সবটাই তুমিময় পর্ব ৩৫ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ৩৫
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

-উহুম!উহুম!
আস্থার গলা ঝাড়ার শব্দ শুনে অঙ্কুর ছেড়ে দিলেন আমাকে।মুহুর্তেই‌ স্বাভাবিক হয়ে ঘর,বিছানা দেখায় মনোযোগী হলেন উনি।আর আমি এলোমেলো মনে তার বলা কথাগুলো ভেবে চলেছি।আস্থা কাধ দিয়ে ধাক্কা মেরে বললো,
-কিরে?চান্স পে ডান্স?থুরি!রোমান্স?বাসরঘর তো তানহা-তিহানের।তা,এটুক ফুল দেখেই তোদেরও রোমান্সের ইচ্ছা জাগলো?

কটমটে চোখে তাকাতেই ও আমতা আমতা করে বললো,
-ইয়ে,আ’ম জোকিং!ইউ মে কন্টিনিউ!আ্…আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।
সরু চোখে তাকিয়ে রইলাম ওরদিকে।ত্বোহা মোম নিয়ে এসেছে।তানহা তিহানও ভেতরে ঢুকলো।আস্থা আর আমি তানহার সাথে কথা বলছিলাম।অঙ্কুর মোমদুটো জ্বালিয়ে দিয়ে ওদের সামনে এসে দাড়িয়ে বললেন,
-উইশ ইউ আ ভেরি হ্যাপি ম্যারিড লাইফ।তানহা?আমার ভুল সংশোধন কিন্তু শেষ।কি বলো?
তানহা সালাম করতে যাচ্ছিলো অঙ্কুরকে।উনি তাড়াতাড়ি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-আরে আরে,কি করছো কি?

-আপনার মতো একজন বড়ভাইয়া সত্যিসত্যি থাকলে আমার জীবনটা ধন্য হতো ভাইয়া।
অঙ্কুর মুচকি হেসে তানহার একগাল ছুয়ে বললেন,
-আ’ম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ।
তিহান বললো,
-থ্যাংকস্ দিয়ে আপনাকে ছোট করবো না স্যার।তবে আজ আপনি যা করলেন….
-তানহাকে দেখো তিহান।ও কিন্তু ওর সবটা ছেড়েছে,তোমার হাত ধরবে বলে।ওর হাত কোনোদিন ছেড়ো না প্লিজ।ভালোবেসে আকড়ে ধরে রেখো আজীবন।
-আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো স্যার।

মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন উনি।আস্থাও দৌড় লাগালো।রোহান ভাইয়া ভেতরেই আসেননি।তাই ওউ এ ঘরে স্থির থাকতে পারে নি বেশিক্ষন।তা আমার,তানহার বা তিহানের কারো বুঝতে বাকি রইলো না।ওর কান্ডে শব্দ করে হেসে দিলাম তিনজন।হাসি থামিয়ে তিহানের সামনে দাড়ালাম গিয়ে।বললাম,
-সম্পর্কগুলোকে আগের মতোই সম্মান করবি,এমনটা আশা রাখছি তোর কাছে।
-তোদের চেনা তিহান,তোর চেনা তিহান কোনোদিন পাল্টাবে না আন্নু।ও জানে,কোনটা ওর বউয়ের প্রাপ্য,কোনটা ওর বন্ধুর।বন্ধু,ভালোবাসা,স্ত্রী,কর্তব্য সব সম্পর্কগুলোতে আমি নিজেকে ঠিক উপযুক্ত করে নেবো।দেখিস।
হাসি ফুটলো মুখে।মুঠো করা হাত ধরলাম ওর দিকে।ওউ হাত মুঠো করে ছুইয়ে দিলো হাতে।তানহাকে জরিয়ে আরেকবার অল দ্যা বেস্ট বলে বিদায় নিলাম তিহানদের বাসা থেকে।বাইরে বেরিয়ে দেখি রোহান ভাইয়া ফোনে কথা বলছেন আর অঙ্কুর গাড়িতে হেলান দিয়ে আমার দিক তাকিয়ে দাড়িয়ে আছেন।যেনো আমার জন্যই ওয়েট করছেন উনি।আস্থাকে বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-কিভাবে বাসায় ফিরবি?
-আর কিভাবে?তুই যা তোর বরের সাথে।আমাকে তোর দুলাভাইয়ের সাথে একলা ছাড়!
আমাকে কিছু বলার সুযোগই দেয়নি ও।হেলতে দুলতে রোহান ভাইয়ার দিকে এগিয়ে দাত কেলিয়ে বললো,
-মিস্টার রোহান?আসার সময় আম্মুকে বললাম আম্মু,তোমার হবু মেয়েজামাই,মানে আপনার সাথে বেরোবো।তাইতো আম্মু আসতে দিলো এতো রাতে।ব্যালকনি দিয়ে দেখেছেও আপনাকে।তাই আমাকে এখন আপনার সাথেই বাসায় ফিরতে হবে।মে উই?

