সবটাই তুমিময় পর্ব ৭ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ৭
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা
সারারাত বৃষ্টি ছিলো।সকালেও অনেকক্ষন বৃষ্টি হয়েছে।থেমেছে খুব বেশিক্ষন হয় নি।তবুও ঝলকানো রোদ উকি দিচ্ছে এখনই।গাছপালার ভিজে পাতার সবুজ রঙ আর আকাশের নীলচাদোয়া মন ভরিয়ে দেয় যেনো।ঠান্ডা শিরশিরে বাতাস বইছে।পরিবেশটা উপভোগ করার মতোই।কিন্তু তবুও ভালো লাগছে না,বিষাক্ত লাগছে।এ ঘরটাও অঙ্কুরের ঘরের মতো বড়সড়,গোছানো।ব্যালকনি আছে।তাই ব্যালকনিতেই এসে মেঝেতে বসেছি।
-আপনাকে এমন চুপচাপ মানায় না মিস পর্বতশৃঙ্গ।
অঙ্কুরের গলা।না শোনার মতো করেই বসে রইলাম।পাশে ট্রাউজার পরা ব্যক্তিটির পা চোখে পরলো।উনি বললেন,
-প্রদীপ সরকার কনফার্ম হতে এসেছিলো,আপনার সাথে ঠিক কি হয়েছে।
-আমার নেক্সট ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচের ডেট ফিক্স হয়েছে।
-আচ্ছা মিস অদ্রি?ধরুন আমার আর প্রদীপ সরকারের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ডিল করার সে ফাইলটা দিয়ে আপনাকে মুক্তি দিয়ে দিলাম আমি।আপনি ইনস্ট্যান্টলি নিউজ করবেন সেটা নিয়ে তাইনা?
একপলক তাকালাম তারদিকে।উনি মৃদ্যু হেসে বললেন,
-কিছু তো বলুন?
-আপনার মনিমা আপনাকে খুব ভালোবাসে তাইনা?
-আপনিও ওনাকে খুব ভালোবাসেন তাইনা মিস অদ্রি?
অঙ্কুর এবার আঙুল দিয়ে একদিকে দেখিয়ে উৎফুল্লভাবে বললেন,
-রংধনু উঠেছে!দেখুন মিস অদ্রি!
তাকালাম সেদিক।সত্যিই রংধনু উঠেছে।অঙ্কুর তাচ্ছিল্যে হেসে বললেন,
-ওই বিশাল আকাশটাও কখনো কখনো নিকষ কালোতে ঢেকে যায় ঠিকই,কিন্তু বৃষ্টির পর ওর নীল রঙ,আর রংধনুর সাতরঙ সে মেঘের অাধারকে ভুলিয়ে দিয়ে যায়!আমার জীবন তো তার চেয়ে কতো ছোট।এতে স্বাভাবিকভাবে কিছু রঙের জোগান দেওয়াটা কি এতোটাই কঠিন ছিলো উপরওয়ালার জন্য?খুব ভুল কিছু হয়ে যেতো,কিছু রঙ আমার জীবনটাতে এটে দিলে?নাকি আমার এটুক চাওয়াটাই এতো অভাবের কারন?
কথাগুলোতে আটকে রইলাম।উনি ছলছল চোখে আমার দিকে তাকালেন।মোচড় দিয়ে উঠলো ভেতরটা।অঙ্কুরের এই রুপ আমার অজানা,অচেনা!একটু সময় ওভাবে তাকিয়ে থেকে পরপরই চোয়াল শক্ত করে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি রুম থেকে।নিজের মতো আবারো বসে থেকে অশ্রুবিসর্জন দিতে লাগলাম নিরবে।
মাঝখানে আরো দুদিন কেটে গেছে।লক্ষ্য করলাম এ ঘরটাতে তেমন আসেন না অঙ্কুর।তাই দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও আমিও আর বেরোই নি।যতটা দুরে থাকা‌ যায় তার থেকে!প্রদীপ সরকারের আগমন নিয়ে কোনো কিছুই জানি না।প্রথম দুদিনের মতো গার্ডসরা এসে খাবার দিয়ে চলে যেতো।আবার নিয়ে যেতো।
-আহানিতা?
