সবটাই তুমিময় পর্ব ৮ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ৮
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

-আজ আমি তোর ন্ নিজের…নিজের মা হলে তুই এমন্…এমনটা করতে পারতি না আন্নু!
জোরে জোরে দম নিয়ে কথাগুলো শেষ করলো মনিমা।হুহু করে কেদে দিলাম।গাড়িতে বসে সারাটা রাস্তা নিশব্দে কেদেছি।হসপিটালে এসেই সোজা ইমারজেন্সিতে ঢুকে পরছিলাম।ডক্টর,নার্স বাধা হয়ে দাড়ালেন।পরে অঙ্কুর যখন তাদের বললেন মনিমা আমার সাথেই দেখা করবে বলে ব্যস্ত হয়ে পরেছে,আর কেউ আটকায় নি আমাকে।অঙ্কুরকে বাইরেই দাড়াতে দেখলাম।তার চোখমুখেও চিন্তা,অস্থিরতা।উনি ইশারায় তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকতে বললেন আমাকে।বিয়েটার কথা মনে পরতেই ঘৃনাদৃষ্টি ছুড়ে ভেতরে ঢুকলাম।

মনিমা অজ্ঞান ছিলো।হসপিটালে আসার পর থেকে তার পাশে হাত মুঠো করে বসে থেকে কেদেছি শুধু।অনেকটা সময় পর জ্ঞান ফিরলো তার।আমাকে দেখেই তারও চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো।মুখ ফিরিয়ে নিলো মনিমা।নার্স বললো,
-আপনি কে হন ওনার?
-আ্ আমি আহানিতা।মনিমার মেয়ে।
-ও।আপনিই তাহলে এনার আন্নু?কেমন মেয়ে আপনি?মাকে এভাবে অসুস্থ্য রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?থ্যাংক গড ওনাকে কাল ঠিকসময়ে এডমিট করানো হয়েছে।নইলে বড়সড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো ওনার।ইভেন আজ সকালেও ওনার সিচুয়েশন খুব খারাপ ছিলো।প্লিজ টেক কেয়ার অফ হার!আর হ্যাঁ,ওনাকে বেশি উত্তেজিত করবেন না!
ফুপাতে ফুপাতে ডাক লাগালাম মনিমাকে,

-ম্ মনি…..
-তোমার মনিমা মরে গেছে আহানিতা!
-না!না মনিমা!ওভাবে বলো না প্লিজ!প্লিজ ওভাবে বলো না!তোমার কিছু হলে যে আমিও মরে‌ যাবো!শেষ হয়ে‌ যাবে তোমার আন্নু!এমন কথা আর কোনোদিনও বলবে না প্লিজ!
-আমার কিছু হলে তোমার কিছু যায় আসে?
-মনিমা?
-হ্যাঁ,তাইতো!তোমার কিছু আসা যাওয়ার কথা না তো!আমি…আমি তো তোমার আপন মা নই।আমিতো শুধু বড় করেছি তোমাকে।
কান্নার বেগ বাড়লো‌ আমার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যতোদুর মনে পরে,মনিমাই‌ আমার সব।অন্যকোনো আত্মীয়স্বজন কোথায়,আদৌও আছে কি না,কিছুই জানি না।মনিমা বলে আমার বয়স যখন পাঁচ বছর,একটা‌ গাড়ি বিস্ফোরনে আমার বাবা মা দুজনেই মারা যায়।তারপর থেকে মনিমার কাছেই আমি।সে কোথায় থেকে কিভাবে,কেনো আমার জীবনে এসেছিলো এ নিয়ে কিছুই জানি না।মনিমাও বলতে চাইনি কোনোদিন।শুধু এটুকো বলতো,আমাকে নিয়েই তার পৃথিবী।তাই তাকে বারবার প্রশ্নতাক করতে ভালোলাগতো না আমার।একটা‌ এনজিওতে কাজ করে আমার পড়াশোনা আর সংসারটাকে ঠিক চালিয়ে‌ নিতো মনিমা।তার কাছে হয়তো এতোএতো টাকা ছিলো না,কিন্তু ভালোবাসারও কোনো অভাব ছিলো না।তাই তাকে ছাড়া আমিও আমার পৃথিবী কল্পনা করতে পারি না।কান্না করতে করতেই বললাম,

