সবটাই তুমিময় পর্ব ২ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ২
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

দুদিন হলো পানি ব্যতিত কিছুই খাওয়া হয়নি।বিছানার পাশে বোতলে থাকা পানিও ফুরিয়েছে অনেক আগেই।প্রতিবার খাবার সময়ে একেকবার একেকজন এসে হরেক রকমের খাবার যেভাবে দিয়ে যাচ্ছে,পরেরবার এসে সেভাবেই ফেরত নিয়ে যাচ্ছে।শুধু পানির গ্লাসটা ফাকা করে দিয়েছি প্রতিবার।তাদের সাথে কথা বলতে গেলে মনে হবে যেনো প্রত্যেকেই অনুভূতিশুন্য কোনো নির্বাক রোবট।কোনো কথার না আছে রিয়্যাক্ট,না আছে উত্তর।দরজা খুলে একজন ভিতরে ঢুকবে তো আরেকজন পাহাড়ায় দাড়িয়ে।ছোটাছুটি,দৌড়াদৌড়ি করেও লাভ হয়নি।

মানানোর চেষ্টা না করে তবুও পালানোর চেষ্টা করতে করতে এভাবে বন্দিদশাতেই কাটিয়ে দিয়েছি দুটো দিন।জানি না কবে মুক্তি পাবো এখান থেকে,আদৌও মুক্তি দেবে কি না সে আমাকে।কিন্তু মনিমার জন্য,নিজের বুদ্ধির জোরে হলেও,বেরোতে আমাকে হবেই।আর তারজন্য আগে বেচে থাকতে হবে।এই মুহুর্তে খিদেয় পেট জ্বলতে শুরু করেছে আমার।পেট ধরে হাশফাস করতে লাগলাম।একটু পরেই দরজা খুলে গেলো।চমকে উঠে দরজায় তাকালাম।এএসএ এসেছেন।কাধের ব্যাগটা দেয়ালে ঠেকিয়ে রাখলেন উনি।গায়ে জার্সি।বোঝাই যাচ্ছে সবে ম্যাচ থেকেই ফিরলেন।মুখ ফিরিয়ে নিলাম।উনি শব্দ করে দরজা লাগিয়ে ঘরের ভেতরে এগোলেন।অঙ্কুর বললেন,

-খাবার খাননি?
-দুদিন না খেয়ে এখনো ফুল এনার্জিতে বসে আছেন কীভাবে?
-খাবার না খেলে অসুস্থ্য হয়ে পরবেন আপনি মিস অদ্রি!আর….
-নান অফ ইউর বিজনেস!
উনি মুচকি হাসলেন।এই হাসিটা নাকি মেয়েদের ঘায়েল করে।আমার তো ঘৃনায় বারবার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসছে।দরজায় নক পরতেই উনি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে‌ দিলেন।হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে আবারো লাগিয়ে দিলেন দরজা।এগিয়ে এসে আমার সামনে হাটুগেরে বসে খাবার মাখাতে মাখাতে বললেন,
-এতোবড় বিছানা,সোফা,চেয়ার।বিনব্যাগও আছে।এসব ছেড়ে এই এককোনে মেঝেতে বসে কি সুখ পান আপনি?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-আমি আছি আপনার যত্মে কোনো রক‌মের ত্রুটি না রাখার চেষ্টায়,আর আপনি আছেন আমার সমস্ত কাজ বিগরানোর চেষ্টায়!
-অদ্রি নামটা বেশ যায় আপনার সাথে।অদ্রি!পাহাড়!পাহাড়ের মতোই বড় আপনার সাহস!
উনি খাবার মুখের সামনে তুলে ধরলেন আমার।শক্তভাবে বললাম,
-খাবো না!
-কেনো?
-আপনি বোঝেন না কেনো?
-না তো!কেনো?
-আমি মুক্তি চাই এখান থেকে!লেট মি গো!প্লিজ যেতে দিন আমাকে মিস্টার অঙ্কুর!প্লিজ!
-হ্যাঁ,যাবেন তো!আমিও যেতে দেবো আপনাকে।আমার শর্ত মেনে,চলে যান!আটকাবো না!আপনি শুধু সেরোগেশনের জন্য রাজি হয়ে যান!ইউ উইল বি ফ্রি!
রাগ নিয়ে চেচিয়ে বললাম,