কটমটে চোখে তাকিয়ে থেকে গাড়িতে উঠে বসলেন রোহান ভাইয়া।আস্থাও উঠে গেলো গাড়িতে।চলে গেলো দুজনে।আহম্মকের মতো তাকিয়ে দেখলাম গাড়িটার চলে যাওয়া।পাশে তাকিয়ে দেখি অঙ্কুর কোট খুলে হাতে ঝুলিয়ে ওভাবেই গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে।একটা শুকনো ঢোক গিলে সবে উল্টোদিকে একপা বারিয়েছি,উনি বলে উঠলেন,
-তোমার দাদুকে ফোন করবো ভাবছি অদ্রি।
পা থেমে গেলো আমার।পেছন ফিরে বললাম,
-কেনো?

-যাতে ওনার ঘুম ভেঙে যায়,আর উনি উঠে দেখেন তুমি রুমে নেই।
বড়বড় চোখে তাকালাম আমি।উনি ডোন্ট কেয়ার ভাবে গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন,
-ড্রামা না করে গাড়িতে উঠে বসো।ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত থাকলে ফোন করার কথা ভুলে যাবো।
বুঝলাম ঠান্ডা কথায় থ্রেট দিলেন উনি আমাকে।চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম।গাড়ি স্টার্ট দিলেন উনি।কিছুদুর আসার পর,ওনার ফোন বেজে উঠলো।মোবাইলের স্ক্রিনে রাইতা নামটা স্পষ্ট লেখা।কপাল কুচকে আসলো আমার।এতো রাতে এ কেনো ফোন করলো?উনি একপলক নামটা দেখে ভ্রুকুচকে তাকালেন।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে এক বিশ্বজয়ের হাসি ফুটিয়ে কানে গোজা ব্লুটুথে বলতে লাগলেন,
-হ্যাঁ,বলো রাইতা।

-ইটস্ ওকে।লাস্ট ডায়ালড্ নাম্বারটা যদি আমারই হয়,কলটা তো আমার কাছেই আসবে তাইনা?আর তাতে ক্ষতির কি বলোতো?তোমার এই ঘুমোঘুমো আওয়াজ শুনতে পেলাম।ফিলস্ গ্রেট!
-হ্যাঁ হ্যাঁ,কেনো মনে থাকবে না?আরে,তোমার সাথে দেখা করার কথা কি ভুলে যাওয়ার মতো কোনো কথা?ডোন্ট টক সিলি!নিজেকে ভুলবো,তাও তোমাকে ভুলবো না।

শেষ কথাটা অঙ্কুর আমার দিক তাকিয়েই বললেন।কিন্তু বললেন তো রাইতাকে।বিস্বাদে মন ভরে উঠলো।আজকের ঘটনাগুলোর মধ্যে ভুলেই গেছিলাম অঙ্কুর রাইতাকে পছন্দ করেন।উনি স্বাভাবিক হয়ে বললেন,
-এনিওয়েজ,ঘুমোও তুমি এখন।আ’ইল কল ইউ লেটার।সুইট ড্রিমস্।
এতো মিষ্টভাষায় কথা বললেন উনি,হাত মুঠো করে সামলালাম নিজেকে।কষ্ট হচ্ছিলো।কিন্তু এমনটাই তো হবে।তবে আমি কেনো কষ্ট পাবো?অঙ্কুর কথা শেষে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলেন।অনেকটা সময় পর বললাম,
-রাইতা ম্যামকে আপনার খুব পছন্দ তাইনা?
-হ্যাঁ।ও মানুষটাই পছন্দ করার মতো!
-আপনার ভালোবাসার মানুষটা…