-মনিমা প্লিজ!এসব বলো না!যাই হয়ে যাক না কেনো,তুমিই আমার মা!এটা তো তুমিও জানো,আমিও মানি।তাহলে কেনো আবার এসব বলছো?এসব সহ্য হয় না তো আমার।জানো তো তুমি!
-সত্যিটাই তো বললাম।আমি…আমি তো পেটে ধরি নি তোমাকে।আমার সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই তোমার।তাহলে আমাকে নিয়ে কেনো এতো…এতোটা ভাববে তুমি আহানিতা?তুমি বরং তোমার কাজে যাও!
চোখ মুছলাম আমি।তারও চোখ মুছিয়ে দিলাম।অভিমান হয়েছে তার।এতোদিন তার থেকে দুরে ছিলাম,এটুকো অভিমান তো হবেই।বললাম,

-আচ্ছা বেশ,এতো কথা বলতে হবে না তোমাকে।তোমার শরীর ভালো নেই।আমি এসে গেছি তো,তুমি….
-কেনো আসলে?তোমার তো কাজটাই জরুরি!আমি মরার পরই না হয়….
-মনিমা,প্লিজ!আমি সবটা বলবো তোমাকে।তুমি একটু সুস্থ্য হয়ে যাও,সবটা বলবো।
-আর কি বলবে?এবারও নিশ্চয়ই কোনো ট্রিপে ছিলে?কারন আমি যতোদুর জানি,কোচিং কিংবা জব ইন্টারভিউয়ে এক সপ্তাহ সময় লাগে না।
-আন্নু আমার সাথে ছিলো মনিমা।
দরজায় তাকালাম।তানহা আর আস্থা এসেছে।অবাক হলাম ওদেরকে দেখে।ওদেরকে খবর দিলো কে?নাকি ওরাই মনিমাকে হসপিটালে এনেছে?হতেও পারে।আমার কলেজের বেস্টফ্রেন্ড ওরা।ওরা ভেতরে ঢুকলো।মনিমা অন্যদিক তাকিয়ে থেকেই বললো,

-আমি বাচ্চা নই তান্নু যে তোরা আমাকে যা বুঝাবি,তাই বুঝবো।
-তোমাকে বাচ্চা কেনো বলতে যাবো?আয়না দেখেছো?সামনের ঢেউতোলা ছোটছোট চুলগুলোয় কতোসুন্দর সাদা রঙ ধরেছে!একে নাকি বাচ্চা ভাববো!
আস্থার কথায় তানহা রাগ নিয়ে তাকালো ওর দিকে।আস্থা জোর করে হেসে বললো,
-ইয়ে,আ’ম জোওওওকিং!
তানহা এগিয়ে এসে মনিমাকে ওর কব্জি দেখালো।ওখানে ব্যান্ডেজ করা।কোনোভাবে কেটে গেছে বোঝাই যাচ্ছে।মনিমা ব্যস্তভাবে বললো,
-এটা কিভাবে হলো তান্নু?
-তান্নু?এটা কি কর্….

আস্থা পায়ে পাড়া লাগিয়ে দিলো আমার।আর কিছুই বললাম না।তানহা বললো,
-সুইসাইড এটেম্পট করতে গেছিলাম ছয়দিন আগে মনিমা।কপাল করে বেচে তো গেছি,কিন্তু হসপিটালাইজড্ ছিলাম তিনদিন,বাসায় আব্বু আম্মু ছিলো না।রিসোর্ট প্লানিংয়ের জন্য কক্সবাজার গেছে তারা।হাহ!জানোই তো,আমার জন্য তাদের কাছে কতো সময়।তাই আন্নুকেই….
মনিমা বললো,
-সুইসাইড?এতোবড় একটা কান্ড ঘটাতে গিয়েছিলি তুই তান্নু?কেনো?
তানহা আনমনে বলে উঠলো,
-নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো কারো কাছে মনিমা।
-কার কাছে?
ধ্যান ভাঙে ওর।ঠোটে হাসি টেনে বললো,
-হুম?ত্ তেমন কিছু না মনিমা!
-কিছু তো!এভাবে কষ্ট পাচ্ছিস কেনো তুই?তোকে তো….
-প্রেমে ছেকা খাওয়ার কষ্ট!তুম কেয়া জানো মনিমা?
আস্থাকে মার লাগালাম আমি।ও বিরক্তি নিয়ে বললো,