নিস্প্রান দৃষ্টিতে দরজায় তাকালাম।রোহান ভাইয়া এসেছেন।মুখ ফিরিয়ে নিলাম।উনি আরো এগিয়ে এসে বললেন,
-এ কি হাল বানিয়েছো তুমি নিজের?
-এমন কেনো করছো আহানিতা?
উনি সামনে এসে বসলেন আমার।বললেন,
-কেনো দুজনে এভাবে একে অপরকে কষ্ট দিচ্ছো আহানিতা?বলতে পারো,এতে কার ঠিক কি লাভ হচ্ছে?
ভাষাহীনভাবেই তাকালাম তারদিকে।একে অপরকে কষ্ট?অঙ্কুর কষ্টপাচ্ছেন?ওহ্!ওনার তো বেবি চাই,সেটা না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন।রোহান ভাইয়া বললেন,
-অঙ্কুরকে কাল সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না আহানিতা।
একটু বিস্ময়ে তাকালাম।কাল সকালেই শেষবার কথা হয়েছিলো ওনার সাথে আমার।কোথায় গেলেন উনি?এজন্যই আসেন নি এ রুমে?তাতে অবশষ্ক আমার কিছুই না।বললাম,
-এখানে,তার বাসায় বসে,তাকে অবশ্যই আমি কিডন্যাপ করি নি।
-না।তা করো নি।কিন্তু তুমি ওর মনে দুর্বলতা গুজে দিয়েছো আহানিতা।আর এই দুর্বলতাই ওর নিখোজ হওয়ার কারন!
-এএসএ?আর দুর্বলতা?
-না।তুমি।আর অঙ্কুরের দুর্বলতা।
-প্লিজ ভাইয়া,একা থাকতে দিন আমাকে।চলে যান এখান থেকে।
-কেনো?একা কেনো থাকবে?তোমরা তো দুজনে একাকীত্ব ডিসার্ভ করো না!অঙ্কুরকে একটু বুঝ্….
-ওনাকে নিয়ে কোনো কথা শুনতে চাইনা আমি ভাইয়া!প্লিজ!আপনাকে ভাইয়া ডেকেছি।নাইবা পারলেন আমাকে মুক্তি দিতে,অঙ্কুরের বিরুদ্ধে বলতে,তা বলে আমার শুনতে চাওয়া না চাওয়ার মতকে এটুকো সম্মান দিন?
-কেনো?কেনো অঙ্কুরের সবটা শুনতে চাও‌ না তুমি?শুধুমাত্র ওর বাইরেরটা দিয়ে কেনো ওকে যাচাই করছো আহানিতা?যে ছেলেটা কাউকে নিজের জীবনে জড়াতে চায়না কোনোদিন,কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবতেও পারে না,আজ সেই ছেলেটা তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে আহানিতা।এসবের কারন জানো আহানিতা?কারন ও তোমাকে….
-কারন উনি আমাকে শাস্তি দিতে চান!
-না!শাস্তি নয়!ও তো তোমাকে….
ধরাম শব্দে দরজা খুলে গেলো।চমকে উঠে চশমা ঠেলে তাকালাম দরজায়।অঙ্কুর এসেছেন।ঘৃনাটা বরাদ্দ ছিলো তার।কিন্তু তার চেহারার অবস্থা দেখে আমার ভেতরটা ধক করে উঠলো।উশকোখুশকো চুল,চোখ লাল হয়ে কোঠরে বসে যাওয়া টাইপ।ওনার সাথেই আরেকজন বয়স্ক লোকও এসেছেন।অঙ্কুর এগোলেন।একপলক রোহান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে,একটা কাগজ এনে আমার সামনে ছুড়ে মেরে শান্ত গলায় বললেন,
-সাইন ইট!
বিন্দুমাত্র‌ গুরুত্ব না দিয়ে অন্যদিকে তাকালাম আবারো।উনি আবারো বললেন,
-সময় নষ্ট করবেন না মিস অদ্রি!সাইন ইট!
