ফ্রেশ হয়েছেন সবে।উনি চেন্জ করেছেন!কোথায়?কখন?আমার বিস্ময়ের চাওনিকে না দেখে,বেশ সুন্দরমতো তার ড্যাম কেয়ার ভাব বজায় রেখে,মনিমার পাশে এসে তাকে একহাতে জরিয়ে দাড়ালেন।হাসিমুখে অঙ্কুরের বুকে মাথা ঠেকালো মনিমা।দাদু আমাকে ছেড়ে তার সামনে দাড়ালো।অঙ্কুর সুন্দরমতো হেসে সালাম দিলেন দাদুকে।দাদু বললো,

-কেমন আছো অঙ্কুর?
-ফার্স্টক্লাস জমিদারমশাই।আপনি?
-ভালো।এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে?
-মাকে ছাড়া ভালো লাগছিলো না।
-খেলেছো কিন্তু ভালোই।
-থ্যাংকস্।

মনে হলো দাদু ক্রিকেটভক্ত।আর অঙ্কুরের খেলারও।হয়তো মনিমা বলেছে,অঙ্কুর তার ছেলে,তাই এভাবে কথা বলছে।আর অঙ্কুর সবার সাথেই ফ্রিলি কথা বললেও দাদুর সামনে কিছুটা গুটিয়ে আছেন বলে মনে হচ্ছে।মনিমা বললো,
-আন্নু?তুই যা,ফ্রেশ হয়ে আয়।
মাথা নেড়ে চলে আসলাম ওখান থেকে।রুমে ঢুকে অঙ্কুরের লাগেজ দেখে আরেকদফা অবাক হলাম।ভেবেছিলাম হয়তো মনিমার রুমে থাকবে এগুলো।একটা শ্বাস ফেলে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখি দাদুর সামনে গুটিশুটি মেরে বসে কথা বলছেন অঙ্কুর।আমাকে দেখে দাদীমা বললো,

-আন্নু?আয় বোনু?এদিকে আয়?
এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলাম।নানীমাও পাশেই বসে।নানীমা আমার গালে হাত বুলিয়ে বললো,
-কতো বড় হয়ে গেছিস তুই!
দাদীমা বললো,
-হ্যাঁ।আমার আকাশের মেয়ে,সেও এতোবড় হয়ে গেছে!
-বড় হয়ে গেছে,বিয়ে দিয়ে দাও!

কথাটা বলে দাদুর দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন অঙ্কুর।দাদু বললো,
-ঠিকই বলেছো দাদুভাই।তবে এখনই না।সবে কাছে পেলাম ওকে,এখন তো আদরে আদরে ভরিয়ে রাখবো সবাই মিলে।শশুড়বাড়ি দেরিতেই পাঠাবো।
দাদুভাই হাসলো।অঙ্কুরের চেহারায় বিরক্তি।পরপরই একটা টেডিস্মাইল দিয়ে ডাক লাগালেন,
-মা?ও মা?মা?
মনিমা ছিলো না ওখানে।সারা বাড়ি কাপিয়ে হাক ছেড়েছেন উনি।অন্যকেউ,অন্যসময় হলে রাগ হতো আমার।কিন্তু মনিমাকে এভাবে ডাকছেন উনি,খুশি লাগছিলো।মনিমা হাত মুছতে মুছতে এসে বললো,
-কি হলো?এভাবে ডাকছিস কেনো অঙ্কুর?

মনিমাও স্বাভাবিক।তারমানে সিডনে যাওয়ার আগে সবটা ভালোভাবেই মিটমাট করে গেছেন অঙ্কুর।উনি বললেন,
-বয়স হয়েছে না তোমার?একা একা কিচেনে কেনো যাও বলোতো?এটাকে নিয়ে গেলেও তো পারো?
এটা বলতে আমাকে বুঝিয়েছেন উনি।কিছুই বললাম না।উঠে দাড়িয়ে পা বাড়ালাম কিচেনের দিকে।মনিমা বললো,
-আন্নু?তুই থাক।অঙ্কুর?তুই তো জানিস আগুনে ফোবিয়া ওর।
-আগুনে ফোবিয়া।কিচেনের অন্য কোনো কাজে না।এটা ওটা এগিয়ে দিলেও তো পারে।এতো ননীর পুতুল বানানোর কি মানে?
দাদু মুখ খুললো এবার।বললো,

-আমার নাতনি কাজ কেনো করবে?আর আফরা?তোমারও কাজ করতে হবে না।আমি….
-আমি যাচ্ছি কিচেনে।তুমি শান্ত হও দাদু।সত্যিই তো,যেটুকো পারি সেটুকো করা উচিত আমার।
মনিমাকে টানতে টানতে নিয়ে আসলাম একপ্রকার।যেটুকোই করেছি,চুলা থেকে চারহাত দুরে দাড় করিয়ে রেখেছিলো আমাকে।এককাপ কফি আর তিনকাপ চা সাথে বিস্কুট দিয়ে বললো সবাইকে দিয়ে আসতে।ড্রয়িংরুমে আসতেই শুনলাম দাদু হাসতে হাসতে বলছে,

সবটাই তুমিময় পর্ব ২৮

-তবে আমিও কিন্ত কাচা খেলোয়ার নই দাদুভাই।গ্রামগন্জের মাটি লেগে আছে এখনো গায়ে।চাইলে সে খেল দেখিয়ে তোমার পাত্তা কাটতেই পারি।
অঙ্কুর বাকা হেসে বললেন,
-তোমার থেকে এক্সপেক্টেশন বেড়ে গেছে জমিদারমশাই।বুড়ো বয়সেও এনার্জী যে ভালোই তা বেশ বুঝতে পারছি।শতহোক,আকাশ ইলিয়াসের বাবা,অদ্রির দাদু বলে কথা!এটুকো তেজ তো তোমাকেই মানায়!তবে এই জমিদারগিরি এখানে দেখিও না।এটার দখলদার পুরোটাই আমি।

এবার দুজনের কথার ধরন দেখে আজব লাগছিলো।আমার কিচেনে যাওয়ার পরপরই সবটা পাল্টে গেলো?চুপচাপ এগোলাম।টি টেবিলে ট্রে রেখে বাকিসবাইকে চা দিয়ে অঙ্কুরের সামনে কফিমগটা ধরলাম।উনি কিছু না বলে উঠে গেলেন ওখান থেকে।পকেটে হাত গুজে দুলতে দুলতে সোজা আমার ঘরে ঢুকেছেন উনি।দাদু,দাদীমা,নানীমা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।ইতস্তত করে বললাম,
-উ্ উনি ভেবেছেন ওটা মনিমার রুম।তাই….
একসাথে ও বলে চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো তিনজনই।কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে।এতোক্ষন অঙ্কুরের ব্যবহার আর এদের কথাবার্তা সবই তো স্বাভাবিক ছিলো।এটুকো সময়ের মধ্যে হুট করে কি হয়ে গেলো?সবটা অস্বাভাবিক লাগছে কেনো আমার?

সবটাই তুমিময় পর্ব ৩০