-তান্নু ওর মা বাবার সাথে আবারো ঝগড়া করেছিলো।ওর মা রাগে বলেছে গো টু হেল!জেদের বশে হেলের দরজায় কড়া নাড়তে গিয়েছিলো।
মনিমা অন্যদিক ফিরে কাদতে লাগলো আবারো।আমাদের কাউকেই কোনঅংশে কম ভালোবাসে না সে।এখন তার বিনিময়ে যদি শুধু টেনশনটাই পায়,কান্না তো করবেই।এরমধ্যেই কেউ ডেকে উঠলো,
-মনিমা?
গলার স্বরটা চেনা।আমাদের একমাত্র ছেলেবন্ধু।তিহান।দরজায় তাকিয়ে দেখলাম হাতে একগাদা ফল,হেল্থ ড্রিংকস্ নিয়ে দরজায় দাড়িয়ে ও।আমার দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন।তারপর এগিয়ে এসে মনিমাকে বললো,
-মাতাজি?কেমন আছো?
মনিমা ভারী গলায় বললো,

-তুই‌ কেনো আসলি তিহান?তোকে কে আসতে‌ বলেছে?তোদের কারো কোনো কাজ নেই?
-সত্যিই কোনো কাজ আছে কি?হিসেবে পাইনা তো?তিনদিন আগে তান্নুর কেবিনে দৌড়দৌড়ি করলাম,তিনদিন পর তোমার এখানে।এখন আগে আগে দেখো,হোতাহে কেয়া!
-তোকে এতোসব জিনিস কে আনতে‌ বলেছে তিহান?
আমার কথায় তিহান তাচ্ছিল্যে হাসলো।বললো,
-তোর মায়ের জন্য কিছু কিনলে আমার হাত একদম খালি হয়ে যাবে,এতোটাও গরীব নই আমি।
-আমি ওভাবে বলিনি তিহান,এসব তো…
মনিমা আমাকে থামিয়ে‌ দিয়ে বললো,

-কিভাবে বললে কেউ‌ কষ্ট পায়,তিহান কষ্ট পায়,সেটা আজও বুঝলে না তুমি আহানিতা।
তিহানের দিকে তাকালাম।মাথা নিচু রেখে চাপা কষ্টের হাসি হাসছে ও।তানহা অনেকটা আগেই পিছিয়ে গিয়ে জানালার ধারে দাড়িয়েছে।একপ্রকার জোর করেই ওর ঠোটে হাসি ঝুলানো।তিহান একটা জোরে শ্বাস ফেলে বললো,
-মনিমা?কি খাবে?
-কিছুই না!
-কিছু না কিছু তো খেতেই হবে তোমাকে মাতাজি।আমি এনেছি বলে কথা!
-খাবো না।
-রাগ কেনো করছো মনিমা?আন্নু এসে গেছে তো!
-হ্যাঁ,এক সপ্তাহ পর!
-তান্নু তো বললো তোমাকে,ওর কাছে ছিলো আন্নু।এখন তান্নুর বাবা মা ওকে টাইম দেয় না,বন্ধু হিসেবে আমাদেরই তো ওকে দেখা উচিত তাইনা?