চুপচাপ বসেই‌ রপলাম।হুট করে আমার ওড়না হাতে পেচিয়ে ধরলেন অঙ্কুর।টান পরতেই উঠে দাড়ালাম।কিছু বলার আগেই চশমাটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিলেন উনি।বললেন,
-সাইনটা করুন!আপনাকে আপনার মনিমার কাছে দিয়ে আসবো!
মনিমার কাছে নিয়ে যাবে শুনেই চোখ চকচক করে উঠলো আমার।পরক্ষনে কাগজে সাইন করার শর্ত মাথায় আসতেই সবটুকো খুশি নুইয়ে গেলো।বললাম,
-কিসের কাগজ ওটা?
-আমাদের বিয়ের!
বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম তার দিকে।তারমানে এবারের শর্ত মনিমার কাছে যেতে চাইলে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করতে হবে আমাকে।করবো না।বললাম,
-আগেই বলেছি,পচে মরবো এ বাসায়,তবুও কোনো বিয়ে হবে না!করবো না আপনাকে বিয়ে!
-সাইনটা করুন মিস অদ্রি!ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম!
-করবো না বললাম তো!
-আপনি আপনার মনিমার কাছে যেতে চান না?
-চাই।তবে আপনাকে বিয়ে করে নয়!
-দেখুন!আপনাকে যেতে হলে আমার শর্ত মেনেই যেতে হবে!
-যাবো না,তবুও আপনার শর্তে রাজি হবো না!
উনি হাত মুঠো করেই দাড়িয়ে ছিলেন এতোক্ষন।জোরে শ্বাস নিয়ে এদিকওদিক হেটে আঙুল কপালে স্লাইড করালেন।তারপর একদম আমার সামনে এসে দাড়িয়ে বললেন,
-মিসেস আফরা খানম হসপিটালাইজড্ মিস অদ্রি!গতকাল সকালে হার্ট এটাক করেছেন উনি!
পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো আমার।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো।পেছোতে পেছোতে বললাম,
-ন্ না,ম্ মনিমা…
-আপনাকে না দেখতে পেয়ে ওনার অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে।সাইনটা করুন!নিয়ে যাবো আপনাকে তার কাছে।
একটু থামলাম।মনিমার অসুস্থ্য হওয়ার খবরটা মিথ্যে হতে পারে।যদি এটা বলে উনি আমাকে ঠকিয়ে….একটা শুকনো ঢোক গিলে কোনোমতে বললাম,
-ব্ বিশ্বাস করি না আপনাকে।কিছুই হয় নি মনিমার।
অঙ্কুর আবারো কপাল ধরে এদিক ওদিক তাকালেন।তারপর কি একটা ভেবে মোবাইল বের করে সামনে ধরলেন আমার।কান্নার বেগ বাড়লো।সত্যিই মনিমা হসপিটালের বেডে শুয়ে।মুখে অক্সিজেন মাস্ক।রাগে হিতাহিত বোধ হারিয়ে ওনার কলার ধরে চেচিয়ে বললাম,
-মনিমা দুইদিন হলো হসপিটালাইজড্!আর আপনি আজ বলছেন আমাকে?
উনি শান্তভাবে বললেন,
-আমি ওনার কাছেই ছিলাম।কাল থেকে উনি ইমপ্রুভই করছিলেন।ভালো রেসপন্স পাচ্ছিলো ডক্টররা।আজ হঠাৎ….
কলার ছেড়ে দিয়ে পাশ কাটিয়ে একছুট লাগালাম বাইরের দিকে।দরজায় কাছে যেতেই অঙ্কুর পথ আগলে দাড়ালেন।বললেন,
-এভাবে যেতে পারেন না আপনি!
-আপনি মানুষ?একজন মুমুর্ষ রোগী,আমার মনিমা,উনি….উনি হসপিটালে,আর আপনি….
অঙ্কুর কোনো গুরুত্ব দেননি আমার কথাকে।কথা শেষ করলেও উনি বুঝতেন না জানি।রোহান ভাইয়ার দিকে এগিয়ে বললাম,
-ভাইয়া?আজ তো কিছু বলুন?
উনি করুনভাবে তাকালেন আমার দিকে।চলে আসতে যাচ্ছিলাম।অঙ্কুর আবারো পথ আটকে দিয়ে বললেন,
-আমি আপনাকে নিয়ে কোনো কমপ্রোমাইজ করতে চাইনা মিস অদ্রি।পেপারটাতে সাইন করুন,আমি নিজে আপনাকে হসপিটালে নিয়ে যাবো।
-আপনি এই মুহুর্তেও…..