-কোনোদিনও মানবো না আপনার শর্ত!
-সমস্যাটা কোথায় মিস অদ্রি?এতে তো আপনাকে নিজেকে আমার কাছে সমর্পন করতে হবে না।শুধুমাত্র একটা ছোট অপারেশন।তারপর আপনি প্রেগনেন্ট,আর দশমাস পর…..
-সেরোগেশনের সঙ্গা আমাকে বোঝাতে আসবেন না মিস্টার অঙ্কুর!আমি জানি এটা কি।কিন্তু আপনি জানেন না এসবের জন্য ভুল মানুষকে চুজ করেছেন আপনি!আমি কোনোভাবেই আপনার বাচ্চার সেরোগেট মাদার হতে রাজি হবো না!
উনি নিচদিক তাকিয়ে বড়সর হাসি দিলেন একটা।তাচ্ছিল্যের হাসি!খাবার আবারো সামনে তুলে বললেন,
-আচ্ছা বেশ,আগে খেয়ে নিন!
-বলেছি তো খাবো না!
-দেখুন মিস অদ্রি,আজ ক্যারিয়ারে প্রথম বার জিরো রানে আউট হয়ে ম্যাচ হেরে এসেছি।তবুও আপনার সাথে এতো ভালোভাবে কথা বলছি।আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না প্লিজ!
বিস্মিত হলাম।উনি সত্যিই ম্যাচ হেরে এসেছেন আজ?তারমানে আমি যা যা শুনেছিলাম,দেখেছিলাম,তাই তাই….
-হ্যাঁ,আপনি যা যা শুনেছিলেন,দেখেছিলেন,তাই তাই ঘটেছে আর ঘটবে।এটা তো জাস্ট ক্লাবের ম্যাচ ছিলো।এছাড়াও…..এনিওয়েজ,যেকারনে আসা!খাবেন না আপনি?
ঘৃনার চোখে তাকালাম তার দিকে।এই লোকটাকে নিয়ে সব ভালো ধারনা নষ্ট হয়ে গেছে আমার।বললাম,

-না!
উনি একটা জোরে শ্বাস ফেললেন।প্লেটটা মেঝেতে রেখে বাবু হয়ে‌ মেঝেতেই বসলেন আরাম করে।তারপর হাতটা ধুয়ে আমার জন্য আনা খাবার প্রচন্ডরকম তৃপ্তি‌ নিয়ে খেতে লাগলেন।যেনো কতো জন্মধরে অভুক্ত রয়েছেন।চোখ সরিয়ে‌ নিলাম আবারো।উনি খেতে খেতেই‌ বললেন,

-ইউ নো হোয়াট মিস অদ্রি?আপনি আমার লাইফে আসার পর থেকে সবকিছুই কেমন কেমন যেনো পাল্টে যাচ্ছে আমার!এএসএ এরআগে কোনোদিনও কোনো বেআইনি কাজে নিজেকে জড়ায়নি।না কোনোদিন কোনো মেয়েকে দেখে এক সেকেন্ডের জন্যও আটকে গেছে।নাইবা কোনোদিন কারো জন্য ওর কোনো পরোয়া হয়েছে।কোনোদিন ম্যাচে হারার জন্য খেলতে নামেনি এএসএ!আজ নিজে থেকে জিরো রানে আউট হয়ে বাসায় ফিরেছে।কোনোদিন হাত দিয়ে খাবার খাইনি আমি।আজ মেঝেতে বসে,হাতে মাখিয়ে খাবার খাচ্ছি।হাহ্!সেটাও কি?অয়েলড্ ফুড!যেটা স্পোর্টসম্যান হিসেবে এভোয়েড করা উচিত আমার!
কিঞ্চিত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।উনি মাথা তুলে শক্ত গলায় বললেন,
-এসবটার জন্য আপনি দায়ী!

-ম্ মানে?
কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে গ্লাসের পানিটুকো শেষ করলেন।আবারো স্বাভাবিক হয়ে খাবার মাখাতে মাখাতে বললেন,
-মানে?মানে হয়তো অনেককিছু,আমার অগোচরে।আর সেখানেই সে মানেগুলোর ইতি টানবো আমি।এসব নিয়ে কোনো রাগ নেই আমার আপনার উপর।ট্রাস্ট মি।যেটা আছে,সেটার নামও আমি জানি না।কিন্তু যে শাস্তিটা আপনাকে দেবো,সেটা আপনার প্রাপ্য।এন্ড ইউ উইল হ্যাভ টু বেয়ার দ্যাট!
আবারো অন্যদিক ফিরলাম।এর কথার কিছুই মাথায় ঢুকছে না আপাতত আমার।পেট চেপে ধরে আছি।ক্ষিধে পেয়ে পেটে যন্ত্রনা হচ্ছে খুব।এএসএ বললেন,