-শোনো অদ্রি,তোমাকে ক্লিয়ারলি বলছি,আমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে এতো আগ্রহ দেখাবে না।যেদিন সবাই জানবে,সেদিন তুমিও জানবে।টিল দেন,হ্যাভ পেশেন্স।তাছাড়া এই আগ্রহটা তোমাকে সুট করে না।তুমি তো মুক্তি চেয়েছিলো।তার ব্যবস্থাই করছি।ডোন্ট ওয়ারি।আমার বউ হওয়ার যোগ্যতা তো সেই রাখে,যাকে আমি যতোটা ভালোবাসি,সেও আমাকে ততোটাই ভালোবাসে।আর এটাই হবে।দেখে নিও।
কথাগুলো কাটকাট গলায় বললেন অঙ্কুর।আমার চোখ ভরে উঠেছে তার কথাগুলো শুনে।জামা খামচে ধরে তারদিকে তাকিয়ে রইলাম।উনি বললেন,

-আমি তো তোমার কেউ না।তুমি চাওনা এই সম্পর্কটা থাকুক।তোমার মতে এই এগ্রিমেন্টাল বিয়েটার কোনো মানে নেই।তাছাড়া আমিও কেনো গুরুত্ব দেবো বলোতো বিয়েটাকে?শুধু দায়িত্ব ছিলে তুমি আমার।সো ইয়াপ!ফরগেট এভরিথিং!আমি আমার মতো করে আমার লাইফ সাজিয়ে নেবো।এই এগ্রিমেন্টাল বিয়ের দাম আমার কাছেও নেই।নাও স্টপ থিংকিং আবাউট ইট।
তার সবগুলো কড়া কথা শুনলাম চুপচাপ।জলভরা চোখে তাকিয়ে তারদিকে।ওনার কাছে সত্যিই আমি শুধু দায়িত্ব ছিলাম।উনি মুভ অন করবেন।এই বিয়েটার কোনো মানে ছিলো না,থাকবেও না।অঙ্কুর গাড়িতে গান চালিয়ে দিলেন।গান বাজতে লাগলো,

Na kuch pucha
na kuch manga,
Tune dill se diya,Jo diya…
Na kuch bola
na kuch tola
Muskuraa ke diya,Jo diya…
Tuhi dhup,tuhi chaya,
Tuhi apna,paraya…
Or kuch na janu main,
Baas itna hi Janu…

গান থামিয়ে দিলাম আমি।অঙ্কুর আমার দিক ফেরার আগেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম তারদিক থেকে।গানের কথাগুলো শুনে নিজেকে দুর্বল লাগছিলো।উনি বললেন,
-গানটা থামালে কেনো?
-ভালো লাগছে না।
-কেনো?
-জানি না।
-জানো।কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছো না।হেই ওয়েট!অদ্রির সাহস কম পরতে শুরু করেছে?লাইক সিরিয়াসলি?ওয়াও!

-মনের কথা বলতে শেখো অদ্রি।তাতে তোমারই মঙ্গল।
ওনার কথায় তাচ্ছিল্য ছিলো।আর আমি কাদছিলাম নিশব্দে।লুকিয়ে।বাইরে তাকিয়ে।কোনো কথা বলিনি আর।বাসার সামনে গাড়ি থামতেই অঙ্কুরের সাথে একটা কথা না বলে সোজা ভেতরে চলে আসলাম।

আজ মনিমার জন্মদিন।তানহা তিহানের বিয়ের পর আর দেখা হয়নি কারোর সাথেই।ভার্সিটিতে এ কয়দিন শুধু আস্থার সাথে ছিলাম।সকাল থেকে ফোন হাতে করে বসে আছি,মনিমাকে কল করবো বলে।বিকেল গরিয়ে গেছে।কিন্তু এখনো পারছিই না মনিমাকে ফোন করতে।বুক ভারি হয়ে আছে এটা ভেবে,এতোগুলো বছরে,এই প্রথমবার,এই দিনটাতে তার কাছে আমি নেই।কোনোদিন থাকতেও পারবো না।দাদু,দাদীমা একসাথে ড্রয়িংয়ে বসে।সব খারাপ লাগা একপাশে ঠেলে কল লাগালাম মনিমার ফোনে।মনিমা বললো,

-আন্নু!
চোখ বন্ধ করে বললাম,
-হ্যাপি বার্থডে মনিমা।
-তোর মনে আছে?
-কোনোবারও ভুলেছি?যে আজ মনে থাকবে না?
-হুম।বুঝলাম।তা মনিমার কাছে না এসে এভাবে শুধু ফোনে উইশ করবি?
-হ্ হ্যাঁ?হ্যাঁ,যাবো… যাবো তো!
-কবে?
-ওই,আসলে….