-সেটা আগে বললে কি হতো বলতো?তান্নুর সাথে থাকলে আমাকে জানাতে সমস্যা কোথায় ছিলো বল তিহান?ফোনটাও সুইচড্ অফ।আমার চিন্তা হয় না বুঝি?একটাবারও কেউ জানালি না?আন্নু,তান্নু,আস্থা ওরা না হয় ছেলেমানুষ।কিন্তু তুই?তুইও একবারও বললি না?
-তান্নুর অবস্থা খুব ক্রিটিকাল‌ ছিলো‌ মনিমা।তোমাকে জানালে আরো বেশি চিন্তা করতে তুমি।আর আন্নুর ফোন হসপিটালে হারিয়ে গেছে।এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে,কলটাও করতে পারে নি তোমাকে।তাছাড়া ধরা পরার ভয়টাও পাচ্ছিলো।তান্নুর কথা জানলে তুমি আবার বেশি হাইপার হয়ে যেতে।
মনিমা আবারো কাদতে লাগলো।বরফগলা জল!বুঝলাম অভিমানের বরফ গলছে।আর সেটা প্রতিবার তিহানের দ্বারাই সম্ভব হয়।একটু স্বস্তির কান্না বেরোলো চোখ দিয়ে।মুছে হাসিমুখ করে দাড়ালাম।মনিমা বললো,
-আমাকে জ্বালিয়ে ক্ষান্ত হস নি তোরা কোনোদিন,হবিও না।সবাই মিলে আমাকে মেরে তারপরই দম নিবি।তার আগে না।
আস্থা মনিমার কপালে চুমো দিয়ে বললো,

-আরেকটা কাজ করেও ক্ষান্ত হবো না মনিমা।তোমার এই সুইট,লিটল,ট্রায়াঙ্গল শেইপের কপালটাতে চুমো দিতে আমার না হেব্বি লাগে।মনে হয় মৌচাক আছে ওতে।কাছে যাওয়া রিস্কি,বাট ফল?হায়্ ম্যায় মারজাওয়া!
মনিমা কান্নার মধ্যেও হেসে দিলো।আমিও ঠোট আটকে আছি।ইচ্ছে করছে সবগুলোকে জরিয়ে ধরে আদর করি একসাথে।আস্থা মনিমাকে জরিয়ে রেখেছে।তানহা বললো,
-মনিমা?আমাদের পাওনাটা?

মনিমা এগোনোর জন্য ইশারা করলো আমাদের দুজনকে।ঠোটে হাসি ফুটিয়ে এগোতেই দুহাতে দুজনের কান ধরলো সে।শক্ত করেই ধরেছে।তানহা ব্যথায় আহ্ শব্দ করলেও আমি খুশিতে কাদছি।মনিমা বললো,
-একবার বেরোই এখান থেকে,তোদের দুটোকে খুন্তি দিয়ে পিটাবো!
তিনজনে মিলে জরিয়ে ধরলাম মনিমাকে।আড়চোখে দেখলাম তিহান দুরে দাড়িয়ে হাসছে।অঙ্কুরের কথা মনে পরলো হুট করেই।মনিমাকে ছেড়ে অনেকটা দুরে সরে দাড়ালাম আমি।সবাই‌ একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে‌ রইলো।মনিমা কিছু বলতে যাবে,এরমধ্যে নার্স এসে‌ বললো,

-আপনারা এই পেশেন্টের‌ বাসার লোকজন বেশ অদ্ভুত।যখন থাকেন,তো এতোগুলো একসাথে।যখন নেই তো কেউই নেই।এখন বেরোন।ওনার রেস্ট দরকার।বেরোন!
ওরা তিনজন হাসিমুখেই বেরিয়ে গেলো।আমি মনিমার কাছে গিয়ে দাড়ালাম আবারো।মনিমা বললো,
-সিস্টার?আন্নু থাকুক।
-বেশ।

নার্সও বেরিয়ে গেলো।বেডের কাছে চেয়ারটা টেনে বসলাম।মনিমাকে জরিয়ে তার হাতের উপর মাথা রাখলাম।কতোদিন পর এই মানুষটাকে কাছে পেয়েছি।শান্তি লাগছে প্রচন্ড।মনিমা আরেকহাতে আমার মাথার চুল নাড়তে নাড়তে বললো,
-মনিমার জন্য কষ্ট হয়নি এ কয়দিন?
-অনেক!
-আজ আবারো তিহানের কথা বিশ্বাস করলাম আমি আন্নু।তোকে নিয়ে হয়তো ওর চেয়ে বেশি আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারবো না কোনোদিন।তোকেও না!

সবটাই তুমিময় পর্ব ৯