-প্রতিটা মুহুর্তেই এএসএ স্বার্থপর!
-যদি সাইন না করি?
-আপনাকে না দেখে আপনার মনিমার সবরকমের অবস্থার জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।
আর কোনো উপায় আছে?কোনো পথ খোলা আছে আমার জন্য?মনিমা ছাড়া কেউ নেই‌ আমার।তার কিছু হয়ে গেলে….না!আমাকে না পেয়ে আরো অসুস্থ্য হয়ে পরবে মনিমা।জোরে একটা শ্বাস নিলাম।চোখের পানিও মুছলাম,কিন্তু আবারো ভিজে উঠলো গাল।কাগজটা তুলে শক্ত হাতে সাইন করে দিলাম ওতে।চশমাটা ছাড়া  আর চোখের জলে আরো ঝাপসা হয়ে থাকা চোখে রেজিস্ট্রি পেপারের ম্যারেজ সার্টিফিকেট কথাটা জ্বলজ্বল করছিলো যেনো।পাথরের মতো এগিয়ে গিয়ে অঙ্কুরের সামনে ধরে বললাম,
-বলেছিলেন জোর করবেন না।এভাবে বাধ্য করবেন এমনটা ভাবিনি।এই নিন।সাইন করে দিয়েছি।
অঙ্কুর কাগজটা নিয়ে নিজেও সাইন করলেন।ওনার সাথে আসা বয়স্ক লোকটিকে ইশারা করতেই উনি ইসলামিক নিয়মে বিয়ের জন্য কবুল বলতে বলেন আমাকে।অঙ্কুর এসে মাথায় ওড়না টেনে দিলেন আমার।অনুভূতিহীন যন্ত্রের মতো লাগছিলো নিজেকে।যার নিজের কোনো কথা নেই,নিজের কোনো আবেগ নেই।অঙ্কুর বললেন,
-তাড়াতাড়ি কবুলটা বলুন মিস অদ্রি!আপনার মনিমা….

সবটাই তুমিময় পর্ব ৬

চোখ বন্ধ করে একশ্বাসে তিনবার কবুল বলে দিলাম।অঙ্কুর নিজেও বললেন।বিয়ে!বিয়েটা হয়েই গেলো।দুটো মানুষের নয়,দুটো মনেরও নয়।একজনের জেদের কাছে অন্যজনের আত্মসম্মান হেরে যাওয়ার।অঙ্কুরের শর্তের সাথে আমার দুর্বলতার।নায়েব কাকা,কাজী,রোহান ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ বলে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।অঙ্কুর চুপ করে অন্যদিক তাকিয়ে।ওনার সামনে হাতজোর করে দাড়িয়ে শান্তভাবে বললাম,
-আপনি যা চেয়েছিলেন,তাই করেছি মিস্টার অঙ্কুর।বিয়েটা হয়ে গেছে।এবার প্লিজ,আমাকে মনিমার কাছে নিয়ে চলুন।প্লিজ!
উনি তাকালেন আমার দিকে।হাত নামিয়ে দিলেন আমার।তারপর দুহাতে আমার দুগাল স্পর্শ করলেন উনি।হাত মুঠো করে সংযত করলাম নিজেকে ওই স্পর্শে।আলতোভাবে আমার কপালে ঠোট ছুইয়ে অঙ্কুর ধীর গলায় বললেন,
-সরি।
-তুমি আমার বউ অদ্রি!ইউ আর মাই ওয়াইফ!
আমার হাত ধরেই উনি বেরিয়ে এলেন বাসা থেকে।ওই স্পর্শকে বাধা দেওয়ার,অস্বীকার করার আর কোনো উপায় নেই আমার।দাতে দাত চেপে সহ্য করে তার সাথে বেরিয়ে এলাম।আমাকে ফ্রন্টসিটে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন উনি।অবাধ্য চোখের জল ঝড়তেই থাকলো অনবরত।

সবটাই তুমিময় পর্ব ৮