-থাক।আর বলতে হবে না।বুঝেছি।আজকে আসার কোনো প্লান নেই তোর।থাকলে এভাবে আমতাআমতা করতি না তুই।আজকের দিনেও তারমানে দেখা হবে না তোর সাথে।
চুপ রইলাম।দেখা করার প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যাবো না ও বাসায়।হয়তো অঙ্কুর আজ মানা করতেন না।তবে ওনাকে দেখলে আমার নিজেকে নিয়ে ভয় হয়।এতোগুলো দিন দুরে থেকে তার কাছে থাকার অভ্যস বদলানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।লাভ হয়নি।বারবার,প্রতি মুহুর্তে তাকে অনুভব করেছি।আবার তার সত্যিকারের অনুপস্থিতি মনে করে কেদেছি।তাকে সামনে দেখলে হয়তো আরো দুর্বল হয়ে পরবো।তারচেয়ে থাকি না এভাবেই।সময়ের সাথে এই অনুভূতিগুলোও ঠিক হয়ে যাবে হয়তো।যেমনটা অঙ্কুর রাইতার সাথে অনেকটাই অন্তরঙ্গ হতে শুরু করেছেন,সেভাবে আমিও নিজেকে ঠিক গুছিয়ে নিতে পারবো।মনিমা বললো,

-আন্নু?অঙ্কুরের লাইভ হচ্ছে।
-হুম?ক্ কিসের লাইভ?
-লাস্ট ম্যাচ নিয়েই কোনো প্রেস ব্রিফিং হয়তো।কেনো?বলেনি তোকে?
-হুম?হ্ হ্যাঁ।বলেছে তো।
-আচ্ছা,এখন রাখছি।লাইভটা দেখি।
হুম বলে কল কাটলাম।দাদুও টিভি অন করেছে।বললো,
-আহানিতা?এই দেখো,অঙ্কুরের লাইভ।
দাদুর পেছনে সোফা ধরে দাড়ালাম।অঙ্কুরের হাসিমুখে কথা বলছিলেন।বরাবরই উনি প্রেসমিডিয়া,ফ্যান ফলোয়ার নিয়ে যতোক্ষন থাকেন,নিজের পুরোটা নিয়েই থাকেন।কিছু প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে এক সাংবাদিক হাত তুলে বলে উঠলেন,
-স্যার?ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,আপনার ব্যক্তিগত এক বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাই।ক্যান আই?
-শিওর।নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।

-শুনলাম খুব তাড়াতাড়িই নাকি আপনি বিয়ে করতে যাচ্ছেন?কথাটার সত্যতা কতোটুকো?
সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে উপস্থিত সকলের মাঝে গুন্জন শুরু হয়ে গেলো।সোফা শক্ত করে আকড়ে ধরলাম আমি।অঙ্কুর মুচকি হেসে মাইক্রোফোনের দিকে আরেকটু এগিয়ে বসে বললেন,
-হ্যাটস্ অফ টু দ্যা জার্নালিস্ট সোসাইটি।আপনারাই যে দেশের ফাস্টেস্ট নেটওয়ার্ক,তা আবারো প্রমান করে দিলেন।জ্বী।কথাটা সত্য।খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে করতে যাচ্ছি আমি।ইনফ্যাক্ট মাকে আজই মেয়েপক্ষের বাসায় পাঠাবো বিয়ের ডেইট ঠিক করতে।

আরো শক্তিতে সোফা ধরলাম আমি।দাতে দাত চেপে আছি।অঙ্কুর বিয়ে করবেন কথাটা সহ্য করতে দম আটকে আসছে আমার।মনিমা মেয়েপক্ষের বাসায় যাবে।তারমানে মডেল রাইতাদের বাসায়।উনি মনিমাকে সবটা বলে দিয়েছেন।কিন্তু কই?মনিমা তো কিছু বললো না আমাকে।কেনো?হয়তো ছেলের পছন্দ শুনে,এগ্রিমেন্টাল বিয়ে,দায়িত্বের বিয়ে শুনে সেও সবটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে।তবে তো ভালোই হলো।যেটা নিয়ে চিন্তা বেশি ছিলো,মনিমার রিয়্যাক্ট,সেটাই অত্যন্ত ভালোভাবে মিটেছে।অঙ্কুর বরাবরের মতো পক্ত হাতে সামলেছেন সবদিক।বিয়ের কথা শুনে সব সাংবাদিকেরা বিস্ময় নিয়ে তারদিকে তাকিয়ে।পরপরই আবারো গুন্জন।একজন বলে উঠলো,
-কনগ্রাচুলেশনস্ স্যার!আমরা কি আপনার হবু স্ত্রীর নাম জানতে পারি?
অঙ্কুরের ঠোট কামড়ে হাসলেন।একটু সময় নিয়ে বলে উঠলেন,