-আপনি খাবেন না,ভালো কথা।না খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পরুন।আই‌ সাজেস্ট,অজ্ঞানটজ্ঞান হয়ে পরুন।ইভেন আমি তো ভাবছি আরো নেক্সট দুদিন খাবার পাঠাতে মানা করবো এ ঘরে!
ভ্রুকুচকে তাকিয়ে রইলাম।উনি জোর করে হেসে বললেন,
-ইয়ে,আসলে কি বলুন তো মিস অদ্রি?আই হ্যাভ আ প্লান!যদি আপনি না খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পরেন,অজ্ঞান হয়ে যান,তাহলে ইজিলি আপনাকে হসপিটালাইজড্ করানো যাবে।আর আপনি সেন্সলেস থাকা অবস্থাতেই সেরোগেশনের অপারেশনটা….

বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম তারদিকে।উনি উকিঝুকি দিয়ে বা হাতে আমার চশমাটা খুলে দিলেন।বললেন,
-হুম,এবার এক্সপ্রেশনটা বোঝা যাবে।
-আপনি আবারো….
-সত্যিটাই বলেছি।একবার অসুস্থ্য হয়ে দেখুনই না।আপনি না চাইলেও এমনটাই হবে।
দাতে দাত চেপে তাকিয়ে রইলাম তারদিকে কিছুক্ষন।উনি এতোটুকো পাত্তা না চশমাটা চোখে পরিয়ে দিলেন আমার।আঙুলে লেগে থাকা খাবার খেতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন আবারো।একটু ভয় হলো আমার।একে বিশ্বাস নেই।না!অসুস্থ্য হওয়া যাবে না আমার!যদি সত্যিই কোনোভাবে…কাপাকাপা হাতে মেঝেতে থাকা খাবারের প্লেট নিতে যাবো,উনি ছো মেরে সরিয়ে নিলেন ওটা।বললেন,

-ইউ লায়ার!বললেন তো খাবেন না,এখন আমার খাবারের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন কেনো?
ওনার বাচ্চাবাচ্চা কথায় আরো গা জ্বলছে আমার।রাগে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলাম।উনি বললেন,
-খাবেন?
একটু সময় নিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।এএসএ’র মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।পরপরই হাসি কমিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন,
-লিসেন মিস অদ্রি!আপনি না খয়ে অজ্ঞান হয়ে আছেন এ আশা নিয়ে মাঠ থেকে সোজা এ ঘরে এসেছি।সে আশা ভেঙে দিলেন।এখানে আসার দরুনই ঠিকমতো ফ্রেশ না হয়ে আনহাইজেনিক ওয়েতে হাত ধুয়ে খাবার খেতে বসে গেছি,যার ফলে অসুস্থ্য হয়ে যেতে পারি আমি,যাতে আমার লাইফরিস্ক আছে।এইসব খাবার মুখে পুরে দিয়েছি খিদের চোটে।এটাও আনহেলদি আমার জন্য।এখন আবার আমার সেই খাওয়াটার মাঝেও ভাগ বসাচ্ছেন।এতোসবের জন্য শাস্তি প্রাপ্য আপনার।তাইনা?

তার অলৌকিক সব যুক্তি দেখে কপাল কুচকে আসলো আমার।বললাম,
-মানে?
-উফ্!এতো কিউটভাবে মানে কথাটা বলেন না আপনি!সব মানে বলে দিতে ইচ্ছে করে।যাই হোক!মানে হলো,আপনাকে এখন আমার হাতেই খাবারটা খেতে হবে।
-আম্….
-সিঙ্গেল ওয়ার্ড মোর,কোনো খাবার জুটবে না আপনার!আর তারপর আপনি….

কথা শেষ না করে শীষ বাজিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল উল্টে বোঝালেন আমি অসুস্থ্য হয়ে পরবো।চশমাটা চোখে আরেকটু ঠেলে ওই উল্টে রাখা বৃদ্ধাঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন।ওনার গলা ঝারার শব্দে কিছু না বলে চুপচাপ হা করলাম।এএসএ নিজের মতো করে খাবার নিজের হাতে খাইয়ে দিতে লাগলেন আমাকে।বিরক্তি নিয়ে তাকালাম তার দিকে।কিন্তু সে বিরক্তিটা আদৌও কতোসেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিলো বলতে পারবো না।
চেহারাটা লালাভ হয়ে আছে ওনার।গাঢ় নীল জার্সিটাতে ঘাম লেগে ভিজে আছে বগল আর কাধের দিকটা।যখন এসেছিলেন,কপালের সামনের চুলগুলো ঘামে ভেজা ছিলো,এখন শুকিয়ে গেছে।ভ্রুর পাশের লালচে তিলটা একদম ছোট,তবুও চোখে পরে।উনি প্লেটের দিকে তাকিয়েই বললেন,

-মন ভরেছে?
হুট করে তার এমন প্রশ্নে কাশি উঠে গেলো আমার।নাকে ঝাল লেগেছে।চোখ,মুখ সব জ্বলছে।এএসএ‌ তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন।চোখ দিয়েও পানি পরছে এবার।উনি দৌড়ে এসে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন।ঢকঢক করে পুরোটা শেষ করলাম।একটু শান্তি লাগছে এতোক্ষনে।চশমা খুলে চোখ মুছে ফেললাম।সামনে হাটুগেরে বসে থাকা লোকটার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই উনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।গলার ওড়না ঠিকঠাকমতো টেনে দিয়ে আবারো হাটু জরিয়ে বসলাম।এএসএ আঙুল উচিয়ে ক্ষীনস্বরে বললেন,

-আ্ আপনার নাক….
কিছুই বুঝলাম না।তবে ঝাল লেগেছে বলে হাতের তালুতে নাকটা ডললাম একটু।আড়চোখে এএসএ কেও দেখছি।এমন করছে কেনো লোকটা?ঝালটা পুরোপুরি মেটেনি।মুখ দিয়ে নিশ্বাস ছাড়ছি।জিভ দিয়ে ঠোট ভেজাচ্ছি বারবার।উনি আবারো বলে উঠলেন,
-মিস অদ্রি,আপনার ঠ্…
হাতের উল্টোপিঠে ঠোট ডলতে যাচ্ছিলাম আমি।কিন্তু এটুক শুনেই থেমে গেলাম।তীক্ষ্মচোখে তাকালাম তারদিকে।এএসএ নিরবে হাতের ভাত ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালেন।বেরিয়েও যাচ্ছিলেন উনি।কি মনে করে পিছন ফিরলেন।আমার রাগী চাওনি দেখে বাকা হাসলেন একটু।পরপরই চিন্তার ভাব ধরে বললেন,
-ওভাবে কাশি কেনো উঠলো আপনার মিস অদ্রি?এমন কি‌ বললাম আমি?

সবটাই তুমিময় পর্ব ১

রাগে হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে বসে রইলাম।উনি সেই গা জ্বালানো মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।মাথা চেপে ধরে বসে রইলাম।সবকিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে আমার।পাগল পাগল লাগছে।এ কোন পৃথিবীতে বন্দিনী হয়ে পরে রইলাম আমি?এমনটা কেউ কোনোদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেনি হয়তো।তবে আমার সাথে কেনো ঘটছে?

দুদিনে কোনো ক্ষতি করেননি উনি আমার।বলছেন জোর করবেন না।আবার ছেড়েও দিচ্ছেন না!আমি তো তার শর্তে এখনো রাজি হয়নি,উনিও কিছু বললেন না আর!কিন্তু এভাবে কয়দিন?দম বন্ধ লাগছে আমার!আমার জীবনটা তো এমন নয়।চারদেয়ালে বন্দি থাকাটা আমার স্বভাবের বাইরে।মৃত্যু না দিলেও,তার দেওয়া এই বন্দিদশায় মনে হচ্ছে শ্বাস আটকে মারা পরবো আমি!আর মনিমা?সে হয়তো আমার চিন্তায় এতোদিনে….মনিমার কথা ভাবতেই চিৎকার করে কাদতে লাগলাম আবারো!যদিও সে কান্না শোনার মতো একটা প্রানীও এ বাসায় নেই তার ধারনা পেয়ে গেছি আমি!তবুও,এই কান্নাই এখন একমাত্র সঙ্গী আমার!বেরোনোর কোনো উপায় নেই!কোনো উপায় নেই!

সবটাই তুমিময় পর্ব ৩