-আসলে,আজ আমার মায়ের জন্মদিন।গিফট্ হিসেবে মায়ের বউমার ইচ্ছে পুরন করবো ভেবেছি।বিয়েটা কবে,কোথায়,কাকে করছি,সবটা ঠিকঠাক হলে,আপনাদের আরো ভালোভাবে জানানো হবে।রাইট নাও,প্লিজ নো মোর কোশ্শেনস্ আবাউট দিস।এক্সকিউজ মি।
অঙ্কুর উঠে চলে গেলেন।সবটা দেখে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো আমার।দাদু,দাদীমার নজর টিভিতেই।আর পারলাম না ওখানে থাকতে।একছুটে রুমে চলে আসলাম।ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করে দিলাম।পাথর হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাটু জরিয়ে বসে একধ্যানে মেঝের দিকে তাকিয়ে আমি।চোখ দিয়ে অনবরত পানি গরাচ্ছে।সময়ের হিসেব নেই।অনেকটা সময় পর তানহার গলা কানে আসলো।হয়তো খবরটা দেখেই এসেছে।চেন্জ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে বেরিয়ে এসে বললাম,

-তান্নু তুই?হঠাৎ?
ও খুতিয়ে খুতিয়ে দেখতে লাগলো আমাকে।চোখমুখ লুকানোর চেষ্টায় ছিলাম।ও বললো,
-এখন শাওয়ার নিয়েছিস কেনো?তোর চোখমুখের এই অবস্থা কেনো?
নাক ডলে,ঠোট দিয়ে জিভ ভিজিয়ে বললাম,
-এ্ এমনি।এ কয়দিন ভার্সিটি আসলি না কেনো তোরা দুজন?
-তিহান জব খুজতে ব্যস্ত ছিলো,আর আমি টিউশনি।
-ও।আয় না?বস?
পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলাম।তানহা হাত টেনে ধরে ওর সামনেই দাড় করালো।কড়া গলায় বললো,
-এএসএ বিয়ে করছে?এতো তাড়াতাড়ি?
-তাইতো দেখলাম তার প্রেস কনফারেন্সে।
-তুই এতোটা স্বাভাবিক কি করে?
-আমার আবার কি হবে?

আবারো চলে আসতে যাচ্ছিলাম।তানহা হাত টেনে ধরলো আমার।বললো,
-এতোটা কঠিন হোস না আন্নু!তোর কষ্ট হচ্ছে।তুই মানতে পারছিস না এএসএ’র বিয়ের খবরটা।তোর বরের বিয়ের খবরটা!
আর পারিনি থাকতে।ওকে জরিয়ে ডুকরে কেদে উঠলাম আমি।ও মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-আজ তোর কান্না করাটা দরকার আন্নু!কান্না কর!বাধা দেবো না তোকে!
চিৎকার করে কাদতে লাগলাম এবার।বললাম,
-ওই মানুষটা তো এমনটাই করবে।বলেছিলোও আমাকে।আমিও জানতাম!তাহলে আমার কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে তান্নু?কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে?

-এটাই তো হওয়ার ছিলো রে!এমনটাই তো হতো!আমিও তো তা জানতাম!অঙ্কুর খুব তাড়াতাড়িই মুভ অন করবেন।তাহলে আজ কেনো মানতে পারছি না?কেনো নিজেকে সামলাতে পারছি না?কেনো?

-আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে!ভেতরটা যেনো কেউ টুকরো টুকরো করে কাটছে।দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছি আমি।এই বাতাসের অক্সিজেন বিষাক্ত লাগছে আমার।দম আটকে আসছে।মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি!মরে যাচ্ছি আমি!
-এটাকে ভালোবাসা বলে আন্নু!
বিস্ফোরিত চোখে ওরদিকে তাকালাম।কান্না থেমে গেছে আমার।ওকে ছেড়ে দু পা পিছিয়েও গেছি আমি।তানহা এগিয়ে এসে আমার দুগাল ধরে বললো,
-হ্যাঁ।তুই ভালোবাসিস এএসএ’কে।তুই তোর বরকে ভালোবাসিস ইয়ার।
-শুধু কষ্টই দিয়েছেন উনি আমাকে।

-বাচ্চাদের মতো কথা বলিস না।তুই নিজেও জানিস এএসএ তোকে নিয়ে কতোটা সেন্সিটিভ।আর তুই ভালোবাসিস বলেই তো কষ্ট পাচ্ছিস।আচ্ছা এটা বল তো?এই ভালোবাসার স্বীকৃতি আমি কেনো দেবো তোকে?তুই বুঝতে পারছিস না?এএসএ’র সাথে অন্য কাউকে মানতে পারবি না তুই!তোর বর সে!আর তুই ভালোবাসিস তাকে!অন্য কারো সাথে ভালোবাসার মানুষটাকে শেয়ার করতে না পারার কষ্ট হচ্ছে তোর।তোর বর অন্যকারো হয়ে যাবে সেই ভয় হচ্ছে তোর।বুঝতে পারছিস না তুই এসব?কেনো?
করুনভাবে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।ও বললো,

-সত্যি করে বলতো?তুই সত্যি এএসএ কে ভালোবাসিস না?আজীবন তাকে ছাড়া থাকতে পারবি?অন্য কারো সাথে তাকে মানতে পারবি?বাচতে পারবি তাকে ছাড়া?
ওর কাছে কথাগুলো শুনেই মনে হচ্ছিলো আমি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি।বাস্তবে এমন হলে তো আমি মরে যাবো,তা বলার অবকাশ থাকে না।ওর কাধে মাথা ঠেকিয়ে কাদতে কাদতে বলতে লাগলাম,

-ভালোবাসি তানহা।খুব ভালোবাসি ওনাকে।শুধু স্বীকার করতে ভয় পেয়েছি এতোদিন।কি করে স্বীকার করতাম?যেখানে সে মানুষটাই অন্য কারো সাথে নিজেকে জুরে দিয়েছে।এই ছেলেখেলা বিয়েটাকে অর্থহীন বলে আখ্যা দিয়েছে।আমাকে শুধু দায়িত্ব বলে সামলেছে।তাকে কি করে ভালোবাসি বলতাম।বল?কিন্তু ওনারই বলা,বোঝানো সেই সর্বনাশা অনুভুতি আমার সর্বস্ব হরন করেছে তানহা।আমাতে আমার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।ওনাকে ছাড়া এতোগুলো দিন,প্রতিটা মুহুর্তে,নিজের অস্তিত্বকে মৃত অনুভব হয়েছে আমার।আজীবন কি করে ‌বাচবো তাকে ছাড়া?আমার,একান্তই আমার নিজের ভাবতে শুরু করা মানুষটাকে কি করে অন্য কারো হয়ে যেতে দেখবো আমি তানহা?কি করে?তাকে যে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।অনেকটা বেশি।

সবটাই তুমিময় পর্ব ৩৪

কেদেছি অনেকক্ষন।বিছানায় বসেছে তানহা।মেঝেতে বসে ওর কোলে মাথা রেখে ফোপাচ্ছি।তানহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-এখন কি করবি তুই?
মাথা তুলে উঠে দাড়ালাম।কান্না থামিয়ে,নাক টেনে,হাতের পিঠে চোখমুখ মুছে বললাম,

-আমার করার কিছুই নেই তানহা।আমি কেনো আমার একতরফা ভালোবাসার অধিকার নিয়ে তার সামনে যাবো?উনি তো রাইতা ম্যামকে ভালোবাসেন।বিয়েও করতে চলেছেন।উনি ভালো থাকুক ওনার ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে।আমি তো শুধুমাত্র ওনার দায়িত্ববোধ ছিলাম।ছিলাম!একটা বিষন্ন অতীতের কালোমেঘ!আমি চাইনা এই মেঘের অন্ধকারচ্ছন্ন ছায়া তার উজ্জল বর্তমান বা ভবিষ্যৎকে এতোটুকো আবছা করে দেয়।অঙ্কুর যেভাবে ভালো থাকতে চেয়েছেন,সেভাবেই ভালো থাকুক উনি।ওনার ভালো থাকাটা দেখে,আমিও ভালো থাকতে পারবো।ঠিক পারবো!

সবটাই তুমিময় পর্ব ৩৬

2 COMMENTS

Comments are closed.